নদীমাতৃক বাংলাদেশের রয়েছে ছোট বড় মিলে প্রায় ৭৫০টি নদী। তম্মধ্যে ৫৭ টি নদী আন্তর্জাতিক, ৫৪টি ভারতের সাথে এবং ৩টি মায়ানমারের সাথে। এসব নদনদীতে রয়েছে বহু প্রজাতির মূল্যবান মৎস্যসম্পদ। মিঠাপানিতে সর্বাধিক চাষকৃত, বাণিজ্যিক গুরুত্ববহুল, অধিক চাহিদাপূর্ণ, সুস্বাদু মাছ হল নদীর ইনহেবিট্যান্ট মেজরকার্প বা রুই-কাতলা। বাংলাদেশের জলসীমায় ৪টি মেজর কার্পের (রুই-কাতলা-মৃগেল-কালিবাউশ) স্টক থাকলেও ৩টি স্টক (ব্রহ্মপুত্র-যমুনা স্টক, গঙ্গা-পদ্মা স্টক, বারাক-মেঘনা স্টক) ডিম ছাড়ে উজান এলাকায় ইন্ডিয়াতে। বাংলাদেশ সীমানার বেশ কিছু নদীতে রুই-কাতলাসহ অন্যান্য মাছের মিশ্র পোনা আহরণ করা হয়। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম-হালদা স্টক ব্রীড করে বাংলাদেশ সীমানার অভ্যন্তরে চট্টগ্রামের টাইডাল নদী হালদাতে। হালদা থেকে রুই-কাতলার শুধু ডিম আহরণ করা হয়। যা যুগ যুগ ধরে স্থানীয় জ্ঞানে নদীর তীরে মাটির কুয়ায় ফুটায়ে রেণু করা হয়।
টাইডাল নদী থেকে ডিম আহরণের নজীর বিশ্বের আর কোথাও নেই। এ কারনেই হালদা নদীকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষনা করা সময়ের দাবী। স্পনিং গ্রাউন্ড তথা ডিম পাড়ার স্থান মুলত: হালদা নদীর বাঁকগুলি। ১৯২৮ সাল থেকে অদ্যবধি হালদা নদীর ৭টি বাঁক কেটে ফেলা হয়েছে। এতে নদীর দৈর্ঘ্য কমেছে প্রায় ২৫ কি.মি.। তারপরও মেজর কার্প বর্ষা মওসুমে (এপ্রিল-জুন) হালদায় ডিম ছাড়ে। ডিমের পরিমান মারাত্বক ভাবে কমে গিয়েছে। ১৯৪৫ সালে যেখানে উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ২৫০০ কেজি রেণু, সেখানে ২০০৭ সালে হয়েছে ৩৫০ কেজি মাত্র। তারপরেও— অযত্নে অবহেলায় বাংলাদেশের নিজস্ব মেজর কার্প তথা রুই-কাতলা এবং তার জিন ব্যাংক হালদা নদী এখনও বেঁচে আছে।
সঠিক পরিকল্পনা গ্রহন এবং বাস্তবায়ন করলে এখনও সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এদেশের উর্বর মাটি, পানি ও অতি বর্ধনশীল দেশীয় মাছ, দেশের দ্রুত বর্ধনশীল মানুষের অপুষ্টি দূর করে ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। বিগত তিন দশক ধরে হালদা নদী নিয়ে আমার গবেষণালদ্ধ তথ্যের আলোকে অত্র প্রবন্ধে হালদা নদীর মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ, উন্নয়ন, প্রজনন সমস্যার উৎস ও তার প্রতিকারের দিক নির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
হালদা নদীর উৎপত্তি ও পানির প্রদান উৎসসমূহ:
বাংলাদেশ সীমানায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি জিলার সর্বউত্তরের সীমানা বদনাতলীর পাহাড় থেকে হালদার উৎপত্তি। হালদা কর্ণফুলীর একটি উপনদী। খাগড়াছড়ি, ফটিকছড়ি, রাউজান, হাটহাজারীর ছোট বড় প্রায় অর্ধশত পাহাড়ী ঝর্ণা হালদার পানির উৎস। হালদার দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০-৮৫ কি.মি.। প্রশস্ততায় উজান (আপ) এবং ভাটিতে (ডাউন) ৪০-৩০০ মিটার। হালদার সাথে সংযুক্ত রয়েছে কর্ণফুলী, শিকলবাহা, চাঁদখালী ও সাঙ্গু নদী।
হালদা নদী কেন গুরুত্বপূর্ণ?
