Wednesday, June 2, 2010

ভাস্কর্য শিল্প

1 comments
শিল্প মাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্য শিল্প খুব বেশি পুরাতন না হলেও খুব বেশি নতুনও নয়। খ্রিস্টপূর্বাব্দ কাল থেকেই মানুষ ভাস্কর্যচর্চা করে আসছে। শিল্পচর্চার মাধ্যমগুলোর মধ্যে ত্রিমাত্রা প্রায়োগিক কারণে অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে ভাস্কর্য মাধ্যমের কদর একটু বেশি। ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাস্কর্যচর্চা শুরু হলেও খুব দ্রুত তা ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে নির্ভজাল শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছে এর বিচিত্রতার মাধ্যমে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ভাস্কর্য শিল্পের অদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন সাজিদুল হক শুভ
ভারতীয় উপমহাদেশ তথাপি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভাস্কর্যের যত নমুনাই পাওয়া যায় তার সবই গুপ্ত যুগের বা তার কিছু পূর্বের। এ থেকে ধারণা করা যায় এই উপমহাদেশে ঐ সমসাময়িক সময়কাল থেকে ভাস্কর্যচর্চার শুরু হয়। ভারতবর্ষের ভাস্কর্যচর্চা গুপ্ত বা মৌর্য যুগে বা তারও কিছু পূর্বে শুরু হলেও এই শিক্ষা বাংলাদেশে আসতে আরো প্রায় কয়েক শত বছর লেগেছিল বলেই ধারণা করা হয়। প্রথম দিকের যত ভাস্কর্য নিদর্শন এই উপমহাদেশে পাওয়া গেছে, তার সবই ছিল ছোট পাথরের টুকরা অথবা পোড়া মাটির তৈরি। অন্যান্য মাধ্যম যেমন কাঠের মাধ্যমেও তখন ভাস্কর্য বানানা হতো এমনটাই বিশেজ্ঞদের মত। কিন্তু হয়তোবা সংরক্ষণের অভাব ও মাধ্যমের অস্থায়িত্বের কারণে আমরা। পরবর্তীতে এই মাধ্যমের কাজগুলো পাই না। মোটামুটিভাবে যেটা বোঝা যায়, শুরু থেকেই পোড়ামাটি, পাথর ও কাঠের মাধ্যমেই ভাস্কর্যচর্চার সূচনা হয় এই উপমহাদেশে।
খ্রীস্টপূর্ব যষ্ঠ শতকে পাল বংশের হাত ধরেই বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের সূচনা- এমনটাই ধারণা করা হয়। সূচনালগ্নে ভাস্কর্য শিল্পটি আসলে শিল্প ছিল না, বরং ধর্মীয় ভক্তি-শ্রদ্ধার স্থানটাই বেশি ছিল। তখনকার সময়ে নির্মিত সব ভাস্কর্যই প্রতিমার। প্রতিমা তৈরির মাধ্যমেই যাত্রা শুরু করে এই শিল্প। তখন যাদের অর্থানুকূল্যে এসব মূর্তি নির্মাণ হতো মোটামুটিভাবে তাদের প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে রীতি-নিয়ম সম্বন্ধে কোনো ব্যক্তিগত মতামত বা নির্দেশক বা রুচি বলতে কিছু ছিল না। ভাস্কর বা সূত্রাধররা তাদের প্রচলিত প্রথা ও আদর্শ, শাস্ত্রীয় অনুশাসন এবং শিল্পরীতির সাধারণ ঐতিহ্য অনুসরণ করে মূর্তি বা ভাস্কর্য গঠন করতেন। এই কাজের চতুর্সীমার মধ্যে শিল্পী যা কিছু ভাবদৃষ্টি ও শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় এবং শাস্ত্রীয় ধ্যানগত কল্পনার সাথে তার দৃষ্টি ও ভাবনা, ধ্যান ও কল্পনা একাত্মো থাকতো। নচেৎ শুধু প্রতিমার গড়ন হতো, শৈল্পিক ধাচ্ থাকতে না। তৎকালীন সময় ভাস্কররা ছিল সমাজের প্রায় নিম্নতম স্তরের লোক। তাদের পেশা বা বৃত্তিও প্রায় নিম্নস্তরের বলে গণ্য হতো। সাধারণভাবে পাল ও সেন পর্বের ভাস্কর্য পাথর হোক বা কাঠের হোক ভাব কল্পনা ও শিল্পিদৃষ্টির ডৌল ও মন্তনের কাঠের বিন্যাসের কোনো পার্থক্য দেখা যায় না।
