ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল এর লেখা "বাংলাদেশ প্রতিদিন" পত্রিকায় ছাপা প্রতিবেদনটি টুকে রাখা হল এই ব্লগে।
ক্যাডার ইমদু
৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২ সাল। কাক-ভোর থেকেই রাজধানীর মিন্টো রোড মন্ত্রিপাড়ায় বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ। মন্ত্রী ও বিচারপতিদের সরকারি বাসভবনের ছাদ, গ্যারেজ, আঙিনায় তাদের অবস্থান। অস্ত্র তাক করে আছেন তারা। তাদের নিশানায় মিন্টো রোডের ৪০ নম্বর বাড়ি। বাড়িটি যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন। মন্ত্রীর বাড়ির সীমানাপ্রাচীরেও পুলিশ উঠে ভিতরের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। তারা গুলি চালাতে প্রস্তুত। শুধু নির্দেশের অপেক্ষা। হ্যান্ডমাইকে পুলিশের অনবরত ঘোষণা- ‘পুরো বাড়ি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। কোনোরকম চালাকি না করে সারেন্ডার করুন, নইলে পুলিশ ভিতরে ঢুকে পড়বে।’ কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই। পুলিশ প্রস্তুতি নিল ভিতরে ঢোকার। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে মন্ত্রীর বাসভবনে অভিযানের অনুমতি নিল পুলিশ।
পুরো ঘটনার নেতৃত্বে তৎকালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার এ এফ এম মাহমুদ আল ফরিদ। সকাল ১০টা থেকে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি বেড়ে যায়। ওয়াকিটকিও তাদের ভীষণ ব্যস্ত। শীতের সকালেও দরদর করে ঘামছেন কর্মকর্তারা। একজন মন্ত্রীর বাসভবন ঘিরে কয়েকশ পুলিশের এই যুদ্ধংদেহী অবস্থানে গোটা শহরে তখন অজানা আতঙ্ক। মিন্টো রোডে সাধারণের যান চলাচল বন্ধ। আশপাশ এলাকায় উৎসুক জনতার ভিড়। দুপুরে একদল সশস্ত্র পুলিশ মন্ত্রীর বাসভবনের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ মন্ত্রীর বাড়ির মূল ফটকের পকেট দরজা খুলে গেল। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছেন একজন! ধীর পায়ে। চাদর গায়ে, মুখ অর্ধেক ঢাকা। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। সুনসান নীরবতা। পুলিশের অস্ত্রের নল ঘুরে গেল লোকটির দিকে। পায়ে হেঁটে লোকটি পুলিশের একদম কাছাকাছি। পুলিশ সদস্যরা তাকে ঘিরে ফেললেন। লোকটি দুই হাত উঁচু করে দাঁড়ালেন। পুলিশ তাকে জাপটে ধরে। লোকটির দুই হাত পেছন দিকে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে তাদের ভ্যানে তুললেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখে তখন হাসি। ভ্যানটি চলতে শুরু করল। পুলিশের গাড়ির বহর ভ্যানকে অনুসরণ করল। উৎসুক জনতার উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে পুলিশ বলে, ‘আমাদের অভিযান শেষ। দেশের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধী এখন আমাদের কব্জায়।’ দুর্ধর্ষ সেই লোকটি ২২ খুনসহ অসংখ্য গুম ও ডাকাতি মামলার আসামি এমদাদুল হক ইমদু। ইমদু নামেই যিনি বেশি পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্ধর্ষ যে কজন অপরাধীর নাম বলা হয়ে থাকে, তাদের অন্যতম এই ইমদু; যার নৃশংসতা মনে পড়লে মানুষ এখনো আঁতকে ওঠে। এই ভয়ঙ্কর অপরাধীকে গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তিন দিন ধরে তৎকালীন যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসভবন ঘিরে রাখতে হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টদের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশে ইমদুই একমাত্র সন্ত্রাসী যাকে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ইমদু একসময় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবে পরিণত হয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ ডন। ইমদুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পুলিশের তৎকালীন কয়েকজন কর্মকর্তার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সঙ্গে কথা বলে তার সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের দেওয়া তথ্যে উঠে এসেছে ইমদুর অপরাধ জীবনের নানা চাঞ্চল্যকর ও ভয়ঙ্কর সব কাহিনী। ইমদু এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন, মানুষ তার নাম উচ্চারণ করত সন্ত্রাস, অপহরণ আর হত্যার প্রতীক হিসেবে। যার শুরু কালীগঞ্জ উপজেলার সাতানিপাড়া গ্রামে, আর সমাপ্তি কারাপ্রচীরের আড়ালে ফাঁসির দড়িতে।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল। এ পাঁচ বছরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন ইমদু। আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে রাজনীতি অস্থির থাকত তার নামে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘুম হারাম করে দেওয়া এই দুর্ধর্ষ অপরাধী দিনদুপুরে মানুষ খুনে ছিলেন পারদর্শী। প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যদের হত্যা করে বাঁশে ঝুলিয়ে রাখার মতো রোমহর্ষক ঘটনাও তিনি ঘটিয়েছেন। তার অপরাধের প্রতিবাদকারীদেরও প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছেন তিনি। পুলিশও রেহাই পায়নি। হত্যা করে লুটে নিয়েছে অস্ত্র। শিশু ও নারীরাও তার শিকার হয়েছে। কালীগঞ্জের বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন করেছেন তিনি। অনেকেই তার ভয়ে ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন। পাইকারি হারে খুন করলেও ইমদু নিজে অসংখ্যবার মৃত্যু থেকে রক্ষা পান অলৌকিকভাবে। প্রতিপক্ষরা অ্যাম্বুশ করে গুলি চালিয়েও তাকে হত্যা করতে পারেনি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার এমন বহু গল্প রয়েছে ইমদুর ঘটনাবহুল অপরাধ জীবনে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যেতেন তিনি। একদিকে তিনি খুন করে বেড়াতেন, অন্যদিকে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সে খবর দেখাত টিভিতে, প্রকাশ পেত পত্রপত্রিকায়। যে কারণে পুলিশও তাকে ঘাঁটাত না। তবে মন্ত্রীর বাসভবন থেকে গ্রেফতারের ঘটনাটি ছিল তার জীবনের শেষ গ্রেফতারের ঘটনা। যতদিন বেঁচে ছিলেন কনডেম সেলের পাথর দেয়ালের মধ্যেই তাকে থাকতে হয়েছে। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়, যা কার্যকর হয় গ্রেফতারের ওই বছরই।
কে এই ইমদু
কালীগঞ্জের সাতানিপাড়া গ্রামের কৃষক আশরাফ আলীর ছেলে এমদাদুল হক ইমদু। সাতানিপাড়া খৈ কোরা হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি লেখাপড়া করেছেন। স্বাধীনতার পর ইমদু জাসদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কালীগঞ্জের জাসদ নেতা আলী হোসেন তালুকদারের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও তাদের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয় একটি ডাকাতি করে পাওয়া মাল ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। এর জেরে জাসদ সেখানে দুই ভাগ হয়ে পড়ে। কালীগঞ্জের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের দক্ষিণ পাশের নেতৃত্ব আলী হোসেনের এবং উত্তর পাশ ইমদুর নেতৃত্বে। তাদের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে, তার শেষ ঘটে খুনাখুনির মধ্য দিয়ে। শুরু হয় উভয় গ্রুপের মধ্যে খুন-পাল্টা খুন।
ভয়ঙ্কর ইমদু
জাসদ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর ইমদু বিএনপিতে যোগদান করেন। তৎকালীন যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের হাত ধরে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন ১৯৮০ সালে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি দানবে রূপ নেন। শুরু হয় তার ‘জাসদ খতম’ মিশন। জয়দেবপুর উপজেলার খিলগাঁও গ্রামের বাবুল, আবদুল কাদের ভূইয়া, কফিলউদ্দিন সামসুকে নিজ হাতে খুন করেন। এরা প্রত্যেকেই তার একসময়ের সহযোগী ছিলেন। বিএনপিতে যোগদানের আগে ইমদু বেশ কয়েকটি রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটান। ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইমদু কামারিয়া গ্রামের আজিজকে তার ভাইয়ের সামনে কুপিয়ে হত্যা করেন। আজিজের লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখে ইমদু বাহিনী। ১৯৮০ সালের ৪ এপ্রিল ইমদু মসলিন কটন মিলের শ্রমিক আবদুর রশিদকে পাকড়াও করেন। তিনি ও তার বাহিনী রশিদকে তার বাড়িতে নিয়ে যায় মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা করাতে। ইমদু তখন রশিদের মাকে বলেন, ছেলের চেহারাটা দেখে নিন। পরে আর সময় পাবেন না। রশিদকে সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৮১ সালের ৪ এপ্রিল ইমদু ও তার বাহিনীর হাতে খুন হন জাসদ নেতা আলী হোসেন। ঢাকার তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনির বাসার সামনেই আলী হোসেনকে খুন করেন ইমদু। শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ রাস্তায় ফেলে রেখে যায় ইমদু বাহিনী। ১৩ এপ্রিল কালীগঞ্জে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হলো। ১১ এপ্রিল কালীগঞ্জের মসলিন কটন মিলের কাছে চলছে মাইকিং। সেখানেও হাজির এই ইমদু ও তার বাহিনী। যারা মাইকিং করছিলেন, তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। তিনজনকে গুলি করে হত্যা করল তারা। একজনের লাশ বাঁশের সঙ্গে বেঁধে কালীগঞ্জে ঘুরে বেড়াল হত্যাকারীরা। এ ঘটনার পর পুরো কালীগঞ্জে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একই বছরে কালীগঞ্জের আবদুল আউয়াল ভূঁইয়ার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে অপহরণ করে ইমদু বাহিনী। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আউয়ালকে দুই সন্তানসহ হত্যার পরিকল্পনা আঁটে ইমদু। আউয়াল দুই সন্তানকে নিয়ে কালীগঞ্জ থেকে ভিটেবাড়ি ফেলে পালিয়ে গেলেন। ইমদু সেই জমিজিরেত দখল করে নেন। এ রকম বহু মানুষ তিনি খুন করেছেন। পুলিশও নিস্তার পায়নি ইমদুর কাছ থেকে। পুবাইল এলাকায় পুলিশকে হত্যা করে রাইফেল লুট করেন ইমদু।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা
ইমদু রাজনৈতিকভাবে কতটা দাপুটে ছিলেন, কয়েকটি ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে। পুবাইল স্টেশনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক জনসভা ছিল। সেদিন মঞ্চে ছিলেন শুধু রাষ্ট্রপতি এবং ইমদু। সে সভায় বাঘা বাঘা মন্ত্রীদের বসতে হয়েছিল মঞ্চের সামনে, সাধারণের কাতারে। আরও একবার বিএনপির জনসভায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের গলার মালা খুলে ইমদুকে পরিয়ে দেন। খুনের নেশায় মত্ত ইমদু দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকেন। বিএনপি সরকারের ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল ইমদুর সন্ত্রাসে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয় ইমদুকে। কিন্তু তখন তিনি যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের ক্যাডার হিসেবেই থেকে যান।
বার বার প্রাণে রক্ষা
নিজের হাতে অনেক খুন করলেও বার বার প্রাণে রক্ষা পান এই ইমদু। ১৯৭৭ সালে আলী হোসেনের দলবল ইমদুর গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় ইমদু পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। হামলাকারীরা ইমদুকে না পেয়ে তার ছোট ভাইকে হত্যা করে। এর কয়েক দিন পর আবারও হামলা হয় ইমদুর বাড়িতে। সেবার প্রতিপক্ষরা খুব কাছে পেয়ে যায় ইমদুকে। সেবারও বেঁচে গেলেন। কয়েক মাস পর আলী হোসেনের লোকজন টঙ্গী এলাকায় পাকড়াও করে ইমদুকে। তারা স্টেনগান ইমদুর বুকে ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দেয়। কিন্তু গুলি বের হয়নি। ওই সুযোগে পালিয়ে গেলেন ইমদু। ১৯৭৯ সালে আলী হোসেনের সঙ্গে আপস আলোচনা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের দোতলায় ডাকা হয় ইমদুকে। ইমদু কলাভবনের দোতলায় আসেন সেই সন্ধ্যায়। আলোচনার এক পর্যায়ে ইমদুকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। গুলি ইমদুর পায়ে বিদ্ধ হয়। ওই অবস্থায় কলাভবনের দোতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ে পালান ইমদু। ফাঁসি : ১৯৮২ সালের ৪ আগস্ট ভোর পৌনে ৪টায় কুখ্যাত খুনি ইমদুর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। এর আগে বেশ কয়েকটি খুনের বিচারে তার ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। অনেক মামলার একটি হলো আবদুল মজিদ হত্যা মামলা। মামলার বিচার হয় ঢাকার ‘ক’ অঞ্চলের ১ নম্বর বিশেষ সামরিক আইন আদালতে। ১২ মে আদালত তার বিরুদ্ধে সর্বসম্মতভাবে ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন।
গাল কাটা কামাল
ছোটখাটো যুবকটি প্রাণপণ ছুটছেন। শার্ট-প্যান্ট পরা। পায়ে কালো হিল সু। তাকে ধাওয়া করছে পুলিশের তিনটি পিকআপ। পিকআপে জনা বিশেক সশস্ত্র পুলিশ। হঠাৎ যুবকটি বড় রাস্তা ছেড়ে সরু গলিতে ঢুকে পড়ল। পিকআপ ঢুকতে পারল না। থেমে গেল। পিকআপ ছেড়ে পুলিশ দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু যুবকটি ছুটতে গিয়ে কানা গলিতে আটকে যায়। চোখের সামনে তার বিশাল এক প্রাচীর! ধরা দিতেই হবে তাকে। পুলিশও খুশি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে যুবকটি সেই প্রাচীর টপকে অপরপাশে লাফিয়ে পড়ল! কিংকর্তব্যবিমূঢ় পুলিশের কেউ কেউ প্রাচীর টপকে তার পিছু নিল। কেউ আবার ভিন্ন পথে অগ্রসর হলো। যুবকটি আধাঘণ্টা দৌড়ে এভাবে একে একে ১১টি দেয়াল টপকালেন। শেষ দেয়ালটি টপকানোর সময় তার জুতার হিল ভেঙে যায়। এতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। এটি ইংরেজি বা বাংলা কোনো চলচ্চিত্রের খণ্ডিত চিত্র বা কোনো কাল্পনিক গল্প নয়।
১৯৮২ সালের জানুয়ারির শীতের এক সকালে এমনই এক শ্বাসরুদ্ধকর নাটকীয় ঘটনার অবতারণা হয়েছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছিলেন দুর্ধর্ষ কামাল, গালকাটা কামাল। এফডিসি থেকে বেরিয়ে ট্রাকস্ট্যান্ড হয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় যাওয়ার সময় পুলিশ তাকে ধাওয়া করে। একে একে ১১টি দেয়াল টপকেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা তাকে পড়তেই হয়েছিল পুলিশের কাছে। পুরো নাম আবুল হাসনাত কামাল। পুরান ঢাকার একটি বৈঠকে কামালের সঙ্গে হাতাহাতি, পরে ভাঙা বোতলের আঘাত। সেই আঘাতেই কামালের চিবুকে বড় ক্ষতের দাগ। তখন থেকেই তিনি হলেন ‘গালকাটা’ কামাল। আর এই গালকাটা কামাল নামটিই হয়ে ওঠে পরবর্তীতে সন্ত্রাসের মূর্তপ্রতীক। কামাল গান গাইতেন, শেখাতেনও। যে হাতে তিনি হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন, সেই হাতেই তিনি অস্ত্র চালাতেন। লাশ ফেলতেন। কখনো নিজ প্রয়োজনে, কখনো ভাড়াটে হয়ে। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে গুলি করে খুন করতে যেমন ছিলেন পারদর্শী, তেমনি ধারালো অস্ত্রের ব্যবহারে দেহ থেকে মাথা আলাদা করতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। খুনের নেশায় মত্ত এই মানুষটির ভয়াবহ সব কর্মকাণ্ডে কাঁপতো ঢাকা শহর। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো সেই দানবে রূপ নেওয়া গালকাটা কামালের অপরাধ জীবনের ইতি ঘটে কারাগারের দেয়ালের আড়ালের ফাঁসির দড়িতে। ১৯৭৪ সালে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা কলেজ ছাত্র কামালের নাম-ডাক খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে।
গালকাটা কামালের অপরাধ জীবন সম্পর্কে জানতে এই প্রতিবেদক কামালের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তাদের বক্তব্যে প্রায় ৩৭ বছর আগেকার কামালের অপরাধ জীবনের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। কামালের ঘনিষ্ঠ ওই সূত্রগুলো জানায়, ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন গালকাটা কামাল। কখনো মোটরসাইকেলে, কখনো জিপে করে। দাপিয়ে বেড়াতেন ঢাকার এ মাথা থেকে ও মাথা। একাই খুন করতে পছন্দ করতেন তিনি। একে একে খুন করে গেছেন, কিন্তু তাকে খুন করার সাহস দেখায়নি কেউ। যে কারণে ‘খুনের বদলা খুন’- আন্ডার ওয়ার্ল্ডের এই নীতিও ধোপে টিকেনি তার অসীম সাহসিকতার কারণে। এক সময়ে এই গালকাটা কামালের নাম ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীজুড়ে। পুলিশের খাতায় তিনি মোস্ট ওয়ান্টেড। এরপরও তিনি কোমরের দুপাশে দুটি পিস্তল গুঁজে বুক চিতিয়ে চলাফেরা করতেন। সরকারের রেড কার্ডধারী এই দুর্ধর্ষ অপরাধী এক সময় হয়ে ওঠেন ‘ঢাকার ডন’। ১৯৭৪ সাল থেকে ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক গালকাটা কামালের হাতে একজন এমপি, যুবদলের জাফর, ফিরোজ, রানাসহ অসংখ্য খুনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি এতটাই প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন যে, তার প্রতিপক্ষ সোহরাওয়ার্দী কলেজের দুই ছাত্রনেতার বাসা লক্ষ্য করে প্রতিদিন নিয়ম করে চার রাউন্ড করে গুলি ছুড়তেন। পুলিশ বা অবৈধ অস্ত্রধারী কেউ তাকে এই গুলিবর্ষণ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। দিনের কোনো না কোনো এক সময় তিনি নিজেই গুলি করে চলে আসতেন। তাকে ঠেকানোর পরিস্থিতি সে সময়ে কারও ছিল না। ফরিদপুরের করণগোলার কার্তিকপুর কামালের গ্রামের বাড়ি। ঢাকায় এসে প্রথমে মোহাম্মদপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম রোডে খালার বাসায় থাকতেন। পরে গোপীবাগের অভয় দাস লেনে তার বাসা ছিল। বিয়ের পর তিনি গেণ্ডারিয়াতেও ছিলেন। কামালের বাবা আবুল হোসেন খান, যিনি প্রথমে পুলিশে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে ব্যবসা ও হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। কামালরা ছিলেন দুই বোন, তিন ভাই। তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ভাইদের মধ্যে বড়। তার পরিবারের সবাই ছিলেন সংগীত শিল্পী। কামাল নিজেও গান গাইতেন, শেখাতেন। চলচ্চিত্রেও তিনি গান গাইতেন। সূত্রগুলো জানায়, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ভারতের বাগাবাড়িতে ট্রেনিং নিয়ে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মতিনের নেতৃত্বে কামাল যুদ্ধে অংশ নেন। এরপর ১৯৭৩ সালে ডামুড্যা হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এ সময় কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রশ্নে পারিবারিক অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে থাকেন কামাল। ওই সময়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য নুরুল হক খুন হন। পুলিশি তদন্তে পাওয়া যায়, এই খুনের নেপথ্যে ছিলেন নূরুল হকের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জাসদের এক নেতা। ওই নেতাই ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটান। আর ভাড়াটে খুনি ছিলেন গালকাটা কামাল। কিন্তু জাসদের ওই নেতা প্রতিশ্রুতি মতো টাকা পরিশোধ না করায় কামালের সঙ্গে তার নতুন করে দ্বন্দ্ব বাধে। কিন্তু এরই মধ্যে কামাল গ্রেফতার হন নুরুল হক খুনের মামলায়। পরে কামালের মা ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ছোটাছুটি করে কামালকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। এর কয়েকদিন পরই অর্থাৎ নুরুল হক খুন হওয়ার ১৭ দিনের মাথায় কামালের বাবা আবুল হোসেন মারা যান। ভাইদের মধ্যে বড় হওয়ায় পরিবারের দায়-দায়িত্ব চলে আসে কামালের ওপর। ’৭৪ সালে কিছু করার মানসিকতা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন কামাল। ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। ওই সময়ে কামালের এক আত্মীয় তৎকালীন পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেই সুবাদে কামাল একটি গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে চাকরি পান। এই কাজের জন্য কামালকে একটি মোটরসাইকেলও দেওয়া হয়। কিন্তু অপরাধ জীবনের হাতছানির কারণে ওই বছরই সেই চাকরি ছেড়ে দেন কামাল। কিন্তু মোটরসাইকেলটি তিনি ফেরত দেননি গোয়েন্দা সংস্থাকে। এই অভিযোগে পুলিশ কামালকে গ্রেফতার করে। কিছুদিন পর কামাল ছাড়া পান। ১৯৭৫ সালে কামাল বিয়ে করেন খালাতো বোন বিউটিকে। গেণ্ডারিয়ায় বাসা ভাড়া করেন। কামাল তিন চারজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে গানের শিক্ষকতা শুরু করেন। ওই বছর ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কামালের পরিবর্তিত জীবন শুরু হয়। জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্র নেতা হালিমের ছত্রছায়ায় অপরাধ জীবন শুরু করেন কামাল। মোহাম্মদপুরে তার খালাতো ভাই জামান খুন হন। ওই খুনের পর তিনি চলে যান পুরান ঢাকায়। ১৯৭৬ সালে ওয়াইজঘাট এলাকার জনৈক নুরু মিয়া সদরঘাট বার্ষিক ইজারা নিলেন কামালের সহযোগিতায়। এই ইজারা নেওয়াকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্র দিলা-মোখলেসের সঙ্গে কামালের দ্বন্দ্ব বাধে। পরে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। দ্বন্দ্ব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে, দেখা মাত্র একে অপরকে গুলি করার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। গালকাটা কামাল তাদের দুজনকে হত্যার নানা পরিকল্পনা করলেও শেষমেশ তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ক্ষুব্ধ কামাল পুরান ঢাকার ‘আজাদ’ সিনেমা হলের সামনে দিলা-মোখলেসের বাড়ির সামনে গিয়ে দু’রাউন্ড গুলি ছোড়ে। প্রতিদিন নিয়ম করে মোটরসাইকেলে করে আসতেন কামাল। কাউবয় স্টাইলে কোমরে গুঁজে রাখা দুটি পিস্তল দুহাতে নিয়ে দুম দুম করে গুলি করতেন তিনি।
ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন হিসাবে নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তার ফিল্মি স্টাইলে নানা অপারেশনের কারণে। জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয়তাবাদী যুবদল গঠনের পর কামাল যুবদলে যোগদান করেন। তিনি কোতোয়ালি থানা যুবদলের সভাপতি মনোনীত হন।
কামালকে রাজনৈতিকভাবে তখন উপরে তোলেন বরিশাল অঞ্চলের তৎকালীন বিএনপির এক নেতা। এ পর্যায়ে কামাল তার পরিবার অর্থাৎ মা ও ভাই-বোনদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। অভয় দাস লেনে চিত্রনায়ক বুলবুল আহমেদের বোনের বাড়ি ভাড়া নেন কামাল।
পল্টনে জাতীয়তাবাদী যুবদল কর্মী ছিলেন জাফর। তিনি ছিলেন অবাঙালি। নয়াপল্টনের জাফর নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে এই জাফরের নামডাক ছিল। তৎকালীন মন্ত্রী আবুল কাশেমের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন এই জাফর। সেই সময়ে মতিঝিল ক্লাবপাড়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী জুয়াড়ি ছিলেন সিরাজ। সারা দেশের অপরাধীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় জুয়ার বোর্ড বসাতেন তিনি। এই সিরাজের সঙ্গে জাফরের কলহ হয় জুয়া নিয়ে। ক্লাবপাড়ায় শত শত লোকের সামনে সিরাজকে মাটি থেকে থুথু চাটতে বাধ্য করেছিলেন জাফর। এই অপমান সহ্য করতে পারেননি সিরাজ। জাফরকে হত্যার পরিবল্পনা আঁটেন তিনি। আর এ জন্য তিনি ভাড়া করেন রাজধানীর তখনকার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধী গালকাটা কামালকে। কামাল ভাড়াটে খুনি হিসেবে জাফরকে হত্যা করেন। এর আগে জাফরকে অনুসরণ করতে করতে তিনি গুলিস্তান পর্যন্ত যান। কামান পয়েন্টে তিনি জাফরকে গুলি করেন। শত শত লোকের সামনে জাফরকে গুলি করে নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন কামাল। ঘটনাস্থলেই জাফরের মৃত্যু ঘটে। পরবর্তীতে ওই সিরাজের বিরুদ্ধে ক্লাবপাড়ায় খুনের অভিযোগ ওঠে। নাসির নামে এক যুবককে হত্যার পর লাশ লুকাতে আজাদ বয়েজ ক্লাবের ম্যানহোলে ফেলে রেখেছিল সিরাজ। সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার নওয়াবপুর এলাকার জাতীয়তাবাদী যুবদলের কর্মী ছিলেন ফিরোজ ও রানা। অভয় দাস লেনের প্রামাণিকের সঙ্গে ফিরোজ-রানার গোলমাল হয়। প্রামাণিক ছিলেন কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আপস মীমাংসার কথা বলে যাত্রাবাড়ী থেকে ফিরোজ-রানাকে একটি জিপে তুলে নেন কামাল। তাদের নেওয়া হয় অভয় দাস লেনের শহীদ নবী বিদ্যালয়ের ভিতর। সেখানে ফিরোজ আর রানাকে কামাল জবাই করে হত্যা করে। হত্যার পর তাদের দেহ আর মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দুজনের খণ্ডিত লাশ আবারও জিপে তুলে নেন কামাল ও তার সহযোগীরা। জগন্নাথ কলেজের ভিতরের একটি মাঠে লাশ ফেলে রাখেন কামাল। এ ঘটনাটি তখন সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরবর্তীতে এই জোড়া খুনের ঘটনাই কামালের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। সূত্র জানায়, ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে কামাল চিত্রজগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার বন্ধু ফজলুর রশিদ ঢালী ছিলেন ‘রসের বাঈদানী’ ছবির প্রযোজক আর কামাল ছিলেন এর প্লেব্যাক সিঙ্গার। রসের বাঈদানী ছবির প্রথম দিনের শুটিংয়ের খবর একটি পত্রিকায় গ্রুপ ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ওই ছবিতে কামালও ছিলেন। তখন পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল কামালকে। পত্রিকায় গ্রুপ ছবি দেখে পুলিশ কামালকে গ্রেফতারের সূত্র খুঁজে পায়। ঢালীর মোহাম্মদপুরের বাসায় হানা দেয় পুলিশ। তাকে জেরা করে পুলিশ। এক পর্যায়ে পরদিন যেখানে ঢালীর সঙ্গে দেখা হবে কামালের, সেখানে পুলিশ ওতপেতে থাকে। পরদিন কামাল এফডিসিতে যান। এফডিসি থেকে বেরিয়ে তেজাগাঁও শিল্প এলাকায় যাওয়া মাত্র পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় ১১টি দেয়াল টপকান কামাল। কামালের তথ্য মতে পুলিশ ওই সময়ে তার বাসা থেকে দুটি রিভলবার উদ্ধার করে। সে সময়ে যুবমন্ত্রী আবুল কাশেম পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেন, কামালের সঙ্গে যুবদলের কোনো সম্পর্ক নেই। সামরিক আদালতে জাফর, ফিরোজ ও রানাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলায় ফাঁসির রায় হয়। ১৯৮২ সালে সেই ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।