দেশীয় মাছ রুই-কাতলার নিষিক্ত ডিম আহরণ ও সেই ডিম নদীর তীরে স্থানীয় প্রাচীন জ্ঞানে মাটির কুয়ায় ফুটায়ে রেণু করে সেই রেণু পুকুরে চাষের নিমিত্তে সরবরাহের জন্যে হালদা নদী গুরুত্বপূর্ণ । বিশ্বের আর কোন টাইডাল নদী থেকে ডিম আহরণের নজির নেই। পোনা আহরণের নজির আছে। এটা একটা ইউনিক নজির, তাই এটা শুধু বাংলাদেশের নয় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হওয়ার যোগ্যতা রাখে
হালদায় কেন রুই-কাতলা জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে?
খাগড়াছড়ি, ফটিকছড়ি, রাউজান, হাটহাজারীর ছোট বড় প্রায় অর্ধশত পাহাড়িয়া ঝর্ণার পানিতে হালদা হয়েছে এক নির্মল চলমান জলরাশি। নদীর অনেকগুলো বাকেঁ বাকেঁ রয়েছে কুম (গভীর এলাকা) যেখানে পানির প্রবল ঘূর্ণনে কার্পমাছের ডিমারসেল (ডুবন্ত) ডিমকে ভাসাতে ও ঘূর্ণনের মাধ্যমে এরিয়েশনের (অক্সিজেন সরবরাহ) দ্ধারা ফুটাতে সাহায্য করে। রয়েছে প্রত্যহ জোয়ার-ভাটার প্রভাব। গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায় বাংলাদেশের অন্যান্য নদ-নদী থেকে হালদার পানির বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর। এই বৈশিষ্ট্য ভৌতিক এবং রাসায়নিক উভয় দিক দিয়েই। বিশেষ করে বর্ষাকালে (এপ্রিল-জুন) প্রজনন সময়ে ভৌতিক এবং রাসায়নিক গুনাগুনের মধ্যে রয়েছে টানা ২/৩ দিন প্রবল বর্ষন, বজ্রপাত, আমাবশ্য- পূর্ণিমার প্রভাবে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, তুলনামুলক কম তাপমাত্রা , তীব্রস্রোত ,অতি ঘোলাত্ব , কম স্বচ্ছতা , কম কনডাক্টটিভিটি , সহনশীল দ্রবীভুত অক্সিজেন , মডারেট পি.এইচ. , কম হার্ডনেস , ও কম এলক্য।। প্রজননত্তোর নদীর দুইকুলের নীচু এলাকায় তৈরী হয় নার্সারী গ্রাউন্ড, যেখানে রয়েছে পোনার খাবার হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমান ফাইটো ও জুপ্লাংটন, রয়েছে সমৃদ্ধ বেনথোস (তলার খাবার)। হালদার এ অনন্য ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যর জন্য রুই-কাতলা হালদায় ডিম ছাড়ে। তাই হালদার নিজস্ব রুই জাতীয় মাছ ছাড়াও পার্শ¦বর্র্তী অন্যান্য নদী (সাঙ্গু, চাদঁখালী, শিকলবাহা, কর্ণফুলী) থেকেও রুই-কাতলা হালদায় ডিম ছাড়তে আসে।
হালদা নদীর ফিশারী:
হালদা নদীর বিশ্বখ্যাত প্রধান ফিশারী হল মেজর কার্পের স্পন বা ডিম আহরণ ও রেণু উৎপাদন ফিশারী। ডিম ও রেণু উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমে গিয়েছে। ২০১২ সালে ৯৯ মেট্রিক টন যা ২৪৭০ কেজি রেণু উৎপাদন হয়েছে তার দাম দাঁড়ায় ৭ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা সঠিক পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় সরকারী তত্ত্ববধান থাকলে হালদার রেণু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারতো
হালদা নদীর ফিডিং উপখালসমূহ:
