মঙ্গলকাব্যগুলো বাংলার ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালের ভাষ্য। ওই সময়টায় বাংলার রাষ্ট্র-সমাজ নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা জটিলতার ঘূর্ণাবর্তে উপনীত। এ জটিলতার প্রভাব সমাজ-সংস্কৃতির ওপর তো বটেই, মানুষের ওপরও বর্তেছে। কাজেই সে সময়কার সাহিত্যে বর্ণিত বিভিন্ন চরিত্রের পশ্চাতে সমকালীন জীবনের একটা সংলগ্নতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না, এমনকি সে চরিত্র যদি পৌরাণিক বা ধর্মাশ্রিতও হয় তবুও।
ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের তুলনায় এর পূর্ব দিককার বাংলা অঞ্চল অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও এর রাজনৈতিক-সামাজিক গুরুত্ব একপর্যায়ে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক হয়ে দেখা দেয়। দুজন প্রধান ধর্মপ্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ এবং জৈন মহাবীর বাংলায় ধর্ম প্রচারের জন্য আসেন। মৌর্যযুগের দীর্ঘ দুর্ভিক্ষ এবং মগধে দক্ষিণী ও তিব্বতি আগ্রাসনের পরিণামে মগধ থেকে বাংলা অভিমুখী জন-অভিপ্রয়াণের (সধংং-সরমৎধঃরড়হ) বিষয়টিও এখানে স্মর্তব্য। গুপ্তযুগেও বাংলার ঊর্ধ্বাঞ্চল মগধে : গুপ্ত-সম্রাটদের আকর্ষণের উপলক্ষ ছিল। শশাঙ্কের গৌড়তন্ত্রের প্রভাবে সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলে বিস্তার ঘটে শৈবতন্ত্রের। এদিকে দক্ষিণ ভারতের সেনারাও একসময় এসে হাজির হয় প্রথমত রাঢ় অঞ্চলে এবং ক্রমশ পুণ্ড্রান্তরে। পালরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রাও তাঁদের শাসনামলে মর্যাদাপূর্ণ অংশীদারির মালিক। পরবর্তী সময়ে সেন আমল থেকে তুর্কি বিজয়কাল পর্যন্ত বাংলায় দেব-খৰ-বর্মণ-চন্দ্র প্রভৃতি রাজবংশ কোনো না কোনো দিকে প্রতিপত্তিশালী। সুলতানি আমলে বিদেশি সংস্কৃতি ও মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটে বাংলায়। দিলি্লতে মোগলদের শক্তিশালী অবস্থানের সুযোগে আফগানরা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে বাংলার দিকে। রাজনৈতিকভাবে বাংলা অঞ্চলে বিকাশ ঘটে বৈচিত্র্যের।
পেশাগত বিচারেও দেখা যাবে, কয়েক শ বছরের ব্যবধানে বাংলার সমাজজীবন বিচিত্র পদ-অভিধায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উচ্চতর আর্য শেণীগুলো ছাড়াও নানা প্রশাসনিক প্রয়োজনে এবং ভূমিকেন্দ্রিকতার কারণে মানুষ বৃত হয়েছে নতুন নতুন পরিচয়ে। মধ্যযুগের বাংলায় তথা সুলতানি মোগল আমলে কমপক্ষে ছত্রিশ রকমের পেশাধারী মানুষের হদিস পাওয়া যাবে। এ পেশাবৈচিত্র্য মানুষ মানুষে প্রভেদ গড়েছে। মাথাপিছু পুঁজির অধিকারিত্ব সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক বৈচিত্র্য ও সম্পর্ক জটিলতার হেতু। সব মিলিয়ে একটা জটিল মানবিক সংস্কৃতিও মধ্যযুগের বাংলায় লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ভাঁড়ু দত্ত চরিত্রটি মধ্যযুগের বাংলার বহুস্তরা সামাজিক জীবনের প্রতিনিধি। চণ্ডীমঙ্গলের অনেক কবির কাব্যেই ভাঁড়ু একটি প্রাণবন্ত চরিত্র, বিশেষ করে দ্বিজ মাধব এবং মুকুন্দরামের কাব্যে সে শিখরস্পর্শী। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁকে দিয়েছেন এমন অবয়ব। চণ্ডীমঙ্গল কবির এমন একটা সময়ের রচনা যখন তিনি বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে অন্যের করুণা-দয়ায় আশ্রিত। বাকি জীবন আর তাঁর ফেরা হয়নি আপন ভূমে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার আফগান শাসন অপসৃয়মাণ। মোগলরা একে একে ঢুকছে পূর্ব পরিবৃত্তে। বার ভূঁইয়ার দাপট ম্রিয়মাণ।
উড়িষ্যার পরাক্রমশালী কতলু খাঁ নিহত হন মানসিংহের হাতে। সেই ক্রান্তিকালে বিপর্যয় জাপটে ধরে জীবনের অভিজ্ঞতাধারী মুকুন্দরামকে। তাঁর কাব্যে প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের গ্রাম ত্যাগের ও সুস্থিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত কবির ভেতরে উন্মীলন ঘটায় এক নব নয়নের। ফলে সামাজিক কাহিনীর একটি ক্ষুদ্র পূর্বভাষণরূপে এসে পড়ে মূল্যবান 'গ্রন্থোৎপত্তির বিবরণ'।
সবটাই কবির জীবনের অভিজ্ঞতা। ভূমিকাংশের বিপর্যয়-বৃত্তান্ত এবং কাব্য-উপাখ্যানের প্লটটিও। কালকেতুর রাজ্য প্রতিষ্ঠার কাহিনী নিঃস্ব মানুষের স্বপ্ন-সংবচন এবং এর মাঝখানে ভাঁড়ু দত্ত মানবমনের স্বপ্ন-প্রসন্নতা ও আরাম ধ্বংসকারী এক চিরন্তন দুঃস্বপ্নের প্রতিরূপ। সাড়ে চার শ বছর আগেকার এ লোকটিকে যেন গতকাল, গত বছর, গত দশকে বা বিগত ইতিহাসের নানা বিন্দুতে দেখতে পাওয়া গেছে। যেন বিষাক্ত তীরের মাথাকে মধুমণ্ডিত করে এখনই ছুড়ে দেবে সে।
ভাঁড়ু শব্দটি মূলত 'ভণ্ড'_এই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাজাত। সে ভাঁড়ুতে পরিণত হয়ে বরং আরো বিচিত্র, আরো দুর্জ্ঞেয়। শব্দটিকে চমৎকার বিশেষ্য বানিয়ে দত্ত পদবিযুক্ত কায়স্থের পরিচিতি এনে যেন অধিকতর সমাজকেন্দ্রিক করে তোলা গেল। মুকুন্দরাম এখন তাঁর চণ্ডীমঙ্গল লিখছেন ১৫৯৬-১৬০০_এর মধ্যে তখন তো ভাঁড়ুরা বটেই, তারও অনেককাল আগে থেকে তারা বাংলার সমাজে-পরিবারে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে প্রকাশমান।
প্রতারণা, চক্রান্ত, নির্যাতন, ষড়যন্ত্র কেবল আজকের দিনের ঘটনা নয়। সন্ত্রাস, রাহাজানি, মাস্তানিও তেমনি উত্তরাধিকারের ফল। কালকেতু চেয়েছে একটি সুবিন্যস্ত শান্তিকামী অসাম্প্রদায়িক জনবসতির প্রতিষ্ঠা; কিন্তু মানুষের এসব মহৎ স্বপ্ন যেন কোনোকালেই পূরণ হওয়ার নয়। শ্রমবিমুখ, পরস্ব-অপহরণকারী, বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির কুচক্রের কাছে পরাজিত হয় সুস্থ-জীবনের অভীপ্সা। ভাঁডু দত্তেরও প্রায় সাত-আট শ বছর আগে চর্যাপদের কবি সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব ও ভাগ্যবিড়ম্বিত হওয়ার কথা পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই দুর্বলের নিগ্রহ চিরকালীন বাঙালি-জীবনের প্রধান কাহিনী। সে জন্যই ভাঁড়ুকে এমন হিরণ্যপ্রভা দেওয়ার আয়োজন দেখি কবির।