তখনকার সময়ের সকল ভাস্কর্য বা মূর্তির মধ্যেই শিল্প সৌন্দর্যের বিষয়টি ছিল প্রায় অনুপস্থিত। তার থেকে দেবভাব ও ভক্তিভাব ছিল ল নীয়। এই ধারা দীর্ঘ কয়েক হাজার বছর ধরে চলে ও অল্প অল্প করে গঠন শৈলীতে পরিবর্তন আসে। অনেক পরে প্রায় অষ্টম শতকের ভাস্কর্যশৈলী কেন্দ্র বিচ্যুত এবং কদর্ম শিথিল। নবম শতকেও মাংসল শৈথিল্য বর্তমান ছিল। কিন্তু তাকে রেখার সীমানায় বাধার একটা চেষ্টা এ সময় ল নীয়। দশম শতক ছিল বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পের স্বর্ণযুগ। এ দশকের ভাস্কর্যগুলোর কেন্দ্রচেতনায় সমগ্র দৃষ্টি জীবন্ত, শিথিল মাংসলদেহে শক্তির আবির্ভাব ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ব্যক্তিত্ব। এর পর থেকেই ভাস্কর্যগুলোর দেহে ধীরে ধীরে ীণতার রূপপ্রবণতা বেড়ে যায়। ধর্মগত বিষয়বস্তু থাকা সত্ত্বেও এইসব ভাস্কর্যগুলো পার্থিব ভোগ চেতনা ও জৈব-কামনা-বাসনা দ্বারা শোভিত। এই ভোগ চেতনা এবং জৈব কামনা বাসনাকে ভিনদেশি দি ণী প্রভাব বলে অনুসান করা হয়। প্রায় ১৫ শতক পর্যন্ত ভাস্কর্য শিল্প তার আপন ধারায় চলার পর ইংরেজদের আগমণের পর একটা বড় পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয় বস্তুর বাইরে বেরিয়ে এসে নতুন ধারার ভাস্কর্য চর্চা শুরশু হয়। ভাস্কর্যশিল্প যে শুধুমাত্র ধর্মের আগ্রাসনে প্রয়োজনীয় নয় বরং সূক্ষè শিল্পবোধের উন্নতিরও পাথেয় তা এসময়ের ভাস্কর্যে ল ্য করা যায়। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তি ও ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়কে ভাস্কর্যের মাধ্যমে ধরে রাখার একটা প্রবণতা এ সময়ের ভাস্কর্যে লি ত হয়। কিন্তু এই সময়ের ভাস্কর্য চর্চায় কাবলী তার ঐতিহ্যও সংস্কৃতি থেকে অনেক খানি দূরে সরে যেয়ে শুধুমাত্র অন্ধের মতো অনুসরণ করে গেছে পশ্চিমা ধারা কে। তারই ধারবাহিকতায় বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পে চলে আসে বির্মুর্ততা। হেনরি যুরের হাত ধরে ১৯৩০ সালের আসে ভাস্কর্য শিল্পে বির্মূততা চলে আসলেও বাংলাদেশে তার আগমণ ঘটে কিছু দেরিতে। সর্বপ্রথম নভেরা আহমেদের কৃষক পরিবার-ই (জাদুঘরে সংরি ত) বাংলাদেশের প্রথম বিমূর্ত ভাস্কর্য। প্রায় ৭৯ দশকে এই ধরনের ভাস্কর্যগুলো ব্যাপকভাবে শুরশু হয়। তৎকালীন সময়ের মধ্যে বাংলার গ্রামীণ লোক জীবনের জীবন চরিত্রই ছিল মুখ্য। এসময়ের ভাস্করদের মধ্যে তার চার পাশের পরিবেশ থেকে বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করার একটি প্রধান ল ণীয়। ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পে আরো বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। স্বাধীনতা যুদ্দ বা উপজীব্য করে ভাস্কর্য তৈরি প্রবণতা অনেকগূন বেড়ে যায়। ‘অপরাজেয় বাংলা’, ‘সোপার্জিত স্বাধীনতা’, ‘সাবাস বাংলাদেশ’-এ সময়ের ভাস্কর্য। ১৯৮৩ সালে শিল্পী আব্দুর রাজ্জাকের হাত ধরে বাস্কর্য শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক শি ায় রূপলাভ করে। যার ফলে আমাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক ভাবধারার সাথে বিভিন্ন বর্হিবিশ্বের দেমের ভাস্কর্যের ভাবধারার সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন ও উন্নত চিন্তার ভাস্কর্য নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে। বর্তমান ভাস্কর্য শিল্পে বাংলাদেশের প্রচলিত কাদামাটি, কাঠ ও পাথরের পাশাপাশি আধুনিক মাধ্যম তামা, ব্রোঞ্চ, ফাইবার গহ্মাস, পহ্মাস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে ভাস্কর্য নির্মাণ হচ্ছে। পূর্ববর্তী ভাস্কর্য ধারা ছিল খুবই বিি প্ত এবং সমসাময়িক ভাস্কর্যগুলো ল ্য করলে তাদের মাজে কোনো ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু বর্তমানের ভাস্কর্য ধারাটি অনেক সুশংঙ্খল ও পরিকল্পিত, যা আমাদেরকে আরো উন্নত একটি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়।
কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও ভাস্কর্য শিল্পটি ছিল ধনীমহলের ও বুদ্ধিজীবী মহলের সৌখিনতার বিষয়বস্তু। সাধারণ মানুষের ধরাছোয়া ও বোধগম্যের বাইরে জিনিস ছিল এটি। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর বিষয়বস্তুর উৎকর্ষে ও ব্যবহারের ভিন্নতায় ভাস্কর্য শিল্প গণমানুষের আপনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভাস্কর্যের মাধ্যমে আমাদের চারপাশের পরিচিত জগতের কিছু বিষয়কে সহজভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিল্পটি মানুষের আরো বেশি কাছে চলে এসেছে। পশ্চীমা রীতিকে অনুসরণ করে রোড আইল্যান্ডগুলোতে বা রোড সাইড স্পেস ও পার্কগুলোতে ভাস্কর্যের স্থাপন শুধুমাত্র দেশের ভেতরেই নয়, বর্হিবিশ্বেও বাংলাদেশের ভাস্কর্যকে অন্য এক মর্যাদায় তুলে ধরতে স ম হয়েছে। আন্তর্জাতিক নবীন চারশুকলা প্রদর্শনীতে ‘ভাস্কর রাসা’ ও ‘তেজস হালদার জফের’ স্বর্ণবাদক প্রাপ্তিকে আমরা এই উন্নতির ধারাবাহিকতা হিসেবেই ধরে নিতে পারি, কিংবা ‘হামিদুজ্জামান খান, ‘নভেরা আহমেদ’ ‘শামীম শিকদার’ প্রমুখদের ভাস্কর শিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে ধরে নিতে পারি আমাদের গৌরবময় অহংকার হিসেবে।
দারিদ্র ও ধর্মান্ধতাকে পেছনে ফেলে, আত্মার ক্ষুধা মেটানোর সুতীব্র তাড়না থেকে, সূক্ষ্ম শিল্পবোধ সৃষ্টি এসব শিল্প আমাদের মানবমনের ক্ষুদ্রতাকে দূর করার অন্যতম পাথেয়। শৈল্পিকতা, সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার বিজিও মিছিলের শেহ্মাগানে মুখরিত ভাস্কর্য শিল্পের এই দূর্বার পথ চলা।

1 comments:

  • January 18, 2022 at 7:47 AM

    অসম্ভব সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন সাজেদুল হক শুভ স্যার,,আপনি আপনার শিক্ষার্থী হতে পেরে গর্ববোধ করছি স্যার

Post a Comment