Sunday, June 27, 2010

পলাশী-পরিক্রমা

0 comments
বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসার পলাশীর যুদ্ধকে গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর অন্যতম মনে করেন। তাঁর এ মতের সঙ্গে কারও দ্বিমত পোষণের অবকাশ খুব কম। তবে বিশ্বখ্যাত এ যুদ্ধটি রণাঙ্গনে দেখি এক ভিন্নরূপ। পলাশীতে যুদ্ধ হয়নি বললেই চলে। ২৩ জুন ১৭৫৭। সুবা-বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের অদূরে পলাশী নামক গ্রামের প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের সেনাবাহিনী ও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজদৌল্লার বাহিনী একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থান। সকাল নয়টায় যুদ্ধ শুরু, বিকেল চারটার মধ্যেই যুদ্ধ শেষ। এ সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের আপাতত ফলাফল ক্লাইভের জয়, সিরাজদ্দৌলার পরাজয়। পলাশী যুদ্ধসংক্রান্ত দলিলপত্র এত ব্যাপক যে, এর ভিত্তিতে এ যুদ্ধের একটি ঘণ্টাওয়ারী বিবরণ দেওয়া সম্ভব। এ সংক্ষিপ্ত পরিক্রমায় পলাশী যুদ্ধের একটি মাঠভিত্তিক বিবরণ আর সমকালীন বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পলাশী যুদ্ধের প্রভাব দেখানো হলো।
১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষ্মবাগ নামে আম্রকাননে এসে তাঁবু গাড়েন। বাগানের উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। এর উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন। গভীর নালা দিয়ে ঘেরা। সুন্দর প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। নবাবের বিশাল বাহিনীর বিভিন্ন শাখার নেতৃত্বে মীরমদন (গোলন্দাজ প্রধান), মোহনলাল কাশ্মিরী, ইয়ার লতিফ খান, মীরজাফর। ইংরেজ বাহিনীর চেয়ে পাঁচগুণ বড় নবাবের বাহিনী। বহু গুণ বেশি নিকট ও দূরপাল্লার কামান এবং গোলাবারুদ দিয়ে সজ্জিত। দূরপাল্লার কামান-আশ্রিত বিশাল অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে সিরাজদ্দৌলা নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁবু গেড়েছেন। প্রায় ৫০ হাজার অশ্বারোহী, পদাতিক বাহিনী ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ গোটা বাহিনী লম্বাকারে দুই মাইলেরও বেশি জায়গা নিয়ে চক্রাকারে এমনভাবে ক্লাইভের ক্ষুদ্র বাহিনীকে ঘিরে অবস্থান নিলেন যে ক্লাইভ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তৈরি হচ্ছেন গঙ্গার পথে পিছু হটার জন্য। একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে নবাবের বিশাল ও সুসজ্জিত বাহিনীর মোকাবিলা করা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করলেন তিনি। পিছু হটার সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেবেন এমন সময় ক্লাইভের সামরিক গুপ্তচর খবর নিয়ে আসেন যে, গোপন চুক্তি মোতাবেক মীরজাফর তাঁর নিজের অধীনে থাকা বাহিনীকে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেবেন না। পরিস্থিতির সবদিক যোগ-বিয়োগ করে ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিলেন সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য।
২৩ জুন বৃহস্পতিবার সকাল আটটা। প্রথম গোলা ছোড়ে নবাবের বাহিনী। প্রথম তিন ঘণ্টা কাটে উভয়পক্ষ দূর থেকে গোলন্দাজি গোলাগুলির মাধ্যমে সুবিধামতো অবস্থান তৈরিতে। সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দেন নবাব। কয়েকটি গোলা ছোড়ার পরই শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টি। বৃষ্টির ফলে নবাবের বারুদ-ভাটা সম্পূর্ণ সিক্ত হয়ে যায় এবং চালনার অযোগ্য হয়ে পড়ে কামান। অন্যপক্ষে ব্রিটিশ বাহিনীর বারুদ সময়মতো আবৃত করার ফলে অক্ষত থাকে। কামানের গোলা উপেক্ষা করে নবাবের অশ্বারোহী বাহিনী সামনে অগ্রসর হতে থাকে। একপর্যায়ে নবাবের সেনাপতি মীরমদন নিহত হন।
