Thursday, November 19, 2009

মামুন রশীদ নব্বইয়ের দশকের কবি

0 comments
মামুন রশীদ নব্বইয়ের দশকের কবি। তিরিশের দশকের বাংলা কবিতাকে যে করে রাহুগ্রাসের মতই নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা গ্রাস করে নিয়েছিল আর যে কারণেই জীবনানন্দ দাশের আর্তনাদ, 'ছিঁড়ে গেছি_ ফেঁড়ে গেছি_ পৃথিবীর পথে পথে হেঁটে হেঁটে', সুধীন দত্তের বুকভাঙা আকুতি 'ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে' দেখে-শুনে আমরা নিজেরাও তলিয়ে ছিলাম অসীম নিঃসঙ্গতার পীড়নে। বাংলা কবিতার এই নৈরাশ্য ও নৈরাজ্য চলেছে পঞ্চাশের দশক অবধি। তারপরেই ষাটের দশকে কবিতা বিশেষত; বাংলাদেশের কবিতায় আসে প্রকট দেশ ও জাতি চেতনা এবং 'মৃত্তিকামুখী সমাজদৃষ্টি'। সত্তরের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলা কবিতাকে আরও বেশি দেশ ও জাতীয় প্রশ্নে পাটফর্মমুখী করে তুলেছিল। মাঝের আশির দশকের স্বৈরশাসনের পীড়নে বাংলা কবিতা ফের তিরিশের কবিদের একাংশের মতই মিথমুখী ছিল। তবে পার্থক্য ছিল_ তিরিশের কবিদের মত তারা আকণ্ঠ নিঃসঙ্গতায় ডুবে ছিলেন না_ উত্তরণের আশা ছিল ভিতরে। যার কারণেই নব্বইয়ের দশকের প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্র আসতেই বাংলা কবিতায় একঝাঁক তরুণ কবির আগমন ঘটে। যারা পূর্বসূরিদের অস্বীকার করেনি বরং তাদের অর্জন এবং নিজেদের নিরন্তর সাধনায় গড়ে তোলেন বাংলা কবিতার একটি নতুন চৌহদ্দি। এর অব্যহতি পরেই আরেকটি দশকের আগমন। এই দুইয়ের চৌহদ্দির মাঝের কবি মামুন রশীদ।
মামুন রশীদের মেধা, মনন ও আত্মজিঙ্গাসার শৈল্পিকরূপ 'কুশল তোমার বাঞ্জা করি (ফেব্রয়ারি ২০০৯)। কবির এটি দ্বিতীয় কাব্য। কাব্যের নামকরণেই কবির পুরোভাবনার ফ্লাশ রয়েছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দাপুটে আগ্রাসনে, মানুষের বিকাশের সকল সম্ভাবনা বিজ্ঞানের কব্জায় চলে যাওয়ায় এখন মূলত অনুভূতিহীন জড়পদার্থ_ মায়ামমতা, প্রেম, বিশ্বাস হারিয়ে বিষময় নিঃসঙ্গতায় পতিত মানুষগুলো যেন এলিয়টের মতই দীর্ঘশ্বাস ফেলছে 'হড়ঃযরহম রিঃয হড়ঃযরহম্থ। সময়ের এই চরম সংকটে দাঁড়িয়ে, 'বিরূপ বিশ্বে নিয়ত একাকী' জেনেও কবি মামুন রশীদের আস্থা মানুষের প্রতিই_ মানুষের মঙ্গল, শুভ, কল্যাণ কামনা তাঁর বাঞ্জা। ইতিহাস ও সময়চেতনা মামুনের কবিতার প্রাণ_ সময়ের ভূগোল ঘুরে তিনি সব খুঁটিনাটি জেনেছেন_ জেনেছেন সাধারণের জীবন, দেখেছেন তাঁর দেশ, সবচেয়ে বড় করে তাকিয়েছেন যেন নিজের সত্তার দিকে_ কীভাবে সময়ের সংকটে আপাদমস্তক মুষড়ে পড়ছেন। মানুষের লড়াই করার শেষ শক্তিটুকুও যেন সময়ের প্রহারে ক্ষত-বিক্ষত হতে চলছে। তবু তিনি বাঁচবেন, হারবেন না যেন সময়ের ভয়ানক আগ্রাসনের কাছে_ কোনতেই তিনি হারাবেন না তাঁর পূর্বপুরুষের স্মৃতি, এবং বাস্তুভিটার আদিমগন্ধ। যে করণেই 'মুকুরে প্রতিফলিত মুখ কখনো সত্য বলে না' জেনেও কবি বলেন 'তবু আমরা আস্থা রাখি বারবারই মুকুরেই।' সময়ের প্রহারে রক্তাক্ত কবি জীবনানন্দের নাটোরে ফেরার মতই যেন মামুন রশীদও শেষে বগুড়া ফিরে আসেন শান্তির খোঁজে_

সকল ভ্রমণ শেষে বগুড়ায় ফিরে যেতে সাধ হয়।
অসংখ্য মানসীর ভিড়ে তুমি যেমন স্থির দাঁড়িয়ে থাকো
যেনো কোনো পোট্রেট! নিখুঁত পটুয়ার আঁকা। ডান ভ্রুর পাশে
কালের জন্ম-দাগ। ট্রেন ছেড়ে দেবার শেষ হাসি।
(সকল ভ্রমণ শেষে)

কবি মামুন রশীদ সময়ের কাছে দায়বদ্ধ কবি। মামুন রশীদই বা কেন, যে কোন সৃষ্টিশীল মানুষই সময়ের কাছে দায়বদ্ধ_ কেননা সে যে সময়ের-ই প্রতিভূ। তবে কালচক্রে কবির দায়বদ্ধতারও রকমফের ঘটে।
মামুন রশীদের স্বাতন্ত্র্যের জায়গা হল গতির জায়গাতে। গতির উপর কবি চরম আস্থাশীল। অস্বাভাকি গতিতে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন, চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ, চিন্তা-চেতনা। প্রযুক্তির সাথে জীবনের যোগ এতটা প্রকট হয়ে উঠেছে, গোটা বিশ্ব এখন নাকি 'গোবাল ভিলেজ'। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের নাম করে মানুষকে ঠেলা হচ্ছে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে_ এই প্রতিযোগিতা মানুষ তাঁর নিজের সাথে, আত্মজা ও স্বজনের সাথে, চারপাশের মানুষের সাথে, বহির্বিশ্বের সকলের সাথে। জীবনের এই গতিই মামুন রশীদের কবিতার গতি। কবি নিজেও আর স্থির থাকতে পারছেন না, চাইলেও পারছেন না। সময় কবিকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। অস্থিরতা, প্রাণান্ত ছুটে চলা মানুষের জন্যে নিয়তির মতই সত্য বলে কবি ভাবেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত মানুষ কতদূর আগায় কিংবা কতদূর আগাতে পারে? মামুন রশীদের কাছে নিজের দেহটাই যেন 'অজন্ম বোঝা'। তাঁর আক্ষেপ, 'যদি চলে যাওয়া যেতো দেহ ছেড়ে।' বেদনার সঙ্গে কবি অনুভব করেন, 'বহু পথ পেরিয়ে তৃষ্ণার মুখোমুখি মনে হয় নদী শুষে মরুভূমি করে গড়ি নিরাপদ বালুচর।' কবির এগিয়ে যাবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা শেষপর্যন্ত করুণ শূন্যতায় পতিত হয়।

যতো দৌড়ে পালাতে চাইছি ততো বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন
মুদ্রায় ডাকিনীর তীব্র চিৎকার ঘিরে ফেলছে। পালাতে চাইছে প্রাণপণ।
পেছনে ফেলে যেতে চাইছি আমার দেখা যাবতীয় দৃশ্য। সীমাহীন
গতিতে শরীর থেকে বেরিয়ে নিখিল ব্রহ্মা-ের দিকে প্রসারিত করে দিতে
চাইছি হাত। অথচ কে যেনো বার বার আমার হাত ভূতের পায়ের মতো
পেছনে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে।
(তোমার কীর্তনে কৃতার্থ দোহার)

বাস্তব সরে সরে গেলে কবি কিন্তু হতাশ হন নি বরং ফিরে গেছেন জীবনের ভিন্ন মাত্রায়-সেখানেও বালুচরে বাধা পড়ে গেলে ফের নতুন শুরু করেন যাত্রা।
কবিতায় শব্দ ব্যবহারে কবি মামুন রশীদ এতটাই কৌশলী এবং এতটাই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, নিছক প্রশংসা করলে যথেষ্ট বলা হয় না, বরং নিন্দুকেরও বলতেই হবে 'নতুনত্বেরও দাবিদার'। তাঁর কবিতায় শব্দ এসেছে শব্দের মর্জিতে, জোরজবরদস্তি করে বা বেহিসাবে নয়। অপ্রচলিত, আটপৌরে, বর্তমান সময়ে অব্যবহৃত কোন শব্দই চোখে পড়ে না।
প্রত্যেক কবিকে একটি নির্মাণশৈলী গড়ে নিতে হয়। তিরিশের দশকের কবি জীবনানন্দ দাশ আমাদের সামনে নিয়তির মত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোন শক্তিতে_ সময় ও ইতিহাসকে অপূর্ব সমন্বয় করতে পেরেছিলেন বলেই।
মামুন রশীদ বয়সে তরুণ_ সামনে তাঁর অফুরান সময়। শব্দ চয়নে, নির্মাণ কৌশলে, চিন্তার স্বাতন্ত্র্যে মামুন রশীদ বাংলা কবিতায় যে সম্ভাবনার বীজ রোপণ করলেন মাত্র দু'টি কাব্যেই, সেই বীজ একদিন প্রকা- বৃক্ষ হবে, সেই বৃক্ষে অমৃত ফলবে_ এই প্রত্যাশা থাকল।

0 comments:

Post a Comment