Friday, April 9, 2010

শাড়ি

0 comments
উড়ছে শাড়ি, উড়ছে আঁচল_পৃথিবীর যেখানেই হোক, এই ছবি আমাদের বাঙালি বা ভারতীয় নারীর চিরায়ত রূপ। তবে কালে কালে পাল্টেছে শাড়ির রকম, পরার ধরণধারন। ১ এপ্রিল এই শাড়ির বিবর্তন নিয়েই সিটি ব্যাংক ও আমেরিকান এক্সপ্রেসের সহযোগিতায় আহসান মঞ্জিলে '১০০ বছরে শাড়ীর বিবর্তন' শীর্ষক একটি শো করলেন ডিজাইনার তুতলী রহমান। সেই শো নিয়েই আজকের আয়োজন। লেখা : রিদওয়ান আক্রাম, ছবি : মোহাম্মদ আসাদশাটী থেকে শাড়ি

শাড়ির চল হয়েছিল ঠিক কবে? নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। খানিকটা অনুমান করে নেওয়া যায়! সূত্র হিসেবে নেওয়া যাক 'শাড়ি' শব্দটির উৎস-সময়কালকে। সংস্কৃত 'শাটী' থেকে এসেছে 'শাড়ি'। তবে অনেকের ধারণা, সংস্কৃত হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও আদতে 'শাটী' ধার করা শব্দ। আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই নাকি 'শাটী' শব্দটির অস্তিত্ব ছিল। সেই হিসেবে বলা যেতেই পারে, শাড়ির ইতিহাস সাড়ে তিন হাজার বছর কিংবা তারও বেশি পুরনো। আর্য ভাষায় 'শাড়ি'কে আরো বিভিন্ন শব্দে আখ্যায়িত করা হয়েছে_'সাটক', 'সাটিকা'। আবার 'মহাভারত'-এ উলি্লখিত দ্রৌপদীর যে 'বস্ত্রহরণ' করা হয়েছিল, অনুমিত হয়, সেটাও শাড়িই ছিল। গুপ্ত যুগের (আনুমানিক ৩০০ থেকে ৫০০ সাল পর্যন্ত) বিখ্যাত কবি কালিদাসের 'কুমারসম্ভব'-এ শাড়ির কথা উল্লেখ আছে। গুপ্ত আমলের ইলোরা অজন্তা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলি বলে দেয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ির অস্তিত্ব ছিল। পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়া ফলক থেকেও প্রমাণ যায়, হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে শাড়ির চল ছিল। তবে এসব শাড়ির সঙ্গে আজকের শাড়ির তফাৎ রয়েছে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার চল ছিল না। এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষ পরলে হতো ধুতি আর মেয়েরা পরলে শাড়ি। উভয়ের শরীরের ওপরের অংশই থাকত উন্মুক্ত। তবে পালা-পার্বণে উচ্চবংশীয় নারীরা ওড়না জাতীয় কাপড়ে নিজেকে ঢেকে নিত।
মধ্যযুগের কবিদের কাছ থেকে শুধু শাড়ির কথাই জানা যায় না, শাড়ির রঙের কথাও জানা যায়। চৌদ্দ শতকের কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন, 'নীল শাড়ি মোহনকারী/উছলিতে দেখি পাশ'। প্রথম মা হওয়া নারীকে উপহার হিসেবে দেওয়া হতো লাল শাড়ি। শাড়ি পরার ক্ষেত্রে ধনী-গরিব বিভাজন ছিল। ধনীরা পরতেন মিহি মখমল কাপড়ের শাড়ি আর গরিবের শাড়ি ছিল সাধারণ সুতি।
মুসলমানরা আগমনের ফলে আরও অনেক কিছুর পাশাপাশি পোশাক-পরিচ্ছদেও লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। তুর্কি-আফগান-মোগল সংস্কৃতির ধারা স্থানীয়রাও গ্রহণ করে। পাগড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও পায়জামার মতো পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও শাড়ির গুরুত্ব কিন্তু কমে যায়নি। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের নারীরা শাড়িকেই নিজেদের পরিধানের প্রধান বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরে থাকে। সম্ভবত মোগল আমলেই চালু হয় ব্লাউজ ও উর্ধ্বাঙ্গ ঢাকার রীতি। তবে তা উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
মাদাম বেলনোসের চিত্রে উনিশ শতকের প্রথমদিকে গ্রামবাংলার অন্তঃপুরের যে ছবি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, এক প্যাঁচেই শাড়ি পরেছেন বাংলার নারী। অধিকাংশ শাড়ির রংই সাদা। তবে পাড় হতো চিকন এবং লাল। সায়া-ব্লাউজ কিংবা অন্তর্বাসের চল ছিল না।