হলদা নদীর পানির উৎস হল হালদার উপখালসমূহ যা’ মূলত: পাহাড়ী ছড়া। বর্ষা মওসুমে বর্ষনের ফলে হালদার দুইকুল ভেসে যায় আবার শীতের সময় হালদার পানি হালদার তলায় ফিরে আসে। বর্ষার সময় নদীর দুইকুলে পানির সম্প্রসারণ এবং শীতের সময় সংকোচন একে বলা হয় নদীর হার্ট বিট বা হৃদ স্পন্দন। ১৯৭৫-৭৬ এবং ১৯৮২-৮৩ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সেঁচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রন প্রকল্পের অধিনে লোয়ার হালদার ১২টি বড় উপখালে ’ফিশ পাশ’ ছাড়া ১২টি স্লুইজ গেট এবং নদীর কুলে ৪৭ কি.মি. বাঁধ নির্মাণ করে হালদা নদীর নরম্যাল হার্ট বিট এর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। নদীর ফিডিং খালের সাথে মূল খালের সরাসরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ফলে নদীর গতিবেগ কমে গিয়েছে, মাছের ও চিংড়ির লোকাল মুভমেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে, যা মাছের সুষ্ট প্রজননে বাধাঁর সৃষ্টি করেছে। এতে করে একদিকে খাল সমূহ ভরাট হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে বদ্ধ পানিতে কচুরিপানা জম্মানোর ফলে খালসমূহের ইকোসিস্টেমও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন। যার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদনও কমে গিয়েছে।
হালদা নদীর মৎস্য প্রজাতিসমূহ:
হালদা নদীতে মেজর কাপের চারটি প্রজাতি কাতলা,রুই, মৃগেল ও কালিবাউশ ছাড়াও আরও অনেক প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বর্তমানে হালদা নদীতে ১৪টি বর্গের ৮২ প্রজাতির ফিন ফিশ, ৯ প্রজাতির শেল ফিশ এবং ১ প্রজাতির রিভার ডলফিন (শুশুক) পাওয়া যায়। স্পন ফিশারীর পরে বর্তমানে গলদা ও কাচকি হল হালদার মূল ফিশারী। ১৯৭৭ সালে হালদায় (পুকুর, ডোবার মাছ সহ) ১২ টি বর্গের ৩৩ টি গোত্রের ৯৯ প্রজাতির মাছের রেকর্ড দখা যায় ।
হালদা নদীর জলযান:
১৯৮৫-১৯৯০ পর্যন্ত চট্টগ্রামের সাম্পানই ছিল হালদা নদীতে চলাচলের একমাত্র জলযান। ১৯৮৫-৯০ সালের দিকে আস্তে আস্তে সাম্পানগুলোতে ইঞ্জিন লাগানোর ফলে মটর জলযানে পরিণত হয়। বর্তমানে এ রকম বিভিন্ন রুটে ১৩৪টি মটর জলযান হালদায় আছে। বাণিজ্যিকভাবে হালদার বিভিন্ন জায়গায় বালি উত্তোলন করা হয়। যা পরোক্ষভাবে হালদাকে ড্রেজিং এর কাজে সাহায্য করে। বালি উত্তোলনের জন্য রয়েছে কিছু বড় ইঞ্জিন নৌকা। ইঞ্জিনযুক্ত সাম্পান ও বালি উত্তোলনের ইঞ্জিন নৌকার শব্দ দূষনের ফলে ব্রিডিং এর সময় সুষ্ট ব্রিডিং এর ব্যাঘাত ঘটায়।
হালদা নদীতে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য:
হালদা নদীর পানিতে ও তলায় রয়েছে মাছ ও মাছের পোনার বিপুল প্রাকৃতিক খাদ্য সম্ভার। প্রচুর সবুজ উদ্ভিদ কণা (ফাইটো প্লাংটন), প্রাণিজ কণা (জু-প্লাংটন) এবং বেনথোস (তলার জীব) রয়েছে হালদায়। হালদাতে রয়েছে ১৯ প্রজাতির ফাইটো প্লাংটন এবং ১৪ প্রজাতির জু-প্লাংটন (চধঃৎধ ধহফ অুধফর ১৯৮৭)। হালদার তলার (বেনথোস) সম্ভারে রয়েছে প্রচুর ক্রাসটেসিয়া (এম্পিপোডস, ডেকাপোডস, মাইসিডিসিয়া, কাকড়ার মেগালোপস, জ্ইুয়া), মাছ ও মাছের লার্ভি (ইল, কুকুর জিহব্বা), চেঁওয়া (মাড গোবি), অন্যান্য মাছের লার্ভি, পলিকিট এবং দ্বিখোলসযুক্ত ঝিনুক (অুধফর ১৯৭৯)।
হালদা নদীতে দূষণ?
