Sunday, July 11, 2010

ঢাকেশ্বরী মন্দির

47 comments
ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির ঢাকেশ্বরী। এর নির্মাণকাল ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক। কিংবদন্তি অনুসারে একবার রাজা বিজয় সেনের রানি লাঙ্গলবন্দে স্নানে গিয়েছিলেন। স্নান শেষে ফেরার পথে তার একটি পুত্রসন্তান জšে§ছিল, ইতিহাসে যিনি বল্লাল সেন নামে পরিচিত। বল্লাল সেন সিংহাসনে আরোহণের পর নিজের জš§স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্মাণ করেছিলেন এই মন্দির। আরেকটি সূত্রে জানা যায়, বল্লাল সেন একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন এই জায়গায় জঙ্গলে ঢাকা অবস্থায় পড়ে আছে দেবী। বল্লাল সেন এই দেবীকে উদ্ধার করে সেখানে স্থাপন করে মন্দির, যা পরিচিত হয়ে ওঠে ঢাকেশ্বরী নামে। তবে স্থাপত্য কৌশলের বিবেচনায় বল্লাল সেন কর্তৃক ঢাকেশ্বরী মন্দির নির্মাণের ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে নিয়ে আরেকটি কিংবদন্তি হচ্ছে, দক্ষ যজ্ঞের সতী নিকৃষ্ট পতির নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহ ত্যাগ করলে শোকে মুহ্যমান মহাদেব সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। এমন নৃত্যে সতীর অবমাননা হয় ভেবে বিষ্ণু তার চক্র দ্বারা সতীর দেহ ছিন্ন ভিন্ন করেছিলেন। ফলে সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে যে স্থানে পড়েছিল সে স্থানগুলো এক একটি পীঠস্থানে পরিণত হয়। সতীদেহের উজ্জ্বল কিরিটের ডাক তথা উজ্জ্বল গহনার অংশবিশেষ এ স্থানে পতিত হলে ওই স্থানের নাম হয় ঢাকা এবং অধিষ্ঠাত্রী দেবী ঢাকেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। যেভাবেই নির্মিত হোক না কেন, দেশের হিন্দু সম্প্রদায় মনে করেন, ঢাকেশ্বরী ঢাকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী তথা ঢাকার দেব দেবীর সভানেত্রী। বাংলা চৌচালা ও শিখর মন্দিরের মিশ্রণ লক্ষ করা যায় ঢাকেশ্বরী স্থাপত্যে। এর নির্মাণশৈলী ও গঠন প্রণালি থেকে ধারণা করা যায় প্রথমে তা বৌদ্ধ মন্দির ছিল। পরবর্তী সময়ে যা রূপান্তরিত হয় হিন্দুমন্দিরে। উনিশ শতকের শেষের (সম্ভবত সত্তরের দশকের) দিকে মন্দিরটি ছিল জঙ্গলে আবৃত। তখন রক্ষণাবেক্ষণের মতো কোনো পুরোহিত ছিল না। মন্দির অঙ্গনে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি সিংহদ্বার। সিংহদ্বারটি নহবতখানা তোরণ নামে পরিচিত। এ সিংহ দ্বারটির ভেতর দিয়ে এক সময় হাতি যাতায়াত করত। পঞ্চরতœ ও নটমন্দির পাশাপাশি অবস্থিত। নট মন্দিরকে ঘিরে আছে একসারি ঘর। মন্দিরের জলাশয় ও বিশ্রামাগারের পূর্ব পাশে সাধুদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত কয়েকটি সমাধি রয়েছে। এ মন্দির বা দেউলের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু হলো শিবলিঙ্গ। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের শ্রী শ্রী দূর্গাদেবী বা দশভুজা মাতা স্বর্ণনির্মিত বলে উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। দেবী মাতার সিংহাসন কাঠের ওপর রৌপ্য বসানো কারুকার্য খচিত ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ নভেম্বর রাতের বেলায় একদল মুখোশ পরিহিত দুষ্কৃতকারী মন্দিরের স্বর্ণমূর্তিসহ অন্যান্য মূর্তি স্বর্ণালংকার এবং সিংহাসনে রৌপ্যের কারুকার্য খচিত অংশগুলো লুট করে নিয়ে যায়। ফলে মন্দিরটি শ্রীহীন হয়ে পড়ে। এমন অপ্রীতিকর ঘটনায় হিন্দু ধর্মানুরাগীরা প্রচণ্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরে ঢাকার কিছু বিশিষ্ট হিন্দু ঢাকেশ্বরী মাতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তারা দেশের খ্যাতনামা পণ্ডিতদের সহায়তায় যজ্ঞাদি ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে ঢাকেশ্বরী মাতার নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায়, এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী হিন্দু মিথ্যা ও ভুয়া কাগজপত্র বের করে দেবোত্তর সম্পত্তি গ্রাসের উল্লাসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ন্যক্কারজনক জঘণ্য অপরাধ তাদের দ্বারাও হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণা। আগের দিন চৈত্র মাসে এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে বিরাট মেলা বসত। অনেকেই চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমীতে লাঙ্গলবন্দে মিলিত হয়ে আশির্বাদ লাভ কল্পে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করত। ওরা ‘ওম ঢাকা ঈশ্বরী’ বলে দেবী মাতাকে সমস্বরে প্রণাম জানাত। আজও চৈত্রের শেষ দিবসে বহু হিন্দু নর-নারীর আগমন ঘটে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। পহেলা বৈশাখে হিন্দু ব্যবসায়ীগণ নতুন হিসাবের খাতা নিয়ে আসে মায়ের মন্দিরে ব্যবসায়ের শুভ মহরত তথা সাফল্য কামনায়। বাংলাদেশে ধর্মচর্চার জন্য তেমনভাবে কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে নতুন আঙ্গিকে বিশ্ব ধর্মতত্ত্বের এক কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। সৌহার্দ, সম্প্রীতির সেতুবন্ধন হিসেবে ঢাকেশ্বরী মন্দির থাকুক চিরজাগ্রত। আর বাংলাদেশ ফিরে পাক তার হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য।

47 comments:

Post a Comment