মনে হচ্ছে, যেন জটিল জীবনের ভেতর থেকে এক শক্তিশালী প্রেক্ষণযন্ত্র দিয়ে মুকুন্দরাম বের করে নিয়ে এসেছেন ভাঁড়ুকে।
কালকেতুর প্রতিষ্ঠিত নগর যে কেবল ভালো মানুষের সমবায়ে একটি আদর্শ উপনিবেশ হয়ে উঠবে, তা কিন্তু নয়। সে না চাইলেও মন্দ মানুষ ঢুকে পড়ে সেখানে। ফলে দ্বন্দ্ব হয়, জটিলতা বাড়ে, জীবনের বিরুদ্ধে স্রোতগুলো স্পষ্ট হয়। যদিও কবির বিবরণ দেখে মনে হতে পারে, ভাঁড়ু দত্ত একা, একাকী, সমাজবিরোধী মধ্যস্বত্বভোগী এক ব্যক্তি। কিন্তু তার পেছনে একটি চক্র হয়তো সক্রিয়। হাটুরেদের মধ্যে ভাঁড়ুর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ এবং দম্ভোক্তি (আমি মহামণ্ডল আমার আগে তোলা) প্রবল সমাজবিরোধীদের কার্যকলাপ। দেশ বাইরের মানুষের দখলে, স্বদেশিদের বেদনা অন্তহীন। ফুল্লরার শ্রমের পসরা রোদে-বৃষ্টিতে কেবলই দীর্ঘশ্বাস ছড়ায় অথচ আপন মানুষদেরই অচেনা ঠেকে। সব চাপের শিকার হয়ে পড়ে শ্রমজীবী মাটিসংলগ্ন জনমণ্ডলী। এমন নগর কালকেতুর প্রত্যাশা ছিল না, ছিল না কবিরও।
পরশ্রীকাতরতার শ্রেষ্ঠ মধ্যযুগীয় দৃষ্টান্ত ভাঁড়ু দত্ত। সমগোত্রীয় মানুষের উত্থানে সে ঈর্ষাকাতর। অন্যের আনন্দ, অন্যের উন্নতি তাকে জ্বালিয়ে মারে। নিম্নস্থ ব্যাধের রাজ্য হওয়াটা তো অনেক বড় সর্বনাশ (ভাঁড়ুর চোখে) কাজেই রাজতোষণের মায়াময় আয়োজন ভাঁড়ুর। রাজা দাক্ষিণ্য, দান, পৃষ্ঠপোষণায় নিজের বৈষয়িক সম্ভাবনা ফাঁপাতে থাকে ভাঁড়ু। উৎপাদন থেকে শত হস্ত দূরে থাকা ভাঁড়ুর সব ষড়যন্ত্র উৎপাদনাশ্রিত মানুষের বিরুদ্ধে। এরাই পরে আরো ভীষণ ও বিভীষণ হয়ে ওঠে।
মুকুন্দরামের কাব্যের শেষ দিকে ভাঁড়ুর পরিণামভোগ ও শায়েস্তার ব্যবস্থায় এটা মনে জাগা স্বাভাবিক যে ভাঁড়ুদের দৌরাত্দ্যেরও শেষ আছে। ভাঁড়ুকেন্দ্রিক দুঃস্বপ্নের অন্তিমে খানিকটা আরাম খোঁজা যায়_'ভাঁড়ুর ভিজায় মাথা দিয়া ঘোড়ার মুত'_এ-ও যে কাজ হয়নি তার প্রমাণ পরবর্তীকালের ভাঁড়ুর নব নব অবতারসমূহের ক্রমাবির্ভাবে। অনন্তর মধ্যযুগের বহু সাহিত্যে আমরা তাদের নানা রূপে নানা মূলে শনাক্ত করি, যাদের বারবার উত্থান ঠেকানো যায় না কোনোভাবেই। ইয়াকুব, রমজান, গদু প্রধান, লুন্দর শেখ, মজিদ, কাদের প্রভৃতি তাদের নতুন নাম বিশেষণ। যে সামাজিক অসম্পূর্ণতা-বিকৃতি, বিকাশহীনতা আবদ্ধতার ফলে ডিফর্মড চাইল্ডের মতো ভাঁড়ুদের জন্ম, সে সমাজটাকে হয়তো আমরা পাঁচ শতাব্দী পেছনে রেখে এসেছি; কিন্তু তার দীর্ঘ প্রলম্বিত ছায়ার নিচে আজও আমাদের দণ্ডায়মানতা।
বিষয় সমূহ
- Animal (67)
- Artical (29)
- Education (79)
- Fitness (19)
- Food (40)
- Game (12)
- Hijra(হিজড়া) (7)
- Journalism (23)
- Law (19)
- Liberation War(মুক্তিযুদ্ধ) (34)
- Love Effect (26)
- Mosque (42)
- Music (16)
- Nobel Prize (5)
