৫২ থেকে শোষন আর নিপীরনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগন যখন নির্যাতিত। প্রতিনিয়ত অধিকার আর ন্যায্য পাওনা হরণ করছে পশ্চিম পাকিস্তানী আর তাদের দোসররা। তখন নিজেদের অস্তিত টিকিয়ে রাখতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামে বাঙালীরা। স্বপ্ন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আর মায়ের মুখের ভাষা। যেখানে থাকবে না কারো বাহাদুরী। হারানোর ব্যাথায় রিক্ত হৃদয়ে বাংলাদেশীরা মার্চে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাক হানাদার বাহিনী সঙ্গে ৯ মাস লড়াই করে ডিসেম্বরে বিজয় আসে বাঙালী জাতির। ডিসেম্বরের এক এক দিন মুক্ত হয় এক এক জেলা। তারই ধারাবাহিক বর্ণনা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
২৯ নভেম্বর:
পঞ্চগড় মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় লাভের ২ সপ্তাহ আগেই দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়। মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর প্রবল আক্রমণে ১৯৭১ সালের এই দিনে পঞ্চগড় পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত পঞ্চগড় থাকে যুদ্ধ মুক্ত। পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পঞ্চগড় দখলে নেয়।
পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হঠে, আশ্রয় নেয় জেলার সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের মাগুরমারী এলাকায়। পাক বাহিনী সড়ক পথে তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইড দিয়ে চাওয়াই নদীর ব্রীজ ভেঙ্গে দেয়ার কারণে পাকহানাদার বাহিনী সেখানে অবস্থান নেয়। একারণে জেলার সর্বশেষ উপজেলা তেঁতুলিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় মুক্তাঞ্চল ছিল। তেঁতুলিয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং, প্রশিক্ষণ, অস্ত্রের যোগান দেয়াসহ সার্বিক কর্মকান্ড পরিচালিত হত।
মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চগড় ছিল ৬ (ক) সেক্টরের আওতাধীন। এ অঞ্চলে মোট ৭টি কোম্পানীর অধীনে ৪০টি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
মুক্তিযোদ্ধারা সুসংগঠিত এবং ট্রেনিং নিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর দালাল শান্তি কমিটি এবং রাজাকার আলবদরদের ওপর গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ জোরদার করে।
দীর্ঘ সাড়ে সাত মাস ধরে এ এলাকায় যুদ্ধ চলে।
মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর ট্যাঙ্ক ও পদাতিক বাহিনীর সাড়াশি আক্রমনে পাকবাহিনী পরাজিত হয়ে পঞ্চগড় এলাকা ত্যাগ করতে থাকে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর একের পর এক ক্যাম্প দখলে নেয়। ফলে পঞ্চগড়ের নুতন নতুন এলাকা মুক্ত হতে থাকে। মুক্তি ও মিত্রবাহিনী পর্যায়ক্রমে পাকবাহিনীর ওপর প্রচন্ড আক্রমন চালিয়ে ২০ নভেম্বর অমরখানা, ২৫ নভেম্বর জগদলহাট, ২৬ নভেম্বর শিংপাড়া, ২৭ নভেম্বর তালমা, ২৮ নভেম্বর মির্জাপুর, আটোয়ারী বোদা মুক্ত হয়। ওই দিন গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদেন সাড়াশি আক্রমনে পরাজিত হয়ে পাকবাহিনী পঞ্চগড়ের মাটে ছেড়ে পিছু হঠে সৈয়দ পুর অভিমুখে চলে যায়। ২৯ নভেম্বর ভোরে পঞ্চগড় পাকহাদার মুক্ত হয়।
৩ ডিসেম্বর:
ঠাকুরগাঁও মুক্তদিবস
৭১ সালের এই দিনে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন গর্বিত মুক্তিসেনারা। কিন্তু যাঁদের রক্তের বিনিময়ে জাতি পেল স্বাধীন ভূখ- পনের কোটি মানুষ পেয়েছে লাল-সবুজ পতাকা, স্বাধীনতার প্রাপ্তি কী জুটেছে তাদের কপালে ? স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও আজও বিচার হয়নি জাঠিভাঙ্গাসহ হাজার হাজার বাঙালি হত্যার ঘাতক যুদ্ধপরাধীদের।
তখন ঠাকুরগাঁও ছিল উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা। বর্তমান ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার ১০টি থানা ছিল এই মহকুমার অন্তর্গত। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওবাসী গড়ে তুলেছিলো দুর্বার প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধের কারণেই ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি ঠাকুরগাঁওয়ের মাটিতে। ১৫ই এপ্রিল ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে মুহুর্মুহু শেল বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকে পড়ে হানাদার বাহিনী। তবে তেতুলিয়া থানাকে কেন্দ্র করে ১৫০ বর্গমাইলের ১টি মুক্তাঞ্চলকে কেন্দ্র করে সংগঠিত ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২ ডিসেম্বর প্রচ- গোলাগুলির পর শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে ২৫ মাইল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঠাকুরগাঁও শহর হয় শত্রুমুক্ত।
তারপর পেড়িয়ে গেছে ৪১ বছর কিন্তু শত্রুমুক্ত হওয়ার এতও বছর পেরোলেও আজও শাস্তি পায়নি যুদ্ধাপরাধীরা যারা জাঠিভাঙ্গাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে নির্বিচারে। বরং শহীদ পরিবারগুলোই আজ অবহেলিত মানবেতর জীবন যাপন করছে। তারই চিহ্ন বহন করছে ঠাকুরগাও সদর উপজেলার শূখান পুকুর ইউনিয়নের বিধবা পল্লির পরিবার গুলো।
শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে রক্ষায় এবং এ অঞ্চলের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে এগিয়ে আসুক মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী বর্তমান সরকার এ দাবী ঠাকুরগাঁওবাসির।
বরগুনা মুক্তদিবস
৩ ডিসেম্বর। বরগুনার ইতিহাসে একটি স্মরনীয় দিন। ১৯৭১ সালের এইদিনে হানাদার মুক্ত হয় বরগুনাবাসী। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক ভূমিকায় একসময় স্বাধীন হয় বাংলাদেশ, স্বাধীন হয় বরগুনাও।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষনের পরে বরগুনার মুক্তিকামী সহস্রাধিক তরুণ বাঁশের লাঠি, গুটি কয়েক রাইফেল, বন্দুক নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে। এরই মধ্যে পাকবাহিনী দুর্বল প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে পার্শ্ববর্তী পটুয়াখালী জেলা দখল করে ফেলে। ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ ও ক্ষয়-ক্ষতির ভয়ে বরগুনার মুক্তিযোদ্ধারা এলাকা ছেড়ে চলে যান। এদিকে পাক বাহিনী বিনা বাঁধায় বরগুনা শহর দখল করে বিভিন্ন থানা ও তৎকালীন মহাকুমা সদরে অবস্থান করে পৈশাচিক নারী নির্যাতন ও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ২৯ ও ৩০ মে বরগুনা জেলখানায় গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে ৭৬ জন নিরীহ মানুষকে। অন্যদিকে কয়েক মাসের মধ্যেই বরগুনার মুক্তিযোদ্ধারা শক্তি অর্জন করে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। নবম সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীনে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুস সত্তার খানের নেতৃত্বে ২ ডিসেম্বর ২১ জনের মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নৌকা যোগে বরগুনার খাকদোন নদীর পোটকাখালী স্থানে অবস্থান নেন। বরগুনা কারাগার, ওয়াবদা কলনী, জেলা স্কুল, সদর থানা, ওয়ারলেস ষ্টেশন, এসডিওর বাসাসহ বরগুনা শহরকে কয়েকটি উপ-বিভাগে ভাগ করা হয়। সকালে ফজরের আজানকে যুদ্ধ শুরুর সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে আজান শুরুর সাথে সাথে ৬টি স্থান থেকে একযোগে গুলিবর্ষন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয় দফা আক্রমন চালিয়ে তারা জেলখানার দিকে গিয়ে জেলখানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ায় এবং মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রাজাকারদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল সাধারণ জনগন।