১৮৮৯ সালে ঢাকা জেলার একটি হিন্দু পরিবারের ওপর করা জরিপে দেখা যায়, একজন মহিলা বছরে পাঁচ-ছয়টি শাড়ি ব্যবহার করে থাকেন। এগুলোর পেছনে খরচ হতো ৪ রুপি। ফ্যানি পার্কস ১৮৫১ সালে তাঁর বইয়ে লিখেছেন, 'ধনী মহিলারাও শাড়ি পরত। শীতের সময় ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়তি হিসেবে ব্যবহার করত চাদর।' তবে তখনো ব্লাউজ-সায়া-পেটিকোটের চল হয়নি, চালু করল কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল। ফুলহাতা ব্লাউজ এবং কুচিছাড়া শাড়িই ছিল সেই সময় উঁচু সমাজের নারীদের প্রধান ফ্যাশন। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শাড়ি আর ব্লাউজ নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে; এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে।
তবে শাড়ির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, তা বলা যাবে না। ভারতবর্ষে শাসক গোষ্ঠী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাটকীয়ভাবে বদলেছে পুরুষদের পোশাক কিন্তু শাড়িকে তার প্রধান পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে রেখেছে নারী। তাই বলা যেতেই পারে, শাড়ি আর ভারতীয় নারী একে অপরের পরিপূরক।
মোগল যুগ
মোগলদের মধ্যে সম্রাট আকবরই প্রথম ভারতবর্ষের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। ভারতীয় নারীদের নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মোগল সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন। সেই ধারাবাহিকতায়ই মোগলাই আভিজাত্যে যোগ হল শাড়ি।
নানা রকম দামি পাথর ছাড়াও সোনা-রূপার সুতা দিয়ে শাড়িতে নকশার কাজ করা হতো। মোগলদের আগ্রহের জন্য মসলিনের শাড়ির উপস্থিতিও থাকত জেনানা মহলে। মোগলদের জন্য মসলিন কাপড় সংগ্রহের জন্য সরকারি লোক নিয়োগ দেওয়া হতো।
জমিদারি আমল
মোগলদের বাংলা জয়ের পর 'জমিদার' একটি বিশেষ পদবি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জমিদার মানেই বিশাল সম্পত্তির মালিক। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়ে ধনিক শ্রেণী হিসেবে 'জমিদার' গোষ্ঠীর আত্দপ্রকাশ ঘটে। তাদের সময়ে শাড়ি পরা হতো এক প্যাঁচে। ব্লাউজও এ সময়ে শাড়ির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশেষ করে ঠাকুর পরিবারের মেয়েরা ব্লাউজকে সাধারণের কাছে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন।ষাটের দশক
ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তরে প্রথম দিকে হিপ্পীদর স্লোগান ছিল 'ফুলের শক্তি'। সমসাময়িক সময়ে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে 'ফুল'। পোশাকের নকশাতেও থাকত ফুলের প্রাধান্য, এমনকি সাজসজ্জায়ও। পরে এ ফ্যাশনে নতুন মাত্রা আনে হিন্দি সিনেমার বহুল প্রচলিত 'মিনি শাড়ি'। বিশেষ করে বলা যেতে পারে 'সত্যম শিবম সুন্দরম' সিনেমাতে জিনাত আমানের পরা শাড়ির কথা। মিনি শাড়ির পাশাপাশি 'টেডি শাড়ি'র কথাও বলা যায়, যা অভিনেত্রী মমতাজ জনপ্রিয় করেছিলেন। শাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ব্লাউজেও লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। ব্লাউজের গলা করা হয় অনেকটা নৌকার আদলে এবং ব্লাউজের পেছনের দিকটা আটকানোর জন্য থাকত মেগি ক্যাপের বোতামভিক্টোরীয় যুগ
উনিশ শতকের চলি্লশ দশক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে বলা হয়ে থাকে 'ভিক্টোরিয়ান যুগ'। এ যুগে ফ্যাশনের মূল কথাই ছিল কাপড়ে সারা শরীর ঢাকা থাকতে হবে। এমনকি গোড়ালি দেখানোটাও অসম্মানকর হিসেবে বিবেচিত হতো। ভারতের সেই গরমেও ইংরেজরা ভিক্টোরিয়ান ফ্যাশনের পোশাক পরতে পিছপা হননি। ব্রিটিশদের সংস্পর্শে থাকা জমিদার ও স্থানীয় ধনীদের পোশাক-পরিচ্ছদেও যোগ হয় ভিক্টোরিয়ান ফ্যাশনের স্টাইল। এ সময়ে শাড়ির সঙ্গে ফুলহাতা ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরার চল শুরু হয়। এই রীতিতে শাড়ি পরাটা বাঙালি নারীর চিরায়ত এক প্যাঁচে শাড়ি পরার ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়।১৯৪০-৫০ দশক