কামালের পরিবারের অভিযোগ : কামালের পারিবারিক সূত্র জানায়, কামালকে যেদিন ফাঁসি দেওয়া হয়, সেদিনই হঠাৎ জানানো হয়েছে পরিবারের সদস্যদের। কামালের সঙ্গে তার মা দেখা করতে যান কারাগারে। কামাল এ সময় তাকে দেখে অবাক হন। কামালকে তার মা বলেন, সে দিনই তার শেষ দিন। তখন কামাল তার মাকে বলেন, এটা হতে পারে না। তাহলে তাকেও জেলার জানাতেন। বিশ্বাস করতে না পেরে কামাল তার মাকে বলেন, জেলারের সঙ্গে দেখা করতে। যদি শেষ দিনই হয়, তাহলে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন তার মাকে। এই কথা শুনে কামালের মা জেলারের কাছে ছুটে যান। জেলার জানান, সে দিনই কামালের ফাঁসি হবে। তখন কামালের মা তার ছেলের কাছে ফের যেতে চাইলে তাকে আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। কামালের সেই শেষ কথাটিও তার মায়ের কাছে জানানো হয়নি। না বলাই থেকে গেল মা আর ছেলের সেই শেষ কথাটি।
বৈঠকী খুনী আকবর শেঠ
১৯৮০ সাল। বর্ষাকাল। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জের রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। লোকজন খুব একটা নেই। দোকানপাটও বন্ধ। সেখানকার একটি এলাকার নাম বরিসুর। সন্ধ্যা থেকে চার রাস্তার মোড়ের একটি টিনশেডের বাসায় তখন খুব হৈহুল্লোড়। গান বাজছে উচ্চৈঃস্বরে। মদের নেশায় চুর ৮-১০ জন যুবক। নিজেরাই নিজেদের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি করে যাচ্ছে। তাদের সেই আনন্দ উল্লাস আর চিৎকারের শব্দ প্রবল বর্ষণের শব্দের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। রাত ৯টায় হঠাৎ পাঁচ-ছয় জন অস্ত্রধারীর আগমন। তাদের দুজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। বাকিদের হাতে ক্ষুরধার রামদা আর চাপাতি। ওরা মদের আসরে ঢুকেই বুঁদ হয়ে থাকা যুবকদের মধ্যে দুজনকে আলাদা করে নিল। সেখানেই চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুজনের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালাল। রক্তাক্ত নিথর দুটি দেহ গাড়িতে তুলে তারা লাপাত্তা। পরে ওই দুজনের লাশ মিলল নদীর ধারে।
দাওয়াত কবুল করে মদের আসরে এসে এভাবেই নির্মম খুনের শিকার হন আইয়ুব ও মিন্টু নামে দুই যুবক। আর তাদের দাওয়াত করে এনেছিলেন পুরানা ঢাকার তৎকালীন সন্ত্রাসের গডফাদার আকবর হোসেন, যিনি আকবর শেঠ নামেই পরিচিত। দাওয়াত দিয়ে এনে আইয়ুব আর মিন্টুর খুনের মতো এমন অসংখ্য খুন করেছেন এই আকবর শেঠ।
জানা গেছে, দাওয়াত দিয়ে খুন করার এ কৌশলটি আন্ডারওয়ার্ল্ডে 'বৈঠকী খুন' নামে পরিচিত, যার জনক বলা হয়ে থাকে আকবর শেঠকে। সেই সময়ে 'বৈঠকী খুন' খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খুনিদের কাছে। বৈঠকী খুনের কারণেই এখনো পুরানা ঢাকায় কেউ কখনো দাওয়াত বা বৈঠকের কথা বললে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্যরা তা কবুল করেন না। আকবর হোসেন ওরফে আকবর শেঠের বাসা নয়াবাজারের আইউবউল্লাহ সড়কে। জিয়া সরকারের আমলে তিনি ছিলেন নয়াবাজার থেকে শুরু করে সদরঘাট পর্যন্ত গোটা এলাকার ত্রাস। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সেই সময়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে কারও কথা বলার সাহস ছিল না। রংবাজি আর মাস্তানিতে আকবর শেঠের নাম তখন মানুষের মুখে মুখে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন, এমন কাউকে তিনি এ দুনিয়াতেই রাখতেন না। তার মাস্তানি এমনই এক পর্যায়ে উঠেছিল, শখ করে এলাকার লোকজন আকবর নামের শেষে 'শেঠজি' জুড়ে দিয়েছিলেন। তবে সাধারণ মানুষ তা খুব একটা জানতেন না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আরমানিটোলা স্কুলের মাঠে একটি জনসভায় অংশ নেন। বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা এই আকবর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে, জিয়াউর রহমান তাকে 'আকবর শেঠ' সম্বোধন করে ডাক দিয়ে মঞ্চে আসতে বলেন। সেই তখন থেকেই তার আসল নাম আকবর হোসেনের স্থলে হয়ে যায় আকবর শেঠ।
আকবর শেঠের অন্যতম শিষ্য ছিলেন নয়াবাজারের আরেক ত্রাস আলীজান। বৈঠকের আয়োজন করতেন আকবর শেঠ, আর তার শিষ্য আলীজানকে দিয়েই দাওয়াত দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। সেই দাওয়াতে এসেই বহু লোক প্রাণ হারিয়েছেন। এমন গল্প আছে নয়াবাজারের মানুষের মুখে মুখে।
মাস্তানিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে বার্ধক্যের কোঠায় পা রেখে ব্যবসা, সমাজসেবা, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে খ্যাতির শীর্ষে উঠে এসেছিলেন আকবর শেঠ। ঠিক ওই সময়ই তিনি নির্মম খুনের শিকার হলেন। খুন হলেন শিষ্যের হাতেই। ক্ষমতার লোভ, লালসা থেকে সৃষ্টি হওয়া পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান শিষ্য আলীজান। যে এলাকায় বুক চিতিয়ে হাঁটতেন আকবর শেঠ, সেই নিজ এলাকাতেই তাকে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে খুন করেছেন আলীজান ও তার সহযোগীরা।
সূত্রগুলো জানায়, পুরান ঢাকা এমনই এক রহস্যময় জটিল জায়গা, যেখানে অলিতে গলিতে স্বল্পপরিসরে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চলে। প্রকৃত বাণিজ্যের আড়ালে অবৈধ বাণিজ্য করে থাকেন সেখানকার কিছু ব্যবসায়ী। ব্যবসাবান্ধব এই পুরান ঢাকার সব কিছুই ছিল আকবর শেঠের নিয়ন্ত্রণে। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যই নয়, সেখানকার আচার-বিচার, সব কিছুই হতো আকবর শেঠকে ঘিরে। একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে গোপনে গোপনে সংগঠিত হলেও, প্রকাশ্যে কেউ কখনো তার সামনে দাঁড়াতে পারেননি। পুরান ঢাকার পশুর হাট থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও দেখতেন আকবর শেঠ। কিন্তু দিন যত এগোতে থাকে ভিতরে ভিতরে তার শত্রুপক্ষ সংগঠিত হতে থাকে।
আকবর শেঠের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, যৌবনের সেই মাস্তানির ঘারানা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে থাকেন আকবর শেঠ। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কিছু কিছু বিষয় থেকে সরে আসতে পারেননি। কিন্তু ঘরের শত্রু বিভীষণ- এ প্রবচনটি ভুলে গিয়েছিলেন আকবর শেঠ। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে নয়াবাজার গরুর হাট নিয়ে তার শিষ্য আলীজানকে বকাঝকা দেন আকবর শেঠ। দুই দিন পর অন্য একটি পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলীজানের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আকবর শেঠ। রাস্তায় শত শত লোকের সামনে আলীজানের গালে চড় মারেন আকবর শেঠ। এতে আলীজানের আত্দসম্মানে লাগে। সেখানে আলীজানের ভাতিজা ও তাদের বন্ধুবান্ধবও ছিল। ক্ষোভে আলীজান সেখান থেকে চলে যান। আলীজানের ভাতিজা আসাদসহ অন্যরা আলীজানকে বলতে থাকেন, তারা এর চরম প্রতিশোধ নেবেন। তাদের এ প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা জেনে যান আকবর শেঠ। পরে এলাকার লোকজন দিয়ে আলীজানকে ডেকে আনা হয় আকবর শেঠের সামনে। সেখানে সমঝোতা হয় তাদের। আর এর জন্য আকবর শেঠ আলীজানকে ২০ হাজার টাকাও দেন। তারা কোলাকুলি করে যে যার দিকে চলে যান। সূত্র জানায়, উপর দিয়ে ঘটনার নিষ্পত্তি ঘটলেও পুরান ঢাকার প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্রের আধিপত্য বিস্তার ও সুযোগ-সুবিধার বহু বিতর্কিত ঘটনার ঝগড়া নেপথ্যে থেকেই যায়; যা খুনের মধ্য দিয়ে পুরনো শত্রুতার নিষ্পত্তি ঘটে। ১৯৯১ সালের ১৩ আগস্ট। আকবর শেঠ তার বন্ধু সুলতানকে নিয়ে রাত পৌনে ১২টার দিকে নয়াবাজার তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পারভেজ ট্রান্সপোর্ট থেকে বাসায় ফিরছিলেন। তারা ছিলেন রিকশায়। বাসার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু গলির ভিতরেই ওত পেতে বসে ছিল খুনির দল। তাদের মধ্যে ছিলেন আলীজান, ফজলু, নাইয়ুম, আলীজানের ভাতিজা আসাদসহ আরও কয়েকজন। চাপাতি আর রামদা নিয়ে রিকশার পেছন থেকে তারা হামলা চালান। চাপাতির কোপে রক্তাক্ত আকবর শেঠ রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে যান। তার বন্ধুর শরীর থেকেও বের হচ্ছে রক্ত। তিনি রিকশা থেকে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টিপু সুলতান রোডের দিকে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। কিন্তু রক্তাক্ত আকবর শেঠ আর উঠতে পারছিলেন না। জনাকীর্ণ ওই রাস্তায় খুনিরা তাকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছিলেন। একজন গলায় পোঁচ দিতে শুরু করেন। শেষে আকবর শেঠকে কয়েক রাউন্ড গুলি করা হয়। খুনিরা তাদের মিশন শেষ করেই গুলি করতে করতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
১৯৭৮ সাল থেকে রংবাজি শুরু করা ঢাকার এই ডন ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন। হালকা পাতলা গড়নের এই লোকটি সাদা পোশাক পরতে ভালোবাসতেন। নয়াবাজারের ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলেছেন, রংবাজি করতে আকবর শেঠের অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। তার এক হুঙ্কার ছিল তপ্ত বুলেটের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আকবর শেঠকে খুনের দায়ে আলীজান এখন জেলে। অন্য আসামি ফজলু জেলে থাকতেই মারা যান। ভাতিজা আসাদ আছেন বিদেশে। পুলিশের কাছে খবর আছে, তিনি এখন ইতালিতে।
কালা জাহাঙ্গীর
২০১০ সালের ৯ এপ্রিল যশোরের বেনাপোলে গ্রেফতার হন ঢাকার রামপুরার সন্ত্রাসী শাহজাদা। এই শাহজাদা ছিলেন কালা জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। পুলিশের জেরার মুখে শাহজাদা জানান, ২০০৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর কালা জাহাঙ্গীর নিজ মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। পরে গুলশানের কড়াইল এলাকার একটি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। দাফনের সময় তাদের আরেক সহযোগী লম্বা শামীম উপস্থিত ছিলেন। সেই শামীমের কাছ থেকেই জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সংবাদ পান বলে শাহজাদা পুলিশকে জানিয়েছেন। আরেক সূত্রের খবর, যশোরের সীমান্তবর্তী গহিন এলাকায় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন কালা জাহাঙ্গীর। পরে তার মুখ ও শরীর এসিডে ঝলসে দেওয়া হয়। পুলিশ তাকে শনাক্ত করতে পারেনি। আবার এমন খবরও আছে, যমুনার পাড়ে তাকে হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অপর একটি সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর কলেজ গেট এলাকায় নিটেলের বাসায় খুন হয় জাহাঙ্গীর। পরিকল্পিতভাবে তাকে সেখানে গুলি করে হত্যা করে পিচ্চি হান্নান। সেখানে সাহেব আলি ও নিটেল উপস্থিত ছিল। এই তিনজন পরে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। তবে কালা জাহাঙ্গীরের পরিবারের কাছেও নেই কোনো সঠিক তথ্য। তবে তাদের অনেকের দাবি, জাহাঙ্গীর জীবিত। নাম-পরিচয় পাল্টে ভিনদেশে বসতি স্থাপন করেছেন। স্ত্রী ও এক কন্যাসন্তান নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভালোই দিন কাটছে তার। বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের মোস্ট ওয়ান্টেড ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি এই কালা জাহাঙ্গীর।
কালা জাহাঙ্গীরের একমাত্র ছবি যা পুলিশ সরবরাহ করেছিলো। এর বাইরে কালা জাহাঙ্গীরের আর কোনো ছবির সন্ধান পাওয়া যায় না। ছবি: সংগৃহীত |
পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে এক নম্বরের দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসীর বাঁচা-মরা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যেমন নানামুখী তথ্য রয়েছে, তেমনি আন্ডারওয়ার্ল্ডে রয়েছে নানা গুজব আর কল্পকাহিনী। দেশের ইতিহাসে কালা জাহাঙ্গীরের মতো আর কোনো সন্ত্রাসীকে নিয়ে এমন গল্প-গুজব সৃষ্টি হয়নি। অন্ধকার জগতের মুকুটহীন এই ‘ডন’ এখন অনেকটাই ‘কিংবদন্তি’তে পরিণত। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর সব গ্যাংস্টারের কোনো না কোনো খোঁজ ইন্টারপোলসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে রয়েছে। বাংলাদেশি এই দুর্ধর্ষ অপরাধীর কোনো খবর জানে না বাংলাদেশ পুলিশ ও আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। কালা জাহাঙ্গীর ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি। তার বিরুদ্ধে ছয়জন ওয়ার্ড কমিশনারসহ ১২টি হত্যা মামলা রয়েছে। তার মধ্যে আটটিতে খালাস পেয়েছেন তিনি। অন্যগুলো বিচারাধীন রয়েছে। নানা রহস্যের স্রষ্টা এই অপরাধী এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন মাত্র একবার। তার একটি মাত্র ছবি রয়েছে পুলিশের কাছে। যা ১৮ বছর আগেকার। যে কারণে পুলিশ তাকে চেনে না। দৃশ্যমান না হলেও তার নামে নিয়মিত চাঁদা উঠছে। হালে আন্ডারওয়ার্ল্ডে কালা জাহাঙ্গীরকে ‘অদৃশ্য মানব’ বলা হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, কল্পকাহিনী আর গুজবের যত ঘটনাই থাক, কালা জাহাঙ্গীর মৃত না জীবিত- তা পুলিশ এখনো নিশ্চিত নয়। মোস্ট ওয়ান্টেড জাহাঙ্গীর পুলিশের খাতায় এখনো পলাতক। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, কোনো কিছু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পলাতক হিসেবেই থেকে যাবে দুর্ধর্ষ এই ‘অদৃশ্য মানব’। কালা জাহাঙ্গীরের প্রকৃত নাম ফেরদৌস জাহাঙ্গীর। যিনি অপরাধের সব শাখাতেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। দেশের দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী বাহিনী ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’। তার সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্রাস্ত্র ছিল বলে পুলিশের কাছে খবর ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের শীর্ষ স্থানটি দখল করে নেন জাহাঙ্গীর। শাসন করেন আন্ডারওয়ার্ল্ড। তার বাহিনীর নামে কাঁপতো আন্ডারওয়ার্ল্ড। ঘুম হারাম ছিল পুলিশ ও গোয়েন্দাদের। ১৯৯২ সালের পর রাজধানীতে সংঘটিত আলোচিত খুনের অধিকাংশই ঘটেছে এই কালা জাহাঙ্গীরের হাতে। খুন আর চাঁদাবাজিতে শীর্ষে থাকা এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী এক সময় হয়ে ওঠেন ঢাকার ডন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, জাহাঙ্গীরের সঠিক কোনো তথ্য নেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোনো সদস্যের কাছেও। গোয়েন্দাদের কাছে যা রহস্যজনক। এখনো বড় মাপের কোনো সন্ত্রাসী ধরা পড়লে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়গুলোর মধ্যে কালা জাহাঙ্গীরের বিষয়টিও স্থান পায়। পুলিশ তাদের নানা প্রশ্ন করেন। জানতে চান, কালা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তার যোগাযোগ বা সর্বশেষ কোথায় দেখা-সাক্ষাৎ বা কথা হয়েছে। কিন্তু সঠিক কোনো তথ্যই পুলিশ বিগত ১৫ বছরেও জানতে পারেনি। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এমন এক সময় গেছে যখন কালা জাহাঙ্গীরকে পাকড়াও করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল মরিয়া। বিশেষ করে ৯৬’ এর জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে কালা জাহাঙ্গীরকে ধরতে পুলিশ ও গোয়েন্দারা ব্যাপক তৎপরতা চালায়। ওই নির্বাচনে কালা জাহাঙ্গীর বিএনপির এক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে ভোলায় গিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পুলিশের কতিপয় সদস্যের সঙ্গেও ছিল তার গভীর সম্পর্ক। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ প্রচার করাটা কাউকে রক্ষা করার একটি কৌশল। এমন তথ্য ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণত পুলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটিকে গ্রেফতারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগে দেশত্যাগ বা পরিচয় পাল্টে আত্মগোপনে চলে যায় অপরাধীরা। কালা জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতে পারে বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা। কালা জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ লোকজনও তার সম্পর্কে জানবে না, এটি অবিশ্বাসযোগ্য। এ ছাড়া কালা জাহাঙ্গীরের স্পষ্ট কোনো ছবি না থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাকে চেনে না। হদিস না মিললেও আন্ডারওয়ার্ল্ডে কালা জাহাঙ্গীর এখনো জীবন্ত।
যেভাবে কালা জাহাঙ্গীর
অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়ার ছেলে ফেরদৌস জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৭৭ সালে। বাবার নাম গোলাম রহমান। বগুড়ার ধুনট থানার বনানীগাঁও তাদের গ্রামের বাড়ি। তার স্কুলশিক্ষিকা মা তাকে রাজধানী ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় তার মায়ের সঙ্গে ইব্রাহিমপুরের ১৩১/১ নং আদর্শপল্লীর বাসায় থাকতেন। ১৯৯২ সালে এসএসসিতে পাঁচ বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্ক পেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন তিনি। ভর্তি হন তেজগাঁও কলেজে। তবে কাফরুল এলাকার লিটন আর মাসুম নামে দুই যুবকের সঙ্গে বিরোধ হয় জাহাঙ্গীরের। শান্ত-ভদ্র জাহাঙ্গীর তাদের ছুরি মেরে বসে। এ ঘটনায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর ২১ দিনের হাজতবাস। এই হাজতবাসই পাল্টে দেয় সবকিছু। শুরু হয় অন্ধকার জগতের এক নতুন জীবন। কম কথা বলা ভদ্র-নম্র এই জাহাঙ্গীর এক সময় হয়ে ওঠেন হিংস্র। ফেরদৌস জাহাঙ্গীর থেকে হয়ে ওঠেন কালা জাহাঙ্গীর। গড়ে তোলেন ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’। অবৈধ অস্ত্রের মজুদও ছিল এই কালা জাহাঙ্গীরের কাছেই। তার হাতে একে একে খুন হতে থাকেন ওয়ার্ড কমিশনার, আইনজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে ব্যবসায়ী। অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকেন জাহাঙ্গীর। নতুন এক ডনের আবির্ভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুরু হয় অস্থিরতা। রাজধানীর দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসীর হাতেই সবচেয়ে বেশি আলোচিত খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এবং এর পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরের চাঁদাবাজির অনেকাংশই তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৯৬ সালে কিসলু হত্যার মধ্যদিয়ে পেশাদার কিলার হিসাবে নাম লেখান জাহাঙ্গীর। এরপর কিরন হত্যা, আইনজীবী হাবিব মণ্ডল, আদালত পাড়ায় মুরগি মিলন, কমিশনার শাহাদত, কমিশনার নিউটন হত্যাসহ আলোচিত বেশ কয়েকটি খুনে নিজেই অংশ নিয়ে গুলি চালান জাহাঙ্গীর। আন্ডারওয়ার্ল্ডে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন সে। তার যোগাযোগ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, শীর্ষ সন্ত্রাসী হওয়ার পর পুলিশ তাকে কখনো গ্রেফতার করতে পারেনি। তার অবস্থান কখন কোথায় তা তার ঘনিষ্ঠ দু’একজন ছাড়া আর কেউ জানতে পারত না। যে কারণে প্রতিপক্ষরাও তাকে পাকড়াও করতে পারত না। ২০০১ সালে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই তালিকায় তার নাম রাখা হয় সর্ব শীর্ষে। এরপরই আত্মগোপনে চলে যান জাহাঙ্গীর।
কালা জাহাঙ্গীর জীবিত! : ‘প্রতিকূল পরিবেশ হলে আন্ডারওয়ার্ল্ডের টপ হিরোদের তিনটি পথ বেছে নিতে হয়, আজীবন জেলে থাকা, না হয় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হওয়া অথবা দেশ ত্যাগ করা। এ ছাড়া চতুর্থ কোনো পথ আর খোলা নেই। যারা ভিরু তারা কোনো কিছু না বুঝে আত্মহত্যা করেন।’ এ কথাগুলো কালা জাহাঙ্গীরের। তার এক আত্মীয়ের কাছে এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন আজ থেকে ১৫ বছর আগে। জাহাঙ্গীরের পরিবারের অনেকেই তাই আত্মহত্যার ঘটনাটি কখনো বিশ্বাস করেনি। তাদের দাবি জাহাঙ্গীর আত্মহত্যা করতে পারে না। বরং তিনি জীবিত আছেন। ভালো আছেন। ভারতের ব্যাঙ্গালোর সিটিতে বসবাস করছেন এবং সেখানেই এক কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন। এটাই বিশ্বাস তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনাপাড়ের কামালপুর এবং বর্তমানে তার মায়ের বসবাসস্থল ও শেরপুরের লোকজনের। তারা বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়েছেন, জাহাঙ্গীর ভারতের ব্যাঙ্গালোর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন এবং সেখান থেকে হংকং, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভুটানসহ অন্যান্য জায়গায় ব্যবসা করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশের খাতায় নিশ্চিত না হয়ে কারও মৃত্যু হয়েছে এমন রেকর্ড রাখা হয় না। কালা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এখনো অনেক জায়গায় মামলা রয়েছে। সেখানে তাকে মৃত বলে দেখানো হয়নি। পুলিশের খাতায় তিনি এখনো ফেরারি আসামি।
রংবাজ এমরান
১৯৭৩ সাল। সন্ধ্যা ৭টা। ৬-৭ জনের দুর্ধর্ষ একটি অস্ত্রধারী গ্রুপ মতিঝিল 'বাংলার বাণী' অফিসের সামনে অবস্থান নিয়ে আছে। তারা অফিসের গেটের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের হাতে স্টেনগান, পিস্তল আর মরণঘাতী গ্রেনেড। তাদের টার্গেট বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক ও যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি। তিনি গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের অস্ত্রগুলো গর্জন করে উঠবে-এমনই প্রস্তুতি সন্ত্রাসীদের। শিকারের জন্যে তারা অধীর অপেক্ষায়। দেশের শীর্ষ স্থানীয় ও তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যার মিশন নিয়ে আসায় অস্ত্রধারীরা উত্তেজনায় কাঁপছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু শিকার আসছে না। অধৈর্য হয়ে পড়ছে অস্ত্রধারীরা। তাদের নেতৃত্বদানকারী স্টেনগান হাতের এক যুবক রাস্তার পাশের একটি অন্ধকার যায়গায় ঘাপটি মেরে আছে। ইশারা ইঙ্গিতে তিনি এই অভিযান পরিচালনা করছেন।
অস্ত্রধারীরা ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে প্রস্তুত।
