একের পর এক জলদস্যুর আক্রমণে আতঙ্কিত ছিলেন রাজধানী ঢাকার সুবাদাররা। আরাকান, পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা সমুদ্র অঞ্চল থেকে ছিপ নৌকা নিয়ে মেঘনার বুক চিরে এগিয়ে আসত ধলেশ্বরীর দিকে। ধলেশ্বরী মোহনায় এসে ঢুকে পড়ত শীতলক্ষ্যায়। সুলতানী আমলে জলদস্যুরা লুটতরাজ করত সোনারগাঁওয়ে। ঢাকায় মোগল রাজধানী স্থাপনের পর সোনারগাঁওয়ের প্রতি আকর্ষণ কমে যায় তাদের। ঢাকার দিকে দৃষ্টি ফেরায় তারা। নদীবেষ্টিত হওয়ায় ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো নির্ধারণ করে নেয় খুব সহজে। শীতলক্ষ্যা দিয়ে উত্তরে অগ্রসর হয়ে বালু নদীর শাখা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় প্রবেশ করে ঢাকায় আক্রমণ ও লুটতরাজ শুরু করে তারা। এই আক্রমণ ও লুটতরাজ ঠেকাতে সুবাদার মীর জুমলা একটি পরিকল্পনা নিয়ে প্রকৌশলীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকাকে দলদস্যুদের আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে তিন ধাপে প্রতিরক্ষা দুর্গ তৈরি করা হবে। নদীর তীরে গড়ে তোলা এ দুর্গ জলদুর্গ নামে পরিচিত হবে। সিদ্ধান্ত হয় প্রথম দুর্গটি নির্মিত হবে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছে ইছামতি নদীর তীরে ইদ্রাকপুর অঞ্চলে। ওই সময় ধলেশ্বরী হয়ে ইছামতি বয়ে যেত ইদ্রাকপুরের পাশ দিয়ে। দুর্গের পূর্ব দেয়ালের পাশে উঁচু স্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। তার ওপর ধলেশ্বরীর দিকে মুখ করে বসানো হবে কামান। চেষ্টা করা হবে শীতলক্ষ্যায় প্রবেশের আগেই জলদস্যুদের নৌকা যেন কামানের গোলার ভয়ে ফিরে যায়। কিন্তু একস্তর নিরাপত্তায় ঠেকানো যাচ্ছিল না জলদস্যুদের আক্রমণ। এবার দ্বিতীয় নিরাপত্তা দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় মোহনা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরে সোনাকান্দায়। এখানে কামান বসানোর স্তম্ভ তৈরি করা হয় পশ্চিম পাশ্বর্ের দেয়ালে। জলদস্যুদের নৌকা শীতলক্ষ্যার সীমানায় প্রবেশ করলেই আঘাত হানা হতো। চূড়ান্ত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তৃতীয় নিরাপত্তা দুর্গ তৈরি করা হয় আরও ছয় কিলোমিটার উত্তরে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে, অর্থাৎ বর্তমান নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জে। এভাবেই তিনটি দুর্গ তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন সুবাদার মীর জুমলা। মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছে এখনো দাঁড়িয়ে আছে মোগলদের সেই প্রাচীন স্থাপনা ইদ্রাকপুর দুর্গ। মীর জুমলা ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে দুর্গটি নির্মাণ করেন। দুর্গের বর্তমান অবস্থান দেওভোগ গ্রামের পূর্ব প্রান্তে ও অফিসারপাড়ার দক্ষিণে মধ্য কোটগাঁও এলাকায়। কালের বিবর্তনে এখন আর মোগল সৈন্যদের কোলাহল দুর্গে ধ্বনিত হয় না। মোগল সৈন্যদের যুদ্ধের সাংকেতিক তুর্যধ্বনিও এখন আর দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে না। নেই ইছামিত নদীর সেই অবারিত জলধারাও। বিবর্ণ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দুর্গটি। দেখার যেন কেউ নেই। দীর্ঘদিন যাবৎ সংস্কার না করায় বর্তমানে দুর্গটি জরাজীর্ণ ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রবেশ পথে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ একটি নোটিশ বোর্ড লাগিয়ে তাদের দায় শেষ করেছে।
অতি পুরনো টালি দিয়ে ছাউনির এ প্রত্নতত্ত্বের সব কক্ষের ছাদ বিনষ্ট হয়ে গেছে। ঝড়-বৃষ্টিতে খসে পড়ছে এর গায়ে লাগানো কাঠ, টালিসহ নানা উপকরণ। প্রাচীন বাংলার অন্যতম এ নিদর্শনটি এখন শুধু ধ্বংসের প্রহর গুনছে। এভাবে থাকলে হয়তো এর শেষ চিহ্নটুকুও আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাবে কালের গর্ভে। স্বাধীনতার পর থেকে এখানকার প্রশাসকরা রাজকীয়ভাবেই ব্যবহার করেছেন এ কেল্লাটি। কিন্তু এখন আর এর দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং এ যেন এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো কারও টার্গেট হয়ে আছে কখন এটিকে গ্রাস করে নেওয়া যায় নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে। এ কেল্লাটির স্মৃতিকে ধরে রাখতে এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। অন্যথায় সবার অগোচরে হারিয়ে যাবে কালের সাক্ষী এ কেল্লাটি।
* লাবলু মোল্লা, মুন্সীগঞ্জ
0 comments:
Post a Comment