সাহিত্যের আদি কবিরা খল চরিত্রের রূপায়ণ করেছেন। ইলিয়ড-ওডিসি, মহাভারত-রামায়ণ মহাকাব্যে খল চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। গ্রিক মিথে রয়েছে দেব-দেবীর বিচিত্র খলামির বিবরণ। মহাভারতের শকুনি, রামায়ণের রাবণ বিখ্যাত খল চরিত্র। জন মিল্টনের প্যারাডাইস লস্টের শয়তান চরিত্রটি শয়তানের শয়তান, বেউলফের গ্র্যান্ডেলের মা প্রকৃত খল। রবীন্দ্রনাথ খল চরিত্র হিসেবে শেক্সপিয়রের ফলস্টাফের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, কল্পনার রসে জারিত হয়ে চরিত্রগুলো সৃষ্টি হয়েছে বলে খল হয়েও আমাদের মনে সেগুলো দাগ কাটে। 'ওথেলো'র ইয়াগো মতলববাজ, ধূর্ত চক্রান্তকারী। হ্যামলেটের চাচা ক্লডিয়াস খলতার পরিচয় দিয়েছে দুষ্কর্ম করে। সে হত্যা করে নিজ ভ্রাতা তথা হ্যামলেটের বাবাকে, বিয়ে করে রানি গারট্রুডকে, যাকে হ্যামলেট মা বলে ডাকে। বাবার প্রেতাত্দা হ্যামেলেটের চাচাকে বদমাশ বলেছে, বলেছে চতুর, ব্যভিচারী, পশু, বিশ্বাসঘাতক। 'টেম্পেস্টে' কুচক্রী অ্যান্টোনিও প্রস্পেরোকে সরিয়ে মিলানের ডিউক হয়েছে। মার্চেন্ট অব ভেনিসের শাইলক ক্রূরতায় খলপনা করেছে। কিং লেয়ার, রিচার্ড দ্য থার্ডে খল চরিত্র আছে। জোশেফ কনরাডের উপন্যাসে, ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটকে, হার্ডির টেসে, নবকভের ললিতায়, মেলভিনের মবিডিকে স্মরণীয় হয়ে আছে খলাঙ্কন। কিপলিংয়ের শের খানের খলত্ব ছাড়াও জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪-তে, ডিকেন্সের রচনায়, গোর্কি ও হামসুনের উপন্যাসে চরিত্রের খলতা আমাদের অতি পরিচিত। বর্তমানে বহুল পরিচিত কিশোর সাহিত্য হ্যারি পটার সিরিজের উপন্যাসগুলোয় জে কে রাউলিং খলের বহুমাত্রিক বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
বিশ্বসাহিত্যের খল চরিত্রগুলোর দিকে মনোযোগ দিলে লক্ষ করা যায়, এরা কেউ অপরাধী, খারাপ ব্যক্তি, সংকীর্ণচেতা, অসততায় অসামান্য এবং নায়কের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শক্তিশালী। সাধারণ মানুষের কাছে এরা বাজে লোক, শত্রু, হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর নীতিহীন। সাহিত্যে খল চরিত্রের রূপায়ণের সার্থকতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : 'বহু লোকের বহুবিধ মন্দত্বের খণ্ড খণ্ড পরিচয় সংসারে আমাদের কাছে ক্ষণে ক্ষণে এসে পড়ে; তারা আসে, তারা যায়, তারা আঘাত করে, নানা ঘটনায় চাপা প'ড়ে তারা অগোচর হতে থাকে। সাহিত্যে তারা সংহত আকারে ঐক্য লাভ করে আমাদের নিত্যমনের সামগ্রী হয়ে ওঠে, তখন তাদের আর ভুলতে পারি নে।' (সাহিত্যের তাৎপর্য)
খল বলতে খারাপ ব্যক্তিকে আমরা বুঝে থাকি, যে অপরের মুখ ম্লান করে দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করে, সাহিত্যে নায়কের বিপরীতে যার অবস্থান। অনেক সময় সে নিজেই নায়ক হয়ে ওঠে। অসততা যার মর্মে ফল্গুস্রোতের মতো প্রবাহিত, হীনতা যার মজ্জাগত তাকে খল হিসেবে অভিহিত করা যায়। খল অন্যের ক্ষতি করে লাভবান হয় নিজে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত নীতি-আদর্শ তার কাছে মুখ্য নয়। বরং অনৈতিক কর্মধারা তার জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে খল চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় সেই সময়ের উচ্চবর্গের জনগোষ্ঠীর মধ্যে। যারা রাতে নিম্নবর্গের নারীদের সঙ্গে সহবাস করত আর দিনের আলোয় সেসব অস্পৃশ্য নারীদের ঘৃণা করত, তারাই চর্যাপদের উদ্দিষ্ট খল। মধ্যযুগের কাব্যে দেবীদের খলপনা লক্ষ করা যায়। চণ্ডী, মনসা, শীতলা দুর্গতির দ্বারা মানুষকে পরাস্ত করে আপন মাহাত্ম্য প্রকাশ করেছে। শৈব চাঁদ-সওদাগরের দুরবস্থা দেবীর কারণে। বিক্রম দেখিয়ে কার্যসিদ্ধি করেছে দেবী। ব্যাধকে বিনা কারণে চণ্ডী দয়া দেখিয়েছে আবার কলিঙ্গরাজকে তেমনি বিনা দোষে নিগ্রহ করেছে। দয়ামায়াহীন ধর্মাধর্মবিবর্জিত শক্তিকে বড় দেখানো হয়েছে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোয়। তবে এসব কাব্যে রূপায়িত খল চরিত্রগুলো কাব্যের সুষমা সৌন্দর্য প্রকাশ করেছে। রবীন্দ্রনাথ 'সৌন্দর্য ও সাহিত্য' প্রবন্ধে বলেছেন, কবিকঙ্কণ-চণ্ডীর ভাঁড়ু দত্ত চতুর স্বার্থপর এবং গায়ে পড়ে মোড়লি করতে মজবুত লোক। তার সঙ্গ সুখকর নয়। তবু কবি মূর্তিমান করতে পেরেছেন তাকে। সে কৌতুকরস নিয়ে জেগে উঠেছে। ভাঁড়ু দত্ত প্রত্যক্ষ সংসারে এভাবে গোচর হয় না। যতটুকু আবশ্যক সুসহ করে ততটুকুই তুলে ধরেছেন কবি। প্রত্যক্ষ সংসারে ভাঁড়ু দত্ত ওইটুকুমাত্র নয়। সমগ্রভাবে গোচর হয় না বলে তাতে আমরা আনন্দ পাই। ভাঁড়ু দত্ত বাহুল্য বর্জন করে কেবল একটি সমগ্ররসে মূর্তিতে প্রকাশ পেয়েছে। সামঞ্জস্যের সুষমার মধ্যে সমস্ত চিত্র দেখায় বলে আমরা আনন্দ পাই_একে সুষমা সৌন্দর্য বলে।
ভাঁড়ু দত্ত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের 'উজ্জ্বল জীবন্ত পাষণ্ড চরিত্র'। লোভী, অত্যাচারী, স্বার্থপর, ধূর্ত আচরণ তার। মৈমনসিংহ-গীতিকায় দুশমন কাজী মলুয়াকে তার স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। অর্থলোভী আত্দীয় ভাটুক ঠাকুর, অত্যাচারী কাজী ও দেওয়ান খল। নেতাই কুটনী, চিকন গোয়ালিনী অপরের লালসার বহ্নিতে ইন্ধন দিয়েছে ও পারিবারিক জীবনের সুখ, শান্তি, পবিত্রতা নষ্ট করেছে। দুষ্টক্ষতের মতো এসব চরিত্র এখনো সমাজজীবনে বিরাজ করছে। 'মহুয়া'র হোমরা বেদে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে ভূমিকা পালন করেছে, তা খলেরই নামান্তর।
উনিশ শতকে বাংলা কাব্যের বিকাশের ধারায় মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র বিভীষণ অন্যতম খল চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের 'দুই বিঘা জমি'র ভূস্বামীর খলত্ব প্রমাণিত হয় যখন পৈতৃক বাস্তুভিটা ছাড়তে হয় কৃষককে। 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' কাব্যে জমিদার প্রতিভূ নায়েবের উসকানিতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেধেছে। কুচক্রী জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর ইন্ধনে নমঃশূদ্র ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। কারাভোগ করে সোজন। প্রেমের দুলি দূরে চলে যায়।