- Organization (30)
- Others (56)
- Plants(গাছ-পালা) (29)
- Politics(রাজণীতি) (22)
- Scandal Religion (1)
- Tribe (8)
- Violence (16)
- Wikileaks (3)
Like for Update
64 Districts
- Bagerhat (4)
- Bandarban (3)
- Barisal (3)
- Bhola (3)
- Bogra (11)
- Brahmanbaria (2)
- Chandpur (4)
- Chapai Nawabganj (2)
- Chittagong (6)
- Comilla (2)
- Cox's Bazar (13)
- Dhaka (65)
- Dinajpur (6)
- Faridpur (1)
- Feni (1)
- Gaibandha (1)
- Gazipur (3)
- Gopalgonj (2)
- Habiganj (2)
- Jamalpur (4)
- Jessore (3)
- Jhenidah (2)
- Khagrachari (1)
- Khulna (3)
- Kishorgonj (2)
- Kurigram (1)
- Kushtia (3)
- Lalmonirhat (2)
- Madaripur (3)
- Magura (1)
- Manikgonj (1)
- Meherpur (2)
- Moulvibazar (14)
- Munsiganj (3)
- Mymensingh (5)
- Naogaon (8)
- Narayanganj (2)
- Natore (10)
- Netrokona (1)
- Nilphamari (2)
- Noakhali (1)
- Pabna (3)
- Panchagarh (2)
- Patuakhali (7)
- Pirojpur (1)
- Rajbari (1)
- Rajshahi (8)
- Rangamati (3)
- Rangpur (5)
- Satkhira (4)
- Sherpur (2)
- Sirajganj (5)
- Sunamganj (4)
- Sylhet (11)
- Tangail (1)
Blog Archive
-
▼
2010
(616)
-
▼
July
(50)
- রিউম্যাটিক ফিভার
- ডায়বেটিক রোগীদের জন্য
- কর্পোরেট পোশাক বনাম শ্বশুর বাড়ি
- একসেস ডিনাইড
- বলধা গার্ডেন
- আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট
- দন্ত চিকিৎসক
- কাসা-কাটু টেন্ট রকস ন্যাশনাল মনুমেন্ট
- সমস্যা যখন চুল পড়া
- টিপস
- বলি রেখা
- রাজধানী সুপার মার্কেট
- বিষবৃক্ষের মালিনী হীরা দাসী
- ঠকচাচা
- ঘসেটি বেগম
- ভাঁড়ু দত্ত
- বাংলা সাহিত্যে খল চরিত্র
- ফেইসবুক অ্যালবামের ছবি ডাউনলোড
- How to Change or Upload a Photo in Facebook
- এটিএন বাংলা
- যেভাবে ইসরাইল এর জন্ম
- উইন্ডোজ ৭ এর ৬৪ বিট ভার্সন ব্যবহারের সুবিধাগুলো কি...
- ঢাকেশ্বরী মন্দির
- মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি কাঁচাবাজার
- কমিউনিটি সেন্টার
- মসজিদের শহর ঢাকা
- পুমা পুনকু
- টিপস
- হোসেনী দালান, ঢাকা
- পুঁথি ও পাণ্ডুলিপির দুর্লভ সংগ্রহশালা
- মনসামঙ্গল
- ফয়’স লেক রিজর্ট
- সাঁওতাল বিদ্রোহ
- নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হতে চাইলে
- রিমোট ওয়ার্ক
- ছেলেদের চুল পড়ে কেন?
- নিরাপত্তা দিতে ফায়ারওয়াল
- পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
- বিউটি টিপস
- পেনিসিলিন আবিষ্কারের কাহিনী
- কালজয়ী চেচেন ইটজা
- পিসার হেলানো টাওয়ার
- তিয়েন আনমেন স্কোয়ার
- টাইটানিক
- পাবনা
- হিন্দু বিবাহ আইন প্রসঙ্গে
- THE HISTORY OF THE INDIAN FLAG
- ফেসবুক ব্যবহারকারী
- জব্বারের বলী খেলা
- কানাডা
-
▼
July
(50)
Friday, July 16, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment