Friday, July 16, 2010

ঠকচাচা

0 comments
আলালের ঘরের দুলালের (১৮৫৮) কাহিনীকারের মতোই প্রকৃত নামটি পর্দার অন্তরালে রয়ে গেল ঠকচাচার। টেকচাঁদ ঠাকুরের আসল নাম (প্যারীচাঁদ মিত্র) যদিওবা আজ সর্বজনবিদিত, কিন্তু মোকাজান মিয়াই যে ঠকচাচা_অনেকেই তা আর মনে করতে পারবেন না। ঠকচাচার আড়ালে ঢাকা পড়েছেন মোকাজান মিয়া। তবে কি প্রকৃত নামকে অতিক্রম করেছে তাঁর কীর্তি? আপাতত তা-ই মনে হয়, কিন্তু কপটতাই মোকাজানের একমাত্র জীবন-পাথেয় নয়। বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে ক্লাসিক মর্যাদাপ্রাপ্ত 'আলাল'-কাহিনীর সবচেয়ে ক্রিয়াশীল চরিত্র ঠকচাচা। এই ঠকচাচা বাংলা কথাসাহিত্যে উচ্চারিত সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম চরিত্র-নাম, যে নামের বয়স দেড় শ বছর পেরিয়েছে বেশ আগেই।
আখ্যায়িকা নাকি উপন্যাস_কী বলব 'আলালের ঘরের দুলাল'কে_সে বিবেচনা উহ্য রেখেই ঠকচাচাকে নিয়ে আলোচনা করা চলে। বাঙালির আখ্যান নির্মাণ মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ও পীর পাচালি থেকে শুরু। ইউরোপ এমন আখ্যানকে উপন্যাস বলতেই পারে। কারণ এ কাহিনীতে 'পূর্ণ-জীবন-প্রমাণ' আছে একমাত্র ঠকচাচাতেই। ঠকচাচা নিজ হাতে নিজের ভাগ্য গড়েছেন, ভাগ্যের বিড়ম্বনায়ও পড়েছেন। বেঁচে থাকার জন্য তাঁকে বেশ কপটতার আশ্রয় নিতে হয়। জেনেশুনেই তিনি তা করেন। কিন্তু একমাত্র স্ত্রীর (ওই সময় বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজে পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণকে দোষ বলে বিবেচনা করা হতো না।) কাছে তিনি অকপট, উদারজন। স্ত্রীর মৃদু ভর্ৎসনাও তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করেন। স্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরতা, নিজের অনুপস্থিতিতে স্ত্রী অন্যকে নিকা করবে এই ভয়, স্ত্রীকে ভালোবাসা_কোনো কিছুর কমতি নেই তাঁর। ১৮৫৮-এর আগে বাংলা মৌলিক গদ্যকাহিনীতে এমন সক্রিয় চরিত্র আর ছিল না; কবিতায় ছিল, ভাঁড়ু দত্ত তাঁর নাম। ঠকচাচা বলেছেন : 'মুই বুক ঠুকে বল্ছি যেত্না মামলা মোর মারফতে হচ্ছে সে সব বেলকুল ফতে হবে_আফদ বেলকুল মুই কেটিয়ে দিব_মরদ হইলে লড়াই চাই_তাতে ডর কি?' ঠকচাচা 'লড়াই' করতে বলেছেন, নিজে 'লড়াই' করেছেন। সত্যি বলতে, বাংলা কথাসাহিত্যে 'লড়াই' করা ঠকচাচাই প্রথম 'মরদ' চরিত্র।
আপ্ত বিশেষণ এই_'খলচরিত্র' ঠকচাচা। কী করে ঠকচাচা 'খল' হলেন বোঝা দায়! চরিত্রকে এভাবে 'খল' অভিধা দিলে 'নির্মল' চরিত্র বলেও তো কিছু একটা থাকার কথা। কিন্তু 'নির্মল' বলে সত্যি কি কিছু আছে এ জগতে_বিশেষ করে মনুষ্য চরিত্রে? বাংলা সাহিত্যেই কোনটি 'নির্মল' চরিত্র? 