মধুসূদন, দীনবন্ধু, মীর মশাররফ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের নাটক-প্রহসনে বিভিন্ন খল চরিত্র তাদের খলতার স্বাক্ষর রেখেছে। মাইকেল মধুসূদনের 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনে প্রবীণ জমিদার ভক্তপ্রসাদের অর্থলোভ, কৃপণতা ও লাম্পট্য চিত্রিত হয়েছে। দীনবন্ধু মিত্রের 'নীল দর্পণে'র নীলকুঠির দেওয়ান গোপীনাথ নীলকরের পক্ষে মিথ্যা মামলা করেছে গোলকচন্দ্রের বিরুদ্ধে। এ নাটকের রোগ সাহেব ও অন্য নীলকররা খল-শিরোমণি। 'জমিদার দর্পণে' মীর মশাররফ উচ্ছৃঙ্খল জমিদার হাওয়াদ আলীর খলামি দেখিয়েছেন। প্রজা আবু মোল্লার যুবতী স্ত্রী নুরুন্নেহারকে বলপূর্বক অপহরণ করে। অপহরণ পরবর্তী সে মৃত্যুবরণ করলে হত্যা মামলায় শেষ পর্যন্ত সাক্ষীদের বশ করে, মুক্তি পায় জমিদার। 'বিসর্জনে' রঘুপতির কর্মতৎপরতা খলাঙ্কনের শামিল, যদিও পরিণতিতে তার হৃদয় দ্রবীভূত। নক্ষত্ররায় রাজাকে বলেছে, 'রঘুপতি দেয় কুমন্ত্রণা। রক্ষ মোরে তার কাছ হ'তে।' গিরিশচন্দ্র ঘোষের 'সিরাজদ্দৌলা' নাটকে জগৎশেঠ-ঘষেটি বেগম, মীর জাফরদের শত্রুতায় ও বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজয় ঘটে নবাবের।
কথাসাহিত্যে খল চরিত্রের রূপায়ণ সবচেয়ে বেশি। গল্প ও উপন্যাসের কাহিনীর ঘটনা ধারায় সম্পৃক্ত এসব চরিত্র কখনো উপন্যাসের সমস্যা আবার কখনো বা বক্তব্যের সঙ্গে জড়িত হয়ে খলারু হয়ে উঠেছে। প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরে দুলাল' রচনায় ঠকচাচা চরিত্রটি উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের খল চরিত্রের চমৎকার দৃষ্টান্ত। কূটকৌশল ও স্তোকবাক্যে মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারদর্শী জীবন্ত চরিত্র ঠকচাচা। প্রবঞ্চনাশ্রয়ী জীবন তার। তাকে বলা হয়েছে উনিশ শতকের ডামাডোলের এক কিম্ভূতকিমাকার অবস্থার নিদর্শন।
তবে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে খল চরিত্রের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। চরিত্রগুলোর মিছিল বাংলা সাহিত্যে অভিনব। এরা পাপভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট, প্রবৃত্তিতাড়িত, ঘাতক-ঘাতিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাঁর নারীরা চতুর ও কূটকৌশলী এবং দাগি। বিমলা, কতলু খাঁ (দুর্গেশনন্দিনী), মতিবিবি, কাপালিক (কপালকুণ্ডলা), পশুপতি, গিরিজায়া (মৃণালিনী), দেবেন্দ্রনাথ, হীরা (বিষবৃক্ষ), গুরগন খাঁ, ফস্টর, দলনী, শৈবলিনী (চন্দ্রশেখর), লবঙ্গ, হীরালাল (রজনী), ইন্দিরা (ইন্দিরা), হরলাল, রোহিনী (কৃষ্ণকান্তের উইল), প্রফুল্ল, হরবল্লভ (দেবী চৌধুরাণী), জয়ন্তী, শ্রী, গঙ্গারাম (সীতারাম), শান্তি (আনন্দমঠ), নির্মলকুমারী, জেবুন্নেসা, দরিয়া (রাজসিংহ) প্রভৃতি চরিত্রের খলাচার ও খলময় স্বভাব বাংলা সাহিত্যে অনন্য। তবে এদের মধ্যে খলস্বভাব ও নায়কোচিত বৈশিষ্ট্য আছে পশুপতির।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিষবৃক্ষের হীরাকে বলেছেন 'ভিলেন'। কুন্দ-নগেন্দ্র-সূর্যমুখী ত্রিভুজ পারিবারিক গণ্ডি থেকে কাহিনী ধারাকে বের করে এনেছে হীরা। ঈর্ষাদগ্ধ, অভিমানবিকৃত, বিদ্বেষক্রূর হৃদয়ের হীরা গৌণ চরিত্র নয়। দেবেন্দ্র-হীরাই উপন্যাসের সমাপ্তি টেনেছে। দুর্বিনীত খল রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসের সন্দীপ। নগ্নভাবে সে নিজেকে জাহির করে, প্রবৃত্তির জয়গান করে, পৌরুষের অহঙ্কারে ছিনিয়ে নিতে চায় সব কিছু। সন্দীপের রাজনৈতিক মত্ততা লেখকের মতে তার চরিত্রেরই নগ্ন লোভাতুরতার পরিণাম। উল্লেখ্য, সন্দীপের আদর্শ নায়ক রাবণ।