৪ ডিসেম্বর:
লক্ষ্মীপুর মুক্তদিবস
৪ঠা ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস । ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা এ দেশীয় দোসর রাজাকার আল বদর জামায়াতের সহায়তায় লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি উপজেলায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ শেষে হাজার হাজার নিরীহ জনসাধারনকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪১ বছরে ও এসব হত্যা কান্ডের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়ায় আজও সে স্মৃতি মনে করে প্রিয়জনদের হারানোর ঘটনায় শিহরে উঠেন অনেকে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সুত্রে জানাযায়, ১৯৭১ সালে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর ১৭টি সম্মুখযুদ্ধসহ ২৯টি দুঃসাহসিক অভিযান চলে। এসব যুদ্ধে সৈয়দ আবদুল হালীম বাসু, মনছুর আহমদ, আবু ছায়েদ সহ ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকহানাদার বাহিনীর হাতে জানা অজানা কয়েক হাজার নর-নারী নিহত হন। এসব নারকীয় হত্যাযজ্ঞের আজও নীরব সাক্ষী হয়ে আছে শহরের বাগবাড়িস্থ গণকবর,টর্চারসেল, মাদাম ব্রীজ বধ্যভুমি, পিয়ারাপুর ব্রীজ বাসুবাজার গনকবর, চন্দ্রগঞ্জ, রসুলগঞ্জ ও আবদুল্যাপুর এবং রামগঞ্জ থানা সংলগ্ন বধ্যভূমি। এ ছাড়া যুদ্ধকালিন সময়ে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনরাও ।
৪ ডিসেম্বর প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হায়দার চৌধুরী ও সুবেদার প্রয়াত আবদুল মতিনের নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হয়ে দালাল বাজার, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ হামছাদি, শাখারী পাড়ার মিঠানীয়া খাল পাড় সহ বাগবাড়িস্থ রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে লক্ষ্মীপুরকে হানাদার মুক্ত করেন। এ সময় প্রায় দেড় শতাধিক রাজাকারকে আটক করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রকাশ্যে লক্ষ্মীপুর শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী করেন মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারে সদস্যরা।
জামালপুর মুক্তদিবস
৪ ডিসেম্বর জামালপুর জেলার ধানুয়া কামালপুর মুক্ত দিবস। হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি কামালপুর দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ১১ নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সূচনা করেছিল ঢাকা বিজয়ের পথ। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হানাদারবাহিনী তাদের দোসর আল-বদর রাজাকারদের নিয়ে বকশীগঞ্জ, কামালপুর ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ধ্বংশযজ্ঞ চালায়, হত্যা করে অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে। হানাদার বাহিনীর এইসব নৃশংশ হত্যাকান্ডের চিহ্ন অনেক গণকবর আর বধ্যভূমি ছড়িয়ে আছে সীমান্তবর্তী কামালপুরসহ বকশীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা জুড়ে। ঐতিহাসিক এই যুদ্ধে অংশ নেয়া অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিপরীতে জামালপুর জেলার পাহাড় ঘেরা বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুরে হানাদার বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই শক্তিশালী ঘাটি গড়ে তুলেছিল। উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল যে কোন মূল্যে এই ঘাটি দখলের। লক্ষ্য অনুযায়ী সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা অনুসরণ করে ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর কামালপুর ঘাটি অবরোধ করে। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। অবরোধের প্রথম দিনই সম্মুখ যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের একটি পা হারান। ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান বীর প্রতীক। ১০ দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় দুর্গে অবরুদ্ধ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন কমান্ডার আহসান মালিক খানসহ ১৬২ জন হানাদার সদস্য মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করে। মুক্ত হয় কামালপুর। আর কামালপুর মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই সূচিত হয় শেরপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ ঢাকা বিজয়ের পথ। কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিন মমতাজ, মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান তসলিমসহ শহীদ হন ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে একজন ক্যাপ্টেনসহ হানাদার বাহিনীর ২২০ জন সৈন্য নিহত হয় এই যুদ্ধে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ধানুয়া কামালপুরে হানাদার বাহিনীর নৃশংশ হত্যাকান্ডের চিহ্ন অনেক গণকবর আর বধ্যভূমি এখন নিহ্নিহের পথে। গণকবর আর বধ্যভূমির উপর তৈরী করা হয়েছে বাড়িঘর, সরকারি গোডাউন, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পুকুরসহ নানা স্থাপনা।
শেরপুর মুক্তদিবস
৪ ডিসেম্বর শেরপুরের ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস। ৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীকে
পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহযোগীতায় মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী অঞ্চলকে
শত্রু মুক্ত করে।
পাক-হানাদার বাহিনী ‘৭১ এর ২৫ মার্চ’ কালো রাতে যখন ঢাকার বুকে হত্যাযজ্ঞে
ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই রাতেই ৩-৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরীত
স্বাধীনতার ঘোষনার টেলিগ্রাম ম্যাসেজ ঝিনাইগাতী ভি এইচ এফ ওয়্যারলেস অফিসে
এসে পৌঁছে। ম্যাসেজ পেয়েই ওয়্যারলেস মাস্টার জামান সাহেব তার অফিসের পিয়ন
পাঠিয়ে শেষ রাতের দিকে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের বাসায় সংবাদ দেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনার সবাদ পেয়ে পরদিন ভোরেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ সকালে
আওয়ামীলীগ নেতা ডাঃ সৈয়দ হোসেন, আব্দুল কাফি মিয়া, সৈয়দ আলী মেম্বার, বাবু