'নির্মল' চরিত্র দেবতার হতে পারে, মানুষের নয়। কারণ জগৎটাই তো 'নির্মল' নয়। ঠকচাচার অভিজ্ঞতাও বলে : 'দুনিয়া সাচ্চা নয়_মুই একা সাচ্চা হয়ে কি কর্বো?' তাই তিনি মনে করেন: 'দুনিয়াদারি করতে গেলে ভালা বুরা দুই চাই_'। ঠকচাচা কেন 'বুরা'-কর্মে লিপ্ত? ঠকচাচা ও ঠকচাচির কথোপকথনেই বিষয়টি স্পষ্ট : 'ঠকচাচী মোড়ার উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন_তুমি হররোজ এখানে ওখানে ফিরে বেড়াও_তাতে মোর আর লেড়কাবালার কি ফয়দা? তুমি হর ঘড়ী বল যে হাতে বহুত কাম, এতনা বাতে কি মোদের পেটের জ্বালা যায়। মোর দেল বড় চায় যে জরি জর পিনে দশ জন ভাল২ রেণ্ডির বিচে ফিরি, লেকেন রোপেয়া কড়ি কিছুই দেখি না, তুমি দেয়ানার মত ফের_চুপচাপ মেরে হাবলিতে বসেই রহ। ঠকচাচা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া বলিলেন_আমি যে কোশেশ করি তা কি বল্ব, মোর কিত্না ফিকির_কেত্না ফন্দি_কেত্না প্যাঁচ_কেত্না শেন্ত তা জবানিতে বলা যায় না, শিকার দস্তে এল২ হয় আবার পালিয়ে যায়।' তাই ঠকচাচা বলেন : 'মুই ওক্ত বুঝে হাত মার্বো।' যিনি স্ত্রীকে সুখী ও খুশি করে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন এবং সময় বুঝে 'হাত মারেন' তাঁকে কিনা বলব 'খল চরিত্র'?
আসলে মোকাজান সম্পর্কে কাহিনীর শুরুতে লেখক যে নেতিবাচক ধারণা দিয়েছেন, পাঠক এবং পরে সমালোচকরা তা থেকে আজও বের হতে পারেননি। টেকচাঁদ ঠাকুর মোকাজান সম্পর্কে কাহিনীর প্রথম দিকে লিখেছেন এ রকম : মোকাজান আদালতের কাজে বড় পটু। নানা কিছু জাল করতে, মিথ্যা সাক্ষ্য সাজাতে, দারোগা-আমলা বশ করতে, সম্পদ 'হজম' করতে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করতে, হ্যাঁ-কে না আর না-কে হ্যাঁ করতে তাঁর তুলনা নেই। এ জন্য নীলকর ও জমিদারদের কাছে মোকাজানের খুব কদর। এ চরিত্র সম্পর্কে টেকচাঁদ আরো লিখেছেন : 'তাহাকে আদর করিয়া সকলে ঠকচাচা বলিয়া ডাকিত,...।' 'ঠকচাচা' নাম একবার উল্লেখমাত্রই কাহিনীকার থেমে যেতে পারতেন, সে সুযোগ তাঁর ছিল। কারণ তিনি তো কাহিনীর 'সকলে' নন, কাহিনীকার। কিন্তু প্যারীচাঁদ স্বয়ং মোকাজান নামটি আর নিলেনই না, তাঁকে 'ঠকচাচা' বলেই উল্লেখ করে গেলেন কাহিনীজুড়ে। কাহিনীকারের পক্ষপাতে ঠকচাচা নামটিই বড় হলো মোকাজান মিয়া নামের চেয়ে। আর 'ঠক' কথাটি নামের সঙ্গে বহুবার উচ্চারিত-আলোচিত-পঠিত হওয়ায় মোকাজানের কপালে 'খলচরিত্র'-এর তিলক হলো আঁকা। আমার বিশ্বাস, প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর কাহিনীতে মোকাজানকে সব সময় 'ঠকচাচা' (এবং তাঁর স্ত্রীকে ঠকচাচি) বলে উল্লেখ না করলে মোকাজান 'খলচরিত্র' বলে সহজে পরিচিত হতেন না। আমরা কি এখন থেকে মোকাজানকে মোকাজান বলে সম্বোধন বা অভিহিত করতে পারি না? কী আশ্চর্য, প্যারীচাঁদের ভাষায় মোকাজানের স্ত্রীও হলেন 'ঠকচাচী'? লেখক তাঁর জন্য কোনো নাম পেলেন না? যিনি কি না গ্রামীণ নারীদের নিয়তি-নির্ভরতা ও নানা সংস্কারকে অবলম্বন করে স্বামীর কষ্টের সংসারে একটু সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজেছিলেন_তাঁকেও 'ঠকচাচী' নাম দিয়ে 'খল-সহধর্মিণী' বানানো বিবেচনাপ্রসূত ছিল কি? 'আলাল'-কাহিনীতে তাঁরাই তো সবচেয়ে নিবিড় দম্পতি, পরস্পর পাশে থেকে যাঁরা একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন সুখ-দুঃখের পসরা! তাহলে তাঁদের জন্য এ অপবাদ কেন? লেখকের দৃষ্টিতে ঠক-দম্পতি হলেন তাঁরা? আর গত দেড় শ বছর ধরে গতানুগতিক মূল্যায়নে বদ্ধ থাকলেন এই যুগল!
মোকাজানকে বলেছি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম 'মরদ' অর্থাৎ পুরুষ চরিত্র। 'নর' মানেই 'পুরুষ' নয়। পুরুষ আর পৌরুষত্ব সম্পর্কান্বিত। পৌরুষত্বের সঙ্গে যুক্ত তেজ, বীর্য, পরাক্রম। অর্থ-পরিব্যাপ্তির দিক থেকে এই প্রতীতি বিচার করলে বলতে হয়, মোকাজানে এ তিনটিই আছে। কর্ম সম্পাদনে তাঁর তেজোদ্দীপ্ততার পরিচয় মেলে; স্ত্রীর প্রতি নিজের নিষ্ঠা এবং নিজের অনুপস্থিতিতে স্ত্রী অন্য কাউকে নিকা করতে পারে_এই চিন্তা বীর্য-ভাবনাপ্রসূত; আর যাঁর কাছে নীলকর বা জমিদার আশ্রয়প্রার্থী, ছেলের হাজতবাসের সংবাদ শুনে মাথায় 'বজ্র ভাঙ্গিয়া' পড়া ধনাঢ্য বাবুরাম বাবু যাঁর শরণ নেন, তিনি যে স্বীয় পরাক্রমের সীমা কত দূর সম্প্রসারিত করেছেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। নিজের বিপৎকালেও যিনি ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রীয় তর্ক অবসানে অগ্রসর হন, তিনি যে পরম বিচক্ষণ সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই বলি, 'আলাল'-কাহিনীতে অনেক 'নর' চরিত্র আছেন বটে, কিন্তু মোকাজান ছাড়া কেউ সে অর্থে 'পুরুষ' নন। নিশ্চয়ই মরণে ভয় আছে তাঁর_মানুষের যেমন থাকে। কিন্তু মরার আগে মরতে রাজি নন তিনি। বাবুরাম বাবুকে নিয়ে নদীতে নৌকাসহ ঝড়ের মুখোমুখি হওয়ার পরও মুখে সাহস প্রদর্শন করতে ছাড়েননি মোকাজান। তিনি বাবুরামের উদ্দেশে বলেছেন : 'ডর কেন কর বাবু? লা ডুবি হইলে মুই তোমাকে কাঁদে করে সেতরে লিয়ে যাব_আফদ তো মরদের হয়।' পরে অন্যত্র বেণীবাবু ও বেচারামের সঙ্গে কথোপকথনকালেও তিনি মরদের লড়াইয়ের প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ করার ব্যাপার, মোকাজান সব সময় 'নর'কে 'মরদ' বা 'পুরুষ' হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। সাধারণ 'নর'-এর জীবন তাঁর কাছে কাম্য ছিল না।
'আলাল'-কাহিনীর শেষ দিকে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জাহাজে চড়ে দূর দেশে যাওয়ার সময় মোকাজান বলেছেন : 'মোদের নসিব বড় বুরা_'। সত্যি বলতে, ভাগ্য তাঁর পক্ষে ছিল না। ভাগ্য পক্ষে না-থাকায় শেষ পর্যন্ত কঠিন শাস্তি জোটে তাঁর 'কপালে'। শুধু ভাগ্য নয়, লেখক নিজেও কি বিপক্ষে ছিলেন না মোকাজানের? ছিলেন। প্যারীচাঁদ মোকাজানের বিপক্ষে ছিলেন বলে নামে তো তাঁকে 'ঠকচাচা' বানানো হয়েছেই, উপরন্তু কাহিনীর শেষ দিকে বেশ কিছু দুর্বলতাও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে এ চরিত্রে। তার পরও 'আলাল'-কাহিনীতে 'পূর্ণ-জীবন-প্রমাণ' বলে যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা আছে মোকাজানেই। মোকাজান 'খল-চরিত্র' নয়_'আলাল'-কাহিনীর প্রকৃত 'মরদ' চরিত্র_আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম 'মরদ'ও।

0 comments:

Post a Comment