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'গৃহদাহে'র সুরেশকে খল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সমাজ ও ধর্মকে সে পৃথক করে দেখেছে। কিন্তু অচলার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে সে যা করেছে, তা প্রচলিত হিন্দু সমাজবহির্ভূত। অচলাকে ভুলিয়ে এনে সুরেশ যে খলযাত্রার পথ উন্মোচন করেছে, তা অচলার জীবনের ট্র্যাজেডিকে ত্বরান্বিত করে তোলে। মীর মশাররফ হোসেনের 'বিষাদ-সিন্ধু'র এজিদ রূপমোহে যে কাজগুলো করেছে, তা তাকে খলের মর্যাদা দিয়েছে। এজিদের উপায় ও কৌশলগুলো ছিল নীতি-আদর্শবহির্ভূত।
'কল্লোলে'র কথাসাহিত্যে রূপায়িত চরিত্রে স্খলনবৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। গল্প ও উপন্যাসে খল, শঠ, শঠতানিপুণ, শয়তান চরিত্রের দেখা মেলে একাধিক। সৃষ্ট চরিত্রের শঠতার সঙ্গে তাদের ক্রূরতা, ক্রূরাচার, ক্রূরমতিত্বের পরিচয়ও পাওয়া যায়। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের রচনায় বেশ্যা-মাতাল-গেঁজেল-জুয়াড়ি-অপরাধীর মিছিল অনর্গল। যুবনাশের 'পটলডাঙ্গার পাঁচালী'তে কালনেমি গণেশ ডাকু নিজের স্ত্রীকে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে রাজি হয়ে খলত্বের পরিচয় দিয়েছে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের 'আকস্মিক' উপন্যাসে ছলনায় পারঙ্গম কুঞ্জ। অন্যদিকে পঞ্জ নানা দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত।
জগদীশ গুপ্তের সাহিত্যে বসেছে খলের হাটবাজার। তাঁর কথাসাহিত্যে 'কোমরবাঁধা শয়তান' মানুষের ইতরতা, নীচতা, নোংরামি প্রকাশিত হয়েছে। মূলত তিনি মানুষের স্বভাবের দৈন্য, কদর্যতা, লালসা, অমানুষিক হীনতা, লোলুপতা ও অপকৌশলের চিত্র তুলে ধরতে খল চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। লঘু-গুরু, অসাধু সিদ্ধার্থ, গতিহারা জাহ্নবী, রোমন্থন, মহিষী, রতি ও বিরতি প্রভৃতি উপন্যাসে মানুষের মনুষ্যত্বহীনতা, খলতা ও খলাচার বর্ণিত হয়েছে। এসব মানুষের নৈতিক মর্যাদাবোধ নেই। সূক্ষ্ম সুখ-দুঃখ অনুভূতি অনুপস্থিত। এরা মেরুদণ্ডহীন।
'অসাধু সিদ্ধার্থে'র নটবর সিদ্ধার্থ নামে মৃত এক ব্যক্তির ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল অজয়া নামে একটি সুন্দরী তরুণীর হৃদয় হরণের জন্য। তাদের বিবাহের আগে নটবরের জাল সিদ্ধার্থ পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ে। তার ছদ্মবেশের ব্যর্থতা প্রকৃতপক্ষে তার খলত্বের পরিণাম। 'গতিহারা জাহ্নবী'তে ভূস্বত্বভোগী নিষ্কর্মা স্থূল প্রবৃত্তিপরায়ণ গ্রাম্য যুবক অকিঞ্চন তার নববিবাহিতা স্ত্রী কিশোরীর দৃষ্টিতে কামার্ত বহুগামিতায় উৎসাহী যুবক। অকিঞ্চনের মাতা কাত্যায়নীকে কিশোরী মনে মনে বলেছে, 'জননী কতবার কত জলে স্নান করিলে তোমার পুত্র শুচি হইতে পারে?' তার প্রতি এ নারীর ঘৃণা ও অরুচি চরিত্রের খলন উন্মোচনে সহায়ক হয়েছে। স্বামীর পরনারীলোলুপতাকে ক্ষমা করতে পারেনি সে। 