অনন্ত কুমার রায়, সেকান্দর আলী, ফকির আব্দুল মান্নান সহ অনেকেই ওয়্যারলেস
অফিসে এসে পৌছান। ইংরেজীতে লেখা টেলিগ্রাম ম্যাসেজটি পেয়েই নেতৃবৃন্দ তৎনাৎ
তা শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের কাছে প্রেরন করেন।
২৬ মার্চ সকাল থেকেই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো ঢাকার সর্বশেষ সংবাদ কি তা
জানার জন্যে শেরপুর শহরে মানুষ সমবেত হতে থাকে। ঝিনাইগাতী ওয়্যারলেসে
পাঠানো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনাটি শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ হাতে
পেয়েই তা বাংলায় অনুবাদ করে শেরপুর নিউ মার্কেট মোড়ে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত
সমাবেশে পাঠ করে শুনানো হয়। বঙ্গবন্ধুর পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষনার শ্রবণ করে
সমবেত জনতা মুর্হুমুর্হু শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে শেরপুরের আকাশ বাতাস।
২৭ মার্চ সকালে শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব এডভোকেট আব্দুল
হালিম এমপি, মুহসিন আলী মাস্টার ও ছাত্র নেতা আমজাদ আলী ঝিনাইগাতী এসে
পৌছেন। ঝিনাইগাতীর নেতৃবৃন্দ তাদের অভ্যর্থনা জানান। ছাত্রনেতা ফকির আব্দুল
মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে তারা নকশি ইপিআর ক্যাম্পে যান। নকশি ক্যাম্পের
সুবেদার হাকিম নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেই বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। দেশকে
শত্রু মুক্ত করা সহ পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পনা
গ্রহণ করেন।
শুরু হলো প্রতিরোধ সংগ্রাম। যুদ্ধের প্র¯‘তি হিসাবে রাংটিয়া পাতার ক্যাম্পে
প্রশিণ শিবির খোলা হয়। ট্রেনিং শেষে এসব স্বে”ছাসেবক সহ মুজিব বাহিনী ও
ইপিআর সৈনিকদের নিয়ে সুবেদার হাকিম মধুপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে তা
পিছু হটে পুরাতন ব্র্হ্মপুত্র নদের চরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৬ এপ্রিল
সুবেদার হাকিম এর খোলা জীপ এসে দাঁড়ায় ঝিনাইগাতী পাঁচ রাস্তার মোড় আমতলায়।
সুবেদার হাকিম জনতাকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অনুরোধ জানান। ২৬ এপ্রিল
পর্যন্ত ঝিনাইগাতী শত্রু মুক্ত ছিল।
২৭ এপ্রিল পাক বাহিনী বহর নিয়ে গোলা বর্ষন করতে করতে পৌছায় ঝিনাইগাতী
বাজারে। ঝিনাইগাতী ঢুকেই আওয়ামী লীগ অফিস আগুন ধরিয়ে পুড়ে দেয়। গাড়ী বহর
নিয়ে রাংটিয়া পাহাড় পর্যন্ত গিয়ে আবার পিছনে ফিরে এসে ঐদিন বিকালেই
কোয়ারীরোডে পাক বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে ঝিনাইগাতীর এক মাইল দেিণ
আহম্মদ নগর হাই স্কুলে তাদের সেক্টর হেড কোর্য়াটার স্থাপন করে। যা
মুক্তিযোদ্ধাদের ১১নং সেক্টরের বিপরীতে পাক বাহিনীর ব্রহ্মপুত্র নদের
উত্তরে একমাত্র সেক্টর হেড কোর্য়াটার। যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর রিয়াজ।
এছাড়া পাক বাহিনী শালচূড়া, নকশি, হলদীগ্রাম, তাওয়াকোচা, মোল্লাপাড়ায়
ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৬ বৈশাখ জগৎপুর গ্রামে হানা দিয়ে গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়
এবং পাক বাহিনী ৪১ জন গ্রাম বাসীকে গুলি করে হত্যা করে। ৫ জুলাই কাটাখালি
ব্রীজ ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা রাংগামাটি গ্রামে আশ্রয় নেয়। দালালদের খবরে
পাক বাহিনী রাংগামাটি গ্রামে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। শুধু রাংগামাটি
বিলের দিক খোলা ছিল। সম্মুখ যুদ্ধে কমান্ডার নাজমুল আহসান শহীদ হন। তাঁর
লাশ আনতে গিয়ে আলী হুসেন ও মোফাজ্জল শহীদ হন। পরদিন রাংগামাটি গ্রামে হানা
দিয়ে পাক বাহিনী ৯জন গ্রাম বাসীকে এক লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
২৩ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা তাওয়াকুচা ক্যাম্প দখল করে এবং মুক্ত তাওয়াকুচায়
বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তাওয়াকুচা যুদ্ধে ৪ জন পাক সৈন্য ও ৭ জন
রাজাকার নিহত হলে পাক বাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে আসে। ৩ আগষ্ট নকশি
ক্যাম্প আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধারা। আগের দিন ২ আগষ্ট বিকেলে মেজর জিয়া
নকশি ক্যাম্প আক্রমনের জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ারের অবস্থানগুলো দেখেন।
এদিনের যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও নিখোজ হন। যুদ্ধে পাক বাহিনীর ৩৫
জন সৈন্য নিহত হয়।
২৭ নভেম্বর কমান্ডার জাফর ইকবালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী
বাজারের রাজাকার ক্যাম্প দখল করে ৮টি রাইফেল সহ ৮ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে
যায়। ২৮ নভেম্বর পাক বাহিনী ঝিনাইগাতী হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবিএম
সিদ্দিকের ছোট ভাই ওমর (১১) ও মুক্তিযোদ্ধা মকবুলের পুত্র খালেক (১০), পাক
বাহিনীর দালাল আব্দুর রহমান, গোজারত মেম্বার সহ ৮জনকে আহম্মদ নগর ক্যাম্পের
বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে তাদের
এক গর্তে মাটি চাপা দিয়ে পুতে রাখে।
৩ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক দেড়টায় শালচূড়া ক্যাম্পের পাক বাহিনী কামালপুর
দুর্গের পতনের আগাম সংবাদ পেয়ে পিছু হটে এবং আহম্মদ নগর হেড কোর্য়ারটারের
সৈনিকদের সাথে নিয়ে রাতেই মোল্লাপাড়া ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেয়।
এভাবে রাতের আঁধারে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শত্রু মুক্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর
মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায়।
৫ ডিসেম্বর
৬ ডিসেম্বর
যশোর মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের এ দিনে দু’দিক থেকে মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী হানাদাররা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সর্বপ্রথম স্বাধীন হয় যশোর জেলা। এর আগে ৪ঠা ডিসেম্বর বেনাপোল ও চৌগাছার বয়রা সীমান্ত দিয়ে হামলা শুরু করে মিত্র সেনারা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় সীমান্তবর্তী যশোর জেলা ছিল পাক হানাদারদের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। বীর মুক্তিযোদ্ধারাও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এ জেলাকে স্বাধীন করতে প্রাণপণ লড়াই শুরু করে। ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে পাকসেনাদের সাথে তাদের তুমুল যুদ্ধ হয় চৌগাছা ও ঝিকরগাছার জগন্নাথপুর, গরীবপুর, আড়পাড়া, দিঘলসিংহা, ঢেকিপোতা, হুদোপাড়া, কদমতলা, মাশিলা, যাত্রাপুর ও সিংহঝুলি এলাকায়। ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে এ যুদ্ধে যে সব মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন, তারা জানান, জগন্নাথপুর আম বাগান এলাকায় দুই বাহিনীর প্রচন্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের রসদ শেষ হয়। তারপরও থেমে থাকেনি লড়াই। খালি হাতেই এ সময় পাক সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অস্ত্রের বাট, বেয়নেট, কিল, ঘুসি, লাথি, এমনকি কুস্তাকুস্তি হয় উভয় পক্ষের মধ্যে।
মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় ৬ই ডিসেম্বর ছোট সিংহঝুলিতে শুরু হয় কামান যুদ্ধ। তুমুল সংঘর্ঘে পাকসেনাদের ৭টি ট্যাংক, ২টি যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করে যৌথ বাহিনী। এলাকার বহু মানুষ এতে প্রাণ হারান। ক্ষয়ক্ষতি হয় গাছপালা ও ফসলের। পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, এ লড়াইয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং প্রায় একশ পাক সেনা নিহত হয়। একই দিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা যশোর সেনানিবাস ছেড়ে খুলনার উদ্দেশ্য পালিয়ে যাবার সময়ও বিভিন্ন স্থানে খন্ড খন্ড যুদ্ধ হয়। তবে শেষ যুদ্ধ হয় যশোরের রাজঘাটে এবং যশোরকে প্রথম স্বাধীন জেলা ঘোষণা করা হয়। এর ফলে সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় এবং প্রচন্ড মনোবল নিয়ে পাক হানাদারদের পর্যদুস্ত করে।
মেহেরপুর মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর সকাল থেকেই মেহেরপুর হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। ১ ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত হলেও সীমান্তে পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা অসংখ্য মাইন অপসারণের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর পুরোপুরিভাবে হানাদার মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর।
প্রথমে ২ ডিসেম্বর জেলার গাংনী উপজেলা হানাদার মুক্ত হলে ভারতের শিকারপুরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী চুয়াডাংগা জেলার হাটবোয়ালিয়া গ্রামে এসে মুক্তিবাহিনীর ঘাটি স্থাপন করে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে ৫ ডিসেম্বর মেহেরপুরে প্রবেশ করে। ১ ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত হলেও সীমান্তে পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা অসংখ্য মাইন অপসারণের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর পুরোপুরিভাবে হানাদার মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর।
কুড়িগ্রাম মুক্তদিবস
কুড়িগ্রাম সদর নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার কিছু অংশ ছিল ৬ নং সেক্টরের অধীনে। উলিপুর উপজেলা কিয়দাংশ সহ চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর উপজেলা ছিল ১১ সেক্টরের অধীনে। ৭১ সালের ৪ এপ্রিল ৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সম্মুখে সমরে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। জেলার অন্যতম যুদ্ধ ছিল উলিপুর উপজেলার হাতিয়াতে। এ যুদ্ধে প্রায় ৬ শত ৫০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা সহ সাধারন মানুষ শহীদ হন।
ভোর বেলা চায়না রাইফেলের গুলির শব্দ শুনে কমান্ডার নজরুল ইসলামের নির্দেশে ১১ নং সেক্টর মাএ ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা পাক বাহিনির উপর আক্রমন করে এতে শহিদ হন ৬ মুক্তিযোদ্ধা।
ধরলা নদি দ্বারা কুড়িগ্রাম জেলা সদর বিভক্ত থাকায় জেলা সদরে পাক হানাদার বাহিনিকে ঢুকতে না দেয়ার জন্য মুক্তি বাহিনি ১ মাস ব্যপি ধরলা নদিও পশ্চিম তিরে অবস্থান করে। নদির পূর্ব তিরে অবস্থান করে পাক বাহিনি। বয়াবহ এ যুদ্ধে পাক বাহিনি পিছু হঠে ভেতর বন্দে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্প করে অবস্থান করেন।
২৭ মে হাসনাবাদ ইউনিয়নের শঠিবাড়ি নামক স্থানে পাক বাহিনির এম্বুসে পড়ে ১৭ মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। এখানে তাদের গন কবর দেওয়া হয়। এছাড়াও এিমোনী, নাজিমখাঁ, ভেতরবন্দ, নাগেশ্বরী, রায়গনজ, ভূরুঙ্গামারীর সোনা হাটে পাক বাহিনির সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের ১০ পূর্বে কুড়িগ্রাম পাকহানাদার মুক্ত হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কুড়িগ্রামে ২৬ টি বধ্য ভূমি রয়েছে। স্মৃতি স্তভ গুলোর অধিকাংশ নিম্ন মানের। আরো উন্নতমানের করার দাবি জানান জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
ঝিনাইদহ মুক্তদিবস
অসহযোগ প্রস্তুতিপর্ব, প্রতিরোধ, গেরিলা আক্রমণ ও শেষে সম্মুখ সমরে বিজয় অর্জন, ১৯৭১ সালের এই ৪টি পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধে ঝিনাইদহের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সম্মুখ সমর সহ বেশ কয়েকটি গেরিলা যুদ্ধ ও অভিযান সংগঠিত হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ সালে ঝিনাইদহ পাকহানাদার কবলিত হয় । তবে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও বহু মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহের মাটি হতে পাক হানাদার বিতাড়িত হয়। ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ হয় মুক্ত। যশোর ক্যান্টনমেন্টে জিওসি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালিয়ে ছিল ঝিনাইদহে সর্বাধিক। শহরের দোকানপাট ভস্মিভুত হয়েছিল, ধুলিসাৎ হয়েছিল বাড়িঘর। গ্রামগঞ্জে আগুন জ্বালিয়েছিল দাউ দাউ করে।
২৮ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিষ্টার আহমেদুল ইসলাম ছদ্দবেশ নিয়ে ঝিনাইদহে রাত্রী যাপন করেন। ১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী কামান ও মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে এক সশস্ত্র কনভয় বিষয়খালীর কাছে বেগবর্তী নদীর তীরে সম্মুখযুদ্ধ হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ বিজয়ের গৌরবে প্রথম মাইল ফলক স্থাপন করে বিষয়খালি যুদ্ধে। ১৬ এপ্রিল সাড়াশি আক্রমনে ঝিনাইদহের পতন ঘটে। এ সময় ৪ আগষ্ট আলফাপুরের যুদ্ধ, ১৪ অক্টোবর আবাইপুর যুদ্ধ, ২৭ নভেম্বর কামান্নার ট্রাজেডিসহ বেশ কয়েকটি গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত হয়। কামান্নায় ২৭ নভেম্বর পাকহানাদাররা ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। ১৪ অক্টোবর আবাইপুরের যুদ্ধে ৪১জন মুক্তিযোদ্ধা, আলফাপুরের যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ২ ক্যাপ্টেন, ৩ সিপাহী সহ ৪ রাজাকার নিহত হয়। ঝিনাইদহের অন্যতম আবাইপুর যুদ্ধের একাধিক গণকবর আজও অরক্ষিত।