হঠাৎ রাস্তার দুই পাশ থেকে দ্রুতগতিতে পুলিশের পিকআপ ছুটে আসতে থাকে। অস্ত্রধারীরা কোনো কিছুই বুঝতে পারছিল না। পিকআপ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত নেমে পড়ল বাংলার বাণী অফিসের সামনে। সন্ত্রাসীদের একজন গুলি ছুড়ল। পাল্টা গুলি চালালো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অস্ত্রধারীরা পালাতে শুরু করল। ধরা পড়ল নেতৃত্বদানকারী সেই যুবকটি। দুর্ধর্ষ সেই যুবকটির নাম এমরান, কাজী আবু এমরান। এই এমরানের পুরো পরিকল্পনায় শেখ মণিকে হত্যার এই প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু এমরানের গাড়ি চালক এই হত্যার মিশনের খবর ফাঁস করে দেওয়ায় পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। স্বাধীনতার পর যে কজন যুবক পথভ্রষ্ট হয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবে পরিণত হয়েছিল, তাদের একজন এই আবু এমরান হলেন অন্যতম। ঠাণ্ডা মাথায় অগণিত খুন করেছেন তিনি। এর মধ্যে পল্টনের রহমান-দুলাল হত্যাকাণ্ডটি অন্যতম। এই হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে সারা দেশে তখন হৈচৈ পড়েছিল। রহমান ছিলেন ঘোড়াশালের শ্রমিক নেতা এবং দুলাল ছিলেন উদীয়মান একজন সাংবাদিক। পারিবারিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও স্বাধীনতার পর দেশের অধিকাংশ ব্যাংক ডাকাতির নায়ক ছিলেন কাজী আবু এমরান। জীবনের বেশ কিছু সময় তাকে জেলে কাটাতে হয়েছে। জীবদ্দশায় তিনি খুন, ডাকাতিসহ অপরাধের সব বিভাগেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। করেছেন রাজনীতি। বিএনপির টিকিটে জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন। একসময় সব ছেড়ে ছুড়ে আধ্যাত্দিক জীবন বেছে নেন। তার মৃত্যুর পর তার কবর রাতারাতি মাজারে রূপ নেয়। ভক্ত আশেকানরা সেখানে যান। বছর বছর ওরসও হয় এমরানের মাজারে। ঘোড়াশাল বাজারের বড় মাজারটিই হলো এই কাজী আবু এমরানের মাজার। কাজী আবু এমরানের বাবা কাজী আবদুস সামাদ। গ্রামের বাড়ি ঘোড়াশালের পাঁচদোনা গ্রামে। ঢাকার জিগাতলায় তাদের বাড়ি। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে এসএসসি পাস করে এমরান ভর্তি হন তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। যুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি ছিলেন জেলে। জেল থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সেখান থেকে বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন। অতঃপর ভাসানী ন্যাপ (মশিউর)। ভাসানী ন্যাপ (মশিউর) বিএনপিতে বিলুপ্ত হওয়ার অনেক পরে এমরান বিএনপিতে যোগদান করেন।
এমরানকে খুব কাছ থেকে চেনেন এমন একজন তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, এমরানের কাছে অপরাধ ছিল এক ধরনের শিল্পিত কাজ। শিল্প সাহিত্যের মতোই সৃষ্টিশীল ওর অপরাধমূলককাণ্ড। টাকা পয়সার অভাব ছিল না। এরপরেও ব্যাংক ডাকাতি করত ধুমছে। তিনি খুন ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্যে দুর্ধর্ষ অপরাধী চক্র তৈরি করেছিলেন। সেই গ্রুপে রাজধানীর পেশাদার খুনি গুলিস্তানের জাফরসহ আরও বেশকয়েকজন চিহ্নিত খুনিও ছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর এমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের ছয়তলার একটি কক্ষে ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৭২ সালে তিনি বে-নজীর আহমেদের একমাত্র কন্যা মুন্নিকে বিয়ে করেছিলেন। পরবর্তীতে তার এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
সূত্র জানায়, ১৯৭৫ সালে এমরান জেল থেকে ছাড়া পান। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবারও ব্যাংক ডাকাতি শুরু করেন। ওই সময়ে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। জিগাতলা থেকে তিনি গ্রেফতারের আগে দেওয়াল টপকাচ্ছিলেন। এ সময় পিছন থেকে তাকে গুলি করা হলে তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার সঙ্গে এ সময় গ্রেফতার হন তার তিন সহযোগী সাঈদ, বুলবুল এবং সাহাবুদ্দিন। এই তিনজনও ছিলেন সেই সময়ের দুর্ধর্ষ অপরাধী। রাজনীতিক মশিউর রহমানের প্রভাবে এমরান জেল থেকে মুক্তি পান। কিন্তু তার তিন সহযোগী মুক্তি পান না। এমরান মুক্তির এক মাস পরই জেল ভেঙে ওই তিনজন বেরিয়ে যায়। বাইরে থেকে তাদের সহযোগিতা করেন এমরান। এমরান তখন বিএনপিতে যোগদান করেন। এ সময় তার পরিকল্পনায় রাজধানীতে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটলেও তিনি থাকতেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সূত্র জানায়, পরিবারের পীড়াপিড়িতে দেশ ছাড়েন এমরান। ১৯৭৭-এর শেষ দিকে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে ইরান হয়ে জার্মান চলে যান। কিন্তু একটি বিশেষ মিশনে অংশ নিতে তিনি '৭৯-তে দেশে ফিরে আসেন। নিষ্ঠুরতা বাদ দেওয়ার জন্য তার স্ত্রী এ সময় বার বার মিনতি করলেও তিনি সাড়া দেননি। স্ত্রীকে বলেছিলেন, তার জীবনের একটি শেষ কাজ আছে। ওটা না করা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। ওটাই হবে তার জীবনের শেষ কোনো অপরাধ।
সূত্র জানায়, ঘোড়াশালের রাজনীতির প্রতি দুর্বলতা ছিল এমরানের। সেখানকার শ্রমিক রাজনীতির উচ্চাশা নিয়ে শ্রমিক নেতা রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা অাঁটে। তার মতে, এই রহমানই হলেন তার রাজনীতির চলার পথের সবচেয়ে বড় বাধা। যে কারণে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই সুযোগ-সুবিধা খুঁজছিলেন রহমানকে হত্যার জন্যে। একসময় সেই সুযোগ এসেও গেল। ১৯৮১ সালের ৭ মে রাজধানীর বিজয়নগরে তিনি সেই মিশন শেষ করেন। ৩৪ বছর আগে এক সন্ধ্যায় ফিল্মি কায়দায় হামলা চালিয়ে খতম করলেন শ্রমিক নেতা ঘোড়াশাল শ্রমিক লীগ সভাপতি আবদুর রহমান ও অর্থনৈতিক বিষয়ক প্রতিভাদীপ্ত সাংবাদিক বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ফেরদৌস আলম দুলালকে। ১৯৮১ সালের ৭ মে দুলাল পিআইবিতে একটি কর্মশালায় ছিলেন। সেখান থেকে তিনি বাসস অফিসে ফিরেন। একটি রিপোর্ট জমা দিয়ে তিনি অফিসের নিচে যান। বাসসের নিচে ছিল শ্রমিক লীগের অফিস। দেখা হয় শ্রমিক লীগ নেতা আবদুর রহমানের সঙ্গে। আবদুর রহমান তাকে বলেন, দুলাল চল, মিজান কাকার (পরে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী) বাসায় যাই। দুলাল তার কথায় রাজি হন। পল্টনের মোড় থেকে একটি রিকশায় চড়ে তারা রওনা হন। তাদের রিকশা বিজয়নগর মোড়ের মুক্তি ঔষধালয়ের সামনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে একটি ভেসপা মোটরবাইক এসে তাদের রিকশার সামনে এসে ব্যারিকেড দেয়। ভেসপায় ছিল তিনজন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চালকের পেছনের দুজনের হাতের অস্ত্রগুলো গর্জে ওঠে। ফায়ার করতে থাকে তারা। এতে রহমানের শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়। দুলালের মাথা ভেদ করে একটি বুলেট। আরেকটি বুলেট তার পেট ঘেঁষে চলে যায়। দুজনই রিকশায় বসা অবস্থায় পেছন দিকে হেলে পড়েন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে তাদের। এই জোড়া খুনের ঘটনায় কাজী এমরান ও আযম খানসহ কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর বলা হয়, এরাই রহমান-দুলালের খুনি। তবে টার্গেট ছিল রহমান। দুলাল তাদের টার্গেট ছিল না।
দেশ কাঁপানো এই হত্যাকাণ্ডের পর সে রাতেই এমরান বিএনপি অফিসে যান। সেখানকার ফোন থেকে তার স্ত্রীকে কল করে জানিয়েছিলেন, 'মুন্নি আমার কাজ শেষ। আমি আসছি।' এই বলেই ফোন রেখে দেন এমরান। সেখান থেকে তিনি মুহসীন হলে যান। কাপড়-চোপড় গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন। জার্মানি থেকে এসে এমরান নয়াপল্টনের ভাসানী মসিউর স্মৃতি সংসদ অফিসে প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা দিতেন। সেখান থেকেই লোক মারফত খোঁজ নিতেন রহমানের গতিবিধির। রহমান-দুলাল হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার হন এমরান। দীর্ঘদিন পর জেলে থেকে মুক্তি পান। তিনি চলে যান নিজ এলাকা ঘোড়াশালে। রাজনীতিতে মন দেন। বিএনপির রাজনীতিতে তিনি এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। '৯১-এর জাতীয় নির্বাচনে তিনি বিএনপির হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান। এর পরের ইতিহাস নাটকীয়। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে রাজনীতি থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেন। রাজনীতি থেকে সরে এবার তিনি নিজেকে ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করতে থাকেন। সাধারণ কাপড়-চোপড় ছেড়ে সাদা থান কাপড় পরিধান করতে থাকেন। চুল-দাড়ি কাটা বন্ধ করে দেন। আধ্যাত্দিক জীবন বেছে নেন তিনি। ধর্মীয় একটি তরিকার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেন। আস্তানা গাড়েন নিজ এলাকার বাড়িতেই। লোকজন আসতে থাকেন তার কাছে। রীতিমতো তিনি ধর্মীয় মুরবি্বতে পরিণত হন। ১৯৯৭ সালের ৯ আগস্ট ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী আবু এমরানের মৃত্যু ঘটে। নিজ আস্তানার কাছেই তাকে দাফন করা হয়। সেখানেই তার কবর পরিণত হয় মাজার শরিফে। সেখানে নিয়মিত ভক্ত আশেকানরা আসেন। আগরবাতি দেন, মোমবাতি জ্বালান। প্রতিবছর তার মৃত্যুর দিনে সেখানে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়।
পিচ্চি হান্নান
রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের গরিব-এ-নেওয়াজ এভিনিউ। সেখানকার ২ নম্বর বাড়িটি র্যাবের ৪০ জনের একটি চৌকস দল ঘিরে ফেলেছে। এদের প্রত্যেকের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। অস্ত্রের নলগুলো ওই বাসার ভিতরের দরজার দিকে তাক করা। হঠাৎ ভিতর থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন এক যুবক। তার দুই হাত দুই পকেটে ঢোকানো। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুবকটি দুই পকেট থেকে কাউবয় স্টাইলে দুটি পয়েন্ট ২২ বোরের পিস্তল বের করলেন। র্যাব সদস্যদের টার্গেট করে গুলি ছুড়তে লাগলেন। হঠাৎ এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না র্যাব সদস্যরা। তাদের মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। অন্য সদস্যরা পাল্টা গুলি চালাচ্ছেন। মধ্যরাতে গোলাগুলিতে উত্তরা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অস্ত্রধারী যুবকটির শরীরে বেশ কয়েকটি গুলিবিদ্ধ হয়। ওই অবস্থাতেই যুবকটি কমান্ডো স্টাইলে লাফিয়ে পাঁচিল টপকে বাড়ির বাইরে চলে যায়। সঙ্গে তার দুই সহযোগীও।
দ্রুত তারা চড়ে বসলেন বাইরে পার্ক করে রাখা মাইক্রোবাসে। র্যাব সদস্যরা এ সময় গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ততক্ষণে মাইক্রোবাসটি হাওয়া। ২০০৪ সালের ২৪ জুন হাতের নাগালে পেয়েও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানকে। কমান্ডো স্টাইলে র্যাবের সামনে দিয়েই গুলি করতে করতে পালিয়ে যান তিনি। কিন্তু দুই দিন পর সাভারের এক হাসপাতালে তাকে ধরে ফেলে র্যাব। পিচ্চি হান্নান তখন ধূর্ত র্যাবকে কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, 'টাকাটা নিয়ে ছেড়ে দিন স্যার'। পরে ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়।
আবদুল হান্নান ওরফে পিচ্চি হান্নান। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেক ডন। যিনি রাজধানীর মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন। শীর্ষ স্থানীয় এই মাদক ব্যবসায়ীর মূল আস্তানা ছিল ঢাকার কারওয়ান বাজার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ২৩টিরও বেশি মামলা ছিল। এর মধ্যে বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মণ্ডল হত্যা মামলা, ওয়ার্ড কমিশনার শাহাদাত হোসেন হত্যা মামলা, এসআই হুমায়ুন কবির হত্যা মামলা রয়েছে। এ ছাড়া ফার্মগেট, পান্থপথে পথ চলতে গিয়েও গুলি করে হত্যা করার ঘটনা রয়েছে তার অপরাধ জীবনে।
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের চরদুখিয়া ইউনিয়নের ওয়াজিউল্লাহর পাঁচ সন্তান। এর মধ্যে হান্নান দ্বিতীয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি। রাজধানীতে তার বাবার কাঁচামালের ব্যবসা ছিল। প্রথম পর্যায়ে তিনি কারওয়ান বাজারে সেই কাঁচা মালের ব্যবসাই দেখাশোনা করতেন। কালক্রমে ছিনতাই চুরির মতো অপরাধ করে হাত পাকিয়ে খুন, ডাকাতি আর অপহরণের মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
চাঁদপুরের এই হান্নান ১৯৯৬ সালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পান্থপথ এলাকায় মাদক ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময়ে স্টার বেকারির পাশে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সশস্ত্র হামলা চালায় পিচ্চি হান্নান। গুলি করে হত্যা করে রানা নামে এক যুবককে। ওটাই ছিল খুনের হাতে খড়ি। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। গড়ে তোলেন শক্তিশালী বাহিনী। পিচ্চি হান্নানের অস্ত্রের ভাণ্ডারে তখন অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানীর আরেক ডন কালা জাহাঙ্গীরকে হত্যা করে নিজের শক্তি সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটান আন্ডারওয়ার্ল্ডে। পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সব সরকার আমলেই সরকারের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন, যারা সরাসরি সহযোগিতা করতেন পিচ্চি হান্নানকে। এমন পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন, যিনি কিনা পিচ্চি হান্নানের ফেনসিডিল ভর্তি ট্রাক পাহারা দিয়ে খালাস করাতেন। আর এ জন্যে পিচ্চি হান্নান মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতেন।
রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ কালা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কালা জাহাঙ্গীর আর পিচ্চি হান্নান মূলত এক সঙ্গেই বিভিন্ন অপরাধ করতেন। খুনের ঘটনাগুলোতেও তারা থাকতেন একসঙ্গে। '৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তারা বিএনপির একই প্রার্থীর হয়ে কাজ করেছেন। তারা আন্ডারওয়ার্ল্ডের ত্রাস হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সমর্থ হয়। পিচ্চি হান্নান ও কালা জাহাঙ্গীরের এই গ্রুপের মাসে চাঁদা উঠত কোটি টাকার ওপর। রাজধানীতে তারা গাড়ি-বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। সূত্র জানায়, পিচ্চি হান্নান চলাফেরা করতেন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেহরক্ষী থাকত চারপাশ ঘিরে। তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কোনো এলাকায় তিনি যাওয়ার পরিকল্পনা করলে অগ্রবর্তী দল গিয়ে সিগন্যাল দেওয়ার পর তিনি রওনা দিতেন।
গ্রেফতার ও মৃত্যু
উত্তরা ২ নম্বর গরিব-এ-নেওয়াজ এভিনিউ'র ২ নম্বর বাড়িটি একজন প্রবাসীর। পিচ্চি হান্নানের ব্যবসায়ী বন্ধু বাবুল টাওয়ারের মালিক বাবুলের মাধ্যমে উত্তরার ওই বাসায় যেতেন পিচ্চি হান্নান। ওখানে পিচ্চি হান্নান এবং তার বন্ধু-বান্ধব মিলে ফুর্তি করতেন। পিচ্চি হান্নান নিয়মিত সেখানে যেতেন। র্যাব এ সংবাদ পাওয়ার পর ২৫ জুন অভিযান চালায় ওই বাসায়। কিন্তু পিচ্চি হান্নান গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালাতে সমর্থ হয়। ওই বাসা থেকে গ্রেফতার হয় পিচ্চি হান্নানের সহযোগী জাকির, বাবুল, দেবাশীষ, সাহেব আলী ও নিটেলসহ আরও কয়েকজন। ওদিকে গুলিবিদ্ধ পিচ্চি হান্নান তার দুই সহযোগীকে নিয়ে প্রথমে আশুলিয়া যান। সেখানে যুবদলের এক নেতার বাসায় গিয়ে রক্তমাখা কাপড় পরিবর্তন করেন। সেখান থেকে তারা সাভারের আরেক যুবদল নেতার বাসায় যান। ওই নেতাই সাভারের ইনসাফ ক্লিনিকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। ক্লিনিকে পিচ্চি হান্নানের শরীর থেকে কয়েকটি গুলি বের করা হয়। দুই দিন পর র্যাব জানতে পারে এ খবর। র্যাবের একটি দল সেখানে গিয়ে হাজির। দোতলার একটি কক্ষে ছিলেন পিচ্চি হান্নান।
র্যাবের এক সদস্য তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ২৪ জুনে তারা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল কিনা। পিচ্চি হান্নান তখন খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে, না স্যার আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি। র্যাব তখন বলে, তুই পিচ্চি হান্নান। ঘাবড়ে যায় হান্নান। তখন র্যাবের কর্মকর্তাদের পিচ্চি হান্নান বলে, ভাই আমি এই মুহূর্তে এক কোটি টাকা দেব, আমাকে ছেড়ে দিন। মোবাইল ফোনটা দেন ভাই, টাকা আনতে বলি। এতে র্যাব কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাকে সেখান থেকে আদালতে নেওয়া হয়। সেই দিনই র্যাব কার্যালয়ে আনার পর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে বের হয় র্যাব। আশুলিয়ায় ক্রসফায়ারে নিহত হয় হান্নান। হান্নানের সহযোগী নিটেল ও সাহেব আলীও ক্রসফায়ারে নিহত হয়। অনুসন্ধানে এই তিনজনের ক্রসফায়ার নিয়ে বেশ কয়েকটি তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, রাজধানীর দুর্ধর্ষ ডন কালা জাহাঙ্গীর আত্দহত্যা করেছে-এমন তথ্য প্রচার করেছে পিচ্চি হান্নান। কারণ কালা জাহাঙ্গীরকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। আর এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারই ঘনিষ্ঠ পিচ্চি হান্নান। কালা জাহাঙ্গীরকে হত্যার পর পিচ্চি হান্নান নিজেকে সমগ্র ঢাকার ডন বলে দাবি করেন। কিন্তু তা বেশি দিন আর থাকতে পারেননি। কালা জাহাঙ্গীরের হত্যাকাণ্ডের মাত্র ছয় মাসের মাথায় পিচ্চি হান্নান নিহত হয়।
সূত্র জানায়, নিটেলের বাসায় কালা জাহাঙ্গীরকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। গেন্ডারিয়ার অপর টেরর কচিও এই হত্যার পরিকল্পনায় ছিল বলে জানা গেছে। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে বিয়ে করেন সেই কচি। কচি এখন তার স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশ রয়েছেন। সূত্র জানায়, কালা জাহাঙ্গীরের বাড়ি বগুড়া জেলায় বলে তার প্রতি দুর্বল ছিলেন বিএনপির এক নেতা। পিচ্চি হান্নান, নিটেল ও সাহেব আলী ছিলেন তার হত্যাকাণ্ডের সময়। আবার এই তিনজনই পরবর্তীতে একসঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সঙ্গে তাই অনেকেই এই তিনজনের মৃত্যুর যোগ সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেন।
সুইডেন আসলাম
রাজধানী ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার নাজনীন স্কুল। মূল ফটক বন্ধ। ভিতরে এক যুবকের আর্তচিৎকার। বাঁচাও, কে আছো আমাকে বাঁচাও ... ওরা আমাকে মেরে ফেলল। ও মা ... মাগো ... আমাকে ওরা মেরে ফেলছে। স্কুলের ফটকের বাইরে তখন এক বৃদ্ধা চিৎকার করছেন। বলছেন, 'গেট খোল। বাবারা তোমরা গেটটা খুলে দেও। আমার ছেলেকে মের না। আমাকে মেরে ফেল, তবুও তোমরা ওর জীবনটা ভিক্ষা দেও।' মিনিট বিশেক পর স্কুলের ভিতর থেকে আর আর্তচিৎকারের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফটক ভিতর থেকে খুলে গেল। ৮-১০ জন যুবক একে একে বেরিয়ে আসছেন। তাদের শরীর, হাতে-মুখে টাটকা রক্ত লেগে আছে। সেই বৃদ্ধা মায়ের সামনে দিয়েই তারা বেরোচ্ছেন। বৃদ্ধা মা তাদের প্রশ্ন করছেন, আমার ছেলে কই? ও বাবারা, আমার ছেলেরে কী করছ? কোনো জবাব কেউ দিচ্ছিলেন না। গেট দিয়ে সর্বশেষ বেরিয়ে এলেন এক যুবক। মাথায় চুল কম। জিন্সের প্যান্ট ও কালো রঙের টি-শার্ট পরা। এক হাতে পিস্তল আর অন্য হাতে রক্তমাখা বেয়নেট। যুবকটি স্কুল থেকে বেরিয়েই পাগলপ্রায় ওই বৃদ্ধা মাকে বললেন, 'এত চিল্লাইতেছেন কেন। কাজের সময় এত চিল্লাইলে ভালো লাগে না। যান, আপনার পোলা ভিতরে আছে'। শেষ কথাটি শুনেই ভিতরে ছুটলেন মা। স্কুলের ভিতরে ক্লাসরুমের পাশের বারান্দায় রক্তে ভেসে যাওয়া ছেলের নিথর দেহ খুঁঁজে পেলেন তিনি।
১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা এটি। সাত-সকালে ঠিক এভাবেই পৈশাচিকতার এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন শেখ আসলাম। আন্ডারওয়ার্ল্ডে যিনি সুইডেন আসলাম নামে পরিচিত। বৃদ্ধা মাকে স্কুলের বাইরে রেখে ভিতরে তার ছেলে শাকিলকে এভাবেই সেদিন নির্মমভাবে খুন করেছিলেন। খুনের পর আসলাম ওই স্কুল থেকে বেরিয়েই উৎসুক জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, আপনারা কি কেউ কিছু দেখেছেন? ভিড় করা লোকজনের জবাব পাওয়ার আগেই আসলাম বলে দেন তাদের, 'নাহ, আপনারা কিন্তু এখানে কাউকেই দেখেননি। যদি দেখে থাকেন, শাকিলের মতোই ভাগ্য নিতে হবে'। এ কথা বলেই সেদিন মোটরসাইকেলে করে দলবল নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে রোমহর্ষক ঘটনার নানা তথ্য সম্পর্কে জানা গেছে।
রাজধানীতে সুইডেন আসলামের এমন নৃশংসতার উদাহরণ রয়েছে বহু। দিনদুপুরে প্রকাশ্যেই তিনি খুন করতে ভালোবাসতেন। রাজধানীতে চাঞ্চল্যকর 'ট্রিপল মার্ডার' থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। আর প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই ছিল তার নিজ প্রয়োজনে। যাকেই তিনি বিশ্বাসঘাতক বা দুশমন বলে সন্দেহ করতেন, তাকেই দুনিয়া থেকে হটিয়ে দিতেন। তার স্টাইল, 'সন্দেহ হচ্ছে একে। তাই কতল করতেই হবে।' আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন সুইডেন আসলাম খুনখারাবি করেই দেশ ছাড়তেন। চলে যেতেন সুইডেন। খুন করার প্রয়োজন হলেই আবার দেশে ফিরতেন। সুইডেন থেকে তিনি যখন দেশে ফিরতেন, আন্ডারওয়ার্ল্ড অস্থির হয়ে উঠত। এটা প্রত্যেকেই জানতেন, আসলাম যেহেতু ঢাকায় এসেছেন, কাউকে না কাউকে প্রাণ দিতেই হবে। তার গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়টি ছিল প্রমাণিত। তার পুরো নাম শেখ আসলাম। সুইডেন প্রবাসী ইতিকে বিয়ে করার পর তিনি সুইডেনের নাগরিকত্ব পান। সেই থেকে তার নাম হয় সুইডেন আসলাম। ঢাকার নবাবগঞ্জ দোহারে তার গ্রামের বাড়ি। বাবার নাম শেখ জিন্নাত আলী। ঢাকার ফার্মগেটে তাদের বাসা।
সাত ভাইবোনের মধ্যে আসলাম দ্বিতীয়। ভাইদের মধ্যে তিনি বড়। আসলাম এসএসসি পাস করেন তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল (বর্তমানে তেজগাঁও সরকারি স্কুল) থেকে। স্কুলজীবনে তিনি ভালো ফুটবল খেলতেন। আন্তঃজেলা স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় তিনি খেলেছেন। তেজগাঁও কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। ইতির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তার চাচাতো বোন সিমিকে বিয়ে করেন আসলাম। জেলে যাওয়ার পর এই সিমি এবং তার এক ছোট ভাই তাসফিক আহমেদ শিমুল তার সাম্রাজ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
যেভাবে উত্থান
ফার্মগেট এলাকা একসময় নিয়ন্ত্রণ করতেন আজাদ-বাপ্পি নামে দুই ভাই। ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফার্মগেট নিউ স্টার হোটেল থেকে বাপ্পিকে জোর করে তুলে নিয়ে যান আসলাম ও তার লোকজন। মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে বাপ্পির ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। একপর্যায়ে কোমল পানীয় ফান্টার একটি বোতল ভেঙে বাপ্পির শরীরে ঢুকিয়ে দেন আসলাম। রক্তাক্ত বাপ্পিকে চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে মিরপুরের দিকে ফেলে দিয়ে আসেন আসলামরা। এরপর এই আসলামের নাটকীয় উত্থান। যেন রূপকথার কোনো গল্প। যিনি ফান্টার ভাঙা বোতল দিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই আসলামই রাজত্ব করেছেন একে-৪৭সহ সব অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। লাশ ফেলতে শুরু করলেন। সুইডেন যেতেন। লাশ ফেলার প্রয়োজন হলে দেশে ফিরতেন। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন। মূলত ওই সময় থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের গতি প্রকৃতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। পেশাদার অপরাধীদের নিয়ে গ্যাং তৈরি করে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। রাজধানীতে এমন শক্তিশালী দুটি গ্রুপের মধ্যে আসলামের 'সেভেন স্টার' গ্রুপটি ছিল অন্যতম। যেখানে সুব্রত বাইন, টোকাই সাগর, পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, টিক্কা, পিয়ালসহ আরও ভয়ঙ্কর অপরাধীরা ছিল। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে সাভার পর্যন্ত তার গ্রুপের লোকজন প্রাধান্য বিস্তার করে রাখত। পুরস্কার ঘোষিত এ সন্ত্রাসীকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন এসি আকরাম গ্রেফতার করে রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছিলেন। এর আগে ফার্মগেট এলাকা থেকে গ্রেফতারের সময় পুলিশের সঙ্গে তুমুল বন্দুকযুদ্ধ হয়।