'রোমন্থনে' সম্মানিত ব্রাহ্মণ হয়েছেন কুচক্রী, মিথ্যা মামলার সাক্ষী। 'মহিষী'তে বখে যাওয়া অশোকের ইতরতা প্রকাশ পেয়েছে নিজ স্ত্রী সম্পর্কে কুৎসা রটনার মধ্য দিয়ে। কূটকৌশলী, অর্থগৃধ্নু মামলাবাজ ও সুদখোর মহাজন ব্রজকিশোরের পারিবারিক কাহিনী এটি। তার সমাজ কলুষ ও ইতরতায় পূর্ণ। দুলালের দোলায় কপটদের ভণ্ডামি ও ইতরতায় পূর্ণ পরিবেশ দেখা যায়। 'কলঙ্কিত সম্পর্ক' গল্পে সাতকড়ি নারী ধর্ষণের দায়ে জেল খেটে মুক্ত হয়ে পুনরায় স্ত্রীর সঙ্গে সংসার শুরু করে। 'আদিকলার একটি'তে সুবল কাঞ্চনের শিশুকন্যাকে বিবাহ করে তার মাতাকে সম্ভোগ করার অভিপ্রায় নিয়ে। তাকে ধর্ষণও করে সে। কাঞ্চন 'যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল, বহুদিনের সঞ্চিত ইচ্ছা খলতায় ছলনায় পরিপূর্ণ হইয়া শামুকের মতো ধীরে ধীরে বুকে হাঁটিয়া অগ্রসর হইয়া হঠাৎ খাড়া হইয়া উঠিয়াছে।...পাপিষ্ঠের এই লজ্জাহীন সহজ ধৃষ্টতায় তার ক্রোধের অন্ত রহিল না।' লেখকের রচনায় দেখা যায় নর-নারী সম্পর্কের ভেতর যৌন আনুগত্য নেই। বিবাহিত সম্পর্কের শুচিতা নেই। ছেলের জন্য নির্বাচিত পাত্রীর রূপে মুগ্ধ বাবা তাকে বিয়ে করে (পৃষ্ঠে শরলেখা) আবার স্ত্রী বর্তমানে দ্বিতীয় বিবাহ, সপত্নীর সমস্যার মধ্যে পুরুষের ইতরতাকে তুলে ধরেন লেখক। 'চন্দ্রসূর্য যতোদিন' গল্পে শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে দীনতারণ প্রথম স্ত্রী ক্ষণপ্রভা থাকতেও শালিকা প্রফুল্লকে বিয়ে করে। জগদীশ গুপ্তের রচনায় পরনারী সম্ভোগে খল চরিত্রগুলোর মনের কোনো নৈতিক বা রুচিগত বাধা নেই। তাদের যৌনক্ষুধার কাছে সম্পর্কজনিত বাধাও বাধা নয়। হিংস্র পাশবিক নীচতায় ভরা জগতে মানুষের ঈর্ষা ও অর্থগৃধ্নুতা সহজাতধর্ম। সম্পত্তি ও টাকার জন্য কুকর্মই এদের দ্বারা সম্ভব। পয়সায় পাপ নেই বলে বন্ধুকেও এরা হত্যা করতে পারে।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'কুয়াশা' উপন্যাসের নায়ক প্রদ্যোত বসুর অতীত জীবন কলুষময় ও ইতরামোতে পূর্ণ। অতীতে সে ছিল জোচ্চোর ও শঠ। অনৈতিক জীবনযাপন নোংরামো ও অসুখে পরিপূর্ণ। 'উপনায়নে' একইভাবে তরুণ সন্ন্যাসী অমৃতানন্দের অতীত হচ্ছে দারিদ্র্য, অনৈতিক ও মনুষ্যত্বহীনতার জীবন। সে অতীতে ছিল বিনু। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও বস্তিবাসী বিনু বাবার অনাচারে জীবনের সুস্থতা থেকে বঞ্চিত হয়। জীবনানন্দ দাশের 'মাল্যবান' উপন্যাসের মাল্যবান-স্ত্রী উৎপলা দাগি অপ্রেমের নারী। হৃদয়হীন নির্মম ও ঘৃণ্য। মাল্যবান বলেছে, 'কতো যে সজারুর ধ্যাষ্টামো, কাকাতুয়ার নষ্টামি, ভোঁদরের কাতরতা, বেড়ালের ভেংচি, কেউটের ছোবল আর বাঘিনীর থাবা এই নারীটির।' স্ত্রীর খলপনার জন্য মর্মান্তিক বিরূপতার সম্পর্ক তাদের দাম্পত্যে।
তিরিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে মানিক, তারাশঙ্কর এবং অন্যদের রচনায় খলাঙ্কন গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। 'কল্লোল' এবং তার পরবর্তী যুগের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা খল চরিত্র নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি'র 'রহস্যময়' হোসেন মিয়া মাঝিদের নিস্তরঙ্গ জীবন বদলে দিয়েছে। গোপন ও দুর্জ্ঞেয় মতলব হাসিল করতে গিয়ে খলতার পরিচয় দিয়েছে সে। 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পে ক্রূরতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুর নির্দয়তা, অকৃতজ্ঞতা, যৌনতা, প্রবৃত্তিতাড়না ও বেঁচে থাকার দুর্নিবার প্রয়াস প্রভৃতির সমন্বয়ে ডাকাত ও ভিখারি ভিখুকে অনন্য খলের নিদর্শন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন মানিক। ডাকাতি করতে গিয়ে আহত হয়ে বন্ধু পেহ্লাদ বাগদির গৃহে আশ্রয় না পেয়ে তাকেই খুন করার হুমকি দেওয়া, আশ্রয়দাতা পেহ্লাদের স্ত্রীকে লাঞ্ছনার পর বন্ধু কর্তৃক প্রহৃত হয়ে তার গৃহেই অগি্নসংযোগ, ভিক্ষাবৃত্তি জীবনে পাঁচীকে পাওয়ার জন্য বসিরকে হত্যা প্রভৃতি ঘটনা তার চরিত্রে পাঁচীর প্রতি মমত্ববোধকে অতিক্রম করে যায়। সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন প্রবৃত্তিতাড়িত ভিখু বলিষ্ঠ বীভৎস আদিম মানবের জিঘাংসা, রিরংসা ও ভোগবাদিতায় শিল্পিত। লেখকের 'জীবনের জটিলতা' উপন্যাসে বিমল নিম্ন-মধ্যবিত্ত। দাম্পত্য জীবনে যৌনঈর্ষাকাতর। চক্রান্তপরায়ণ, নীরব পীড়নকারী। স্ত্রীকে স্নায়বিক অত্যাচার চালায়, আত্দহত্যায় প্ররোচিত করে। স্ত্রী তার কারণে আত্দহত্যা করলে স্ত্রীর প্রেমিকের বোনকে বিয়ে করতে চায় সে। নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তার এ আকাঙ্ক্ষা। 'অহিংসা'র আশ্রম পরিচালক বিপিন ভণ্ড। আশ্রম হচ্ছে তার ধন উপার্জনের উপায় এবং আশ্রমের কপট সাধু সদানন্দ ধর্মের মুখোশ আবৃত এক যৌনবিকারগ্রস্ত মানুষ। 'দর্পণে'র মিল মালিক লোকনাথ ধূর্ত, ঠগ, ফন্দিবাজ ও কূটকৌশলী। নানা কৌশলে শ্রমিকদের শোষণ করে সে। নিকটাত্দীয়ের সঙ্গে প্রতারণা করে। পারিবারিক জীবন তার কলুষ, অনৈতিকতা ও বিকারে পূর্ণ। লাম্পট্য তাদের পরিবারের প্রধান ধর্ম। 'জীয়ন্তে' নারীলিপ্সু চরিত্রহীন জমিদার পুত্র খলামি করেছে। প্রজাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে কাপুরুষ জমিদার পুত্র পালিয়ে গেছে কলকাতায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'আরণ্যকে' দেবী সিং, ছটু সিং, রাসবিহারী সিং, নন্দলাল ওঝার মতো স্বার্থপর ও প্রতিপত্তিশালী অত্যাচারী মহাজন চরিত্র অঙ্কন করেছেন। যারা জমি বিলি থেকে মুনাফা করতে চায়।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা-পঞ্চগ্রাম, নীলকণ্ঠ, প্রেম ও প্রয়োজন, কালিন্দী প্রভৃতি উপন্যাসে খলদের সমাবেশ লক্ষণীয়। 'গণদেবতা-পঞ্চগ্রাম' উপন্যাসের খল শিরোমণি শ্রীহরিপাল। সে 'ইতর, লম্পট, প্রভুত্বগর্বোদ্ধত'। এ উপন্যাসে সমাজপতিদের ক্রূর অভিসন্ধিপরায়ণতা, ষড়যন্ত্র, কুটিলতায় অপর ব্যক্তিজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। নীলকণ্ঠে মহাজন চরিত্রটি ক্রূর, অভিসন্ধিপরায়ণ, অসৎ প্রতারক, লোভী। প্রেম ও প্রয়োজনে জমিদার লোভী, দাম্ভিক, ক্রূরতা ও বহুনারীসম্ভোগে পঙ্কিল। কালিন্দীর নব্যবণিক বিমলবাবু কূটকৌশলী, শঠতা ও অর্থের জোরে চরের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