হবিগঞ্জ মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে হবিগঞ্জ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। মুক্ত হয় হবিগঞ্জ জেলা।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় তেলিয়াপাড়া ডাকবাংলো থেকে সারা দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর বিভক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের উপ সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল এম এ রব (বীরোত্তম) ও মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে ভারতের খোয়াই বাঘাই ক্যাম্পের ২২ কোম্পানীর ৩৩ মুক্তিফৌজ নিয়ে গঠিত ১ নং প্লাটুন কমান্ডার আব্দুস শহীদের নেতৃত্বে ৩ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বাহুবলে অবস্থান নেয়। এর পর তারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে হবিগঞ্জের বিভিন্ন পাক ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় বেশ কয়েকজন পাকসৈন্য প্রাণ হারায়। একটানা ৩ দিনের অভিযানের পর ৬ ডিসেম্বর ভোরে পাক বাহিনী পালিয়ে যায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেসে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে সদর থানায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ওই দিন একই সাথে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, লাখাই, চুনারুঘাট ও অন্যান্য উপজেলাও মুক্ত হয়। আর এ হবিগঞ্জ মুক্ত করতে গিয়ে বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি, লাখাই উপজেলার কৃষ্ণপুর, চুনারুঘাট উপজেলার লাল চান চা বাগান, নালুয়া চা বাগান ও বাহুবল উপজেলার রশিদপুর সহ বিভিন্ন স্থানে সহস্রাধিক মুক্তিকামী নারী-পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
কিন্তু ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জেলার ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে আহত হন ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া নিরীহ অসংখ্য মানুষ নর-নারী ও মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকারে শহীদ হন। এসব শহীদদের জন্য তেলিয়াপাড়া, ফয়জাবাদ, কৃষ্ণপুর, নলুয়া চা বাগান, বদলপুর, মাখালকান্দিতে বধ্যভূমি নির্মিত হয়। হবিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা ও তরুন প্রজন্মের দাবী অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সম্পন্ন, অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্নবাসন ও গণহত্যা, বধ্যভূমি ও মুক্তিয্দ্ধুকালীন স্মৃতিস্থানগুলো সংরক্ষন করা হউক।
সুনামগঞ্জ মুক্তদিবস
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের বেরিগাঁও ৫নম্বর সেক্টর ছিল ভারতের বালাট সাব সেক্টরের অধীনে। এখানে ’৭১ সালের ১৫আগস্ট ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সম্মুখে সমরে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। জেলার অন্যতম যুদ্ধ ছিল এটি। এ যুদ্ধে অনেক পাকবাহিনীর সদস্যরা ও নিহত হন।
এ যুদ্ধে ৮জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২৬জন মুক্তিযোদ্ধাকে জীবিত ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। ২জন মুক্তিযোদ্ধা পালিয়ে আসলেও ২৪জনকে মেরে ফেলে পাক বাহিনী। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নলুয়া গ্রামে গনকবর দেয় পাকিস্থানীরা । বাকীদের ধরে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা সুনামগঞ্জের আহসানমারা ফেরীঘাটে নিয়ে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। নদীতে লাশ ভাসঁতে দেখে এলাকার মুক্তিকামী মানুষ নদী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ এনে দক্ষিন সুনামগঞ্জ উপজেলার উজানীগাঁও গ্রামে তাদের সমাহিত করেন ।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত হয়। এ যুদ্ধের পর অনেকেই মুগাই নদী পাড় হয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
৭ ডিসেম্বর
চুয়াডাঙ্গা মুক্তদিবস
৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সীমান্ত ঘেঁষা চুয়াডাঙ্গা জেলা হানাদার মুক্ত হয়। এ দিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর তুমুল প্রতিরোধের মুখে পাকহানাদার বাহিনী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ্ জেলা অভিমুখে পালিয়ে যায়। হানাদারমুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা। মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার অবদান অবিস্মরণীয়। প্রথম রাজধানী হিসেবে নির্ধারিত হয় চুয়াডাঙ্গা। তারিখও নির্ধারিত হয় এপ্রিলের ১০। খবরটি পূর্বাহ্নে জানাজানি হয়ে যাওয়ার ফলে কৌশলগত কারনে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় প্রথম রাজধানী হয় এবং প্রবাসী সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর জেলার জীবননগর শহরে পাকহানাদার বাহিনীর পতন ঘটলেও চুড়ান্ত বিজয় আসে ৪ ডিসেম্বর। এদিন প্রত্যূষে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কমান্ডার মেজর দত্ত ও বর্ম্মা এবং ৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে জীবননগর, দত্তনগর, হাসাদহ সšেতাষপুর,রাজাপুর, ধোপাখালী ও মাধবখালীতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর অতর্কিতভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী প্রচন্ড যুদ্ধ। এ সময় রাজাপুর ও মাধবখালী সীমান্তে সন্মুখ সমরে শাহাদৎ বরন করেন হাবিলদার আব্দুল গফুর, নায়েক আব্দুল মালেক, আব্দুর রশিদ, সিপাহী সিদ্দিক আলী, আব্দুল আজিজ ও আবু বকর। সে সময় গ্রামবাসীর সহযোগীতায় মাধবখালী সীমান্তেই এ সব বীর সেনাদের কবর দেয়া হয়।
জীবননগরের উথলী স্কুল মাঠে সম্মুখ যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর ২৯ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় জীবননগর থানায় ফেলে যাওয়া পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন নারী ধর্ষণকারী ও অমানুষিক নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত মুনছুর আলীর ব্যবহৃত জিপ গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আগুন ধরিয়ে দেয় এবং থানার মালখানা থেকে উদ্ধার করে পাশবিক নির্যাতনের পর সদ্য হত্যা করা ৭/৮ জন অজ্ঞাত পরিচয় যুবতীর লাশ।
অপরদিকে জেলার দর্শনা ও দামুড়হুদা অঞ্চল দিয়ে পাক বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমন শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী। এর ফলে চুয়াডাঙ্গা জেলা পুরোপুরি শত্র“মুক্ত হওয়ার পথ সুগম হয়।
এর আগে ৫ আগষ্ট সন্মুখ সমরে দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহ নামক স্থানে শাহাদৎ বরন করেন মুক্তিপাগল আট তরুন- তারেক, হাসান, আফাজ উদ্দীন, খোকন, আবুল কাশেম, রবিউল, রওশান ও কিয়ামুদ্দিন।
এরপর ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাক বাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহরমুখি মাথাভাঙ্গা নদীর ব্রিজের একাংশ শক্তিশালি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অনুসরণ করতে না পারে। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়।
এরপর ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে চুয়াডাঙ্গা জেলা পুরোপুরি শত্র“মুক্ত হয়। এ দিন স্বতঃস্ফুর্ত মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গার মাটিতে প্রথম উত্তোলন করে লাল-সবুজ খোচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা। শুরু হয় প্রশাসনিক কর্মকান্ড। মোস্তফা আনোয়ারকে মহকুমা প্রশাসক করে এখানে বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়।
দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গাকে মুক্ত করে এ জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। আর দীর্ঘ ৪০ বছর পর আজকের এইদিনে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দেখে যেতে যান এ জেলার বীর সন্তানেরা।
চুয়াডাঙ্গায় মোট মুক্তিযোদ্ধা ১৬’শ। এর মধ্যে যুদ্ধাহত ১৪৬ জন। এ রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্থানী বাহিনীর সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার এসব সূর্য সন্তানদের অসম সাহসী মোকাবেলা চুয়াডাঙ্গাকে করেছে মহিমান্বিত। এ কারনে জাতীয় গৌরবের প্রেক্ষাপটে চুয়াডাঙ্গা জেলার নন্দিত অবস্থান ইতিহাসে স্বীকৃত।
নোয়াখালী মুক্তদিবস
মাইজদি পিটিআই এলাকার যুদ্ধ নোয়াখালী জেলার শেষ যুদ্ধ । ৭ ডিসেম্বর সংঘটিত এ যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে নোয়াখালী পাক হানাদার মুক্ত হয়। মুক্ত হয় নোয়াখালী জেলা ।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত ১২ টার পর পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে । শুরু করে জঘণ্য হত্যাযজ্ঞ্ ।২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকা থেকে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মনজরুল করিম,বঙ্গবন্ধুর প্রথম সারির সহচর মরহুম মালেক উকিল ও তখণকার দৈনিক পাকিস্তানের রির্পোটার কামাল উদ্দিন আহমেদের কাছে গোপনে মেসেজ আসে যে,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন । সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালী টাউন হল রুপ নেয় বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ট্রোল রুমে। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত নোয়াখালী ছিল শত্রুমুক্ত। ২৬ এপ্রিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল নোয়াখালীতে প্রবেশ করে মাইজদি পি টি আইতে ঘাঁটি স্থাপন করে ।জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন চালাতো।তৈরী করে টর্চার সেল।
৬ ডিসেম্বর ফেনী ও লক্ষীপুর সহ তৎকালীন নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল শত্রুমুক্ত হতে থাকে। এরপর মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে নোয়াখালী জেলা শহর ঘিরে ফেলে । এ দিকে নোয়াখালী জেলা বি,এল,এফ কমান্ডার মাহমদুর রহমান বেলায়েত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে প্রত্যেকটি থানা কমান্ডারদের নির্দেশ দেন প্রত্যেক থানা সদর দপ্তর আক্রমন করে পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করতে। জেলা সদরে পি টি আই দখলের দায়িত্ব পড়ে সদরের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। পিটিআই আক্রমন করতে এসে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের প্রবেশ পথে নাহার বিল্ডিং রাজাকার ক্যাম্প, মাইজদী কোর্ট স্টেশন রাজাকার ক্যাম্প,দত্তের হাট রাজাকার ক্যাম্প ওড়িয়ে দেয়। তারা জামে মসজিদের পশ্চিমে অবস্থিত রেনু মিয়া কন্টাক্টরের বাড়ি থেকে বর্তমান নতুন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। উত্তর দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চল থেকে সকল মুক্তিযোদ্ধা শহরে উঠে বাকি তিন দিক ঘিরে ফেলে ।
৬ ডিসেম্বর রাত ৩ টা থেকে ফায়ার শুরু হয়। রাতের অন্ধকারে কিছু রাজাকার পালিয়ে যায়। পিটি আই এলাকাটি সংরক্ষিত এলাকা । রাজাকারা থেকে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের জবাব দেয় ৩০৩ রাইফেল দিয়ে। এদিকে ফেনী ২ নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জাফর ইমাম মাইজদী পি টি আই যুদ্ধের খবর পেয়ে তার একটি সেকশন নিয়ে দুপুরে এসে মাইজদী অবস্থান নেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সকল অবস্থান এবং শক্রুর অবস্থান জেনে শত্র“র আস্তানায় দুটি দুই ইঞ্চি মটর সেল নিক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে রাজাকাররা ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। এতে ঘটনাস্থরে শহীদ হন নোয়াখালী সরকারি কলেজের অধ্যাপক আবুল হাসেম,ছাত্র স্বপন,আব্দুল জলিল,নাজির বসু মিয়া এবং ছাত্র নজরুলসহ মোট ৫জন্ । একটানা ৪৮ ঘন্টা যুদ্ধের পর ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানী দোসররাা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আর্তসমর্পন করে। শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী। ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত দিবসের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে পিটি আই ভবনের সম্মুখদ্ধারে একটি স্মৃতি ফলক নির্মিত হয়।
সাতক্ষীরা মুক্তদিবস
১৯৭১‘সালের ৭ই ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত হয় । দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে রাজাকার আল বদরদের সহযোতিায় পাক বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন ও গুলিতে সাতক্ষীরার শত শত নারী পুরুষ প্রাণ হারায় । যুদ্ধ ক্ষেত্রে শহীদ হয় ৩৩ জন বীর বাঙ্গালী । যুদ্ধ হত হয় ২১ জন মুক্তিযোদ্ধা। শত শত মানুষের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় পাক বাহিনী। জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এসব নিহতদের বদ্ধ ভূমি ও গন কবর ।
১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল সাতক্ষীরার ভোমরায় প্রথম মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে পাক বাহিনীর যুদ্ধ হয় । যুদ্ধে শহীদ হয় অনেক মুক্তিযোদ্ধা । ৮ নং সেক্টর কমান্ডার এম এ মুঞ্জুর,৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের নেতৃত্বে কলারোয়া উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা বাজার ,সদর উপজেলার সাতানী, শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর, দেবভাটা উপজেলার ট্উন শ্রীপুর এলাকায় পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়বহ যুদ্ধ হয় । আরও একাধিস্থানে যুদ্ধ হয় । সবশেষে যুদ্ধ হয় ৭ ই ডিসেম্বর সাতক্ষীরা আদালত এলাকায় । এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাক বাহিনী সাতক্ষীরা ছেড়ে পালিয়ে যায় । মুক্ত হয় সাতক্ষীরা । দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে সাতক্ষীরায় ৩৩ জন বীর বাঙ্গালী শহীদ হয় । যুদ্ধাহত হয় ২১ জন । পাকসেনারা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় এর পিছনে কয়েক শত নারী পুরুষ শিশুকে গুলি করে হত্যা করে । রাজাকার আলবদরদের সহযোগতায় পাকসেনারা কলারোয়ার মুরালী কাটির কুমুর পাড়া, বলফিল্ড মাঠ,ভোমরা ,কালিগঞ্জের নারায়ণপুর, শ্যামনগরে হাজার হাজার নিরহ মানুষকে পাকসেনারা হত্যা করে ।
