Thursday, November 19, 2009

হিলারি ম্যানটেল

0 comments

অসাধারণ সৃষ্টির উপাদান ও উপাত্তের কোনো কাল নেই। প্রাচীনতম বস্তুর ভেতরে যদি নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য আমরা খুঁজে পাই তাহলে আলোড়িত হয়ে উঠি, নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দে আমরা পুলকিত হই। আমাদের দেখার পরিধি বিস্তৃৃত হয়। যিনি দেখান তাকে বাহবা দিয়ে আমরা ধন্য হই। তেমনি ইতিহাসের এক চিরচেনা ঘটনাকে নতুন করে উপস্থাপন করেছেন হিলারি ম্যানটেল, তার উপন্যাস ওল্ফ হল'র মধ্য দিয়ে। তার অসাধারণ কল্পনাশক্তি, সাবলীল লেখনি শৈলির পথ ধরে মানটেল দ্রুত হেঁটে গেছের ইতিহাসের পাতায়; পাঠককে টেনে নিয়েছেন সঙ্গে। তাই মান বুকার পুরস্কারটিও ললনার সুগঠিত পায়ের আলতায় অাঁকা আল্পনা হয়ে ধরা দিয়েছে।

হিলারি মানটেলের নবম উপন্যাস ওল্ফ নিয়ে আলোচনা করতে হলে পঞ্চদশ শতাব্দির ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিতির প্রয়োজন পড়বে। অনেকগুলো কারণে ইংল্যান্ডে রাজা অষ্টম হেনরীর শাসনামল স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৪৯১ সালে রাজা সপ্তম হেনরি এবং এলিজাবেথ অব ইয়র্কের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন অষ্টম হেনরি। ভাই বোনের মধ্যে ষষ্ঠ ছিলেন তিনি। হেনরির ভাই বোনের মধ্যে তিনজন মাত্র শৈশব পার করতে পেরেছিলেন। হেনরির বড় ভাই আর্থার ১৫০২ সালে ১৫ বছর বয়সে মারা গেলে হেনরিই প্রিন্স অব ওয়েলস হিসাবে অভিষিক্ত হন। আর্থারের স্ত্রী ছিলেন স্পেনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রানী ইসাবেলার কনিষ্ঠ কন্যা ক্যাথেরিন অব অরাগন। তার মৃত্যুর পর হেনরির পিতা স্পেনের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ক্যাথেরিন অব অরাগনকে হেনরির সঙ্গে বিয়ে দেন।
হেনরি মোট ছয়টি বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়েকে ঘিরেই ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ব্যাপক ঘটনাবলী জন্ম নেয়। ১৫০৯ সালে ক্যাথেরিনকে বিয়ে করলেও হেনরি তাকে ১৫৩৩ সালে তালাক দেন। হেনরি সে বছরই আনে বোলিনকে গর্ভাবস্থায় বিয়ে করেন। আনে বোলিনের গর্ভে এলিজাবেথ নামে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। হেনরি আনেকে অবিশ্বাসের কারণে ১৫৩৬ সালে মৃত্যুদ- দেন। মৃত্যুদ- কার্যকরের এক মাস পার না হতেই তিনি জেইন সেমুরকে বিয়ে করেন। এই সেমুরের গর্ভেই অষ্টম হেনরীর একমাত্র পুরুষ উত্তরাধিকারী এডোয়ার্ডের জন্ম হয়। ১৫৪০ সালে হেনরি জার্মান প্রিন্সেস আনে অব ক্লেভেসকে বিয়ে করেন। নিষ্কণ্টক হয়নি সে বিয়েও। ওই বছরই তিনি ক্যাথেরিন হাওয়ার্ডকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাকেও দু' বছর পর মৃত্যুদ- প্রদান করেন। শেষ বিয়েটি তিনি করেন ১৫৪৩ সালে ক্যাথেরিন পারকে। হেনরি ছিলেন শৈল্পিক বোধ ও নিষ্ঠুরতার এক অদ্ভুত সমন্বয়। তিনি ছিলেন গোরা ক্যাথলিক। আবার রোমান চার্চের সঙ্গে তিনি ইংল্যান্ডের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সে সময় এটি ছিল এক অবিশ্বাস্য পদক্ষেপ। রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে ইংল্যান্ডের চার্চের সম্পর্ক ছিন্ন করার পেছনে ছিল বোলিনকে বিয়ে। একটি সময় হেনরি অস্থির হয়েছিলেন এক পুত্র সন্তানের জন্য। শিল্প ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সমঝদার