গোলান্দাজ বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর সিরাজদ্দৌলা মীরজাফর ও রায় দুর্লভকে তাঁদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তাঁর নির্দেশ অমান্য করলেন। তাঁদের যুক্তি হলো গোলন্দাজ বাহিনীর আশ্রয় ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। কিন্তু কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েক শ গজ। সিরাজদ্দৌলা বুঝতে পারলেন, যুদ্ধ আর তাঁর পক্ষে নেই। মীরজাফর ক্লাইভকে খবর দিলেন, তিনি যুদ্ধ করবেন না এবং ইংরেজের পক্ষ থেকে আঘাত বন্ধ করে ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে চান। কিন্তু ক্লাইভ যুদ্ধ চালিয়ে যান। বিকেল পাঁচটায় সিরাজদ্দৌলা বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করেন।
মীরজাফর ও ক্লাইভের মধ্যে গোপন চুক্তি সফল হলো। হতভম্ব নবাব নিজেকে ও রাজ্য রক্ষার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রের তাঁবু থেকে আত্মগোপন করে সাধারণ বেশে বেরিয়ে গেলেন পাটনার পথে। পাটনা থেকে নতুন সাজে রাজ্য রক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরবেন—এই ছিল তাঁর তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা। একটি দ্রুতগামী উটে চড়ে নদীপথে পাটনায় পৌঁছাবার লক্ষ্যে তিনি পদ্মার তীরে ভগবানগোলা বন্দর থেকে রাজমহলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। রাজমহলে এসে তিনি নৌকা থেকে নেমেছেন খাবারের ব্যবস্থার জন্য। কিন্তু দীনহীন মলিন বস্ত্রধারী হলেও তিনি দানা শাহ নামে এক ফকিরের চোখে পড়ে গেলেন। এই দানা শাহ নানা ধর্মীয় ভণ্ডামির অপরাধে সিরাজদ্দৌলার হাতে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ফকিরি করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার অপরাধে দানা শাহর এক কান কেটে তাঁকে মুর্শিদাবাদ থেকে সিরাজদ্দৌলার নির্দেশে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কান কাটা দানা শাহ পরে রাজমহলে গিয়ে আশ্রয় নেন। দানা শাহ সিরাজদ্দৌলাকে ধরিয়ে দিলেন তাঁর শত্রুর হাতে। বন্দী নবাবকে ফিরিয়ে আনা হলো মুর্শিদাবাদে। তাঁকে হস্তান্তর করা হলো মীরজাফরের পুত্র মীরনের হাতে। মীরন সে রাতেই (২ জুলাই) মোহম্মদী বেগকে নির্দেশ দেন নবাবকে হত্যা করার জন্য। মোহম্মদী বেগ মীরনের উপস্থিতিতেই হত্যা করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরজদ্দৌলাকে। এই সেই মোহম্মদী বেগ, যাঁকে ছোটবেলা থেকে সিরাজদ্দৌলার পিতা নিজের ছেলের মতো সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে লালন-পালন করে বড় করে তুলেছেন এবং সিরাজদ্দৌলার মা তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করে একটি তালুকও দান করেছিলেন।
গুরুত্বের দিক থেকে পলাশী যুদ্ধকে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়। পলাশীর যুদ্ধ রাজায় রাজায় সংঘটিত হয়নি। যুদ্ধ হয়েছে নবাব এবং একটি বিশ্ব পুঁজিবাদী বাণিজ্যিক কোম্পানির মধ্যে। এক রাজার পতন হলে আরেক রাজার আবির্ভাব ঘটে। জীবন চলতে থাকে সনাতনভাবেই। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে নবাবের পতন হয়েছে একটি কোম্পানির হাতে; সাত সমুদ্রের ওপার থেকে আসা একটি বিদেশি বাণিজ্যিক কোম্পানি দেশের শাসকে পরিণত হলো। সনাতন রাজনীতিতে রাজার শাসনে থাকে প্রজাকুলের নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজনীয়তা, যা একটি বিদেশি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের থাকতে পারে না। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিবেচনা মুনাফা। মুনাফাকে মোক্ষ করেই শাসিত হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা রাষ্ট্র, অন্তত কোম্পানির প্রথম ৫০ বছর। ফলে আমরা দেখতে পাই, দ্বৈতশাসন, নিলামি বন্দোবস্ত, দশ সালা বন্দোবস্ত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, পত্তনী ব্যবস্থা, সূর্যাস্ত আইন, ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ, সংক্ষিপ্ত আদালতের মাধ্যমে মানবাধিকারের পতন ইত্যাদি। আঠারো শতকের প্রথম ভাগে নবাবি শাসনামলে আমরা কোনো দুর্ভিক্ষ দেখি না, দেখি না কোন প্রজাবিদ্রোহ। কিন্তু দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ কোম্পানি আমলে দেখি অভাবনীয় অভাব, দুর্ভিক্ষ ও প্রজাবিদ্রোহ। জমিদার সমাজেও অসন্তোষ। সূর্যাস্ত আইনের ফলে দেখতে পাই, নিলামে জমিদারি বিক্রয়, নতুন জমিদারের আবির্ভাব, প্রজাদের ওপর খাজনা বৃদ্ধির প্রবণতা। সরকার জনসাধারণের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেনি কারণ তা মুনাফার হিসাবে মেলে না। ফলে নবাবি আমলের মাদ্রাসা, পাঠশালা, টোল প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোম্পানি আমলে বিলীন হলো। বিলীন হলো গ্রামপর্যায়ে মানুষের নিরাপত্তাও।