মাগুড়া মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাগুরা জেলা পাকহানাদার মুক্ত হয়। বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে শহীদ বেদীতে পুস্পস্তবক অর্পণ, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘মাগুরা মুক্ত দিবস’ পালনের আয়োজন করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারিভাবেও দিনটি পালনের জন্য নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
সেই সময়ের মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্যমতে- জাতির জনক বাঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আহবানে মাগুরায় সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। প্রাথমিক ভাবে মাগুরা শহরের নোমানী ময়দান ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ক্যাম্প এবং ওয়াপদা ভবনে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়। এখান থেকেই সমগ্র মাগুরার প্রতিরোধ যুদ্ধ নিয়ন্ত্রন করা হতো।
মাগুরা শহরের পি.টি.আই ভবনে পাক সেনারা ক্যাম্প স্থাপন করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন চালায়। এ সময় নিহত শহীদদের পি.টি.আই মাঠে গনকবর দেওয়া হয়। এছাড়া পাক বাহিনি মাগুরা নবগঙ্গা নদীর তীরে মুক্তিযোদ্ধাদের চোখ বেধে নির্যাতন ও হত্যা করত।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ি যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরের শুরুতে সে সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্বরত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীকে পরাস্ত করতে থাকে। এসব কমান্ডারদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শ্রীপুরের আঞ্চলিক বাহিনীর কমান্ডার আকবর হোসেন মিয়া, সহ অধিনায়ক মোল্যা নবুয়ত আলী, আলমখালী অঞ্চলে দায়িত্বরত মাজেদ বাহিনীর কমান্ডার খন্দকার আব্দুল মাজেদ, মহম্মদপুর ও ভাটিয়াপাড়া অঞ্চলে দায়িত্বরত কমল বাহিনী প্রধান মাশরুরুল হক কোমল সিদ্দিকী বীর উত্তম। তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র আক্রমনের মুখে পাকবাহিনী পরাজিত হতে থাকে।
এরই এক পর্যায়ে ৬ ডিসেম্বর যশোর ও ঝিনাইদহ শত্রুমুক্ত হলে মিত্র বাহিনী ৭ ডিসেম্বর মাগুরায় প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি মিত্র বাহিনীর বোমা হামলায় পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে ৭ডিসেম্বর বিকালে মাগুরা শহর ছেড়ে কামারখালি গড়াই নদী পাড় হয়ে ফরিদপুরের দিকে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর মাগুরা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়। এ দিন জেলার মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে নিয়ে জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে মাগুরা শহরের রাস্তায় নেমে আসে। তৎকালিন মাগুরা মহাকুমা শহরসহ সর্বত্র উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা।
৮ ডিসেম্বর:
চাঁদপুর মুক্তদিবস
৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর মুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে ৮ডিসেম্বর পাক বাহিনীকে বিতাড়িত করে চাঁদপুর জেলা মুক্ত হয়। মুক্তদিবসকে ঘিরে শহরের লেকের পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে অঙ্গীকার নামে একটি স্তম্ভ। এ স্থানে প্রতি বছর মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার আয়োজন করা হয়। জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার ১নং রাজারগাঁও ইউনিয়রেন নাছির কোর্ট গ্রামে সবচেয়ে বড় শহীদদের সমাধিস্থল। নাছিরকোর্ট শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সমাধিস্থলে ৯জন শহীদকে একই স্থানে সমাহিত করা হয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যমতে নাছিরকোর্ট ও আশপাশের এলাকায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদদের নিরাপদ স্থান হিসেবে এ এলাকায় সমাহিত করা হতো। ৯শহীদের সকলেই আশপাশের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধাদের অভয়াশ্রম হিসেবে খ্যাত নাছিরকোর্ট এলাকা। নাছিরকোর্ট উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ডাঃ শামছুল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইচ্ছুকদের পরিচয়পত্র দিয়ে ভারতে প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হতো। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো। নাছিরকোর্ট সমাধিস্থলকে ঘিরে একটি কলেজ ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এছাড়া চাঁদপুর শহরের নিউ ট্রাকরোডস্থ পোদ্দার বাড়ীতে পাক বাহিনীকে রুখতে বোমা তৈরী করতে গিয়ে চাঁদপুরে প্রথম শহীদ হন কালাম, খালেক, সুশীল ও সংকর। তাদের স্মরণে ২০০৪ সালে ওই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ কালাম-খালেক, সুশীল ও সংকর মুক্তিসৌধ। শহরের বড় স্টেশন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে বিভিন্নস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধাদের এনে নির্যাতন করে পাক বাহিনী নদীতে পেলে দেয়। ওইস্থানটিকে স্মরণে রাখতে ২০১১ সালের শেষের দিকে সরকারি উদ্যোগে বড় স্টেশন মোলহেডে নির্মাণ হয়েছে রক্তধারা। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ বধ্যভূমির অগণন শহীদ স্মরণে এ স্মৃতিস্থম্ভ।
কুমিল্লা মুক্তদিবস
৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এদিনে কুমিল্লা পাক হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত হয়। র্দীঘ নয় মাসের যুদ্ধ,আর নির্যাতনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মিত্রবাহিনীসহ গণ জাগরনের আনন্দ উল্লাসে মুক্তির চিরন্তর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধ্বনিতে প্রকল্পিত হয়ে উঠে। মুক্ত হয় কুমিল্লা। কিন্তু এ সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের চর্তুদিকে পাকসেনাদের ঘিরে ফেলে মুক্তবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর জোয়ানরা। পরে ১৬ ডিসেম্বর আতœসমর্পনের মধ্য দিয়ে সেনানিবাস পাক হানাদার দখল মুক্ত হয়।
এর আগের দিন রাতে ৭ ডিসেম্বর রাতে সীমান্তবর্তী এলাকার তিনদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী কুমিল্লা বিমান বন্দরে পাক বাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের ঘাটিঁতে আক্রমণ শুরু করে। পাক বাহিনীর অবস্থানের উপর মুক্তিসেনারা মর্টার আর্টিলারি আক্রমণ চালিয়ে শেষ রাতের দিকে তাদের আতœসমর্পন করাতে সক্ষম হয়। সারারাত ব্যাপী পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাক বাহিনীর কতিপয় সেনা বিমান বন্দরের খাঁটি ত্যাগ করে শেষ রাতে বরুড়ার দিকে এবং সেনানিবাসে ফিরে যায়। বিমান বন্দরের ঘাঁটিতে ধরা পড়া কতিপয় পাক সেনা আতœসমর্পন করে। রাতে মিত্রবাহিনীর ১১ গুর্খা রেজিমেন্টের আর কে মজুমদারের নেতৃত্বে কুমিল্লা বিমানবন্দরের তিনদিকে আক্রমন চালানো হয়। সীমান্তর্বতী বিবির বাজার দিয়ে লেঃ দিদারুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল এবং অপর দুটি দল গোমতী নদীর অতিক্রম করে ভাটপাড়া দিয়ে এবং চৌদ্দগ্রামের বাঘের চর দিয়ে এসে বিমান