সুইডেন আসলামের এই নজিরবিহীন উত্থানে অস্থির হয়ে ওঠে গোটা আন্ডারওয়ার্ল্ড। যারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড শাসন করেছিলেন, তারাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন সুইডেন আসলামের এই অগ্রযাত্রায়। পুলিশের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। সোনা চোরাচালান থেকে শুরু করে রাজধানীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও কিলিং মিশনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন আসলাম। ঢাকার সাভার থেকে শ্যামপুর, টঙ্গী থেকে কেরানীগঞ্জ- এমন কোনো এলাকা ছিল না, যেখানে সুইডেন আসলামের ক্যাডার ছিল না। এমন একটি সময় ছিল যখন তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা তার নির্দেশ মতো জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৯৯০ সালের মধ্যেই ঢাকার অন্যতম ডন হয়ে ওঠেন সেভেন স্টার গ্রুপের নেতৃত্বদানকারী সেই সুইডেন আসলাম।
উল্লেখযোগ্য খুন : রাজাবাজারে শাকিল হত্যাকাণ্ড দিয়ে খুনি হিসেবে হাত পাকান সুইডেন আসলাম। গ্রেফতারের আগে সর্বশেষ খুন করেন ঢাকার যুবলীগ নেতা গালিবকে। এই গালিব খুনের পরই ১৯৯৭ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে আসলামের নাম ঘোষণা করে সরকার। তাকে গ্রেফতারে ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৭ সালে শাকিল খুনের পর পুরান ঢাকার আগামাসি লেনে তিনজন খুন হন। মামুন, গোপাল কর এবং নুরুল ইসলাম নামে আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই তিন যুবককে গুলি করে হত্যা করেন আসলাম ও তার সহযোগীরা। সুইডেন থাকতেই আসলামের সঙ্গে তার স্ত্রী ইতির দ্বন্দ্ব হয়। সুইডেন থেকে ইতি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে বিয়ে করেন আসলাম গ্রুপের মামুনকে। আসলাম সুইডেন থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন মামুনকে হত্যার জন্য। আগামাসি লেনে আগা শামীমের আস্তানায় মামুনকে সমঝোতার কথা বলে নেওয়া হয়। মামুন সেখানে যান ভারতীয় সন্ত্রাসী গোপাল কর ও গোপীবাগের নুরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সেখানে এই তিনজনকেই গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর আসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বিপুলকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। মামুনের সঙ্গে বিপুলের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এ কারণেই বিপুলকে তেজতুরী বাজারের একটি মাঠে নিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। আসলাম একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিপুলের দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করেন। এরপর কলাবাগানে খুন করেন কিসলুকে। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ তেজকুনিপাড়ায় খুন হন যুবলীগ নেতা মাহমুুদুল হক খান গালিব। এ ছাড়াও তার হাতে আরও বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় সর্বমোট ১৯টি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি হত্যা, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির মামলা। আসলামের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, অত্যন্ত চতুর প্রকৃতির লোক আসলাম। ফার্মগেট এলাকা একসময় নিয়ন্ত্রণ করতেন চাইনিজ, শাকিলসহ আরও বেশ কয়েকজন। তাদের কারণে আসলাম কখনো মাথা উঁচু করে চলতে পারতেন না। চাইনিজের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তেই ইতিকে বিয়ে করেন। ইতি হলেন চাইনিজের বোন। চাইনিজ সুইডেনে চলে গেলে শাকিল ঢাকায় একা হয়ে যান। সেই পুরনো ক্ষোভ মেটাতেই শাকিলকে নৃশংসভাবে খুন করেন আসলাম।
জেলে-বাইরে একই রকম : দেশের যে জেলেই থাকুন না কেন আসলাম সেখান থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ করতেন। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় দুটি মোবাইল ফোনে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম। ইতিপূর্বে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে তার কাছ থেকে। জানা গেছে, ওই কারাগারের কর্তাব্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করেই দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আসছেন এই ডন। শুধু আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীই নয়, মোবাইল ফোনে কারাগার থেকে এই সন্ত্রাসী প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এমনকি প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্তাব্যক্তির সঙ্গেও নিয়মিত কথা বলতেন।
এরশাদ শিকদার
‘আমি তো মরেই যাব, চলে যাবো, রেখে যাব সবি/ আছসনি কেউ সঙ্গের সাথী, সঙ্গেনী কেউ যাবি / আমি মরে যাব...’- শতাব্দীর ভয়ঙ্কর খুনি খুলনার কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের সেই বিখ্যাত গানের প্রথম দুই লাইন এটি। মানুষ খুন করেই যিনি দুধ দিয়ে গোসল করে পবিত্র হতেন। পবিত্র হওয়ার পর ‘জলসা’র আয়োজন করতেন। আর সেই জলসার মূল আকর্ষণ থাকত এরশাদ শিকদারের নিজ কণ্ঠে গাওয়া এই গানটি। পরবর্তীতে কাকতালীয়ভাবে সেই গানটির প্রতিটি লাইনের সঙ্গেই তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রেফতারের পরপরই তার সহায়সম্পদ পরিবারের সদস্যরা যে যার মতো দখল করে নেয়। ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ পর্বে এরশাদ শিকদার তার স্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘শত শত কোটি টাকার সম্পদ রেখে গেলাম। আমার নামে একটা গরু কোরবানি দিতে পারলা না? তাইলে তো আমি বাঁইচা যাইতাম। আমার এই দুঃসময়ে তোমরা কেউ পাশে রইলা না।’
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবে রূপ নেওয়া এরশাদ শিকদারের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো কেটেছে দৈন্যদশায়। তার রেখে যাওয়া টাকা ও সম্পদ কেউ তার পেছনে খরচ করতে চাননি। কারাগারের অভ্যন্তরে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের এ নিয়ে বকাঝকাও করতেন তিনি। এমনি পরিস্থিতিতে কনডেম সেলের ভিতরেও তার বিখ্যাত গানটি তিনি গাইতেন গুনগুন করে। এরশাদ শিকদারের নৃশংসতা এমনই ভয়াবহ ছিল যে, আস্তে-ধীরে রয়ে-সয়ে কষ্ট দিয়ে খুন করতেন তিনি। তার বরফকলে যার ডাক পড়ত, তিনি আর কখনোই সেখান থেকে জীবিত বের হতে পারতেন না। এদের অধিকাংশের লাশও আর খুঁজে পাওয়া যেত না।
এরশাদের নৃশংসতা
দিনভর সেখানে মানুষের কোলাহল। সন্ধ্যা নামতেই নিস্তব্ধতা। স্বল্প আলোয় গায়ে কাঁটা দেওয়া অদ্ভুত এক ভৌতিক পরিবেশ। শুধু একটি কক্ষ থেকে মানুষের আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। কিন্তু খুলনার ঘাট এলাকার এই বিশাল বরফকলের চার দেয়ালের ভিতরই চাপা পড়ে গগনবিদারী সেই আর্তনাদ। হাত-পা বাঁধা হতভাগ্য এক যুবকের পা চেপে ধরে রেখেছেন এরশাদ শিকদার। আরেকজন বড় হাতুড়ি দিয়ে পায়ের ওপর পিটিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম। পা থেঁতলে গেছে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে দুই পায়ের হাড়। হাতুড়ি রেখে মানুষরূপী দানব এরশাদ শিকদার ধীরেসুস্থে একটি রশি নিলেন। রক্তাক্ত যুবকের গলায় পেঁচিয়ে ধরে টান দিলেন। যুবকটির নড়াচড়া তখন বন্ধ। নাক-মুখ এমনকি চোখ দিয়েও রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। জিভ একটু বেরিয়ে পড়েছে। মানুষরূপী দানবটি মৃত যুবকের নাকের কাছে হাত রেখে নিশ্চিত হলেন, প্রাণ নেই। এরপরও তিনি ঠাণ্ডা হলেন না। হঠাৎ মেঝের ওপর পড়ে থাকা যুবকটির বুকের ওপর দাঁড়ালেন। লাফাতে শুরু করলেন। পাঁজর ভাঙার শব্দ হলো। শান্ত হলেন তিনি। এরপর বড় এক বালতি দুধ দিয়ে গোসল করলেন এরশাদ। যুবকের লাশ জমাটবাঁধা সিমেন্টের ব্যাগের সঙ্গে বেঁধে ফেলে দেওয়া হলো ভেরব নদে। শতাব্দীর ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলার খুলনার কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের খুনের নিজস্ব কৌশল এটি। ঠিক এভাবেই তিনি একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটি কাঁপিয়েছেন। তার হাতের মুঠোয় ছিল জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যার পর খাঁটি দুধ দিয়ে গোসল করে ‘পবিত্র’ হতেন। যাকে পথের কাঁটা মনে করেছেন, তাকেই তিনি হত্যা করেছেন। তার সহযোগী ও পরবর্তীতে মামলার রাজসাক্ষী নূরে আলমের মতে, এরশাদ শিকদার কমপক্ষে ৬০টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। তবে তিনি ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন। ১১ বছর আগে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা মামলার রায় কার্যকর করা হলেও মানুষের কাছে তিনি এখনো নৃশংসতার প্রতীক। কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদার তার রাজত্বকালে রূপসার যুবলীগ কর্মী খালিদ; দৌলতপুরের অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবীর ফটিক; সোনাডাঙ্গার ইনসাফ, কামাল, খালেক; সেনহাটির টাক আজিজসহ আরও অনেককে হত্যা করে জমাট সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে ভৈরব নদে ফেলে দেন। এর মধ্যে শুধু খালিদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদের লাশ পাওয়া যায়নি। তবে তাদের পরিধেয় কাপড় আর কিছু হাড় পরবর্তীতে পুলিশ উদ্ধার করে। খুলনার এই ডন নিয়ন্ত্রণ করতেন আন্ডারওয়ার্ল্ড। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার হন এরশাদ শিকদার। গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে তার নৃশংসতার অজানা সব কাহিনী। তার নৃশংসতার ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হতবাক। খুলনার কারাগারে নেওয়ার পর সেখানেও পেশাদার অপরাধীরা তার বিচার চেয়ে মিছিল করেন। শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য মায়েরা এখনো এরশাদ শিকদারের নাম বলে ভয় দেখান। এখনো কোথাও কোনো নৃশংস ঘটনা ঘটলেই চলে আসে এরশাদ শিকদারের নাম। বিদেশি গণমাধ্যমেও সিরিয়াল কিলার হিসেবে এরশাদ শিকদারের নাম উঠে আসে। তখন খবর বেরিয়েছিল, তার মুক্তির ব্যাপারে শত কোটি টাকার বাজেট ধরা হয়। তার ছোট স্ত্রী শোভা এ সময় কয়েক বস্তা টাকা নিয়ে ঢাকায়ও এসেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এরশাদ শিকদারের বিষয়ে সিদ্ধান্তে অটল থাকায় সে সময় আর রক্ষা পাননি তিনি।
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি তার জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে আসেন। খুলনায় আসার পর এরশাদ সেখানে কিছু দিন রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করত এমন দলের সঙ্গে যোগ দেন। পরে তিনি তাদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন ও এলাকায় ‘রাঙ্গা চোরা’ নামে পরিচিতি পান।
১৯৭৬-৭৭ সালে তিনি ‘রামদাবাহিনী’ নামে একটি দল গঠন করেন, যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত। এ রামদাবাহিনী নিয়েই এরশাদ ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং এর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৮২ সালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিনি তৎকালীন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমান ২১ নম্বর ওয়ার্ড) কমিশনার নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর এরশাদ শিকদার বিএনপিতে যোগ দেন।
১৯৯৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর এরশাদ আবারও দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু সমালোচনার মুখে কিছু দিন পরই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।
১৯৯৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার সময়ও তিনি ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন।
১৯৯১ সালে তিনি ৪ নম্বর ঘাট এলাকা থেকে রফিক নামে একজন বরফকলের মালিককে ভয় দেখিয়ে বিতাড়িত করে বরফকল দখল করেন। সব ব্যবসায়ীকে তার কল থেকে বরফ কিনতে বাধ্য করেন।
নূরে আলম আরও সাক্ষ্য দেন, এরশাদের কাছে ৭০টিরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। যদিও তার ‘স্বর্ণকমল’ নামে খ্যাত বাড়ি থেকে মাত্র একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
যেভাবে খুন : ১৯৯৯ সালের ১১ আগস্ট হত্যা করা হয় যুবলীগের খালিদকে। সে সময় খালিদের সঙ্গে ছিলেন খুলনার ব্যবসায়ী আপন দুই ভাই মুনির ও চয়ন। এ দুজনের ওপরও এরশাদ শিকদার নির্মম নির্যাতন চালান। নির্যাতনের শিকার চয়ন আদালতে জানান, ‘সন্ধ্যার পর জরুরি কথা আছে বলে এরশাদ শিকদার আমাদের ৫ নম্বর ঘাটে ডেকে নিয়ে আসেন। আমরা একটি প্রাইভেট কারে আসি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই মুনির, যুবলীগ কর্মী খালিদ, মোস্তফা ও ড্রাইভার আবুল। আমাদের সঙ্গে মোটরসাইকেলে এসেছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা অসিত বরণ। ঘাটে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এরশাদ শিকদার তার লোকদের নিয়ে ওজন মাপার হন্দর, শাবল, হাতুড়ি দিয়ে হামলা চালান। আমার বড় ভাই মুনিরের দুই পা চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন। খালিদকে ধরে বরফকলে নিয়ে যান। সেখানে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর এরশাদ নিজেই খালিদের পাঁজর ভেঙে লাশের সঙ্গে জমাট সিমেন্টের বস্তা বেঁধে ভৈরব নদে ফেলে দেন। লাশের সঙ্গে আরও ফেলে দেওয়া হয় আমাদের প্রাইভেট কার ও দুটি মোটরসাইকেল।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, এরশাদ শিকদার ১৯৯৯ সালের প্রথম দিকে খুলনা নিউমার্কেট এলাকায় নৈশপ্রহরী ইনসাফ, কামাল ও খালেককে ৫ নম্বর ঘাটে ধরে নিয়ে একইভাবে হত্যা করে ভৈরবে ফেলে দেন। এরশাদের একসময়ের সহযোগী টাক আজিজকেও হত্যা করে ভৈরবে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দৌলতপুরের পাবলার অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবীর ফটিককেও এরশাদ নিজ হাতে হত্যা করেন। পরে তার লাশ নদে ফেলে দেন। ফটিকের লাশের কোনো সন্ধান মেলেনি।
এরশাদের দেহরক্ষী নূরে আলমের স্বীকারোক্তিতে ফটিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা যায়। এ ছাড়া ঘটনার পরপর ফটিকের বাবা হাশেম আলীও তার মেধাবী সন্তান হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। নূরে আলমের ভাষ্য হচ্ছে, ‘এরশাদের বড় বউ খোদেজার সঙ্গে ফটিকের প্রেম রয়েছে- এ অভিযোগেই তাকে হত্যা করা হয়।
১৯৯৮ সালের ৬ এপ্রিল এরশাদ খোদেজার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে দিয়েই ফটিককে স্বর্ণকমলে ডেকে নিয়ে আসেন। সন্ধ্যায় ৫ নম্বর ঘাটের বরফকলে নিয়ে গলায় রশি পেঁচিয়ে ফটিককে হত্যা করা হয়। এরপর এরশাদ ফটিকের বুকে উঠে লাফিয়ে লাফিয়ে তার পাঁজর ভেঙে দেন। পরে জমাট সিমেন্টের সঙ্গে ফটিকের লাশ বেঁধে ভৈরব নদে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।’
বিভিন্ন মাধ্যমে এরশাদের ছয়টি বিয়ের কথা জানা যায়। তার প্রথম স্ত্রীর নাম খোদেজা বেগম। সানজিদা আক্তার শোভা তার সবচেয়ে ছোট স্ত্রী। যাকে তিনি তার বিলাসবহুল বাড়ি স্বর্ণকমলে এনেছিলেন। এ ছাড়াও রূপসার রাজাপুর গ্রামের তসলিমা, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ফরিদা, সহযোগী বারেক কমান্ডারের স্ত্রী রামেছা এবং যাত্রাদলের নায়িকা পাইকগাছার দুর্গারানীর কথা জানা গেছে। খোদেজার গর্ভে এরশাদের চারটি সন্তান রয়েছে। শোভার গর্ভে এষা নামে একটি মেয়ে আছে। রাজধানী ঢাকায় তার তিনতলা বাড়ি রয়েছে। যেখানে প্রতি মাসে তিনি জলসার আয়োজন করতেন। সেখানে যোগ দিতেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালী মানুষ।
১৯৯৯ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার হন এরশাদ শিকদার। তখন তার নামে ৪৩টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এর অধিকাংশই হত্যা মামলা। আদালতের বিচারে সাতটি হত্যা মামলায় তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয় ও চারটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তার আবেদন নাকচ করে দেন এবং ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পরে টুটপাড়া কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
দুর্ধর্ষ বিকাশ
১৪ ডিসেম্বর, ২০১২। গাজীপুর কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভোর থেকে চারটি দামি গাড়ি পার্ক করা। ছয়-সাত জন অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। একটি গাড়িতে দুই নারী বসা। সকাল ৮টায় কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। জিন্সের প্যান্ট আর জ্যাকেট পরা। চোখে সানগ্লাস। দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে লোকটি বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সামনের লোকগুলোর তৎপরতা বেড়ে গেল। তারা দৌড়ে লোকটির সামনে গিয়ে সালাম দিলেন। ওই স্থান দিয়ে হেঁটে যাওয়া কারারক্ষীরাও সালাম দিচ্ছিলেন তখন। তবে এসব কিছুতে কোনো ভ্রৃক্ষেপ নেই লোকটির। তিনি শুধু মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নিলেন। হঠাৎ লোকটি হাঁটার গতি বাড়িয়ে একটি গাড়িতে চড়ে বসলেন। চারটি গাড়ি একসঙ্গে বেরিয়ে গেল কারাগার কম্পাউন্ড
থেকে। কারাগারের সীমানার বাইরে অপেক্ষায় ছিল আরও দুটি গাড়ি ও দুটি মোটরসাইকেল। লোকটিকে বহন করা গাড়ির গতি কমে গেল। জানালা দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে কথা বললেন লোকটি। এরপরই ছয়টি গাড়ি ও দুটি মোটরসাইকেল দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করল। লোকটি দেশের শীর্ষস্থানীয় কোনো রাজনৈতিক বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নন। তিনি ছিলেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন। নাম তার বিকাশ। পুরো নাম বিকাশ কুমার বিশ্বাস, যাকে লোকজন চেনে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন হিসেবে। ওই দিন জামিনে মুক্তি পেয়ে এভাবেই কাশিমপুর কারাগার থেকে বিকাশ বেরিয়ে যান। বিকাশের মুক্তির খবর মুহূর্তেই চাউর হয়ে যাওয়ার পর সারা দেশেই তোলপাড় শুরু হয়। তাকে ফের গ্রেফতারে পুলিশ প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু এ তৎপরতার রেশমাত্র পড়েনি বিকাশের এই ছুটে চলায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কয়েকবার তাদের গাড়ি থামালেও তাতে কোনো সমস্যা হয়নি। নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেছেন তারা গন্তব্যস্থলে। গাড়ির বহর নিয়ে স্ত্রীসহ বিকাশ ও তার দেহরক্ষীরা দুপুরের পরপরই নিরাপদে যশোরে পৌঁছেন। সেখানে রাতযাপন। পরদিন সকালেই বেনাপোল সীমান্ত হয়ে ভারতের হরিদাসপুর। সেখান থেকে কলকাতা। এভাবেই রাজকীয় প্রস্থান ঘটে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই ডনের। যিনি সিরিজ হত্যা, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য মামলার আসামি। কাশিমপুর থেকে বেনাপোল- এ পর্যন্ত সড়ক নিরাপদ রাখতে বিকাশকে খরচ করতে হয়েছে ৫ কোটি টাকা। সেই বিকাশ কলকাতাও ছেড়েছেন। তিনি এখন আছেন ফ্রান্সে। ফ্রান্সে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন তারই ছোট ভাই প্রকাশ। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তিনিও একজন অন্যতম সদস্য।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মামলার নথিপত্র এবং বিকাশ-প্রকাশের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে পরিচিত এই বিকাশের ছোট ভাইয়ের নাম প্রকাশকুমার বিশ্বাস। তাদের বাবার নাম বিমলকুমার বিশ্বাস। বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার শিবনগরে। ঢাকার মিরপুর পাইকপাড়া তাদের বাসা।
১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার যে শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা করেছিল, তাতে বিকাশ-প্রকাশের নাম ছিল। ওই তালিকার পরই প্রকাশ ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি আইন বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করেন। বর্তমানে তিনি রয়েছেন ফ্রান্সে। প্রায়ই তাকে সেখানকার বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায়। সেখানে বেড়াতে যাওয়া পূর্বপরিচিত অনেক বাংলাদেশির আতিথেয়তা মেলে প্রকাশের বাসায়। তবে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হলেও প্রকাশের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।
সূত্র জানায়, বিকাশ আর প্রকাশ বর্তমানে ফ্রান্সে থাকলেও তাদের নামে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় হচ্ছে ঢাকায়। ঢাকা থেকে পাঠানো মোটা অঙ্কের টাকায় তারা ফ্রান্সে আলিশান জীবনযাপন করছেন। আগারগাঁও পিডব্লিউডির টেন্ডার এখনো নিয়ন্ত্রণ করছেন বিকাশ। জেলে থাকতেও তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফ্রান্স থেকে টেলিফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার সহযোগীদের সঙ্গে। আদেশ-নির্দেশ দিচ্ছেন। সেভাবেই তার শিষ্যরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের দিকে পাইকপাড়াকেন্দ্রিক মস্তানি করতেন বিকাশ। সেই সময়ে এশিয়া সিনেমা হলের টিকিট কালোবাজারির প্রধান রমজানকে হত্যা করেন। রমজানকে খুনের মধ্য দিয়েই মূলত তার আন্ডারওয়ার্ল্ডে হাতেখড়ি। রমজান খুন এবং বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার ছোট ভাই প্রকাশ মিরপুর বাঙ্লা কলেজের তখন ছাত্র। বড় ভাইয়ের এই নামডাকের কারণে প্রকাশ বিভিন্ন স্থানে সমীহ পেতে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনিও গ্রুপ তৈরি করেন। বড় ভাইকে সহযোগিতা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিকাশ-প্রকাশ বাহিনী হিসেবে শক্তিশালী বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে।
সূত্র জানায়, আগারগাঁও পিডব্লিউডির টেন্ডারে হাত বাড়ান বিকাশ-প্রকাশ। বাধা হয়ে দাঁড়ান আরেক সন্ত্রাসী শামীম। পিডব্লিউডির ভিতরই শামীমকে গুলি করে হত্যা করে বিকাশ-প্রকাশ বাহিনী। সঙ্গে শামীমের সহযোগী মামুনও খুন হন। জোড়া খুনের পর বিকাশ-প্রকাশের নাম আরও ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ নেতা জরিপকে হত্যার পর বিকাশ আর প্রকাশ এ গ্রেডের অপরাধী হিসেবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নাম লেখান। মিরপুর, সাভার, ইব্রাহীমপুরসহ আশপাশ এলাকায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েন তারা। হয়ে ওঠেন শক্তিশালী ফাইভ স্টার গ্রুপের সদস্য। এসব ঘটনার পর বিকাশ-প্রকাশ তখন অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট। তাদের অস্ত্রের ভাণ্ডারে অত্যাধুনিক সব ক্ষুদ্রাস্ত্র মজুদ ছিল। গোটা রাজধানীতেই এ বাহিনী ছিল সক্রিয়।
আরও খুন : কারাগারে বন্দী বা মুক্তি- কোনো কিছুই আসে যায় না শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের জন্য। বাইরে থাকতে যেমন খুন করেছেন, তেমনি জেলে গিয়েও খুনের নির্দেশ দিয়েছেন। এমন বহু খুনের সঙ্গেই তার সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত আলী মিস্টার, ব্যবসায়ী নেতা ও প্রিন্স গ্রুপের মালিক কাজী শহীদুল্লাহ, ব্যবসায়ী আহম্মেদ আলী, ব্যবসায়ী আফতাব হোসেন, আবদুল বারেক, ছিন্নমূল মার্কেটের সভাপতি রিপন খান, মাহবুব, সেলিম, গুদারাঘাটের টিপু, ছাইদুল ইসলাম রিপন, পল্লবীতে মৎস্য খামার ব্যবসায়ী হামিদুর রহমান খোকন, বাদশা মিয়া, কল্যাণপুরে মুদি দোকানি রুহুল আমিন, মিরপুরে খাজা মার্কেটের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বিপ্লব, মনিপুরের মুদি দোকানি সেলিম, পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পের লবণ ব্যবসায়ী ফকরুদ্দীন আহম্মেদ ও তার ছেলে বাবুল, কল্যাণপুরে ঠিকাদার আবদুল জাব্বার, শিল্পপতি আজহারুল ইসলাম, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ, ভিডিও সেন্টারের মালিক মাহবুব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিকাশের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে দেখা গেছে।