কাউকে পথের কাটা মনে করলে মৃত্যুদ- দিতে সামান্য কুণ্ঠা বোধ করতেন না। হেনরি ছিলেন ভয়ানক রকমের প্রোটেস্ট্যান্ট বিরোধী। কিন্তু বর্তমান ইংল্যান্ডেও শ্রুতি আছে যে তিনি মৃত্যুকালে প্রোটেস্ট্যান্ট হয়ে উঠেছিলেন। ইংল্যান্ডে তখন রানীকে তালাক দেয়া আর চার্চকে তালাক দেয়া ছিল সমান কথা। তার উপর চার্চের সঙ্গে সমঝোতা করেই প্রথম স্ত্রীর বিয়েটা সব পক্ষ, অর্থাৎ হেনরির পিতা ও স্পেনের রাজা মিলে ম্যানেজ করেছিলেন। কারণ চার্চের মত ছিল, মৃত ভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে করতে হলে সারা জীবন সন্তানহীন থাকতে হবে। যদিও ক্যাথেরিন অব অরাগন দাবী করেছিলেন, তার সঙ্গে আর্থারের বিয়েটা দৈহিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়নি।
মজার বিষয় হল, হিলারি ম্যানটেল সেই সময়কে দেখিয়েছেন অতি সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে আসা থমাস ক্রমওয়েলের মধ্য দিয়ে। যার ফলে হিলারির উপন্যাসে রাজপ্রাসাদ থেকে রাস্তা সমানভাবে উপস্থিত। ক্রমওয়েল ছিলেন রাজার প্রধান উপদেষ্টা। ১৯৪০ সালে ক্রমওয়েলকে রাজা মৃত্যুদ- প্রদান করেছিলেন। ম্যানটেলে উপন্যাসের মূল চরিত্র রাজা অষ্টম হেনরি নয়, ক্রমওয়েল। ম্যানটেল ক্রমওয়েলকে ষোড়শ শতাব্দির উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব বলে প্রমাণ করেছেন তার উপন্যাসে। অবশ্য ইতিহাসবিদরাও মনে করেন ক্রমওয়েল ছিলেন মধ্যযুগের এক জিনিয়াস প্রশাসক। নিষ্ঠুর হেনরির পাশে অবস্থান করে ক্রমওয়েল হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যান্ডের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। একদিকে অসাধারণ আবেগ অন্যদিকে বিচক্ষণতা, শত্রু থমাস মোরকে মৃত্যুদ- প্রদান-এই বৈপরিত্যের মাঝেও ক্রমওয়েলকে বুঝতে পাঠকের কোনো অসুবিধাই নেই। অতি সূক্ষ্ম বিষয়গুলো ম্যানটেল চিত্রায়িত করেছেন সাবলীলভাবে। অনেকে বিয়ের কারণে, বিয়ের বৈধতা প্রশ্নে রাজাকে ইংল্যান্ডের হেড অব দি চার্চ পদে শপথ করাতে অস্বীকার করেন থমাস মোর। সে কারণেই মোরকে মৃত্যুর স্বাদ পেতে হয়। রাজা পোপদের হাত থেকে চার্চকে মুক্ত করেন। কিন্তু থমাস মোর কে? তিনি কী ইংল্যান্ডের চার্চ সমাজের আদর্শকে সমুন্নত রাখতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? ম্যানটেল বলছেন, না। থমাস মোর তার ক্রীতদাসকে নিষ্ঠুরভাবে পেটাতেন। তার নিজের স্ত্রীর প্রতি ছিলেন নির্দয় এবং প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে অমানবিক অত্যাচার করতেন।
বালক ক্রমওয়েলের জীবনের হৃদয় বিদারক এক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে হিলারি ম্যানটেল তার উপন্যাস শুরু করেছেন-
ুঝড় হড় িমবঃ ঁঢ়!চ্ ডধষঃবৎ রং ৎড়ধৎরহম ফড়হি ধঃ যরস, ড়িৎশরহম ড়ঁঃ যিবৎব ঃড় শরপশ যরস হবীঃ. যব ষরভঃ যরং যবধফ ধহ রহপয ড়ৎ ঃড়ি, ধহফ সড়াবং ভড়ৎধিৎফ, ড়হ যরং নবষষু, ঃৎুরহম ঃড় ফড় রঃ রিঃযড়ঁঃ বীঢ়ড়ংরহম যরং যধহফং ড়হ যিরপয ডধষঃবৎ বহলড়ুং ংঃধসঢ়রহম ুডযধঃ ধৎব ুড়ঁ, ধহ ববষ?চ্ যরং ঢ়ধৎবহঃ ধংশং. ঐব ঃৎড়ঃং নধপশধিৎফ, মধঃযবৎং ঢ়ধপব ধহফ ধরসং ধহড়ঃযবৎ শরপশ........
ুখড়ড়শ হড়,িষড়ড়শ হড়,িচ্ ধিষঃবৎ নবষষড়ংি. ঐব যড়ঢ়বং ড়হ ড়হব ভড়ড়ঃ, ধং রভ যব রং ফধহপরহম. ুখড়ড়শ যিধঃ ও যধাব ফড়হব. ইঁৎংঃ সু নড়ড়ঃ, শরপশরহম ুড়ঁৎ যবধফ.চ্
