Wednesday, June 30, 2010

নকশি কাঁথা

0 comments
কাপড়ের উপর তৈরি নকশা করা কাঁথাই নকশি কাঁথা। এক সময় গ্রামীণ বধূ, ঝিরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে শৌখিন নকশি কাঁথা তৈরি করত। সুই-সুতা দিয়ে কাঁথা সেলাই করে সেখানে ধরে রাখত বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। মেয়ের বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর সময় মা, নানি, দাদিরা মেয়েকে উপহার দিত বাহারি রঙের নকশি কাঁথা। নতুন জামাইকে নকশি কাঁথা, বালিশ, দস্তরখানা, রুমাল উপহার দেয়া আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। এটি ছিল ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণীর মানুষের ঐতিহ্য। এমনকি বাড়িতে নতুন কোনো মেহমান এলে তার থাকার বিছানা সাজান হতো বিছানার চাদর, কাঁথা, বালিশ দিয়ে। জামালপুরের বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, যশোর, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা অঞ্চল নকশি কাঁথা তৈরির জন্য বিখ্যাত। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নকশি কাঁথা তৈরি হয় জামালপুরে। জামালপুরে নকশি কাঁথা শিল্পের নানাবিধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

এখানকার নকশি কাঁথা গুণগতমানে উন্নত এবং দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় দেশ-বিদেশে এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লুপ্তপ্রায় এ শিল্পটি দুই দশক ধরে আবার আলোর মুখ দেখেছে। এনজিও প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের আড়ং বাণিজ্যিকভাবে নকশি কাঁথা উৎপাদন করছে। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে কেবল জামালপুরেই গড়ে উঠেছে_ রংধনু হস্তশিল্প, সৃজন মহিলা সংস্থা, সুপ্তি, ক্যাম্প, কারু নিলয়, জোসনা হস্তশিল্প, প্রত্যয় ক্রাফট, রওজা কারুশিল্প, কারুপল্লী, কারু নীড়, দোলন চাঁপা, ঝিনুক, সূচিকা, তরঙ্গ, দিপ্ত কুটির, বুনন, অণিকা, মিম, মামিম, শতদলসহ প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। ব্র্যাক গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলেছে। তাদের উৎপাদিত কাঁথা দেশীয় ক্রেতাদের কাছে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেটসহ বড় জেলা শহরগুলোতে নকশি কাঁথার বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব বাজারে নকশি কাঁথা রপ্তানি হচ্ছে। দেশে নকশি কাঁথা উৎপাদনকারীদের পণ্যগুলো অধিকাংশ মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে। জামালপুর থেকে সরাসরি পণ্য বহন করে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার শো-রুমে সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে এসএ পরিবহন ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অল্প সময়ে দ্রুত মালামাল সরবরাহ করা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত মেলায়ও এখানকার ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করে থাকেন। এসব প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে। দেশে নকশি কাঁথা সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে_ নকশি কাঁথা, বেড কভার, থ্রি-পিস, ওয়ালমেট, কুশন কভার, শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিস পাঞ্জাবি, ইয়ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ির পাড়, ওড়না, ফ্লোর কুশন, মাথার ব্যান্ড, মানি ব্যাগ, কলমদানি, মোবাইল ব্যাগ, শিকা, শাল চাদর ইত্যাদি।

নকশি কাঁথা পণ্যের মূল্য ২৫ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকার ঊর্ধ্ব পর্যন্ত। নকশি কাঁথাশিল্পের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করেন। তাদের মূল সমস্যা হলো- পুঁজি সংকট, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, শ্রম মজুরি বৃদ্ধি, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, নিখুঁত পণ্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়া, উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্দ্য, বকেয়া টাকা পরিশোধ না করা, ডিজাইনে বৈচিত্র্যের অভাব, সরকারি আনুকূল্য না পাওয়া ইত্যাদি।

পাঁচ বছর যাবৎ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে। এ শিল্পের সমস্যাগুলো দূর করা হলে শিল্পটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগে গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। তাহলে গ্রামীণ নারীদের দারিদ্র্য দূর হবে; সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। নারীর ক্ষমতায়নও বাড়বে। টিকে থাকবে নকশি কাঁথার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় ঐতিহ্য। এ শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যাদি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। শেখ মেহেদী হাসান

0 comments:

Post a Comment