ব্রিটিশমুক্ত ভারতে ১৯৪০ দশকের শেষের দিক থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল হিন্দি চলচ্চিত্রের 'সোনালি সময়'। এসব চলচ্চিত্রের নায়িকারা ছিলেন তখনকার ফ্যাশন আইকন। নার্গিস, মধুবালা এবং বৈজয়ন্তীমালার মতো নায়িকাদের পোশাক ভাবনা ভারত উপমহাদেশের নারীদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করা শুরু করে। পাশাপাশি বাঙালি নারীদের সামনে ছিল সুচিত্রা সেন। তাঁর ছোট আস্তিন এবং লম্বা গলার ব্লাউজের স্টাইলগুলো ছিল দারুণ অনুকরণীয়। শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজও এ সময়ে হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে সাধারণ ব্লাউজও সমানভাবে জনপ্রিয় হয়১৯৭০-৮০ দশক
দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাংলাদেশ ১৯৭১-এ স্বাধীন এক দেশ হিসেবে আত্দপ্রকাশ করে। বাংলাদেশিরা নিজেদের সব কিছুর মধ্যে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা শুরু করে। তাদের পছন্দের শাড়ির মধ্যে জায়গা করে নেয় দেশি খাদি এবং তাঁতের শাড়ি। আর এসব শাড়ির সঙ্গে চুলের সাজও ছিল আলাদা, করা হতো লম্বা বেণি কিংবা খোঁপা। ফুল দিয়েই সারা হতো খোঁপা অলঙ্কৃত করার কাজ। সে সময় আমরা পোশাকে অনুকরণীয় হিসেবে পেয়েছিলাম কবরী, শাবানা এবং ববিতার মতো অভিনেত্রী।
আন্তর্জাতিক সংগীতে একদিকে তখন ডায়ানা রসের ডিস্কো এবং অন্যদিকে বি জিসের জনপ্রিয় গান। এসবের সঙ্গে যোগ হওয়া ঝলমলে, জমকালো এবং চকচকে পোশাক পরার রীতি এ সময়ের শাড়ির ধরন ঠিক করে দেয়। ঠিক তখনই দৃশ্যপটে আসে হিন্দি চলচ্চিত্র 'সিলসিলা'য় অভিনেত্রী রেখার পরা 'সিলসিলা' শাড়ি। ঘন রঙের এই শাড়ির সঙ্গে পরা হতো হাতাবিহীন কিংবা হোল্টার গলার ব্লাউজ। আর সাজসজ্জার অনুষঙ্গ হিসেবে থাকত সুরমা, গাঢ় রঙের লিপস্টিক আর চিকন ভ্রূ। এ সময়ে শাড়ির সঙ্গে মিল করে কেশবিন্যাস নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। অনেকে পছন্দ করেছেন রেখার মতো চুলকে লম্বা করে ছেড়ে দিতে আবার কেউবা অভিনেত্রী ফারাহ ফসেটের মতো ঢেউ খেলানো চুলই পছন্দ করেছেন।
নব্বইয়ের দশক
এ দশকে এসে মনে হলো বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিস্কোর অনেক গ্ল্যামার এবং চাকচিক্য দেখেছে। এবার নিজের স্বরূপ চেনার সময় এসেছে। ব্লক প্রিন্ট, নকশিকাঁথা, জামদানী, এবং টাঙ্গাইল সিল্ক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশী নারীদের কাছে। পাশাপাশি মিরপুর কাতান শাড়িও বিয়ের শাড়ি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ যেন নিজের হারানো ঐতিহ্যকেই পুনঃআবিস্কার। বিখ্যাত মসলিনের সঙ্গে প্রাচীন বাংলার কাপড় বুননের রীতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে এই জামদানি। জামদানির নকশা মূলত জ্যামিতিক। এতে লতাপাতা এবং ফুলের উপস্থিতি থাকে পূর্ণমাত্রায়। বলা হয়ে থাকে এই ধারা এসেছে ইরানী এবং মোগলদের কাছ থেকে। সাধারণত অভিজাতরাই এ শাড়ি পরে থাকতো।

২০০০ ও অতঃপর
বিশ্বায়ন আমাদেরকে একে অপরের কাছে নিয়ে এসেছে। কাছে নিয়েছে এসেছে সংস্কৃতি এবং মানুষদেরকে, আগে যা কল্পনাও করা যায়নি। উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে আজকের ফ্যাশন হচ্ছে বিভিন্ন উপাদানে প্রস্তুত এক নতুন ধারা। এমন কি হলিউড এবং বলিউড একে অপরের স্টাইল গ্রহণ করছে। সম্প্রতি বলিউডে শাড়ি থেকে ব্লাউজকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। আর বাংলাদেশ এই পূর্ব পশ্চিমের মিশ্রিত রূপই গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন এখন জামদানিতে এমব্রয়ডরি হাতে করা রং স্লিক ও
মসলিন Source: Kaler Kontho

0 comments:

Post a Comment