বনফুলের 'বৈতরণী তীরে' উপন্যাসে ধনী বন্ধু দরিদ্র স্বামীর রূপসী স্ত্রীকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে স্বামী ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যদিকে দাগি বিবাহিত নারী স্বামীকে ভালোবাসতে পারে না স্বামীর ভালোমানুষী স্বভাবের জন্য। সে ভালোবাসতে চায় শক্তিমান নিষ্ঠুর পুরুষকে। নিষ্ঠুরতা ও শক্তিকেই সে গণ্য করে পৌরুষরূপে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের 'সত্যাসত্যে'র দে সরকার সন্দীপের মতোই নর-নারী সম্পর্ক বিষয়ে নায়িকা উজ্জয়িনীকে আন্দোলিত করতে চেয়েছে। বাদল তার বন্ধু হলেও তাকে শত্রু ভেবেছে। কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলীযাত্রী মুমূর্ষু সীতারাম চট্টোপাধ্যায় যশোবতীর চরিত্রে সন্দেহ করে বলেছে, 'হারামজাদী নষ্ট খল খচ্চর মাগী।' এখানে 'খল' শব্দটির প্রয়োগ লক্ষণীয়। সমরেশ বসুর উপন্যাসে বিদ্বেষপরায়ণ, হিংস্র, নির্বেদজর্জর, বিচ্ছিন্ন ও আত্দগ্লানিময় চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। 'স্বীকারোক্তি'র অনামা নায়কের হননের ইচ্ছা মানুষ সম্বন্ধে অবিশ্বাস, ঘৃণা বিবমিষা জন্ম দিয়েছিল। 'প্রজাপতি'তে সুখচাঁদ বা সুখেন গুণ্ডা মূল চরিত্র। 'পাতকে'র অনামা নায়ক মূল্যবোধের বিপর্যয়ে নিজের মাকে খুন করে। 'বিশ্বাস' উপন্যাসে লিপির মা ছুঁড়ি সেজে থাকে। কারণ অন্য লোকের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক। লিপির অবৈধ গর্ভ সঞ্চার ও গর্ভপাত এবং নীরেনকে ধোঁকা দিয়ে অন্যের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া খলাচার। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী'তে আছে খল জমিদার কুমার বিশ্বনাথ। ক্রোধ, প্রতিহিংসা, উগ্রতা, অমিতাচারী ও সম্ভোগমত্ত বেহিসেবী সে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'দ্বীপপুঞ্জে'র ধনী নবদ্বীপ সার পুত্র মুরলী সুদর্শন, নিষ্কর্মা এবং লম্পট। কৌশল কিংবা বলপ্রয়োগে নারীদেহ সম্ভোগই তার কাজ। গোপাল হালদারের 'ভাঙন' উপন্যাসে নৃপেন্দ্র অকর্মণ্য, আয়েশি, স্বার্থপর, সংকীর্ণ ও দুশ্চরিত্র। স্ত্রীর বর্তমানে একটি খ্রিস্টান ধাত্রী মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে সে। নীতিহীনতাই তার আদর্শ।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে যে খলমতি ও খলময় চরিত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার বাস্তব প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোকপাত পাওয়া যায় বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়র 'মান্ধাতার মুখ' উপন্যাসে। উপন্যাসের একটি চরিত্র ঋদ্ধিনাথ শর্মা বলেছে : 'ক্যারেক্টার বলতে তো স্রেফ ভণ্ডামি, চালাকি আর ভাঁওতাবাজি। সে কাজে যার যতো বেশি নাম সে ততো বড়ো ভণ্ড-ধূর্ত-ভাঁওতাবাজ। ইংরেজ শাসন আর ইংরেজি শিক্ষা এ দেশের মান্ধাতাকে প্যান্ট-সুট-বুট পরিয়ে আরও চালাক, আরও ভণ্ড, আরও বেশি ভাঁওতাবাজ করে ছেড়েছে। দেশের ছোটবড় সবার এখানকার ভাবনা কি করে ধরে মেরে শুষে খাব ও কি করে মান্ধাতার মতো রাজতি্ব করব।' বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসে এ ধরনের বাস্তবতা লক্ষ করা যায়। তাঁর উপন্যাসে নগরজীবনের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনের রূপে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বহুচারিতা, ছেনালিপনা, প্রগলভতা চিত্রিত হয়েছে। 