১৯৭১-উত্তাল দিনগুলোতে, মুক্তিকামী বাঙালিকে সাহস জোগাতে শিল্পীরা ক্যানভাস রাঙান প্রতিবাদী তুলিতে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর পোস্টার প্রকাশনার বিস্তার ঘটে। ১৮৬৪ সালে কলকাতায় সরকারি আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন এ প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন অন্নদা প্রসাদ বাগচী। ওই প্রতিষ্ঠানের লিথো গ্রাফ পদ্ধতিতে ছাপানো পোস্টার তৎকালীন সময় প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এসব পোস্টারে মূল বিষয় ছিল দেবদেবী, মনীষী ও পৌরাণিক কাহিনী। ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হাতেলেখা পোস্টারই বেশি চোখে পড়ে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচারের পর পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন মিছিল, মিটিং ও সমাবেশে যেসব পোস্টার দেখা যেত তা মূলত হাতে লেখা পোস্টারই ছিল।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সচিবালয়ের পাশে প্রথম হাতেলেখা পোস্টার নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে হাতেলেখা পোস্টারই চোখে পড়ে বেশি এবং এর ধারাবাহিকতা ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত। এছাড়াও ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও এ ধরনের পোস্টার দেখা গেছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জে এক পোস্টার আঁকাকে কেন্দ্র করে মুস্তাফা মনোয়ার জেল খেটেছিলেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ইমদাদ হোসেনের আঁকা বেশকিছু পোস্টার জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন' শীর্ষক পোস্টারটি সাড়া জাগিয়েছিল। ৬০-এর দশকের শুরুতে এক রঙের অফসেট মেশিনে পোস্টার ছাপা হয়। তৎকালীন যে প্রেসগুলো পোস্টার ছাপানোর কাজ করত এগুলো হলো_ পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি প্রেস, রিগ্যাল প্রেস, আর্টপ্রেস। ১৯৭০ সালে বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অন্যায়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালিদের ওপর। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
রং-তুলির আঁচড়ে ক্যানভাস রাঙিয়ে, সাত কোটি বাঙালীর মাঝে স্বাধীনতার আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সে সময়কার শিল্পীরা। পটুয়া কামরুল হাসানের, এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে কিংবা নিতুন কুন্ডুর সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী শীর্ষক পোস্টার অন্যরকম সঞ্জীবনী শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিপাগল বাংলার মানুষকে।
এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, মানুষরূপী হায়েনা ইয়াহিয়া খানের বীভৎসতা ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব। শিল্পী কামরুল হাসান সাদা ক্যানভাসে, কালো তুলির আঁচড়ে, ফুটিয়ে তুলেন নরঘাতক ইয়াহিয়া’র স্বরূপ।
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
সাতই মার্চে, যার অগ্নিঝরা ভাষণে উথাল-পাথাল হয়ে ওঠেছিল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, সেই মহান নেতা, শতবর্ষের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এ পোস্টার।
বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি
যুগ যুগ ধরেই, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত গাঙ্গেয় এ ব-দ্বীপ, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সাম্প্রাদিয়ক সম্প্রীতির অনন্য এক উদাহরণ। ৭১-এর রক্তঝরা দিনগুলোতেও, ব্যতয় ঘটেনি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধর্মের মানুষ।
বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা
লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে, অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। যুদ্ধ ময়দানে, এদেশের নারীদের অবদানের কথা অনস্বীকার্য।
সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী
দিন-রাত, সকাল-সন্ধ্যা, শীত-গ্রীষ্ম-প্রকৃতির বৈরীতা কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে, বুকের রক্ত বিলিয়ে স্বাধীনতা এনেছে যারা, তাদের দৃঢ়, সংকল্প অনমনীয়তা ফুটে ওঠে নিতুন কুণ্ডুর এ পোস্টারে।
দেশের সীমানা পেরিয়ে, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে, বিশেষ ভূমিকা রাখে সেদিনের সে পোস্টারগুলো। পাক হানাদারদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ নাড়া দিয়েছিল ভিনদেশী শিল্পীদেরও। তাদের আঁকা বেশ কিছু ছবি তখন প্রকাশিত হয় বিদেশী পত্র-পত্রিকায়। দ্রোহের আগুনে স্বাধীনতার চেতনা ছড়িয়ে, পোস্টারগুলো হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল।
(C) Fazle Rezowan Karim
Picture Source: Internet
0 comments:
Post a Comment