পুরস্কার ঘোষণার পর বিকাশকে ১৯৯৭ সালে প্রথম গ্রেফতার করা হয়। নারায়ণগঞ্জ থেকে তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম বন্দুকযুদ্ধের পর পাকড়াও করতে সমর্থ হন আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই ডনকে। ওই সময় বিকাশের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগসহ ১২টি মামলা ছিল। ২০০৯ সালের ১৭ জুলাই কাশিমপুর কারাগার থেকে একবার মুক্তি পেয়েছিলেন বিকাশ। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওই দিনই গাজীপুর থেকে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় (অপরাধে জড়িত সন্দেহে) গ্রেফতার করে আবার কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তেজগাঁও থানার একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
আলোচিত জামিন : বিকাশের এই জামিন নিয়ে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে এর নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধানে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে বিকাশ ছিলেন জেলে। তখন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ কারাগারে অন্তরীণ। আওয়ামী লীগের ওই রাজনীতিবিদদের মধ্যেই প্রভাবশালী একজন নেতা ছিলেন, যিনি বিকাশের পাশের কক্ষেই ছিলেন। ওই রাজনীতিককে কারাগারের অভ্যন্তরে নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছিল। খাবার-দাবারও ভালো দেওয়া হতো না। তেলাপোকাসহ নানা রকম পোকামাকড় থাকত খাবারের ভিতর। ওই নেতা ওই খাবার খেতে পারতেন না। এ খবর জানতে পারেন বিকাশ। তিনি একসময় সুযোগ-সুবিধা মতো ওই নেতার সঙ্গে পরিচিত হন। কথাবার্তা বলেন। নেতাকে তিনি ভালো খাবার-দাবারসহ নানা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে ওই নেতা তাকে বলেছিলেন, কখনো সুযোগ এলে তিনি এ ঋণ শোধ করবেন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ওই নেতা পান একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সে ঋণ শোধ করতেই বিকাশকে জামিনে মুক্তির পর দেশত্যাগে সহায়তা করেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সূত্র মতে, দেশত্যাগের সময় পথেঘাটে যেন সমস্যা না হয়, সে ব্যবস্থাও আগে থেকে করে রাখা হয়েছিল।
প্রকাশ ফ্রান্সে সোচ্চার : বিকাশের ছোট ভাই ও পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ বর্তমানে ফ্রান্সে প্রকাশ্য নানা কর্মসূচিতে যোগ দেন। প্রায়ই তাকে সেখানকার বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সোচ্চার দেখা যায়। সেখানে বেড়াতে যাওয়া পূর্বপরিচিত অনেক বাংলাদেশির আতিথেয়তা মেলে প্রকাশের বাসায়। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রকাশ মিছিল-মিটিং করে যাচ্ছেন। সেখানে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে এসব তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য এসেছে।
গ্যাং কিলিং মাস্টার সুব্রত বাইন
তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাং কিলিং মাস্টার। রাজধানী ছাপিয়ে তিনি বিভিন্ন জেলায় মানুষ খুন করেছেন। তার নামে উঠছে কোটি কোটি টাকার চাঁদা। ট্রিপল, ডাবলসহ নানা কৌশলে তিনি খুনের ঘটনা ঘটান। দিন-রাত তার কাছে কোনো পার্থক্য নেই। যখন-তখন লাশ ফেলতে পারেন। বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকার অন্যতম সদস্য তিনি। পুলিশের ঘুম হারাম করে দেওয়া এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর ভয়ঙ্কর সব অপরাধে আন্ডারওয়ার্ল্ড পর্যন্ত থাকে অস্থির। তার অপরাধের পরিধি শুধু দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সীমানা পেরিয়ে ভিন দেশেও তিনি ভীষণ তৎপর। নেপালের জেল ভেঙে পালিয়েছেন তিনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশেরও তিনি তালিকাভুক্ত শীর্ষ অপরাধী। তাকে গ্রেফতারে বাংলাদেশ সরকার যেমন ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশি শীর্ষ এই অপরাধীকে পাকড়াওয়ে ভারত সরকারও ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছিল। তিনি সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া এবং দুবাইতে ব্যবসা করছেন ভিন্ন নামে। তার সঙ্গে ভারতের ডন দাউদ ইব্রাহিমের যোগাযোগ রয়েছে বলেও খবর রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
বাংলাদেশের শীর্ষ এই অপরাধীর নাম সুব্রত বাইন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে গ্যাং কিলিং জনপ্রিয় করে তোলেন অপরাধ জগতের এই মুকুটহীন সম্রাট। রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের শক্তিশালী দুটি গ্রুপের মধ্যে অন্যতম সেভেন স্টারের তিনি জনক। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। বর্তমানে তিনি কলকাতায় কারাগারে আটক রয়েছেন। সুব্রত বাইনের বাবার নাম বিপুল বায়েন। মা কুমুলিনি বায়েন। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। পারিবারিক জীবনে তিনি তিনটি বিয়ে করেছেন। বাংলাদেশে দুটি, পশ্চিমবঙ্গে একটি। তার প্রথম স্ত্রীর নাম লুসি। সেই ঘরে তার দুই সন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রী সুইটির সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া এলাকার মেয়ে জামেলা খাতুন তার তৃতীয় স্ত্রী। তার সঙ্গেই তিনি রয়েছেন। ১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম সুব্রতকে তার ১২ সহযোগীসহ গ্রেফতার করে। সুব্রত বাইন জেলে থাকার সময় তার স্ত্রী লুসির সঙ্গে তার গ্রুপের এক যুবকের প্রেম হয়। পরবর্তীতে সুব্রত বাইন জেল থেকে বেরিয়ে এসে তার স্ত্রী লুসিকে নিজেই বিয়ে দেন ওই যুবকের সঙ্গে। সুব্রত বাইনের বাবা মা টঙ্গীর নিজস্ব বাড়িতে থাকেন।
১৯৮৭ সাল থেকে মগবাজার কেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডে বিচরণ করতে শুরু করেন সুব্রত বাইন। রফিক মার্ডার দিয়ে খুনাখুনিতে জড়ান সুব্রত। এরপর একে একে ট্রিপল, ডাবল মার্ডার।গ্যাং কিলিং : ২০০০ সালের ২৯ আগস্ট। রাজধানীর খিলগাঁও ৪৪৬/সি নম্বর বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় তিন যুবকের লাশ। তিনজনকেই হত্যার পর এসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দেওয়ার চেষ্টা করে খুনিচক্র। এরপরও তিনজনকেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এদের একজন হলেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ শীর্ষসন্ত্রাসী গোপীবাগের আসিফ, তার দেহরক্ষী গিয়াসউদ্দিন টিপু এবং সহযোগী রিপন। এ ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে ঢাকার আগামাসী লেনের একটি পরিত্যক্ত কারখানার ভিতর খুন হন মামুন, গোপাল কর এবং নুরুল ইসলাম নামে তিন যুবক। এই তিনজনই আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধী। আরজত পাড়ার গোসাইঘাটে খুন হন তিন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। ঢাকার এসব গ্যাং কিলিংয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ ডন সুব্রত বাইন জড়িত। এ ছাড়া রাজধানীতে আরও বেশ কয়েকটি গ্যাং কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে, যার প্রায় প্রতিটিতেই সুব্রতের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। আন্ডারওয়ার্ল্ডে সুব্রত বাইনের আবির্ভাবের পর গ্যাং কিলিংয়ের ঘটনা বেড়ে যায়। মূলত সুব্রত বাইনই আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাং কিলিং জনপ্রিয় করে তোলেন। অভিযোগ ওঠে, এসব হত্যাকাণ্ডে তাকে সহায়তা করেন একই দলের সুইডেন আসলাম। এই গ্যাং কিলিংকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপই দলভারি করতে থাকে। বাড়াতে থাকে অস্ত্রশস্ত্র। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে আসতে থাকে অত্যাধুনিক অস্ত্র।
১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইনের। পুলিশ সূত্র জানায়, আন্ডারওয়ার্ল্ডে হান্নানের অনুপস্থিতিতে তার দলের সদস্যরা সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার নামে দুই ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। সেভেন স্টারের নেতৃত্ব দেন সুব্রত বাইন। আর ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলেন যুবলীগ নেতা লিয়াকত। লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেয় পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, আরমান, জিসান, রনি, বিকাশ, প্রকাশ, নিটেল, আলাউদ্দিন, কিলার আব্বাস, আগা শামীম, কাজল এবং অশ্রু। অন্যদিকে সুব্রত বাইনের সেভেন স্টার বাহিনীতে যোগ দেয় মুরগি মিলন, তানভীরুল ইসলাম জয়, টোকাই সাগর, ইমাম হোসেন ইমাম, মোল্লা মাসুদ, সাইদুর রহমান নিউটন, তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ, তানজিল, কচি, টিক্কা, আসিফ, কালা লিয়াকত, জরিফ, নাটকা বাবু, মুরাদ, মানিক, চঞ্চল, জুলু এবং জন। এরা সবাই তখন ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের একেকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী। লিয়াকতের সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুইডেন আসলাম হাত মেলায় সুব্রত বাইনের সঙ্গে। আর এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শক্তি বাড়ে সুব্রত বাইনের।
২০০০ সালের ১৮ মে পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনকে। পুলিশ জানায়, সেভেন স্টার গ্রুপের পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর এবং ডাকাত শহিদ এই হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেয়। পুলিশের একাধিক সূত্রের মতে, শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে যে স্বর্ণ চোরকারবারি হতো, তার নেতৃত্ব দিতেন মুরগি মিলন। ফাইভ স্টার গ্রুপের সঙ্গে একসময় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, এমন একজন জানান, লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে থাকলেও একসময় দলের সঙ্গে বেইমানি করে টিক্কা। গোপনে সাহায্য করতে থাকে সেভেন স্টার প্রধান সুব্রত বাইনকে।
২০০১ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে বন্দুযুদ্ধের পর ধরা পড়েন টিক্কা। গুলিবিদ্ধ টিক্কা পরে হাসপাতালে মারা যায়।ভারতে সুব্রত : মুরগি মিলন খুনের পর সুব্রত বাইন দেশ ছেড়ে পালান। তিনি কলকাতায় আত্মগোপন করেন। মোহাম্মদ আলী নামে তিনি কলকাতার অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলেন বড় একটি চক্র। কলকাতার বালিগঞ্জে রয়েছে তার প্রাসাদোপম বাড়ি। সেখান থেকেই ১৩ লাখ রুপির জাল নোটসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতা পুলিশের হাতে প্রথম গ্রেফতার হন সুব্রত। তিনি সেখানে মোহাম্মদ আলী নাম পরিচয়ে চলতে থাকেন। কলকাতা থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। কলকাতার মোহাম্মদ বাপি নামে এক ব্যক্তি তাকে সহায়তা করতে থাকেন। একটি ফুটবল টিমের কর্মকর্তা হয়ে তিনি সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন। এরপর তিনি চান আর দুবাই গিয়ে ব্যবসা করেন। পরিচয় হয় দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে। দুবাই থেকে তারা যান নেপাল। কিন্তু তখনই ভারত সরকার তার নামে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করে। নেপালে আত্মগোপন করেন।
২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সুব্রত বাইন সেখানে গ্রেফতার হন। ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সুব্রত বাইন ১২ সহযোগীসহ নেপালের কারাগার থেকে সুড়ঙ্গ কেটে পালান। এরপর ২৭ নভেম্বর কলকাতা পুলিশের হাতে ফের গ্রেফতার হন। এরপর থেকে তাকে দেশে ফেরাতে ভারতের সঙ্গে একাধিকবার বাংলাদেশ চিঠি চালাচালি করে। কিন্তু তাকে দেশে ফেরত আনা যায়নি। সর্বশেষ তথ্য মতে, গত মাসে আলীপুর কারাগারে আটক সুব্রত বাইনের কাছ থেকে সাতটি সিম কার্ড ও একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। যা লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে জমা রয়েছে। ওই সীমগুলো দিয়েই তিনি ঢাকায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। চাঁদাবাজি করছেন। চাঁদার টাকা রাজধানীর একটি মার্কেটের একজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে নিয়মিত যাচ্ছে সুব্রত বাইনের কাছে।
কিলিং মেশিন মোল্লা মাসুদ
১৯৯৭ সাল। ঈদের কয়েক দিন বাকি। রমজান মাসের শেষ সময়টাতে রাজধানী খুব ব্যস্ত। মার্কেট, বিপণিবিতান, ফুটপাথ, রাস্তায় ভীষণ ভিড়। মানুষের দম ফেলার সময় নেই। বিকালের দিকে মিরপুর চিড়িয়াখানা সড়ক দিয়ে মামুন তার স্ত্রীকে নিয়ে মার্কেটিং করে রিকশা করে যাচ্ছিলেন। তাদের হাতে বেশ কয়েকটি ব্যাগ। হঠাৎ তাদের রিকশার দুই পাশ দিয়ে দুটি মোটরসাইকেল অতিক্রম করে কয়েক গজ সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মামুন বিপদ আঁচ করেই তার নিজ কোমর থেকে দ্রুত পিস্তলটি হাতে তুলে নিলেন। ততক্ষণে মোটরসাইকেল থেকে দুই যুবক নেমে দাঁড়িয়েছেন। একজনের দুই হাতে দুটি পিস্তল। আরেকজনের এক হাতে একটি। কালবিলম্ব না করে মামুন গুলি ছুড়তে শুরু করলেন। মুহূর্তেই দুই হাতে দুই পিস্তল ধরা যুবকটি শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার দুই হাতের পিস্তলও তখন গর্জে উঠছে। অব্যর্থ গুলি। চারটি গুলি মামুনের শরীরে বিদ্ধ হলো। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত হলো গোটা এলাকা। শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়া যুবককে দেখে পথচারীরা তখন ভেবেছিল, সে প্রশাসনের লোক। যে কারণে যে যার মতো ঘটনাস্থল থেকে সরে গেল। রক্তাক্ত মামুনের দেহ পড়ে রইল রাস্তার ওপর। তার স্ত্রীকেও আর দেখা যাচ্ছিল না। ঘাতক ওই যুবকটি মামুনের দেহের সামনে এসে দাঁড়াল। সে এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে যে, মামুনের নিথর দেহে আবারও গুলি চালাতে লাগল। তার সহযোগীরা এসে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে জোর করেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। ঘাতক ওই যুবকটির নাম মাসুদ। আন্ডারওয়ার্ল্ডে মোল্লা মাসুদ নামে পরিচিত। সে নিজ হাতে অন্তত দুই ডজন খুন করেছে। অপরাধ সাম্রাজ্যে সবাই তাকে কিলিং মেশিন হিসেবে জানে। সব কটি খুনই করেছে অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট দুর্ধর্ষ ডন সুব্রত বাইনের হয়ে। মোল্লা মাসুদ সেভেন স্টার গ্রুপের একমাত্র স্ট্রাইকার। আন্ডারওয়ার্ল্ডে খুনিকেই স্ট্রাইকার বলা হয়।
সেভেন স্টার গ্রুপের প্রধান সুব্রত বাইনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মোল্লা মাসুদের বাড়ি ঝালকাঠির মহাদেবপুর। তার বাবার নাম আমজাদ হোসেন। বাসা ঢাকার রমনার মিরবাগে।
২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঘোষণা করা হয়। এ তালিকায় মোল্লা মাসুদ ছিল ১৩ নম্বরে। তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণার পাশাপাশি সারা দেশেই ছবিসহ পোস্টার করা হয়। দেশের ইমিগ্রেশনে তার ছবি টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ইন্টারপোল তার নামে রেড নোটিস হুলিয়া জারি করে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে। মোল্লা মাসুদ পুলিশের তাড়া খেয়ে দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আস্তানা গাড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেখানে গ্রেফতার হয় মোল্লা মাসুদ। এসএসসি পাসের পর মোল্লা মাসুদ ভর্তি হয় সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। ওই কলেজে থাকার সময় জড়িয়ে পড়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ছাত্রলীগ থেকে মনোনয়ন চায়। না পেয়ে ছাত্রদলে ধরনা দেয়। সেখান থেকেও সে মনোনয়ন পায় না। শেষে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচন করে। নির্বাচনে হেরে যায় মাসুদ। শিবিরে যোগদানের পর কয়েক মাস সে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের দেহরক্ষী হিসেবেও কাজ করেছে। যোগ দেয় সুব্রত বাইনের গ্রুপে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে মাসুদ নামে আরও বেশ কয়েকজন থাকায় তার নামের আগে যোগ হয় ‘মোল্লা’ শব্দটি। শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বলেই তার নাম হয়ে ওঠে মোল্লা মাসুদ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুব্রত বাইনের গ্রুপে যোগদানের পর মোল্লা মাসুদকে বেশ কয়েকটি কাজে পাঠানো হয়। যেখানে তাকে হুমকি-ধমকির জন্য পাঠানো হতো, সে খুন করে চলে আসত। চাঁদা দাবি করতে চিঠি নিয়ে গেলেও খুন করা ছাড়া ফিরে আসত না। যে কারণে শুধু খুনের কাজেই তাকে ব্যবহার করত সুব্রত বাইন।
মোল্লা মাসুদের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, মোল্লা মাসুদ তার গ্রুপের সবাইকে বলত, কাম (আন্ডারওয়ার্ল্ডে খুন করাকে কাম বলে) ছাড়া তার ভালো লাগে না। গুলি করার পর ফিনকির মতো রক্ত বেরোতে না দেখলে তার মনে হয় না যে কিছু একটা করেছে। মাসুদের ভাষায়, ‘চোখের সামনে দাপরায়া দাপরায়া কেউ মরতাছে, তা দেখলে খুব ভালো লাগে।’
সূত্র জানায়, যে অপারেশনেই তাকে পাঠানো হতো শতভাগ সফল হয়ে আসত মোল্লা মাসুদ। খুব দ্রুত সে সুব্রত বাইনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত করে। সূত্র জানায়, আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীরাও তাকে সমীহ করে চলত। কথার আগেই তার পিস্তলের গুলি বেরিয়ে যেত। যে কোনো অপারেশনে তার আগে কেউ গুলি ছুড়তে পারত না। ছোট-বড় যে কোনো ধরনের অস্ত্র চালাতে সে পারদর্শী। মোল্লা মাসুদকে সুব্রত বাইনের দল থেকে ছাড়িয়ে নিতে বিভিন্ন অপরাধী গ্রুপ চেষ্টা চালালেও তা শেষমেশ কেউ নিতে পারেনি।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি সূত্র জানায়, খুন করতেই মোল্লা মাসুদ ভালোবাসে। তার আগে কেউ গুলি চালালে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠত। একটি অপারেশনে সে গুলি করার আগে অন্য কারও গুলিতে খুনের ঘটনা ঘটার পর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল মাসুদ। ওই সময়ই নিজের গ্রুপের সদস্যকেই গুলি করেছিল সে।
১৯৯৯ সালের দিকে সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদসহ গ্রুপের অন্য সদস্যরা মগবাজারে দিনের বেলা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ওত পেতে ছিল। তাদের কাছে খবর ছিল, ওই স্থান দিয়ে যুবলীগ নেতা লিয়াকত যাবেন গাড়িতে করে। কিছু সময় পরই ওই স্থান দিয়ে লিয়াকত গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। লিয়াকতের গাড়ি দেখেই সুব্রত বাইনের লোকজন এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। লিয়াকতের গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। গাড়ি থেকেও পাল্টা গুলি চালানো হয়। লিয়াকতের গাড়ির চালকের দুঃসাহসিকতার কারণে সে যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পান লিয়াকত। কিন্তু অস্ত্রহাতে ক্ষুব্ধ তখন মোল্লা মাসুদ। লিয়াকতকে হত্যা করতে না পারায় সে এক পথচারীকে গুলি করে হত্যা করে তখন। এমনি বহু ঘটনা রয়েছে মোল্লা মাসুদের অপরাধ জীবনে। মোল্লা মাসুদের বিরুদ্ধে খিলগাঁওয়ের তিন হত্যা, মগবাজারের রফিক হত্যা, আদালত প্রাঙ্গণে মুরগি মিলন হত্যাসহ প্রায় দুই ডজন হত্যা মামলা রয়েছে। মুরগি মিলনকেও প্রথম গুলি করেছিল এই মোল্লা মাসুদ।
সূত্রমতে, মগবাজারের একটি মার্কেটেই ছিল তাদের আস্তানা। সেখানে একটি অফিস নিয়ে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করত। পাশাপাশি শিবিরের সঙ্গেও বেশকিছু অপরাধ কর্মকাণ্ড করেছে মোল্লা মাসুদ। ২০০৪ সালে ঢাকায় ক্রসফায়ারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মোল্লা মাসুদ, সুব্রত বাইন দেশ থেকে পালিয়ে যায়। সূত্রমতে, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর মোল্লা মাসুদ পরিচিতি পায় রাসেল মাসুদ নামে। পরে মুর্শিদাবাদে ভারতীয় নাগরিক রিজিয়া সুলতানাকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কিন্তু তার পরও থেমে থাকেনি মোল্লা মাসুদের চাঁদাবাজি। সে ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করে বিভিন্ন সময় মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে আসছিল। তার সহযোগীদের মাধ্যমে সে চাঁদা তুলত। কোনো কোনো ব্যবসায়ী হুন্ডির মাধ্যমে চাঁদার টাকা তার কাছে পৌঁছে দিতেন।পশ্চিমবঙ্গে সুব্রত বাইনের সঙ্গে থেকে জাল নোটের কারবারে জড়িয়ে পড়ে। সেখানকার অপরাধী চক্রের সঙ্গে থেকে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় মোল্লা মাসুদ।দীর্ঘদিন অপরাধ জগতে জড়িয়ে থাকার পর ঢাকার এ শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ইন্টারপোলের রেড নোটিসধারী মোল্লা মাসুদ ভারতে গ্রেফতার হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি পুলিশ ফেব্রুয়ারিতে ব্যারাকপুর এলাকায় তাকে গ্রেফতার করে। ইন্টারপোল দিল্লি তার গ্রেফতারের বিষয়টি সে সময় বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করে। মোল্লা মাসুদের বিরুদ্ধে ব্যারাকপুর থানায় বিদেশি নাগরিক অনুপ্রবেশ আইনে মামলা হয়েছে। মামলা নম্বর ৯, তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বিভিন্ন থানায় দুই ডজনের বেশি মামলা রয়েছে।জানা গেছে, এই কিলিং মেশিনকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার।
দানব ডেভিড
ভালো ক্রিকেট খেলতেন নারায়ণগঞ্জের মোমিনউল্লাহ ডেভিড। ছিলেন শহর যুবদল নেতা। রাজনীতির পথে হাঁটতে গিয়ে ক্রিকেট ব্যাট ছেড়ে হাতে তুলে নেন অবৈধ অস্ত্র। খুন, চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি করতে করতে হয়ে ওঠেন প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নারায়ণগঞ্জের শীর্ষসন্ত্রাসী। পুলিশও তার কাছ থেকে রেহাই পায়নি। পুলিশকে মারধর ও গুলি ছিনিয়ে নেওয়ারও ঘটনা ঘটান এই ডেভিড। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষ-কতায় তিনি চলে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কোনোভাবেই তার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছিল না। সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয় নারায়ণগঞ্জ।
অবশেষে দল ক্ষমতায় থাকতেই র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন ফ্রাঙ্কেন স্টাইনের সেই দানবে পরিণত হওয়া মোমিনউল্লাহ ডেভিড। পুলিশের হিসাবে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হামলাসহ ডেভিডের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা ছিল।
মোমিনউল্লাহ থেকে ডেভিড
ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমিতে। ভালো ব্যাট করতেন। ফলো করতেন অস্ট্রেলিয়ান জনপ্রিয় ক্রিকেটার ডেভিড বুনকে। ডেভিড বুনের ব্যাটিং স্টাইল রপ্ত করেছিলেন ভালোভাবেই। ক্রিকেট একাডেমির কোচ তাকে ডেভিড বলেই ডাকতেন। সেই থেকে তার নাম হয় মোমিনউল্লাহ ডেভিড। পরিচিতি পান ডেভিড নামে। এই ডেভিড ক্রিকেট খেলতে খেলতে এক সময় জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। ক্রিকেট ব্যাট চালাতে তিনি যেমন ছিলেন পারদর্শী, অস্ত্রও চালাতেন ঠিক তেমনি। এক সময় অস্ত্র আর ব্যাট দুই-ই চালাতে থাকেন। সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেট ব্যাট ফেলে নিত্য-নতুন অস্ত্র তার হাতে শোভা পেতে থাকে। সন্ত্রাসী থেকে বনে যান শীর্ষ সন্ত্রাসীতে। এক সময়ে তিনি হয়ে ওঠেন নারায়ণগঞ্জের অপরাধ জগতের ডন।
১৯৯০ সালে ডেভিড সন্ত্রাসের পথে হাঁটতে থাকলেও সেই সময়ে তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সেই সময়ে বিএনপির দুডজন সন্ত্রাসী বেপরোয়াভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ওই অপরাধীরা গা-ঢাকা দিলেও আড়ালে যাননি ডেভিড। এলাকায় থেকেই গা-ঢাকা দেওয়া অপরাধীদের আস্তানাগুলো দখলে নিতে শুরু করে।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ হিসেবে উত্থান ঘটে মোমিনউল্লাহ ডেভিডের। বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অপরাধীরাও তার কাছে তখন নস্যি। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ডেভিড দ্রুত এগিয়ে যান। তখন তিনি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জে অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হন। তার কাছে অস্ত্র যেন একটি খেলনা দ্রব্য। প্রকাশ্যেই অস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন শহরের এক মাথা আরেক মাথা। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি অফিস আদালতও তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল। কোনো কিছুতেই তার এই অগ্রযাত্রাকে রোধ করা যাচ্ছিল না। অত্যাধুনিক অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলেন তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে।
মূলত এরশাদ আমলে ১৯৮৮ সালে জোড়া খুনের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন ডেভিড। কালাম ও কামাল নামে দুই যুবককে হত্যা করে ডেভিড। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কিছু করতে না পারলেও ২০০১ সালের পর তৎকালীন ছাত্রদলের এই নেতা দানবে পরিণত হয়। খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনে সশস্ত্র হামলা চালায় ডেভিড। এতে পাণ্ডা নামে এক যুবক নিহত হন। এ ছাড়া মিশনপাড়া এবং চাষাঢ়ায় গুলি করে হত্যা করে মনির নামে এক যুবককে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন রাজনীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ডেভিড সোনার হরিণ হিসেবে বেছে নেয় সন্ত্রাসকে। এ পথ ধরে ডেভিড কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিলে অনেক দূর এগিয়েছিল। সে সময়ে প্রতিদিন তার অবৈধ আয় ছিল ৭০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা। ডেভিডের এই অবৈধ আয়ের উৎস ছিল সব ধরনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, শীতলক্ষ্যা নদীর চাঁদাবাজি, গার্মেন্ট জুট ব্যবসা, চোরাই তেল ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সন্ত্রাসের মহীরুহে পরিণত হন ডেভিড। অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলেন নারায়ণগঞ্জে। ডেভিডের আমলে টেন্ডারকে নারায়ণগঞ্জে প্রায় প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটত। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব- অনেকেই তার হাতে প্রকাশ্যে নাজেহাল হয়েছেন। ভয়ে কেউ টুঁ-শব্দটি করার সাহস পেত না।
সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের ব্যবসায়ীরা ছিলেন মোমিনউল্লাহ ডেভিডের কাছে জিম্মি। এমন কোনো ব্যবসায়ী ছিলেন না, ডেভিড ও তার দল-বলের নির্যাতন সহ্য করেননি। তাদের চাঁদাবাজির দৌরাত্দ্য এমনটাই বেড়ে যায় যে, কোনো ব্যবসায়ী এলসি খুললেই চাঁদা দিতে হতো। ২০০৫ সালের ২৫ নভেম্বর রাজধানীর মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে গ্রেফতার হন মোমিনউল্লাহ ডেভিড। সেখানেই ক্রসফায়ারে নিহত হন নারায়ণগঞ্জের গডফাদারে পরিণত হওয়া মোমিনউল্লাহ ডেভিড।
নীরব ঘাতক তারেক
২৯ জুলাই, ২০১৩। রাত সাড়ে ১২টা। রাজধানীর গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের উল্টো দিকের রাস্তার পাশে একটি গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে কালো পাঞ্জাবি পরা একজন নেমে রাস্তা পার হচ্ছেন। হঠাৎ সেখানে একটি মোটরসাইকেল এসে থামল। মোটরসাইকেল থেকে নেমে দ্রুত এগিয়ে আসছেন এক যুবক। পাঞ্জাবি-পাজামা পরা যুবকটির মাথায় টুপি। বাম হাতে ধরা মোবাইল ফোনে কথা বলে যাচ্ছেন। ডান হাতে তার পিস্তল। যুবকটি গাড়ি থেকে নামা লোকটির সামনে এসেই মাথায় গুলি চালান। গুলিবিদ্ধ লোকটি রাস্তায় পড়ে গিয়ে আবার ওঠার চেষ্টা করেন। ঘাতক যুবকটি ফোনে কথা বলেই যাচ্ছেন, পাশাপাশি গুলিও করছেন। খুব কাছ থেকে ছয়-সাতটি গুলি চালান যুবকটি। এরপর অপেক্ষমাণ মোটরসাইকেলে উঠেই হাওয়া। ঈদের আগে ব্যস্ততম সড়কে ফিল্মি কায়দায় এভাবেই যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যান অস্ত্রধারী ওই ঘাতক। সিসিটিভির বদৌলতে দেশবাসী দেখেছে খুনের এ দৃশ্য।
ঘাতক ওই যুবকের নাম তারেক। পুরো নাম এস এম জাহিদ সিদ্দিকী তারেক। আন্ডারওয়ার্ল্ডে যিনি সাইলেন্ট কিলার বা নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত।
‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’-এর ওস্তাদ এই তারেক নিজের গাড়িতে ছদ্মবেশে সবসময় অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। একটি খুনের জন্য তিনি পারিশ্রমিক নিতেন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। এভাবেই তিনি রাজধানীতে নীরবে ২৫ থেকে ৩০টি খুন করেছেন। মিল্কী হত্যাকাণ্ডটি সিসিটিভিতে ধারণ করায় তারেক ধরা খেয়ে যান। এর আগে পুলিশ প্রশাসনের কাছেও তার ব্যাপারে এমন ভয়ঙ্কর তথ্য ছিল না। মিল্কী খুনের পর তারেক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়েন উত্তরার একটি ক্লিনিক থেকে। এরপরই খিলক্ষেত এলাকায় র্যাবের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তার সহযোগীরা। গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে নিহত হন পেশাদার এই কিলার তারেক। পুলিশ, গোয়েন্দা ও তারেকের একসময়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন বেশ কয়েকজনের বক্তব্যে তারেকের ভয়ঙ্কর সব অপরাধের চিত্র ফুটে উঠে।
সূত্রগুলো জানায়, কালা জাহাঙ্গীর, বিকাশ, ডাকাত শহীদ এবং সুইডেন আসলামসহ অনেকের কাজ (কন্ট্রাক্ট কিলিং) করে দিতেন এই তারেক। ওর অস্ত্রভাণ্ডারে ছিল অত্যাধুনিক বিদেশি অস্ত্র। পুরান ঢাকার শাহাদাত কমিশনার, মতিঝিলের দর্পণ, শাহজাহানপুরের রাজীব, পুরান ঢাকার আইনজীবী হাবিব মণ্ডল, ধানমন্ডিতে ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত হোসেন, আগারগাঁওয়ে এসআই হুমায়ুন কবির, ছাত্রলীগ নেতা তপন ও আঁখি, জাতীয় পার্টির কমিশনার খালেদ ইমাম, মোহাম্মদপুরে শোভনের শ্যালক এবং সায়েদাবাদে এক শিল্পপতিসহ অনেককেই তিনি নিজ হাতে খুন করেছেন। তারেকের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি অন্য কাউকে দিয়ে খুন করাতেন না। নিজেই খুনের কাজটি নিপুণ হাতে করতেন।
তারেকের গ্রামের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা আবদুল হাই। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে। তারেকের শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও রাজনৈতিক জীবন খুব কাছ থেকে দেখা এমন কয়েকজন নেতা-কর্মী বলেন, নব্বইয়ের দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়েই তারেকের রাজনৈতিক পথচলা শুরু। সে সময় ওই নেতার পক্ষে ছিলেন রিয়াজুল। ওই সময় পুরো মতিঝিল এলাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন ইখতিয়ার, জিসানসহ আরও কয়েকজন। ইখতিয়ার ও জিসান ছিলেন মতিঝিলের এক ওয়ার্ড কমিশনারের সহযোগী। তাদের কারণে তারেক, রিয়াজুল শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হতেন। রাজনৈতিকভাবেও তারা পিছিয়ে ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ নির্যাতন ও নিগ্রহ থেকে বাঁচতে তারেক আশ্রয় নেন মিরপুরের তৎকালীন শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের কাছে। সেই সূত্রে তারেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ভারতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত, তাজসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তারেকের কাজই ছিল এ তিন সন্ত্রাসীর বিরোধীদের চিহ্নিত করে হত্যা করা। ২০০১ সালের দিকে তারেক মিরপুরের গুদারাঘাটের বাসিন্দা সন্ত্রাসী টিপুকে এলিফ্যান্ট রোডে একটি রেস্তোরাঁয় গুলি করে হত্যা করেন। মূলত ওটাই ছিল নিজ হাতে তার জীবনের প্রথম কাউকে খুন করা। এরপর একে একে খুন করে গেছেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই সাইলেন্ট কিলার তারেক। নাম প্রকাশ না করে মতিঝিলের এজিবি কলোনির একজন রাজনৈতিক নেতা বলেন, এভাবে খুন করতে করতে পারদর্শী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল তারেক। অন্যদিকে মতিঝিল এলাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণকারী ইখতিয়ার, জিসানসহ কয়েকজন দুই পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি হন। তারা দেশের বাইরে পালিয়ে যান। আর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাইরে চলে যান ইখতিয়ার ও জিসানের আশ্রয়দানকারী ওই ওয়ার্ড কমিশনার। এ সুযোগে তারেক মতিঝিলের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। জড়িয়ে পড়েন একের পর এক হত্যাকাণ্ডে।
সন্ত্রাসী ইমন
মেশিন পাঠায়া দিছি। পাইছস?
হ ভাই পাইছি। গুলি পাইছি ১৫টা।তাইলে ‘কাম’ সাইরা ফালাইয়া দে তাড়াতাড়ি...জেলখানার চার দেয়ালে বন্দী একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী মোবাইল ফোনে এভাবেই কথা বলছিলেন তার সহযোগীর সঙ্গে। মোবাইল ফোনের এমন কথোপকথনের কয়েকদিন পরই তাদের সেই ‘কাম’ হয়ে যায়। রাজধানীর হাজারীবাগে একজন ব্যবসায়ীর লাশ ফেলার মধ্য দিয়ে তাদের সেই ‘কাম’ হাসিল হয়। যার খবর একইভাবে জেলখানায় আটক ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে জানানো হয়েছিল। তার সহযোগী শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ফোনে বলেন, ‘ফাইনাল, শেষ। একদম পইড়া রইছে।’ জবাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী তাকে বলেন, ‘চুপ কর, তুই এখন সইরা যা’। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সৌখিন সন্ত্রাসী-খ্যাত ইমন কারাগারের ভিতরে-বাইরে একই রকম। কারাগারের বাইরে যখন ছিলেন, খুন করেছেন একের পর এক। যখন ভিতরে-তখন দিয়েছেন খুনের নির্দেশ। মোবাইল ফোনের এমন নির্দেশের পর লাশ পড়েছিল হাজারীবাগে। র্যাব তার মোবাইল ফোনের কথাবার্তা রের্কড করলে বেরিয়ে আসে খুনের নির্দেশের এমন ঘটনা।
স্বনামধন্য চিকিৎসক দম্পতির সন্তান ইমন। তার পুরো নাম সানজিদুল ইসলাম ইমন। ধানমন্ডিতে তাদের বাসা। এলাকার বখাটে কিছু ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে তার পরিচয়। তার শখ হয় নিজের কাছে অস্ত্র রাখার। সেই শখ মেটাতেই টাকা দিয়ে নিত্যনতুন অস্ত্র কিনতে থাকেন ইমন। যখন যার কাছে নতুন কোনো অস্ত্রের সন্ধান পান, তাকেই বলেন অস্ত্র কিনে দিতে। ধীরে ধীরে তার এই অস্ত্রের ভাণ্ডারের সংবাদ চাউর হয়ে যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডে। তার শত্রুও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তাকে টার্গেট করে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে। এরপরই মূলত ইমন নিজেকে রক্ষায় শখের সেই অস্ত্র হাতে তুলে নেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে শুরু হয় তার অন্যরকম এক সহিংস মিশন। সৌখিন এই সন্ত্রাসী একসময় হয়ে ওঠেন দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী।
সানজিদুল ইসলাম ইমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হয় ১৯৯৯ সালে ধানমন্ডি এলাকার গালকাটা জব্বার নামে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে। পরে তিনি হয়ে ওঠেন ধানমন্ডি এলাকার ত্রাস। পর্যায়ক্রমে ইমনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিধি বিস্তৃত হয় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, রমনা, বাড্ডা, কোতোয়ালি, লালবাগ, উত্তরা, তেজগাঁও ও হাজারীবাগ এলাকায়। তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় ৩০টির বেশি হত্যা মামলা রয়েছে। যার মধ্যে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল ইসলাম অশ্রু হত্যাকাণ্ড রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একসময় মোহাম্মদপুরের একটি বাহিনীর সঙ্গে ইমনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ওই বাহিনীর সঙ্গে থেকে হিমেল, পলাশ, মার্ডারসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ফেরার হয় সমাজের উচ্চপর্যায়ের একটি পরিবারের সন্তান ইমন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার নিজস্ব বাহিনী গড়ে ওঠে। তার বন্ধু ও সহযোগী মামুনকে নিয়ে গড়ে তোলা এ বাহিনীর নাম হয় ইমন-মামুন গ্রুপ। চাঁদাবাজি, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তারা। ভাড়াটে হিসেবে তারা খুন-খারাবি শুরু করেন। এ বাহিনীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হতো আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যসব বাহিনীকে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ইমনকে সমীহ করতেন। তাকে দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিতেন।
বিশেষ করে দেশের একজন আলোচিত-সমালোচিত বিতর্কিত ব্যবসায়ী যিনি দেশের বাইরে থাকেন, সেই ব্যবসায়ীর অন্যতম ক্যাডার ছিলেন এই ইমন। তার হয়ে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করেন। সূত্র জানায়, ইমন বিয়ে করেন তার বন্ধুর বোনকে। তার শ্বশুরবাড়ি যশোরে। এমন একটি সময় গেছে, যখন খুন-খারাবি ছাড়া ইমন যেন আর কিছুই ভাবতে পারতেন না। শ্বশুরবাড়ি যশোর গিয়েও তিনি খুন করে এসেছেন। নিছক পাশের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে তর্কবিতর্কের কারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আফতাব আহমেদ হত্যাকাণ্ডেও জড়িত রয়েছেন এই ইমন। এ ছাড়া কারাবন্দী জোসেফের ভাই টিপুসহ দুই খুনেও ইমন জড়িত বলে পুলিশ জানায়।
সর্বশেষ খুনের নির্দেশনা
২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে হাজারীবাগ তিন মাজার মসজিদের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে হাজারীবাগের ট্যানারি ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন সাত্তারকে হত্যা করা হয়। সাত্তার রাজধানীর ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সভাপতি ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ছিল। এর আগে কারাগারে বসে সাত্তারকে খুন করান বন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। প্রায় এক মাসের পরিকল্পনায় তিনি ভাড়াটে খুনি ব্যবহার করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। কারাগারে বসেই ইমন তার সহযোগীদের সঙ্গে দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোনে হত্যাকাণ্ডের ছক আঁকেন। ইমন ও তার সহযোগীদের মোবাইল ফোনের কথোপকথনের সূত্র ধরে সাত্তার খুনে ইমনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তা ছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর ইমনের সহযোগী বুলু ও মাসুদকে গ্রেফতার করে র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে ইমনের পরিকল্পনায় কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার বিস্তারিত খুলে বলেন বুলু।সূত্র জানায়, সাত্তার সে সময় বুঝতে পেরেছিলেন তার জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ কারণে তিনি বাড়ি থেকে বাইরে বের হওয়া প্রায় বন্ধ করে দেন। আর এতে অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে পড়েন ইমনের সহযোগীরা। হত্যাকাণ্ডের তিন দিন আগে ইমন কারাগার থেকে কিলিং মিশনের সর্বশেষ নির্দেশনা দেন।
ওই কথোপকথন ছিল নিুরূপ
বুলু : ভাই, স্লামালেকুম।
ইমন : বল, কি খবর, ওই (সাত্তার) কি বাইর হইছে।
বুলু : না ভাই। কি করন যায় কন দেহি।
ইমন : চুপ থাক। একটা লোক ৫ দিন ঘরে থাকতে পারে কিন্তু ৬ দিনের দিন সে বাইর হইবই।
বুলু : অগোরে (ভাড়াটে কিলার) তো বাড়ির আশপাশে খাড়া কইরা রাখছি।
ইমন : মেশিন পাঠায়া দিছি। পাইছস।
বুলু : হ ভাই পাইছি। গুলি পাইছি ১৫টা।
ইমন : তাইলে কামডা সাইরা ফালাইয়া দে তাড়াতাড়ি।
এরপর ১৪ ডিসেম্বর সাত্তারকে খুন করে ইমনকে আনন্দের সংবাদ জানান কিলার বুলু।এ সময়ের কথোপকথন ছিল-বুলু : ভাই,ইমন : হুবুলু : ফাইনাল, শেষ।ইমন : ঠিক আছে।বুলু : একদম পইড়া রইছে।ইমন : চুপ কর, তুই যাইছ না।২০০০ সালের শেষ দিকে গ্রেফতার এড়াতে ইমন ভারতে আত্মগোপন করেন। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার গঠনের পর দেশে ফেরেন ইমন। আবার শুরু হয় তার সন্ত্রাসী তৎপরতা। তবে ২০০৫ সালে র্যাবের ক্রসফায়ারের ভয়ে আবার ভারতে পালিয়ে যান ইমন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের শেষ দিকে সিআইডির সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আরেফের (বর্তমানে পুলিশ সুপার) নেতৃত্বে একটি টিম ইমন, তাজ, ইব্রাহিম, লম্বু সেলিমসহ সাত সন্ত্রাসীকে দেশে ফেরত আনে। এরপর থেকে ইমন কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু কারাবন্দী থেকেও থেমে নেই ইমনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
কামাল পাশা
সাত সকালে রিভেলদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায় ২৬-২৭ বছরের এক যুবক। এলোমেলো চুল। পরনে তার জিন্সের প্যান্ট, প্রিন্টের শার্ট। চিৎকার করে রিভেলকে ডাকছিল। এত সকালে কে ডাকাডাকি করছে, তা দেখার জন্য রিভেলের মা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। যুবকটিকে তিনি বলেন, রিভেল ঘুমিয়ে আছে। বিনয়ের সঙ্গে যুবকটি তখন বলল, খালাম্মা রিভেলকে খুব দরকার। যুবকটি চেনাজানা বলেই মা রিভেলকে ডেকে দেন। রিভেল ঘুম থেকে উঠে বাসার বাইরে গিয়ে যুবকটির সঙ্গে দেখা করে। দুজনে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে চলে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি নীরব স্থানে গিয়ে যুবকটি তার পকেট থেকে একটি পিস্তল বের করে। রিভেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালায়। গুলি রিভেলকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত রিভেল নর্দমায় পড়ে থাকে। আশপাশের লোকজনের সন্দেহ হওয়ার আগেই যুবকটি ওই স্থান থেকে সরে যায়। এর আধা ঘণ্টা পর ওই যুবকটি আবারও ফিরে যায় রিভেলদের বাসায়। এবার রিভেলের বড় ভাই জুয়েলকে প্রয়োজন। একই ভাবে জুয়েলকে ডাকতে থাকে সে। জুয়েল বেরিয়ে আসে। কথা বলতে বলতে তারা দুজনে এগিয়ে যায় সামনের একটি রাস্তার ধারে। যুবকটি এবার আর কোনো নীরব স্থান খুঁজেনি। রাস্তার ওপরই জুয়েলের শরীরে পিস্তল ঠেকিয়ে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। রক্তাক্ত জুয়েল পড়ে থাকে রাস্তায়। হাতে ধরা পিস্তল উঁচু করে এবার দৌড়ে পালায় যুবকটি।
২০০০ সালের ৫ মে’র ঘটনা এটি। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এভাবেই আধা ঘণ্টার ব্যবধানে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ওই যুবকটি ফিল্মি স্টাইলে দুই ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। একজন মাত্র খুনি ঠাণ্ডা মাথায় পরপর দুটি খুন করে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা পুলিশের কেস হিস্ট্রিতেও বিরল। আর ঠাণ্ডা মাথার এই খুনি হলেন রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল পাশা। পলাতক থাকা অবস্থায় যার মাথার মূল্য সরকার লাখ টাকা ঘোষণা করেছিল। বর্তমানে দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসী কারাগারে আটক রয়েছেন। একের পর এক ফিল্মি স্টাইলে খুনের ঘটনা ঘটালেও তার পরিবার প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিল, তাদের সন্তান মানসিক প্রতিবন্ধী। মানসিক সমস্যার কারণে কামাল পাশাকে চিকিৎসাও করানো হয়েছিল। পরিবারের এই দাবির পর থেকে কামাল পাশা আন্ডারওয়ার্ল্ডে ‘পাগলা পাশা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কামাল পাশা দিনের বেলায় খুন করতে পছন্দ করতেন। তিনি তার সহযোগীদের প্রায়ই বলতেন, দিনে নানা কায়দায় আক্রমণ করা যায়। প্রতিপক্ষের মৃত্যু নিজের চোখে দেখা যায়। এতে শান্তি পাওয়া যায় মনে।কামাল পাশার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন জানান, অন্ধকারকে ভয় করত পাশা। যে কারণে দিনের বেলায় খুনের ঘটনা ঘটাত। যে হত্যাকাণ্ডগুলো পাশা ঘটিয়েছে, তার প্রত্যেকটি দুঃসাহসিক। ফিল্মি স্টাইলে খুন করতে সে ভালোবাসত। তাকে দিয়ে রাজধানীর অন্যান্য শীর্ষ সন্ত্রাসীরা খুন করাত। তার বিরুদ্ধে যে খুনের অভিযোগ রয়েছে, তার অধিকাংশই ভাড়াটে হিসেবে কাজ করেছে পাশা। ইতিমধ্যে দুটি খুনের ঘটনায় ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে আগারগাঁওয়ে খুন হন শামিম ও মামুন। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ এই জোড়া খুনের ঘটনাটি ঘটায়। কিন্তু কিলার হিসেবে ছিল কামাল পাশা। কামাল পাশার নেতৃত্বেই ওই জোড়া খুনের ঘটনাটি ঘটে। মূলত শামীম-মামুন জোড়া খুনের মধ্য দিয়েই হয় তার খুনাখুনির হাতে খড়ি।
১৯৯৭ সালের ২২ মে কামাল পাশা শাহবাগ পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) গুলি করে হত্যা করে ঠিকাদার আশিক ইকবালকে। দিনদুপুরে কামাল পাশা এবং তার সহযোগী রাশেদ মোস্তফা ওরফে রতনকে নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আশিক ইকবালকে গুলি করে হত্যার পর তারা দুজনে একটি বেবিট্যাক্সি নিয়ে পালাতে থাকে। শত শত লোকের সামনে পিস্তল উঁচিয়ে রাখে কামাল পাশা। বেবিট্যাক্সিতে ওঠার পরেও তার হাতে পিস্তল শোভা পাচ্ছিল। সোনারগাঁও হোটেলের সামনে একজন সার্জেন্ট পুলিশ জীবনবাজি রেখে তাদের সেই বেবিট্যাক্সির গতিরোধ করে। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাদের দুজনকে পাকড়াও করা হয়। উদ্ধার হয় দুটি পিস্তল ও ২০ রাউন্ড গুলি। আটক কামাল পাশা জামিনে বেরিয়ে আসে।
এরপর ২০০০ সালের প্রথম দিকে উত্তরায় গুলি করে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এর কিছুদিন পরই বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে দুই ভাই আশরাফ হোসেন জুয়েল (২৮) এবং মোহামদ আলী রিভেলকে (২৪)। কামাল পাশা গাঢাকা দেয়। ওই অবস্থায় বনানীতে একজন ব্যবসায়ীকে হত্যা করে কামাল পাশা।বিএনপি জোট সরকার আমলে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে কামাল পাশাকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরে কামাল পাশার বাবা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
কিলার মামুন
ছেলেটির বয়স ২০ থেকে ২২। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা। পরনে কালো প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। দুই হাত জোড় করা অবস্থায় হাঁটু গেড়ে বসা। তার উল্টো পাশে আট থেকে ১০ জন যুবক। তাদের একজন পিস্তলে গুলি লোড করছে। কালো কাপড়ে বাঁধা ছেলেটি অনুনয় বিনয় করছে। বলছে, ‘আমারে জানে মাইরেন না ভাই।’ পিস্তল হাতের যুবকটি বললেন, ঠিক আছে, তুই যেমনে কবি, ওমনেই হইবো। এইবার বল, তোর শরীরের কোন দিকে গুলি করলে কষ্ট কম হইবো। মনে কর, এইটাই তর জীবনের শেষ ইচ্ছা।’ এ কথা শুনেই হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে ছেলেটি। পা ধরে, মাফ চায়, কসম কাটে, কত কী! কিন্তু পিস্তল হাতের যুবকটির এক কথা, কোথায় গুলি করলে কষ্ট কম হবে। বার বার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে সে। এক সময় চোখ বাঁধা ছেলেটির পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, ঠিক আছে, তরে পায়ে গুলি করি। এ কথা বলেই ট্রিগারে চাপ দেয়। গুলি পায়ের এক দিকে ঢুকে আরেক দিকে বেরিয়ে যায়। ‘ওরে বাবা’ বলে চিৎকার করে ছেলেটি। সহযোগীরা ছেলেটিকে ঝাপটিয়ে ধরে রাখে। মুখের ভিতর গুঁজে দেয় কাপড়। এবার বুকে, হাতে এবং শেষে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালাল। গগনবিদারি চিৎকার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে নিস্তব্ধতা। খুনি এবার সহযোগীদের নির্দেশ দিয়ে বলল, ‘যা লাশটা মাটিতে পুঁইতা রাখ গা।’
ঢাকার আমিনবাজারের তুরাগ নদীর পাড়ে এভাবেই একের পর এক খুন করেছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। যিনি বর্দির (বরদেশী গ্রামের ছোট নাম) মামুন নামেই পরিচিত। তার পুরো নাম খন্দকার মামুন। কথা বলতে বলতে মানুষ খুন করা ছিল তার নেশার মতো। তবে খুনের আগে জীবনের শেষ ইচ্ছা জেনে নিত মামুন। মামুনের কাছে শেষ ইচ্ছা বলতে শরীরের কোথায় গুলি করা হবে-তা জেনে নেওয়া। এভাবেই শেষ ইচ্ছা জেনে নিয়ে খুন করত কাছ থেকে ধীরে সুস্থে।