'অসূর্যস্পৃশ্যা'র দাগি নারী ভানুমতী সেন। অর্থের জন্য অপরিসীম অতৃপ্তিগ্রস্ত, জমাট জমকালো জীবনলোলুপ। যেকোনোভাবে অর্থলাভ করা, ইচ্ছেমতো খরচ করা, শরীরকে সুখ দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী সে। ব্যারিস্টার স্বামী পেশাগত জীবনে ব্যর্থ হলে তার সানি্নধ্য সে অসহ্য মনে করে। লেখকের অন্যান্য উপন্যাসেও অর্থগৃধ্নুতা, বিলাস, বিকার ও ছেনালিপনা দেখা যায়। 'পরিক্রমা'য় বিজন ঘোষ অমার্জিত ও দুশ্চরিত্র। একঘেয়ে তাদের দাম্পত্য জীবন। সংকীর্ণ, পরশ্রীকাতর, কুৎসাপ্রবণ ও স্থূল তার মানসিকতা। ধনের প্রদর্শন, পরনিন্দা, পরছিদ্রান্ব্বেষণ এই জীবনের আনন্দ, ইতরতা ও নোংরামিতে পূর্ণ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়' উপন্যাসে রাইমোহন ধনী বাবুদের মোসাহেব। গান বাঁধতে জানে, সুরও দেয়; সংস্কৃতিমনা। সে বাইজি হীরা বুলবুলকে ভালোবাসে। জমিদার শ্রেণী প্রজা-পীড়ন করত তার নিদর্শন ত্রিলোচন দাসের নিপীড়ন। কলহ, ঈর্ষা, লোভ, লালসা, চতুরতা, প্রতারণা আর ব্যভিচার মিছিল করেছে এ উপন্যাসের মধ্যে। শংকর ওরফে মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের সীমাবদ্ধ (চলচ্চিত্র সত্যজিৎ রায়) উপন্যাসে শ্যামলেন্দু উচ্চাশাকে বাস্তবে রূপ দিতে নীতিবোধ বিসর্জন দিয়ে খলামিতে লিপ্ত হয়। ইংরেজির অধ্যাপক থেকে কম্পানির ডিরেক্টর পদে আসীন হয়েছে নীতি বিসর্জন দিয়ে দিয়ে। দেবেশ রায়ের 'সময় অসময়ের বৃত্তান্তে' পুলিশ খলের ভূমিকায় অবতীর্ণ। পুলিশ নারী ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়। আবুল বাশারের 'ফুলবউ' উপন্যাসে মিল্লাতের বাবার বিধবা চতুর্থ স্ত্রী রাজিয়াকে ধর্ষণ করে মিল্লাতের বন্ধু মবিন।
বাংলাদেশের উপন্যাসে বিখ্যাত সব খল চরিত্র সাহিত্যের খলযাত্রায় শামিল হয়েছে। লাল সালুর মজিদ, চাঁদের অমাবস্যার কাদের, শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তকের রমজান ও সারেং বৌয়ের লুন্দর শেখ, সূর্যদীঘল বাড়ীর গদু প্রধান, সালাম সালেহ উদ্দীনের নগরবালার আশরাফ উল্লেখযোগ্য। শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন প্রমুখের রচনায় একাধিক খল চরিত্র বাংলা সাহিত্যের সরণি প্রদিক্ষণ করেছে। খলের রাজত্ব দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধের একাধিক উপন্যাসে। উপন্যাসে রাজাকার চরিত্র রূপায়ণে লেখকরা তাদের খল সম্রাট করে চিত্রিত করেছেন।
মূলত সাহিত্যে খল চরিত্রের স্বরূপ ও ক্রিয়া বর্ণনা করেছেন অনেক লেখক। প্রাচীন-মধ্যযুগের সাহিত্যের খল আধুনিক সাহিত্যে ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তবে বাংলা সাহিত্যের খলের ক্ষেত্রে দেখা যায় তরুণ, বৃদ্ধ ও মধ্যবয়সী প্রত্যেকেই ধুরন্ধর, অসৎ, নিষ্ঠুর, দুশ্চরিত্র, মেরুদণ্ডহীন। দুর্বল ও অভিসন্ধিপরায়ণ তারা। উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ নির্বিশেষ তাদের খলযাত্রা একই গন্তব্যে ধাবমান।