পলাশী যুদ্ধ বিশ্বঅর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। উপনিবেশবাদ আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে প্রথম ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলায়। জানা উচিত যে, বঙ্গদেশই হলো বিশ্বের প্রথম আধুনিক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। এর আগে ইউরোপের অনেক দেশ মহাসাগরীয় অঞ্চলের জনশূন্য জায়গায় কলোনি বা উপনিবেশ স্থাপন করেছে বা কোনো জনবহুল জায়গায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছে, কিন্তু এশিয়া-আফ্রিকার কোথাও জনবহুল রাজ্য দখল করে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। ইতিহাসে বাংলাই প্রথম ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র, যার উৎপত্তি পলাশীর পরাজয় থেকে।
বাংলায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে আন্তমহাসাগরীয় বাণিজ্যে ব্রিটেন অভাবনীয় সুবিধা অর্জন করল। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে ব্রিটিশ শিল্প-বিপ্লবে ও সামরিক ক্ষমতায়। বঙ্গদেশ পরিণত হলো ব্রিটিশ শিল্প-পণ্যের একটি বন্দী বাজারে এবং ব্রিটিশ শিল্পের জন্য কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে। মুনাফার লোভে ব্রিটেনের অনুকরণে ইউরোপের অধিকাংশ সাগর উপকূলীয় রাষ্ট্রই ব্রিটেনের অনুরূপ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়। উপনিবেশবাদ থেকে সূত্রপাত আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের।
আমাদের যুক্তি এমন নয় যে, পলাশী যুদ্ধের জন্যই কেবল এসব ঘটেছে। আমাদের বক্তব্য হলো, পলাশী যুদ্ধের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে শুরু করে ক্রমেই সমগ্র ভারতে এবং আরও পরে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থাপন করে বাণিজ্যিক বলয়, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্রিটিশ শিল্প-বিপ্লবে এবং পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইউরোপীয় দেশগুলো ব্রিটেনের আদলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রকল্প গ্রহণ করে।
পলাশীর আগে বহুবার বাংলায় শাসকগোষ্ঠীর পালাবদল হয়েছে। কিন্তু দেখা যায় যে, শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন হলেও শাসন ব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এর প্রভাব দেখা যায় নগণ্য। মৌর্য শাসন, গুপ্ত শাসন, পাল শাসন, সেন শাসন, তুর্কি শাসন, মোগল শাসন যতটা ছিল শাসক শ্রেণীর পরিবর্তন, নিম্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ততটা ছিল না। শাসন ব্যবস্থায় ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন ছিল মোটামুটি অপরিবর্তনের ঐতিহ্যে প্রবাহিত। দেখা যায় যে, প্রাগ ব্রিটিশ যুগে প্রতিটি নতুন শাসকগোষ্ঠী শাসন করেছে স্থানীয় সামাজিক শাসকগোষ্ঠীকে অংশী করে। হিন্দু আমলে তো এ ঐতিহ্য ছিলই, এমনকি তুর্কি ও মোগল আমলেও এ ধারা ছিল অব্যাহত। নবাবি আমলে প্রশাসনে স্থানীয় নেতাদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বজনীন।
স্থানীয় শাসকশ্রেণীকে সহযোগী করে শাসন করার ঐতিহ্য বাতিল হয়ে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করা হলো শ্বেতাঙ্গ উপাদানে। কোম্পানি রাষ্ট্রব্যবস্থা হলো এমন যে, দেশের শাসকশ্রেণী সব বিদেশি আর শাসিত দেশি। এমনটি বাংলার ইতিহাসে কোনো পর্বে ঘটেনি। এর সামগ্রিক ফল হলো সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে নেমে এল চরম হতাশা।