হালদার পানি এখনও নির্মল। মেজর কার্পের ডিম পাড়া এবং গঙ্গা শুশুকের ব্যাপক উপস্থিতি তারই প্রমান। কুষি জমিতে প্রয়োগকৃত কীটনাশক ও আপদনাশক ধৌত হয়ে অন্যান্য নদীর মত হালদায়ও পড়ে। তবে নিকটবর্তী এলাকা হাটহাজারীর নন্দীর হাটে একটি পেপার মিল হয়েছে। ইদানিং অনেক কারখানার বর্জ্য হালদায় গিয়ে পড়ে। যেই উপখাল দিয়ে বর্জ্য হালদায় নামে সে খালে ব্যাপক মাছের মড়ক হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ রয়েছে।
হালদা নদীর বর্তমান মূল সমস্যাসমুহ:
নদীতে ভাটার সময় ডিম ফোটানোর কুয়াতে পানির অপ্রাপ্যতা ও ঘোলা এবং আবর্জনাযুক্ত প্রবাহবিহীন পানিতে অক্সিজেনের অভাব, ও ছত্রাক আক্রমনে মাটির কুয়ায় ডিম ও পোনার মৃত্যু হার > ৫০%। মৃত্যু হার কমানোর জন্য উন্নত পদ্ধতিতে ডিম ফোটানো এবং রেণু প্রতিপালনের জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনা ও পৃষ্টপোষকতার অভাব।হালদা বাঁচানোর জন্য গঠিত ”হালদা নদীতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির” আরও সক্রিয় ও কার্যকরী ভূমিকা প্রয়োজন।মৎস্য আইনের দূর্বলতা। মৎস্য আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ ও কার্যকরী ফলাফলের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোর অভাব।হালদার রেণু দিয়ে দেশের প্রত্যেক হ্যাচারীতে ব্র“ড তৈরী বাধ্যতামূলক করা, যাতে সারা দেশের হ্যাচারীসমুহ ইনব্রিডিং এর হাত থেকে রক্ষা পায়। এ কাজ সম্পন্ন হলে পুকুরে মাছের উৎপাদন বহুগুন বৃদ্ধিপাবে।
উপসংহার:
উপরোক্ত কাজগুলির সঠিক বাস্তাবায়ন হলে হালদার স্পন ফিশারীসহ হালদার আশেপাশের চট্টগ্রামের সকল নদীতে মাছে টইটুম্বুর হবে, মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুন বেড়ে যাবে, যা জাতীয় অর্থনীতিকে মজবুত করতে সহায়তা করবে। দেশের ৭০০ এর অধিক কার্প হ্যাচারী ইনব্রিডিং এর হাত থেকে রক্ষা পাবে। পুকুরে দেশীয় রুই-কাতলার উৎপাদন বাড়বে। মায়ানমার এবং ভারতের ফরমালিনযুক্ত রুই-কাতলার আমদানী বন্ধ হবে। হালদা শুধু বাংলাদেশের নয়, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এটা সময়ের দাবী । এ দাবী বাস্তবায়ন হউক। হালদা বাচুঁক, বাচুঁক দেশীয় মাছ, পুনরুদ্ধার হউক হালদার হারানো গৌরব, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা ।