Tuesday, June 19, 2012

মাদাগাস্কার, আফ্রিকা

0 comments
রহস্য কি কখনো সৌন্দর্য হতে পারে? সেই তর্কের ফলাফল যাই হোক না কেন, বিষয়টি যখন মাদাগাস্কার, তখন একে অপরূপ সৌন্দর্যের রহস্য না মেনে উপায় নেই। এই দ্বীপটি কেবল দ্বীপই নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র। আগে মাদাগাস্কারের নাম ছিল মালাগাছি। কিন্তু আগের সেই নাম অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। এখন এর পুরো নাম 'দ্য রিপাবলিক অব মাদাগাস্কার'। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ দেশটি ভারত মহাসাগরের পাশে ও আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র। আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত মাদাগাস্কারের আয়তন ৫ লাখ ৮৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপরাষ্ট্র। এর চেয়ে বড় দ্বীপরাষ্ট্র তিনটি হলো_ গ্রিনল্যান্ড, নিউ গায়ানা আর বোর্নিও।

মাদাগাস্কার বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হচ্ছে এর অসাধারণ আর অদ্ভুতুড়ে জীববৈচিত্র্যের কারণে। অসংখ্য প্রাণী আর উদ্ভিদে ভরপুর এ দ্বীপটির জীববৈচিত্র্যের কথা শুনলে অবাক হতে হয়। আরও মজার ব্যাপার হলো_ মাদাগাস্কারের জীবজন্তুর ৮০ ভাগই পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এসব জীব দেখতে হলে মাদাগাস্কারে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর এর কারণ হচ্ছে দেশটির ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। দেশটির পূর্ব এবং মধ্য-দক্ষিণে আছে রেইন ফরেস্ট। আবার পশ্চিমে আছে ড্রাই ফরেস্ট। আবার একই দ্বীপে দুই বনের পাশে দক্ষিণ দিকেই আছে মরুভূমি। এমন দ্বীপ পৃথিবীতে বিরল। আর সে জন্যই এখানকার জীববৈচিত্র্যও বিরল।
মাদাগাস্কারে প্রায় ৬০০ প্রজাতির জীব আছে। জীব বলতে আবার শুধু পশুপাখি ও পোকামাকড় আর মাছ নয়। মাদাগাস্কারে অদ্ভুতুড়ে গাছের সংখ্যাও কম নয়। এই দ্বীপে ৬০০ প্রজাতির জীবের মধ্যে নানারকম গাছপালা ৩৮৫ প্রজাতির, কীটপতঙ্গ আছে ৪২ প্রজাতির, মাছ আছে ১৭ প্রজাতির, উভচর প্রাণী আছে ৬৯ প্রজাতির, সরীসৃপ আছে ৬১ প্রজাতির আর স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে ৪১ প্রজাতির।

বিজ্ঞানীদের হিসাবমতে, মাদাগাস্কারে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২ লাখ প্রাণী এবং গাছ আছে, যার মধ্যে প্রায় দেড় লাখই পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৫ প্রজাতির লেমুর, ৩৬ প্রজাতির পাখি এবং আরও অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রাণী। আবার মাদাগাস্কারের অসংখ্য ব্যাঙের শতকরা ৯৫ ভাগই শুধু মাদাগাস্কারেই দেখা যায়। তবে অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া না গেলেও এসব প্রাণীর কিছু কিছু জাতভাই অবশ্য দক্ষিণ আমেরিকা আর দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়।
মাদাগাস্কারে প্রায় ৩০০ প্রজাতির সরীসৃপের আবাসস্থল। এখানে প্রায় সব ধরনেরই সরীসৃপই আছে। কেননা, পৃথিবীর প্রায় ৯০ ভাগ সরীসৃপই শুধু মাদাগাস্কারে থাকে। মাদাগাস্কারকে রীতিমতো সরীসৃপদের স্বর্গ বলা যায়। এখানকার সরীসৃপদের অন্যতম হচ্ছে গিরগিটি, সাপ, কুমির ইত্যাদি। তবে দুর্লভ হলেও এদের সবগুলোই যে পৃথিবীর আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না এমন নয়। যেমন অজগর সাপ মাদাগাস্কার ছাড়াও আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি বাংলাদেশেও দেখা যায়। অজগর ছাড়াও আছে 'ইগুনাইড গিরগিটি' আর 'বোয়া' (অজগরের মতোই এক ধরনের বিশালাকৃতির সাপ)। এদের আবার মাদাগাস্কার ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকায়, বিশেষ করে মহাবন আমাজনে বেশি দেখতে পাওয়া যায়।

আরেকটি দীর্ঘায়ু প্রাণীর নাম কচ্ছপ। শক্ত খোলসের ভেতরে বসবাসকারী এ প্রাণীটি কিন্তু সত্যিই বেশ অদ্ভুত আর মজার। মাদাগাস্কারে এ কচ্ছপ আছে প্রায় ৪ প্রজাতির। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত আর বড় আকারের কচ্ছপটির নাম হচ্ছে 'প্লোশেয়ার কচ্ছপ'। এরা কিন্তু দুর্লভ প্রজাতির। আর আশঙ্কার কথা হচ্ছে সেখানকার কচ্ছপের সব প্রজাতিই বিলুপ্তপ্রায়।


মাদাগাস্কারে সাপ আছে মোট ৮০ প্রজাতির। এদের কোনোটিই বিষধর তো নয়ই, ভয়ঙ্করও নয়। আসলে যে প্রজাতির সাপগুলো বিষাক্ত হয়, এ যেমন ধর গোখরা, মাম্বা, ভাইপার, র্যাটল স্নেক_ এসব সাপ মাদাগাস্কারে নেই। বোয়া আর ক্লুব্রিডস সাপই এখানে বেশি দেখা যায়। একমাত্র বিষাক্ত সাপটির নাম হচ্ছে 'রেয়ার-ফেংড'। যদিও এই সাপ কামড় দিলে মানুষ মারা যায় না, বড়জোর শরীরের কিছু অংশ একটু অবশ হয়ে যায়। সে আর এমন কী। আমাদের গোখরা এক কামড় দিলেই তো নির্ঘাত মরণ। তবে সমুদ্রে দু'ধরনের খুব বিষাক্ত সাপ আছে। এদের একটির নাম হচ্ছে 'হুক-নোজড সি স্নেক' আর অন্যটি হচ্ছে 'ইয়েলো-বেলিড সি স্নেক'।

পৃথিবীর সব দেশেই পাখি কমবেশি পাওয়া যায়। তবে মাদাগাস্কারে এ পাখি আছে প্রায় ২৫৮ প্রজাতির। এর মধ্যে আবার ১১৫ প্রজাতি হচ্ছে এন্ডেমিক_ অর্থাৎ পৃথিবীতে এদের একমাত্র বাসা মাদাগাস্কার। এক সময় এই দ্বীপে বিশালাকৃতির এক প্রজাতির পাখি দেখা যেত। একেকটা পাখি ওজনে ছিল প্রায় ৫০০ কেজি আর উচ্চতায় হতো প্রায় ১০ ফুট। 'এপিওরনিস' নামের এ পাখিকে তাই ডাকা হতো 'এলিফ্যান্ট বার্ড' নামেই। তবে গত কয়েকশ' বছর ধরে সব লোভী শিকারি এ পাখিটিকে এতো বেশি শিকার করেছে যে, পৃথিবী থেকে একদম বিলুপ্তই হয়ে গেছে এ দানব পাখিটি। তবে মাদাগাস্কারের বিভিন্ন স্থানে এখনো মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় এ পাখির ডিম।

অসংখ্য বিচিত্র ধরনের কীটপতঙ্গের আবাসস্থল এ মাদাগাস্কার দ্বীপে। ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞান একাডেমীর এক হিসাব অনুযায়ী, মাদাগাস্কারে পাওয়া মাকড়সার প্রায় ৮০% পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। মোট ৪১৮ প্রজাতির মাকড়সার মধ্যে ৩৭৯ প্রজাতিই এন্ডেমিক। মাকড়সাই আছে প্রায় ১০০০ প্রজাতির।

মাদাগাস্কারের সমুদ্রেও সুন্দর সুন্দর প্রচুর মাছ আছে। তবে ওখানকার অনেক মাছই আবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি মাছগুলোও খুব একটা শান্তিতে নেই। ওদের বেশির ভাগই বিলুপ্ত হওয়ার পথে। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার। আর তাই মাদাগাস্কারের স্নেকহেডস, স্কুইট ফিশের মতো অদ্ভুত অদ্ভুত আর সুন্দর সুন্দর সুস্বাদু মাছের প্রায় সবই এখন বিলুপ্তির পথে।
মাদাগাস্কারে ব্যাঙ আছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির। এর চেয়েও মজার ব্যাপার হচ্ছে_ এসব প্রজাতির মধ্যে দু'চারটি ছাড়া আর কোনোটাই অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।

খানিকটা কুকুর এবং খানিকটা কাঠবিড়ালের মতো দেখতে অবাক প্রাণী লেমুর মাদাগাস্কারের আরেক আকর্ষণ। এ ছাড়া মাদাগাস্কারে প্রচুর প্রাইমেট প্রাণী (দুপায়ে ভর করে হাঁটা) পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রায় ২১ শতাংশ প্রাইমেটই এই মাদাগাস্কার দ্বীপে বাস করে। তবে এখানকার প্রাইমেটদের মধ্যে বানর, গরিলা বা শিম্পাঞ্জি খুব একটা নেই। সেখানকার বেশির ভাগ প্রাইমেটই হচ্ছে লেমুর। মাদাগাস্কারে এখনো প্রায় ১৫ প্রজাতির লেমুর পাওয়া যায়।

--জুয়েল সরকার

0 comments:

Post a Comment