পলাশীর পরাজয়, ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অনুপস্থিতি থেকে বাঙালির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে একটি বিশেষ মানসিকতা: হীনম্মন্যতা। ইংরেজের অনুকরণে অচিরেই বাঙালিদের অনেকে নিজেদের নানা দিক দিয়ে হীন গণ্য করতে শুরু করল। ইয়ং বেঙ্গলরা যেমন, যা কিছু বঙ্গ সংস্কৃতির সেসব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভরে বর্জন করাই তাদের আধুনিকতা। যা কিছু বিদেশি তা উত্তম, আর যা কিছু দেশি অপাঙেতয়—এমনটিই হয়ে উঠল অনেকের মনোভঙ্গি। পোশাক, সাজসজ্জা (ফ্যাশন), ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, খেলাধুলা, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা ও শাসন পদ্ধতি, শিল্প-স্থাপত্য প্রভৃতিতে বিদেশি প্রভাব এমনই স্পষ্ট ও স্থায়ী যে, অনেককেই বলতে শুনি, আধুনিকতার জন্য এ দেশে ইউরোপীয় শাসন প্রতিষ্ঠা ছিল একটি বড় আশীর্বাদ। অথচ প্রাগ ব্রিটিশ যুগের বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনায় দেখি, স্থানীয় শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, বৈদেশিক বাণিজ্য, ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য, শিল্প-চর্চা, সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য প্রভৃতিতে এ দেশের অবস্থা ছিল রীতিমতো ঈর্ষা করার মতো।
যাহোক, পলাশী যুদ্ধ ছিল কয়েক ঘণ্টাব্যাপী একটি নামেমাত্র যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ফলাফল যে বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে এ ব্যাপারে কারও মতভেদ নেই। তবে ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, যুদ্ধের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা এক সাধারণ ব্যাপার। যুদ্ধে যে পক্ষ যত বিশ্বাসঘাতকদের কাছে টানতে পারে, ব্যবহার করতে পারে, তারা দারুণ সুবিধা লাভ করে। যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তারাও জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই তা করে। সিরাজদ্দৌলা যুদ্ধে জয়ী হলে মীরজাফর, জগৎশেঠদের শিরচ্ছেদ হতো। তবে কথা ওঠে, মীরজাফর, জগৎশেঠরা কেন বিশ্বাসঘাতকতা করলেন? সিরাজদ্দৌলা ইংরেজদের নানা কারণে অপছন্দ করতেন। তিনি পছন্দ করতেন ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। তাঁর সেনাবাহিনীতে সাত শ ভাড়াটে ফরাসি সৈন্য ছিল। মূলত তাঁরাই যুদ্ধ করেছেন। জগৎশেঠের সব ব্যবসা ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে। ব্রিটিশরা যুদ্ধে হেরে গেলে জগৎশেঠের বাণিজ্যিক আধিপত্য নস্যাৎ হতে বাধ্য, আর জিতলে তাঁর মুনাফা তুঙ্গে উঠবে বলে ছিল তাঁর ধারণা। মীরজাফর আসলে ষড়যন্ত্রে ততটুকু সক্রিয় ছিলেন না, যতটুকু ধারণা করা হয়। ষড়যন্ত্রটি পাকিয়েছে জগৎশেঠের নেতৃত্বে কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়ে জড়িত কলকাতা, কাশিমবাজার ও মুর্শিদাবাদের বণিকগোষ্ঠী। ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরীর মতে, জগৎশেঠই প্রায় অশিক্ষিত ও ব্যক্তিত্বহীন মীরজাফরকে উচ্চাভিলাষী করে তোলেন। অতএব ঘটে গেল নামেমাত্র পলাশী যুদ্ধ।
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, মীরজাফর ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি, পারেননি জগৎশেঠও তাঁর সম্পদ ধরে রাখতে। যে জগৎশেঠ পরিবার ছিল ১৭৫৭ সালে বিশ্বের অন্যতম ধনী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যাংকার, শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই সে পরিবার সমূলে ধ্বংস হয়ে কোম্পানি সরকারের কৃপায় একটি পেনশনে জীবনযাপন করতে হয়। অমনিভাবে দেশের সেরা ধনী ও প্রভাবশালী জমিদার পরিবারগুলোও নিঃস্ব হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবে। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখার জন্য যেসব ব্যক্তি ও পরিবার কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে পারে তাদের সবাইকে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নিয়ে আসা হলো। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখার এটাই ছিল সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা।

0 comments:

Post a Comment