পাটনির মদ্যপ কামার পিতা এর পরের প্রায় ১৪টি পাতায় ম্যানটেল ক্রমওয়েলকে বর্ণনা করেছেন ইতালীয় কুক থেকে সেনা পর্যন্ত নানা পেশায়। এবং নিয়ে গেছেন নিষ্ঠুর হেনরির দরবারে। ক্রমওয়েল সাধারণ মানুষের জন্য ইংল্যান্ডকে বসবাস উপযোগি করে তুলতে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলে আমৃত্যু। সেটা যেমনি ইতিহাসের সত্য তেমনি উঠে এসেছে ম্যানটেলের উপন্যাসে। নিজে ক্রমওয়েল যে সমাজ থেকে উঠে এসেছিলেন সেই সমাজকে অভিজাত, দুর্নীতিবাজ চার্চের অধিকর্তাদের হাত থেকে রক্ষার একটি প্রচেষ্টা গোটা উপন্যাসেই চিত্রিত আছে। রাজা হেনরির উপর ক্রমওয়েলে প্রভাব এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে নিজে গোড়া ক্যাথলিক হয়েও রাজা অনেক বিষয়েই চার্চের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। হেনরির সবগুলো বিয়ের মধ্যে আনে বোলিনকে বিয়ে করা নিয়েই সবচেয়ে বড় ঝড়টি উঠেছিল। উপন্যাসের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে আনে বোলিনকে বিয়ের ঘটনাবলী। ক্রমওয়েল আনেকে গভীরভাবে পছন্দ করতেন, আবার আনেকে হেনরির বিয়েতে ক্রমসওয়েল সমর্থন যুগিয়েছেন। হেনরি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা, সহিষ্ণুতা, বিবেক, বিচক্ষণতায়। নিজের ব্যক্তি জীবনের এই চর্চাই তাকে ক্ষমতার দোড়গোড়ায় নিয়ে এসেছিল।
অষ্টম হেনরি এবং আনে বোলিনের রোমাঞ্চকর বিয়ে নিয়ে অনেক গল্প এবং কাহিনী ইংরেজি সাহিত্যে রচিত হয়েছে। তার অধিকাংশ কাহিনী হয় পুরোটাই ইতিহাস নির্ভর অথবা ভিত্তিহীন কল্পনা। কিন্তু ম্যানটেলের এই উপন্যাস অষ্টম হেনরি, হেনরির উপদেষ্টা থমাস ক্রমওয়েল, ইটউডর ইংল্যান্ডের রাজ কর্মচারী এবং চার্চ সমাজ সম্পর্কে দিয়েছে নতুন পাঠ। পেছনের কাহিনীসহ ম্যানটেল ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করেছেন নিপুণ হাতে। মধ্যযুগের ইংরেজ সমাজের কুসংস্কার এবং তার প্রভাব ম্যানটেল তার উপন্যাসে সফলভাবে উপস্থাপন করেছেন।
ম্যানটেলের উপন্যাস ওল্ফ হলের আলোচনা করতে গিয়ে অনেক আলোচক দুটি নেতিবাচক দিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ম্যানটেল ব্যাকগ্রাউন্ড ঠিক রাখতে গিয়ে যে বংশ পরিচয় তুলে ধরেছেন তা কিছুটা একঘেয়েমি এনে দিয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু এ ধরণের একটি ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসে ব্যাকগ্রাউন্ড এক অপরিহার্য অংশ। সেই ব্যাকগ্রাউন্ডকে উপেক্ষা করে রচনাকে শক্তিশালী করে তোলা প্রায় অসম্ভব কাজ। দ্বিতীয়ত ম্যানটেলের উপন্যাসে বিশেষণের মাত্রা চোখে পড়ার মত বলে অনেকে মনে করেন। ইংরেজি সাহিত্যে বরাবরই বিশেষণের ব্যবহার প্রাবল্য লক্ষ করা যায়।
২০০৯ সালের মান বুকার শর্ট লিস্টে ছিলেন, এ, এস বাইয়াট, জেম্স কোয়েৎসি, অ্যাডাম ফোল্ডস, সাইমন মাওয়ার এবং সারাহ ওয়াল্টারের নাম। কিন্তু ভুল করেননি অথোরিটি-অন্তত অনেকে তাই মনে করেন। টিউডর বংশের শাসন নিয়ে এ ম্যান অব অল সিজনস, আনে অব এ থাউজেন্ড ডে'জ, দি টিউডরস এর মত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ম্যানটেল এই চিত্রটি অাঁকতে সক্ষম হয়েছেন যে হেনরি ৬টি বিয়ে করলেও, সে বিয়ের পেছনে অনেক নিষ্ঠুরতা-অনেক ঘটনা প্রবাহ থাকলেও তিনি ভয়ানক যৌন পিপাসু কোনো রাজা ছিলেন না। হেনরির অন্দর মহলকে যেভাবে ম্যানটেল তুলে এনেছেন তা পাঠক সমাজ এক কথায় মেনে নিয়েছে।

0 comments:

Post a Comment