মামুন এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে, আমিনবাজারে তার নাম মনে করলে এখনো মানুষ আঁতকে উঠে। এই মামুন এক সময় খুন হওয়ার পর আমিনবাজারের মানুষ যেন প্রাণ ফিরে পায়। ওই সময়ে সিরিজ গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। একসঙ্গে তিনজন, দুজন গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। অতিষ্ঠ মানুষ মামুন খুনের পর তার সহযোগীদের যেখানে পেয়েছে সেখানেই গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে। মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এমন একটি সূত্র জানায়, হ্যাঙ্গলা পাতলা গড়নের মামুনের ভীষণ সাহস ছিল। সব সময় অস্ত্র বহন করত। ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াত। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সাল থেকেই রাজধানীর সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া ছিল এই আমিনবাজার। রাজধানীর উপকণ্ঠ আমিনবাজারের এ জায়গাতেই ভিড়ত ফেনসিডিলের চালান। যার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত বর্দির মামুন। আর এই মাদকের ডিপো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে খুন-খারাবি থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধই করেছে মামুন। মামুন বাহিনীতে শুধু ওই এলাকার অপরাধীরাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকার দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে এসেছিল মামুন। পুলিশও মামুনের আখড়ায় হানা দিতে এক সময় ভয় করত। যে কারণে মামুন চলাফেরা করত বুক চিতিয়ে। মাদক ব্যবসায় অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান মামুন। অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলেন আমিনবাজারে। রাজধানীর দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলে তার নিজস্ব বাহিনী। যারা আমিন বাজার থেকে শুরু করে রাজধানীর শ্যামপুর পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াত। আমিনবাজারের বরদেশী গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা তুরাগ নদীর তীর ছিল তার খুন করার জায়গা। মাদকের ব্যবসায় যারা প্রতিবাদ করত বা নতুন করে মাদক ব্যবসা শুরু করত তাদেরকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হতো নদীর তীরে। যেখানে সন্ধ্যার পর মানুষ চলাচল করে না। সেখানেই বসত তার খুনের আসর। তার প্রতিপক্ষ গুলজারকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। সাভার থানার ওয়ারেন্টের আসামি মামুন এতটাই দুর্ধর্ষ ছিল যে, অস্ত্র হাতে সাভার থানায় গিয়ে পুলিশ সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছে।
’৯০ সালের দিকে মামুনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে বিকাশ আর প্রকাশের সঙ্গে। সমঝোতার কথা বলে মিরপুর এলাকায় মামুনকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে মামুনকে হত্যার জন্য গুলি চালায় প্রকাশ। গুলিবিদ্ধ মামুনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ হাসপাতালে যায় মামুনকে গ্রেফতারের জন্য। এ খবর মামুনের কাছে পৌঁছে যায়। হাসপাতাল থেকেই ট্রলিসহ তার সহযোগীরা বের করে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় মামুনকে। এরপর সে সুস্থ হয়ে ওঠে। বেপরোয়া হয়ে পড়ে মামুন। রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী আসলাম, সুভ্রত বাইন, পিয়ালসহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রাজধানীর এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এক জোট হয়ে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। ১৯৯৬ সালে মিরপুর এলাকায় মোল্লা মাসুদ গুলি করে হত্যা করে মামুনকে। ঈদের আগে স্ত্রীকে নিয়ে শপিং করে রিকশায় ফিরছিল মামুন। কিন্তু আগে থেকে ওতপেতে থাকা মোল্লা মাসুদের বাহিনী তাকে গুলি চালায়। মামুনও গুলি চালালেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। গুলিবিদ্ধ মামুন নিহত হয়।
টোকাই সাগর
শিল্পী রফিকুন নবী বা রনবী’র টোকাই চরিত্রটি বাস্তবের এমন কিছু পথশিশুর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা মানুষের ফেলে দেওয়া আবর্জনা কুড়িয়ে নিয়ে যায়। থাকে রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে, ফুটপাথে, ফেলে রাখা কংক্রিটের পাইপের ভিতর, পার্কের বেঞ্চিতে, ভাঙা দেয়ালের পাশে, কাঠের গুঁড়িতে, ঠেলাগাড়ির ওপর, ইটের ওপর মাথা পেতে। তার পাশে থাকে কুকুর, কাক। তার পোশাক বলতে একমাত্র লুঙ্গি।
এখানে এমন এক টোকাইর কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে পুরোটাই উল্টো। তার নামের আগে ‘টোকাই’ শব্দটি থাকলেও আদতে এই ব্যক্তিটি কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। তাকে রাস্তায় বা পাইপের ভিতর থাকতে হয় না। দেশ-বিদেশে রয়েছে তার বিশাল বিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকা। আর এই বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন তিনি মাস্তানি করে। তার নাম আমিনুর রসুল সাগর, যিনি টোকাই সাগর নামে পরিচিত। দুর্ধর্ষ সেভেন স্টার গ্রুপের অন্যতম সদস্য এই টোকাই সাগর খুন, চাঁদাবাজি ও বিমানবন্দরকেন্দ্রিক নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তার অস্ত্রের ভাণ্ডারে ছিল অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। বলা হয়ে থাকে, টোকাই সাগরের অস্ত্রের ভাণ্ডারে যে ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও ছিল না। খুন আর সোনার চোরাচালান লুট করাই ছিল টোকাই সাগরের কাজ। রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই গডফাদার মাস্তানি করেই কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে বিরল। তবে অঢেল সম্পদের মালিক হলেও তিনি দেশে থাকতে পারেননি। একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী-সব সময় তাকে থাকতে হয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে।
মূলত টোকাই সাগরের এই সোনা চোরাচালানকে কেন্দ্র করেই রাজধানীর শীর্ষ অপরাধীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গড়ে তোলা হয় দুই গ্রুপের অস্ত্রের মজুদ। খুন পাল্টা খুনে রাজধানীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় গ্যাং কিলিং। রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে থাকে। বাংলাদেশ সরকার এই দুর্ধর্ষ অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ২৩ শীর্ষ অপরাধীর অন্যতম এই টোকাই সাগর বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপন করে আছেন।
বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে উত্থান হওয়া এই সাগরের কাজ ছিল বিমানবন্দর এলাকায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা। অস্ত্রের মুখে চোরাচালানি চক্রের সোনার চালান লুটে নেওয়া। সোনার চালান লুট করতে করতে একসময় তিনি নিজেও চোরাচালানে যুক্ত হয়ে পড়েন। দেশের শীর্ষস্থানীয় চোরাকারবারিদের সঙ্গে তার ওঠাবসা শুরু হয়। আর এই লাভজনক অবৈধ ব্যবসা ঠিক রাখতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলেন আলাদা বাহিনী, যার নাম দেওয়া হয় সেভেন স্টার গ্রুপ। সুইডেন আসলাম, সুব্রত বাইনসহ শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের নিয়ে গড়া এই গ্রুপটির সন্ত্রাসী তৎপরতায় আন্ডারওয়ার্ল্ড যেমন অস্থির হতে থাকে, হারাম হতে থাকে পুলিশের ঘুম।
সেভেন স্টার গ্রুপের কিলিংয়ের ঘটনার অধিকাংশেই টোকাই সাগরের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত টোকাই সাগর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বেপরোয়া হয়ে পড়েন। চলে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে তার ছিল দহরম-মহরম। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গাড়িসহ মালামাল ডাকাতির ঘটনা তাদের বেড়ে যায়। অঢেল সম্পদ ও সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক হওয়া এই সাগর একসময় হয়ে ওঠেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন।
সূত্রে জানা গেছে, চোরাকারবারিদের সোনার চালান বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই খবর চলে আসত সাগরের কাছে। এরপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দর সড়কেই সোনার চালানের গাড়ির গতি রোধ করা হতো। চালক ও মালিককে বের করে দিয়ে গাড়িসহ সোনার চালান লুটে নিয়ে যেতেন সাগর। এ কাজটি প্রথম পর্যায়ে আশকোনা, দক্ষিণখান এলাকার অপরাধীদের নিয়ে করতেন তিনি। পরে এ কাজে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীরা জড়িয়ে পড়ে।
সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯১ সালে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইন ও টোকাই সাগরের। আন্ডারওয়ার্ল্ডে যুবলীগের হান্নানের অনুপস্থিতিতে তার দলের সদস্যরা সুব্রত বাইন ও টোকাই সাগরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার নামে দুই ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। সেভেন স্টারের নেতৃত্ব দেন টোকাই সাগর আর সুব্রত বাইন। আর ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলেন লিয়াকত। লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেয় পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, আরমান, জিসান, রনি, বিকাশ, প্রকাশ, নিটেল, আলাউদ্দিন, কিলার আব্বাস, আগা শামীম, কাজল ও অশ্রু।
অন্যদিকে টোকাই সাগরের সেভেন স্টার বাহিনীতে যোগ দেন মুরগি মিলন, তানভীরুল ইসলাম জয়, ইমাম হোসেন ইমাম, মোল্লা মাসুদ, সাইদুর রহমান নিউটন, তোফায়েল আহমেদ ওরফে যোশেফ, তানজিল, কচি, টিক্কা, আসিফ, কালা লিয়াকত, জরিফ, নাটকা বাবু, মুরাদ, মানিক, চঞ্চল, জুলু ও জন। এরা সবাই তখন ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের একেকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী। লিয়াকতের সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুইডেন আসলাম হাত মেলান সুব্রত বাইন আর টোকাইয়ের সঙ্গে। আর এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শক্তি বাড়ে সাগরের। পরে অবশ্য দলবদলের ঘটনা ঘটে। এ দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলতে থাকে গ্যাং কিলিং। একই সময় সুব্রত বাইনের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান আগামসি লেনের ‘সন্ত্রাসী’ আসিফ। যোগ দেন লিয়াকত গ্রপে।
২০০০ সালের ২৯ আগস্ট খুন হন আসিফ, তার বডিগার্ড গিয়াসউদ্দিন টিপু ও সহযোগী রিপন। খিলগাঁওয়ের ৪৪৬/সি নম্বর বাড়ি থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। আগারগাঁও বস্তি দখলকে কেন্দ্র করে সুব্রত বাইন গ্রুপের সদস্য জন এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে জানা যায়। অভিযোগ ওঠে, এ হত্যাকাণ্ডে তাকে সহায়তা করেন সেভেন স্টারের সুইডেন আসলাম। আসিফের বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন জন। পুলিশের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। এই গ্যাং কিলিংকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপই দল ভারী করতে থাকে। বাড়াতে থাকে অস্ত্রশস্ত্র। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে আসতে থাকে অত্যাধুনিক অস্ত্র।
২০০০ সালের ১৮ মে পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনকে। সেভেন স্টার গ্রুপের পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর ও ডাকাত শহিদ এ হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে সোনা চোরাকারবার নিয়ে টোকাই সাগরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে। আর দ্বন্দ্বের কারণেই মিলন খুন হন আদালতপাড়ায়।
ভয়ঙ্কর শাহাদাত
অপরাধ জগতের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ আর পুলিশের তালিকায় তিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী। সরকার তাকে পাকড়াওয়ে পুরস্কার ঘোষণা করেছে লাখ টাকা। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে এখন তিনি ফেরার। আছেন কলকাতায়। ঢাকার চাঁদার টাকায় সেখানে তিনি আলিশান জীবন-যাপন করছেন। ফেরার হলেও তিনি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারসহ রাজধানীর নানা শ্রেণি- পেশার মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। তার নাম শুনলে অনেকেই প্রাণভয়ে গোপনে চাঁদা দেন। তার নামে প্রতি মাসে উঠছে কোটি কোটি টাকার চাঁদা। তার অধীনে রয়েছে ১৫-২০ জনের অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রকাশ্যে তিনি যেমন ভয়ঙ্কর, পলাতক থাকা অবস্থাতেও একই রকম ভয়ঙ্কর। রাজধানীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের অধিকাংশ এখনো তার নিয়ন্ত্রণে। তাদের দিয়েই তিনি খুন-খারাবির ঘটনা ঘটাতেন। অন্ধকার জগতের মুকুটহীন এই সম্রাটের নাম হলো শাহাদাত হোসেন। মিরপুরের শাহাদাত নামে পরিচিত।
শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ব্যাঙ্গা বাবু ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে বলেছে, তিনি নিজে একাই খুন করেছেন ২৬টি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, কলকাতায়ও শাহাদাতের রয়েছে একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়ার্ড কমিশনার নিউটন হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামি শাহাদাত কলকাতায় রয়েছেন রাজার হালে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। আর এ কারণে কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা বাংলাদেশি অপরাধীদের কাছেও তিনি পরিণত হয়েছেন আতঙ্ক। অধিকাংশ বাংলাদেশি অপরাধী গ্রেফতার হয়েছেন এই শাহাদাতের দেওয়া তথ্যের কারণেই। তার কারণে অনেক অপরাধী কলকাতা থেকে পালিয়েও গেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় তার নাম শাহাদাত হোসেন। বাবার নাম নুরুজ্জামান। স্থায়ী ঠিকানা ১/বি, ৭৯/৮০ শাইনপুকুর রোড, শাহআলী, ঢাকা।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহাদাত। ওয়ার্ড কমিশনার নিউটন হত্যার পর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যান। সেখানে তার বন্ধু খোরশেদ একজন ভাসমান সন্ত্রাসী। বিভিন্ন অপরাধে যৌথ নেতৃত্ব দেওয়ায় এ গ্রুপটির নাম হয়ে যায় খোরশেদ-শাহাদাত বাহিনী। পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রভাবশালী এক ব্যক্তির (পশ্চিমবঙ্গের সাবেক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা) ছত্রছায়ায় রয়েছেন শাহাদাত। সেখানে মাছের খামারসহ বিভিন্ন ব্যবসা করছেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শাহাদাতের সঙ্গে পারিবারিকভাবে দ্বন্দ্ব ছিল মিরপুর গুদারাঘাটের বাসিন্দা টিপুর। টিপু ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের সহযোগী।
তখন ১৯৯৭ সাল। শাহাদাত তখনো সন্ত্রাসী হয়ে উঠেননি। দ্বন্দ্বের কারণে শাহাদাতকে কুপিয়েছিল টিপু। মিরপুর-১ নম্বর এলাকার ‘ডিশ রেজা’র ছোট ভাই শাহীন ছিল শাহাদাতের বন্ধু। প্রতিশোধ নিতে শাহীন ও ডিশ রেজার সহায়তায় ১৯৯৮ সালে টিপুকে গুদারাঘাট এলাকায় খুন করেন শাহাদাত। এভাবেই অপরাধ জগতে পা ফেলে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন শাহাদাত হোসেন। একপর্যায়ে পেশাদার কিলারদের দিয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন বাবু ওরফে ব্যাঙ্গা বাবু।
২০১৩ সালে তিনি গ্রেফতার হন। পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে সরকারি বাঙলা কলেজ ছাত্র রিংকুকে কলেজ মাঠে খুন করে গলা কেটে মাথা নিয়ে যায় ব্যাঙ্গা। ওই বছরেই ব্যাঙ্গা মিরপুরের লাল্টুকে হত্যা করে। ওই বছর বাঙলা কলেজের জিএস ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ আলীকে খুন করে ব্যাঙ্গা বাবু। সেগুনবাগিচার নবাব আলী হত্যা, মিরপুরের নান্টু হত্যা, ছাত্রদল নেতা বিপ্লব হত্যা, মিরপুরের সাবেক কমিশনার তৈয়েবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগ নেতা মাহবুব হত্যা, প্রিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল্লাহ হত্যা, মুক্তিযোদ্ধা শপিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান আফতাব আহমেদ হত্যার হুকুমের আসামি এই ব্যাঙ্গা। মিরপুর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিটুর ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা মামুন হত্যা, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার শওকত হোসেন মিস্টার হত্যা এবং মিরপুর ১ নম্বরের মাসুদ ওরফে গোড়া মাসুদ হত্যা মামলার আসামি এই ব্যাঙ্গা বাবু।
১৯৯৮-৯৯ সালে এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্যাঙ্গা বাবু তার প্রতিদ্বন্দ্বী সারোয়ারকে খুন করে। ওয়ার্ড কমিশনার সাইদুর রহমান নিউটন হত্যা মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও আপিল বিভাগে তিনি খালাস পান।
শাহাদাতের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ওয়ান-ইলেভেনের সময় জরুরি অবস্থা চলাকালে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের কাছে ই-মেইল করেন। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর তিনি তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদের কাছে টেলিফোন করলেও সাড়া পাননি। এরপর তিনি র্যাবের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি। ওই সূত্র জানায়, কলকাতায় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে শাহাদাতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তাদের দিয়েই বাংলাদেশি কিছু অপরাধীকে ধরিয়ে দেন।
হাতুড়ি নজরুল
তেজগাঁও রেলস্টেশন। পূর্ব দিকেই পরিত্যক্ত রেললাইনের পর বেশ কয়েকটি বগি। সেখানেই কাপড় দিয়ে চোখ আর দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা এক যুবককে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ৮-১০ জন তাকিয়ে আছে। তারা অপেক্ষায় তাদের এক বড় ভাইয়ের জন্য। তিনি আসার পর যুবকটির ব্যবস্থা হবে। সন্ধ্যার পর তাদের সেই বড় ভাই সেখানে এসে পেঁৗছলেন। একজন বড় ভাইয়ের হাতে লোহা পেটানোর একটি বড় হাতুড়ি তুলে দিলেন। চোখ বাঁধা যুবকটি তখন অাঁচ করতে পেরেছেন, তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। প্রাণরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আকুতি, মিনতি করে যাচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতুড়ি হাতে নিয়ে সেই বড় ভাই ধীরে ধীরে চোখ বাঁধা যুবকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। সহযোগীরা যুবকটির হাত-পা চেপে ধরে রেলের পাতের ওপর শুইয়ে দিলেন। এরপরই শুরু হলো সেই বড় ভাইয়ের নিষ্ঠুরতা। যুবকটির হাত ও পা রেলের পাতের সঙ্গে পিষে যাওয়া পর্যন্ত হাতুড়িপেটা করেই যাচ্ছিলেন সেই বড় ভাই। একসময় হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া যুবকটির লাশ ফেলে রাখা হয় রেললাইনের পাশে কিংবা কোনো পরিত্যক্ত বগির ভিতর। সেই বড় ভাইয়ের নাম নজরুল। পুরো নাম নজরুল ইসলাম। তিনি রেললাইনের ওপর ফেলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে এমনভাবেই অসংখ্য খুন করেছেন। তার নৃশংসতায় অনেকেই এখন পঙ্গু। খুনের জন্য তিনি পিস্তল বা চাপাতি, রাম দার চেয়ে হাতুড়ি পছন্দ করতেন। তার অধিকাংশ খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে হাতুড়ি দিয়ে।
নিহতদের বেশির ভাগই ছিলেন তার প্রতিপক্ষ আর তেজগাঁও স্টেশন এলাকার অপরাধী। হাতুড়ি পেটানোর এই নজরুল ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গোটা তেজগাঁও এলাকায়। ছোটখাটো দেখতে এই দুর্ধর্ষ অপরাধীকে ভয় করতেন ঢাকার অন্য সন্ত্রাসীরাও। এ ছাড়া তেজগাঁও ফার্মগেট এলাকার সন্ত্রাসীরা তার নৃশংসতাকে ভয় করতেন। নজরুলের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। বাবা ছিলেন রেলওয়ে মাস্টার। তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে তাদের বাসা ছিল।
১৯৮৬ সালে তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে নজরুলের স্কুলপড়ুয়া ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কলোনির মাসুদের মারামারি হয়। একপর্যায়ে একজন আরেকজনকে ছোরা বসিয়ে দেয়। এ ঘটনার জের ধরে কলোনির লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা তখন নিত্যদিনকার ঘটনা। স্থানীয়দের উদ্যোগে সেখানে দুই পক্ষের সমঝোতার বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। এক সন্ধ্যায় বসে সে বৈঠক। কিন্তু বৈঠক চলাকালে স্টেশন এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাতের অাঁধারে বৈঠকেই হামলা চালানো হয়। কুপিয়ে নৃশংসভাবে সেখানে খুন হন মাসুদের বাবা ও ফুফাতো ভাই। এই জোড়া খুনটি পরিকল্পিতভাবেই তখন করা হয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। এই জোড়া খুনের পর থেকেই নজরুল আরও দুর্ধর্ষ হয়ে পড়েন। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, ভাড়াটে হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও তিনি গুণ্ডামি করেছেন। অস্ত্র চালিয়েছেন। ওই এলাকায় তার ওপর তখন আর কেউ ছিলেন না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, এই মাসুদের পরবর্তীতে ছাত্রদলের একজন বড় ক্যাডার হিসেবে নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। যাকে একবার ফার্মগেট এলাকায় কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়েছিল। বিএনপির খরচে তাকে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা করানো হয়। এরপর থেকে তার নাম হয় ল্যাংড়া মাসুদ। আর এই মাসুদকে কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়েছিলেন সুইডেন আসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বিপুল। যাকে পরবর্তীতে আসলাম নিজেই দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে খুন করেন। আর ল্যাংড়া মাসুদ পরে নিহত হন রাজধানীর ডিওএইচএস-এ। মাসুদ হত্যাকাণ্ডেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি গ্রুপের যোগসাজশ রয়েছে।
তেজগাঁও এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নজরুলের অস্ত্রের ভাণ্ডারে প্রচুর অস্ত্র ছিল। কিন্তু তিনি গুলি করার চেয়ে পিটিয়ে হত্যা করতে পছন্দ করতেন বেশি। পেটানোর জন্য তিনি রাখতেন বড় বড় হাতুড়ি। তার অস্ত্রের ভাণ্ডারেও বড় বড় হাতুড়ি থাকত। তেজগাঁও স্টেশন এলাকা ও তার আশপাশ এলাকায় একের পর এক লাশ পড়ে থাকলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারত না। ১৯৮৯ সালের এক রাতে তার প্রতিপক্ষ গ্রুপের সন্ত্রাসীরা তাকে রেলওয়ে কলোনিতেই এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। তার ওই হত্যার মধ্য দিয়েই অবসান ঘটে নজরুলের শাসন। নজরুলের মৃত্যুর পর সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ান চোরা খালেক। তার মৃত্যু পুলিশের নির্যাতনে। এরপর সেখানে এসে দাঁড়ান সেলিম ওরফে রায়পুইরা সেলিম। এই রায়পুইরা সেলিম ওই এলাকায় ফেনসিডিলের গডফাদার ছিলেন। পুলিশ দেখলেই বোমা আর গুলি চালাতেন। তার প্রধান শত্রুই ছিল পুলিশ। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, দূর থেকে তিনি যদি পুলিশের টুপি দেখতে পেতেন, সঙ্গে সঙ্গেই গুলি চালাতেন। তেজগাঁও এলাকার সন্ত্রাসী গেসু ছিলেন সেলিমের সমন্ধি। সেলিমের হাতেই গেসুর মৃত্যু হয়। সেলিমের স্ত্রী পারভীনও পিস্তল চালাতে পারদর্শী ছিলেন।
২০০২ সালের দিকে সেলিম তেজগাঁও থেকে এক দিন যাচ্ছিলেন উত্তরায়। জসীমউদ্দীন রোডের কাছাকাছি পুলিশের চেকপোস্টে পড়ে। পুলিশ দেখা মাত্রই সেলিম গুলি চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেন। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পুলিশের একটি দল তাকে ধাওয়া করে পাকড়াও করে। এরপর জামিনে মুক্তি পেলে পুলিশ আবারও তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। তেজগাঁও এলাকায় তাকে গ্রেফতার করতে গেলে তুমুল বন্দুকযুদ্ধ হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সেলিম।
ডাকাত শহীদ
পুরান ঢাকার কাউন্সিলর যুবদল নেতা আহাম্মদ হোসেনকে ফোন করেন ডাকাত শহীদ। ফোনে তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ‘টুপিওয়ালা, তোর দিন শেষ।’ এ হুমকির তিন মাস পর আহাম্মদ হোসেনের লাশ পড়ে। সূত্রাপুর থানার এসআই গৌতম রায়কে কলকাতা থেকে মোবাইল করেছিলেন ডাকাত শহীদ। ফোনে তিনি এই পুলিশ কর্মকর্তাকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এরপরই পুরান ঢাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় এসআই গৌতম দাসকে।
শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, ডাকাত শহীদ যাকে ফোনে হুমকি দিতেন, তার লাশ পাওয়া যেত রাস্তায় কিংবা নর্দমায়। পুরান ঢাকায় ডাকাত শহীদের অপকর্ম ছিল ‘সন্ত্রাসের কিংবদন্তি’তুল্য। এক যুগের বেশি সময় ধরে পুরান ঢাকার ত্রাস ছিলেন এই শহীদ। কখনো নিজ হাতে মানুষ খুন করেছেন, আবার কখনো তার অদৃশ্য নির্দেশে পড়েছে একের পর এক লাশ। বিদেশে পালিয়ে থেকেও দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ করেছেন আন্ডারওয়ার্ল্ড। তার নির্দেশ মতো চাঁদা না দিলেই জারি হতো ডাকাত শহীদের ‘মৃত্যু পরোয়ানা’। শেষ পর্যন্ত অবসান হলো ডাকাত শহীদ যুগের।
গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, অর্ধশতাধিক খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ডাকাত শহীদ। ডাকাত শহীদের পুরো নাম শহীদুল ইসলাম শহীদ। বাবা মৃত ইসমাইল হোসেন ওরফে আবদুর রহমান। গ্রাম-মাকডাল, থানা- শ্রীনগর, জেলা-মুন্সীগঞ্জ। ইসমাইল হোসেন পেশায় ছিলেন কৃষক। তাই সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারেননি। অবশ্য সেদিকে যেতে ছেলেটির আগ্রহও ছিল কম। তাই সদরঘাটে কুলির কাজ শুরু করেন তিনি। সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা এই কিশোরই একসময় হয়ে ওঠেন নৌ-ডাকাতদের রাজা। সর্বশেষ রাজধানীর বিশেষ করে পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। রাজধানীর পুরান ঢাকার এমন কেউ নেই, যিনি ডাকাত শহীদের নাম শোনেননি। আর এমন ব্যবসায়ী নেই, যিনি ডাকাত শহীদকে চাঁদা দেননি। তবে সামনা-সামনি তাকে দেখা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। সেই ডাকাত শহীদ ২০১২ সালের জুনে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। তার সঙ্গে নিহত হন সহযোগী কালু মিয়া ওরফে পাঞ্চি কালু। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই তার লাশ দেখতে মর্গে ছুটে গেছেন। তবে এই ছুটে যাওয়া কোনো আফসোসের কারণে নয়। মানুষজন সেখানে গেছেন ঘৃণা প্রকাশ করতে। অনেকেই তার লাশের ওপর থুথু ছিটিয়েছেন। তবে ডাকাত শহীদ না থাকলেও রয়ে গেছে তার সহযোগীরা। তারাই এখন চাঁদাবাজি করছে পুরান ঢাকায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ডাকাত শহীদ ২০-২২ বছর বয়সে ১৯৮৮ সালের দিকে সদরঘাটে কুলি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছিঁচকে চুরি করে অপরাধীর খাতায় নাম লেখান তিনি। ধীরে ধীরে শুরু করেন লঞ্চ ডাকাতি। কিন্তু তাকে ধরতে পারে না পুলিশ। তাই তখনই তার নাম হয় ডাকাত শহীদ। এরপর তিনি বিক্রমপুরে বাস শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯৯০ সালে তিনি বাস শ্রমিক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। সে সময় অস্ত্র, গুলি আদান-প্রদান এবং টিকাটুলী এলাকায় রাস্তা থেকে চাঁদা উঠানোর কাজ শুরু করেন। ওই বছরেই একটি ডাকাতি মামলায় মুন্সীগঞ্জ জেলে তিন মাস কাটানোর পর বের হয়ে ১৯৯১ সালে কুয়েতে চলে যান।
১৯৯৪ সালে কুয়েত থেকে দেশে ফেরেন এবং নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান। তখন জুরাইনে আবুল গ্রুপের সঙ্গে অস্ত্রের মাধ্যমে টেন্ডারবাজি শুরু করেন।
১৯৯৮ সাল থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী লিয়াকতের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওয়ারীতে টেন্ডারবাজি শুরু করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরতে হয়নি। অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেই নেতৃত্ব নিয়ে শুরু করেন টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি। জুরাইন থেকেই তার একক নিয়ন্ত্রণের হাতেখড়ি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, জুরাইনে তিনি অন্যের ভাড়াটিয়া হিসেবে জমি দখল করে দিতেন। সঙ্গে চাঁদাবাজি তো ছিলই। তখনই তিনি আলিম কমিশনারসহ দুজনকে খুন করেন। এর কিছুদিন পর তাঁতীবাজারে স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাবা-ছেলেকে খুন করে আলোচনায় চলে আসেন। সবাই তাকে একনামে চিনতে শুরু করেন। নাম বললেই দিয়ে দেন চাহিদা মতো চাঁদার টাকা।
২০০২-০৩ সালের দিকে পূর্ণ উদ্যমে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ট্রাক-বাসস্ট্যান্ড দখল করার কাজ শুরু করেন ডাকাত শহীদ। ২০০৪ সালে ডিবির এসি আকরাম ৫টি অস্ত্রসহ তাকে আটক করেন। ঢাকা কারাগারে এক বছর থাকার পর বের হয়ে আবার চাঁদাবাজি শুরু করেন। র্যাব প্রতিষ্ঠার পর তিনি যশোর গিয়ে আত্মগোপন করেন। সেখানে তিনি ‘আরমান’ নাম ব্যবহার করে চলতে থাকেন।
২০০৫ সালে ভারত সীমান্তের পাশে বাসাভাড়া করে অবস্থান করেন। তখন কালু প্রতি মাসে চাঁদার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে শহীদের কাছে পাঠাত। এরপর তিনি কলকাতার নাগরিক হিসেবে বসতি স্থাপন করেন।এরপর বিভিন্ন সময়ে তিনি নদীয়া, কলকাতা, উড়িষ্যায় অবস্থান করেন।
২০১০ সালে তিনি নদীয়া থেকে নেপালে চলে যান। পরে নিজেকে বাংলাদেশের শিল্পপতি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে সেখানকার একটি মেয়েকে বিয়ে করেন।অসংখ্য খুন, কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়ডাকাত শহীদ কতগুলো খুন করেছেন তার কোনো পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও নেই। শুধু যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে তারই হিসাব দিতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের হিসাবে ৮টি খুনের মামলাসহ দেড় ডজন মামলা ছিল ডাকাত শহীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাস্তবে তার খুনের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ৩৮টি মামলার হিসাব তাদের কাছেই ছিল। আর জিডির সংখ্যা সহস্রাধিক।
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডাকাত শহীদের হাতে যারা খুন হন তাদের মধ্যে আছেন- ওয়ার্ড কমিশনার আলিমসহ দুজন, তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ ও তার ছেলে, অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মণ্ডল, ওয়ার্ড কমিশনার বিনয় কৃষ্ণ, ছাত্রদল নেতা ছগির আহমেদ, যুবলীগ নেতা শিমুল এবং কমিশনার আহাম্মদ হোসেন, কেরানীগঞ্জের ববি, ছাত্রদল নেতা লাসানী।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ ও পরে গেণ্ডারিয়ায় একই দিনে ছয়জনকে হত্যা করেছিলেন এই ডাকাত শহীদ।ডাকাত শহীদের নামে চাঁদা উঠত কোটি কোটি টাকা। নিচে ৫ লাখ আর উপরে ৫০ লাখ।
পুরান ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিল তার শতাধিক ক্যাডার। একেক এলাকা একেকজন নিয়ন্ত্রণ করত। চাঁদা তোলার পর বড় অংশই চলে যেত বিদেশে ডাকাত শহীদের কাছে। আত্মগোপনে থেকেও সহযোগীদের দিয়ে টেলিফোনের মাধ্যমে দেশে নিয়মিত চাঁদাবাজি চালিয়ে যান।
অভিনেত্রী দিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ
একজন অভিনেত্রী দিয়ে পুরান ঢাকার ১০টি এলাকার নিয়ন্ত্রণ করতেন ডাকাত শহীদ। ডাকাত শহীদ এই অভিনেত্রীর মাধ্যমে আন্ডারওয়ার্ল্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদানপ্রদানও করেছেন। প্রায় ৩৫ বছর বয়স্ক ওই অভিনেত্রীর চলচ্চিত্রজগতে বেশ যশ-খ্যাতি ছিল। দীর্ঘদিন ধরে ডাকাত শহীদের হয়ে কাজ করেছেন তিনি।গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পুরান ঢাকায় ডাকাত শহীদের একাধিক গ্রুপ এখনো সক্রিয়। তার গ্রুপে অন্তত ১০০ ক্যাডার এখনো আছে। ডাকাত শহীদের অবর্তমানে বাঙাল সুমন নামে এক সন্ত্রাসী পুরান ঢাকায় তার জায়গা দখল করেছে। এ ছাড়া শুটার বিদ্যুতের লোকজনও চাঁদাবাজি করছে।
ব্যাঙ্গা বাবু
ছেলেটিকে মাটিতে ফেলে কয়েকজন শক্ত করে ধরে রেখেছে। এরপর একজন ধারালো একটি রামদা ওই ছেলেটির গলায় চালিয়ে দিল। রক্ত ঝরছে, ফিনকির মতো। সেই রক্তে ঘাতকদের শরীর ভিজে যাচ্ছে। অসহায় ছেলেটির তখন কী প্রাণপণ চেষ্টা। হাত-পা ছুড়ছিল। গো গো শব্দ বেরোচ্ছে। একসময় হাত-পা ছোটাছুটি বন্ধ হয়ে গেলেও রামদা হাতের যুবকটির জবাই করা যেন শেষ হচ্ছিল না। সে রামদা চালিয়ে যাচ্ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না শরীর থেকে মাথাটা আলাদা না হচ্ছিল। এরপর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা মাথাটা ফুটবল বানিয়ে খেলার চেষ্টা করে।
এটি খোদ রাজধানীর ঘটনা। ১৪ বছর আগে এক রাতে মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের মাঠে এভাবেই নৃশংসভাবে খুন করা হয় একই কলেজের ছাত্র রিংকুকে। ঘাতক রিংকুর মাথা দিয়ে ফুটবল খেলার পর সেটি নিয়ে চলে যায়। আর নিষ্ঠুর এই ঘাতক হলো মিরপুরের বাবু, নাজমুল হাসান বাবু। আন্ডারওয়ার্ল্ডে ব্যাঙ্গা বাবু নামে পরিচিত। রাজধানীর পেশাদার কিলারদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হলো ব্যাঙ্গা বাবু। খুন করা তার নেশা, খুন করা তার পেশা। কখনো জবাই করে, কখনো গুলি করে- দুভাবেই সে খুন করতে পারদর্শী। এমনিভাবে রাজধানীতে সে একাধারে খুন করেছে ২৬টি।
পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র জানায়, একসময় ভালো ফুটবল খেলত এই বাবু। গোলকিপার হিসেবে অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বল ধরত। মিরপুরে তার বন্ধুরা তাকে ব্যাঙ্গের সঙ্গে তুলনা করত। সেই থেকে তার নাম হয় ব্যাঙ্গা বাবু।
সূত্র জানায়, একসময় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল এই ব্যাঙ্গা বাবু। কিন্তু পরবর্তীতে সে নিজেই দল গঠন করে চাঁদাবাজি-খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাঙ্গা বাবু শুধু রাজধানীতেই নয়, ভাড়াটে কিলার হিসেবেও সে খুন করেছে বিভিন্ন জেলায়। ব্যাঙ্গা বাবুর সিরিজ খুনের কারণে পুলিশের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অবশেষে পুলিশের হাতে পাকড়াও হয় এই ব্যাঙ্গা বাবু। স্বস্তি ফিরে আসে পুলিশ বাহিনীতে। গত তিন বছর ধরে এই ব্যাঙ্গা বাবু আটক রয়েছে কারাগারে।
মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাতেম আলীর ছেলে ব্যাঙ্গা বাবু। ছোটবেলা থেকেই বেড়ে উঠেছে রাজধানীর মিরপুর এলাকায়। থাকত শাহ আলী এলাকার সি ব্লকের ৬ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়িতে। ১৯৯৩ সালে তার বাবা মারা যান। তখন থেকে সংসারের হাল ধরে ব্যাঙ্গা বাবু ও তার বড় ভাই। কয়েকটি সেলাই মেশিন কিনে বাসায় বসে জামা তৈরি করে মার্কেটে ও দোকানে বিক্রি করত। ধীরে ধীরে কারখানা গড়ে তোলে। কারখানার ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে গিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকেই মিরপুরের বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে তার ওঠাবসা। সন্ত্রাসী বাহিনী আলী গ্রুপ, নান্টু গ্রুপ, ইকবাল গ্রুপসহ আরও একাধিক দলের সন্ত্রাসীর সঙ্গে চলতে থাকে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ বিভিন্ন গার্মেন্ট মালিক, কর্মী ও বস্তিবাসীর ওপর অন্যায়-জুুলুম-নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই কর্মকাণ্ড চালাত।
১৯৯৯ সালে ব্যাঙ্গা বাবুর ছোট ভাই হিসেবে পরিচিত বাপ্পী ও আকরামের কাছে চাঁদা দাবি করে বসে নান্টু গ্রপের সন্ত্রাসীরা। না দিলে মারধর করে। তারা ব্যাঙ্গাকেও ছুরিকাঘাত করে। পরে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে।
১৯৯৮-৯৯ সালে এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্যাঙ্গা বাবু তার প্রতিদ্বন্দ্বী সারোয়ারকে খুন করার মধ্য দিয়ে খুনি হিসেবে হাত পাকায়।
এরপর ২০০১ সালে ব্যাঙ্গা মিরপুরের লাল্টুকে হত্যা করে। একই বছর সরকারি বাঙলা কলেজের ছাত্র রিংকুকে কলেজ মাঠে খুন করে গলা কেটে মাথা নিয়ে যায় ব্যাঙ্গা। খুনের নেশা পেয়ে বসে ব্যাঙ্গা বাবুকে। ওই বছর বাঙলা কলেজের জিএস ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ আলীকে গুলি করে হত্যা করে।
সেগুনবাগিচার নবাব আলীকেও একই কায়দায় খুন করে। এরপর একে একে খুন করে ছাত্রদল নেতা বিপ্লব, মিরপুরের সাবেক কমিশনার তৈয়েবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগ নেতা মাহবুব, প্রিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা শপিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান আফতাব আহমেদ, মিরপুর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিটুর ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা মামুন, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার শওকত হোসেন মিস্টার, মিরপুর ১ নম্বরের মাসুদ ওরফে গোড়া মাসুদকে। এসব সিরিজ খুনের পর আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করতে থাকে। ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজবাড়ীর স্বরূপচর গ্রাম থেকে ব্যাঙ্গা বাবুকে গ্রেফতার করে গোয়ালন্দ থানা পুলিশ। গ্রেফতারের পর সে মিথ্যা পরিচয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। পরে পুলিশি অনুসন্ধানে তার আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘মহারাজা’ আর ‘যুবরাজ’
আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীরা ’৯০ সালের পর এমনই বেপরোয়া হয়ে পড়ে যে, তাদের লাগাম টেনে ধরাটা একসময় পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড আসামিরা নিজেদের ‘মহারাজা’ আর ‘যুবরাজ’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ করতে থাকে। এক গ্রুপ বহু গ্রুপে পরিণত হয়। আধিপত্য বিস্তারে শুরু হয় গ্যাং কিলিং। খুন পাল্টা খুনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সব খানে। এসব অপরাধী রাজধানী ছাপিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে বিভিন্ন জেলা পর্যন্ত।
খুনাখুনি করতে গ্রুপগুলোর কাছে আসতে থাকে ভয়ঙ্কর সব আগ্নেয়াস্ত্র। মানুষ তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। এমনই এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে সরকার সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রকাশ করে। তাদের ধরিয়ে দিতে ঘোষণা করা হয় পুরস্কার। তবুও সন্ত্রাস থেমে থাকেনি। সন্ত্রাসীরা জেলখানা থেকে কলকাঠি নাড়ছে। কেউ বিদেশে থেকেই চাঁদাবাজি করছে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে বিবেচনা করা হতো সাবেক যুবলীগ নেতা আওরঙ্গকে।একসময়ের জনপ্রিয় এই রাজনৈতিক নেতা কীভাবে নাম লেখালেন আন্ডারওয়ার্ল্ডে তা নিয়ে বিস্তর তর্ক রয়েছে।
একাধিক সূত্র জানায়, ১৯৮১ সালে রাজধানীর সাকুরা বার-এর সামনে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় সেই যুবলীগ নেতা আওরঙ্গের বিরুদ্ধে। এরপরই ভারতে পালিয়ে যান তিনি। এই যুবলীগ নেতা ছাড়াও নব্বইয়ের দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রভাবশালী আরও দুজনের নাম পাওয়া যায়। একজন হলেন লিয়াকত এবং মানিকগঞ্জের মুশফিকুর রহমান হান্নান ওরফে বড় হান্নান। বলা হয়ে থাকে সেসময় এই দুজনই ছিলেন সেই যুবলীগ নেতার প্রধান শক্তি। রাজনৈতিক কারণে তাদের সন্ত্রাসের পথে হাঁটতে হয়।
সূত্র মতে, ১৯৯১ সালে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইন এবং গোলাম রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরের। পুলিশের সূত্র জানায়, আন্ডারওয়ার্ল্ডে আশির দশকের একজন সন্ত্রাসীর অনুপস্থিতিতে তার দলের সদস্যরা সুব্রত বাইন এবং টোকাই সাগরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার নামে দুই ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। সেভেনে স্টারের নেতৃত্ব দেন সুব্রত বাইন। আর ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলেন লিয়াকত। লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেয় পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, আরমান, জিসান, রনি, বিকাশ, প্রকাশ, নিটেল, আলাউদ্দিন, কিলার আব্বাস, আগা শামীম, কাজল এবং অশ্রু। অন্যদিকে সুব্রত বাইনের সেভেন স্টার বাহিনীতে যোগ দেয় মুরগি মিলন, তানভীরুল ইসলাম জয়, টোকাই সাগর, ইমাম হোসেন ইমাম, মোল্লা মাসুদ, সাইদুর রহমান নিউটন, তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ, তানজিল, কচি, টিক্কা, আসিফ, কালা লিয়াকত, জরিফ, নাটকা বাবু, মুরাদ, মানিক, চঞ্চল, জুলু এবং জন। তারা সবাই তখন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একেকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী।
লিয়াকতের সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুইডেন আসলাম হাত মেলায় সুব্রত বাইনের সঙ্গে। আর এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শক্তি বাড়ে সুব্রত বাইনের। এ দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলতে থাকে গ্যাং কিলিং। একই সময় সুব্রত বাইনের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান গোপীবাগের ‘সন্ত্রাসী’ আসিফ। যোগ দেন লিয়াকত গ্রুপে। ২০০০ সালের ২৯ আগস্ট খুন হন আসিফ, তার বডিগার্ড গিয়াসউদ্দিন টিপু এবং সহযোগী রিপন। খিলগাঁওয়ের ৪৪৬/সি নম্বর বাড়ি থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই গ্যাং কিলিংকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপই দল ভারি করতে থাকে। বাড়াতে থাকে অস্ত্রশস্ত্র।
ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে আসতে থাকে অত্যাধুনিক অস্ত্র। সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পিচ্চি শামিম এবং টোকাই মিজান এ সময় যোগ দেয় লিয়াকতের গ্রুপে। সুব্রত বাইন এবং লিয়াকত গ্রুপে চলতে থাকে খুন-পাল্টা খুন। নিজ নিজ দলের কলহেও মারা যায় বেশ কজন। এই দুই গ্রুপের কলহ আর আন্ডারওয়ার্ল্ডে ক্ষমতা দখলের বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে ২০০০ সালে। এ সময় সেভেন স্টার এবং ফাইভ স্টার গ্রুপ ঢাকা সিটি করপোরেশনের টেন্ডার দখলের জন্য জড়িয়ে পড়ে প্রকাশ্য বন্দুকযুদ্ধে। দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে মারাত্মক আহত হয় টোকাই মিজান। পাঁচটি বুলেট লাগলেও বেঁচে যায় সে। আর এ সময়ই দুই গ্রুপের সংঘর্ষ মারাত্মক আকার ধারণ করে। চলতে থাকে খুন-পাল্টা খুন।
২০০০ সালের ১৮ মে পুরান ঢাকার জজ কোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনকে। সেভেন স্টার গ্রুপের পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর এবং ডাকাত শহিদ এই হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেয়। পুলিশের একাধিক সূত্রের মতে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে যে সোনা চোরকারবারি হতো, তার নেতৃত্ব দিত মুরগি মিলন। ফাইভ স্টার গ্রুপের সঙ্গে একসময় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এমন একজন জানান, লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে থাকলেও একসময় দলের সঙ্গে বেইমানি করে টিক্কা। গোপনে সাহায্য করতে থাকে সেভেন স্টার প্রধান সুব্রত বাইনকে।
২০০১ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয় টিক্কা। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু ঘটে। সন্ত্রাসী জগৎ থেকে বেরিয়ে আসা অনেকেই জানান, একসময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের এসব ‘ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা’ দুটি গ্রুপে ছিল। এক সময় অনেক নামে ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। ব্ল্যাক প্যান্থার, টাইগার, পাইথন আর কোবরা। ভয়ঙ্কর বিষধর হিংস্র প্রাণীর নামে গড়ে ওঠে নানা বাহিনী।
ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড ১৩টি ভাগে ভাগ করে চলতে থাকে সন্ত্রাসী কাজ। রাজধানীর কলাবাগান, গ্রীন রোড, পান্থপথ, সোবহানবাগ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তানভীরুল ইসলাম জয়। সুইডেন আসলামের দখলে থাকে ফার্মগেট, নিউ ডিওএইচএস, রাজাবাজার, তেজতুরিবাজার ও কারওয়ানবাজারের একাংশ। মিরপুরের ডন বনে যান বিকাশ কুমার বিশ্বাস আর তার ভাই প্রকাশ কুমার বিশ্বাস। আর মোহাম্মদপুরের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের হাতে এবং আরেক অংশের দখল নেয় ছাত্রদল নেতা পিচ্চি হেলাল।
১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে জোসেফ গ্রুপের মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কাঁঠালবাগান, কারওয়ানবাজারের একাংশ, হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোডের দখল নেয় পিচ্চি হান্নান। হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকা, রায়েরবাজার এবং জিগাতলার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দখল নেয় লেদার লিটন, সিদ্ধেশ্বরীতে খুরশিদ আলম রাশু, ধানমন্ডি, রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুরের একাংশে ইমন, মিরপুরের একাংশে কিলার আব্বাস, মিরপুর ও পশ্চিম কাফরুল এলাকায় কালা জাহাঙ্গীর এবং জুরাইন, পোস্তগোলা ও গেণ্ডারিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকে কমিশনার শাহাদাতের হাতে।
পরে কালা জাহাঙ্গীর বাহিনীর হাতে কমিশনার শাহাদাত খুন হলে তার এলাকার নিয়ন্ত্রণ পায় কালা জাহাঙ্গীর। এ ছাড়া পুরান ঢাকায় আগা শামিম এবং ইস্কাটন, মৌচাক, মগবাজার ও বাংলামোটর এলাকার নিয়ন্ত্রণ থাকে লিয়াকত-হান্নান বাহিনীর হাতে। সন্ত্রাসীদের মধ্যে এ সময় শুরু হয় খুন পাল্টা খুন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে দিনে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয় সন্ত্রাসীরা। চাঁদাবাজি খুনসহ নানা অপরাধে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের এমন টালমাটাল সময়ই আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ১৯৯৮ সালে সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রকাশ করে। পরে ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামের তালিকা প্রকাশ করে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কালা জাহাঙ্গীর, প্রকাশ বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, সুব্রত বাইন, পিচ্চি হান্নান, আলাউদ্দিন, আগা শামিম ও আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১ লাখ টাকা এবং লিয়াকত ও তার ছোট ভাই কামরুল হাসান ওরফে হান্নানসহ ১২ জনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে গণপিটুনিতে মারা যান আলাউদ্দিন।
তেজগাঁওয়ে পুলিশ কর্মকর্তা এএসআই দিনেশ কুমার বিশ্বাসসহ তিনজনকে গুলি করে পালানোর সময় তার মৃত্যু ঘটে। তালিকা প্রকাশের আগে থেকেই কারাগারে রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী মোহাম্মদপুরের পিচ্চি হেলাল। পুরস্কার ঘোষিত অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী মশিউর রহমান কচি ২০০৫ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতের আদেশে মুক্তি পায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, টোকাই সাগর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। বিকাশ-প্রকাশ এখন ফ্রান্সে। সুব্রত বাইন কলকাতায় কারাগারে। সুব্রত বাইনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মোল্লা মাসুদও রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কারাগারে।
লিয়াকত হোসেন ২০০৩ সালের ২ অক্টোবর গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে ২২ বার আটকাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ওই বছরই লিয়াকতের পরিবার আটকের বিরুদ্ধে রিট করে।
২০০৮ সালের আগস্টে আদালত আটকাদেশ অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পান লিয়াকত হোসেন।
মুক্তির দুই মাস পর কলাবাগানের বাসা থেকে লিয়াকত হোসেন গুম হন। পরিবারের অভিযোগ, র্যাব সদস্যরা বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ লিয়াকত।
পুরস্কার ঘোষিত অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভীরুল ইসলাম জয় মালয়েশিয়া আর কানাডায় যাতায়াতের মধ্যে রয়েছেন। তালিকাভুক্ত এসব সন্ত্রাসীর মধ্যে কারাগারে আছেন খোরশেদ আলম রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, নাঈম আহমেদ টিটন, ফ্রিডম সোহেল, কিলার আব্বাস, আরমান, কামাল পাশা, মামুন ও ইমন। তালিকার শীর্ষে থাকা কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন তা নিয়ে নানা ধরনের তথ্য রয়েছে। ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাসী সম্পর্কে কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।অবশ্য, ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কামরুল হাসান হান্নান। ২৩ জনের তালিকায় তার অবস্থান ছিল ২০ নম্বর। ১৯ নম্বরে ছিলেন তার বড় ভাই দীর্ঘদিন থেকে গুম যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা লিয়াকত হোসেন। হান্নানের পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: বাংলাদেশ প্রতিদিন
ভাই খুবই তথ্যবহুল,অনেক ভালো লাগল
best article
Top terror halim ke niya likhen Mohammadpur er