বন্দরের পাক সেনাদের ঘাটিঁতে আক্রমন করে। রাতের মধ্যে বিমান বন্দরের ঘাঁিটতে অবস্থানরত পাক সেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে পাকসেনাদের প্রধান ঘাঁটি পতনের মধ্য দিয়ে পরদিন ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা পাক সেনা মুক্ত হয়। এদিন ভোরে মুক্তিসেনার শহরের চকবাজার টমছমব্রিজ ও গোমতী পাড়ের ভাটপাড়া দিয়ে আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। তখন রাস্তায় নেমে আসে জনতার ঢল। কুমিল্লাার আপামর জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে মুক্তির উল্লাসে বরণ করে নেয়। পরে এদিন বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা মিত্রবাহিনী জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তৎকালীন প¬িম পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী, দলীয় পতাকা এবং কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক এডভোকেট আহমেদ আলী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তদিবস
৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বাঞ্চল আখাউড়া মুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। আখাউড়া থেকে রেললাইন ও উজানীসার সড়ক দিয়ে অগ্রসরমান যৌথবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পৌছে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যাবার পূর্বে ৬ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনী এখানে জগন্যতম হত্যাকান্ড ঘটায়। অর্ধশতাধিক বন্দী মুক্তিযোদ্ধা, সাধারন নিরাপরাধ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীকে শহরের দক্ষিনপার্শে কুরুলিয়ার খালে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। এখানেই শহীদ হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজের বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক লুৎফর রহমান, সরাইলের আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট সৈয়দ আকবর হোসেন বকুল মিয়া, তার ছোট ভাই সৈয়দ আফজাল হোসেন সহ অর্ধশতাধিক বন্দী মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ নিরাপরাধ মানুষ।
ঝালকাঠি মুক্তদিবস
৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় ঝালকাঠি জেলা। ৭১ এর দীর্ঘ নয় মাস ধরে বধ্যভূমিতে গণহত্যা, লুটসহ ঝালকাঠিতে চলে পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪১ বছর পর আজও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষন হয়নি।
একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্থানী সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়ে গেলে বিনা বাঁধায় ঝালকাঠি হানাদার মুক্ত হয়। ৮ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঝালকাঠি ও নলছিটি থানা দুটি মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয় । রাতের মধ্যেই পুরো জেলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে আসে। স্বাধীনতার পর থেকে ৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠি মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
কিন্তু একাত্তরের নয় মাস ঝালকাঠির বিভিন্ন স্থানে বধ্যভূমিতে গণহত্যা, লুট আর নারী নির্যাতনসহ হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতন চালায়। ঝালকাঠি জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি শহরের সুগন্ধা নদী পাড়ে বর্তমান পৌর খেয়াঘাট এলাকায়। ১৯৭১ সালের ৩০ মে একদিনেই এখানে ১০৮ জন নিরিহ বাঙ্গালী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। জেলার বেশাইন খান গ্রামে ৭ জুন হানাদাররা মসজিদ থেকে নামাজ পড়া অবস্থায় ধরে এনে সেখনকার বধ্যভূমিতে হত্যা করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিজনকে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তথ্য অনুযায়ি জেলায় ২৪টি বধ্যভুমির তালিকা কথা জানা গেছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
কিন্তু আত্মত্যাগী এই সব শহীদের স্মৃতি রক্ষায় স্বাধীনতার ৪১ বছরেও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষন হয়নি। বধ্যভূমিরগুলোর কোথায়ও সরকারী উদ্যোগে একটিও স্মৃতি সৌধ নির্মান হয়নি। জেলার সবচে বড় পৌরখেয়াঘাট এলাকায় একাত্তরের বধ্যভূমিতে নির্মিত হয়েছে পৌর কশাইখানা। আর সারা দেশের সাথে ঝালকাঠি জেলায় নির্মিত জেলা শহীদ স্মৃতি ফলকটিতে নির্মানের ৬ মাসের মধ্যেই ফলক থেকে মুছে গেছে শহীদের নাম।
স্বাধীনতার পর বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ না করায় অনেকগুলো স্থান স্মৃতির গর্ভে হারিয়ে গেছে। কোন কোনটি দখলও হয়ে গেছে।
আর নির্মম হলেও সত্য, জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধাহত এবং তাদের পরিবারের পুনাঙ্গ তালিকা ৪০ বছরেও তৈরি করতে পারেনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।
মৌলভীবাজার মুক্তদিবস
মৌলভীবাজার ৮ ডিসেম্বর পাক হানাদার মুক্ত দিবস। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১সালের ৮ডিসেম্বর শসস্ত্র সংগ্রাম করে পাক হানাদার বাহিনীকে বিতারিত করে শত্রুমুক্ত করেছিলেন। তবে এর আগে হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই করে ও পাক-বাহিনীর নির্যাতনে শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী নারী-পুরুষ। নিজেদের ইজ্জত হারিয়ে ছিলেন অনেক মা-বোন। নির্যাতন আর নিপিড়নের স্থানগুলো আজও রাজ স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে জেলাবাসীর কাছে।
১৯৭১ সালের ৩০এপ্রিল থেকে ৭ডিসেন্বর পর্যন্ত পাকিস্থান পাক হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজারে হত্যা করেছিল অগনিত নীরপরাধ মানুষকে। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অপারেশনে বহুমূখী দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ৭ডিসেম্বর পাক বাহিনী মৌলভীবাজার থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অনেক নির্যাতন-নিপীড়ন আর তর-তাজা প্রানের বিনিময়ে মৌলভীবাজার হানাদার মুক্ত হয়েছিল। ৮ ডিসেম্বর গন পরিষদ সদস্য ও বর্তমান জেলা পরিষদ প্রশাসক আজিজুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে তৎকালীন সময়ে মৌলভীবাজার মহকুমা কার্যালয়(বর্তমান জর্জ কোট) প্রাঙ্গনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ছিলেন আনুষ্টানিক ভাবে।
দেশ স্বাধীন হয়েছে দীর্ঘদিন কিন্তু আজ মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের চাদাঁয় বিভিন্ন দিবস পালন করে আসছেন। মুত্তিযোদ্ধাদের যথাযত মর্যাদা ও মুল্যয়ন আসবে এই আশায় আছেন তারা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার।
৯ ডিসেম্বর
বরিশাল মুক্তদিবস
১০ ডিসেম্বর
টাঙ্গাইল মুক্তদিবস
১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার দামাল সূর্যসেনারা পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করে। উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। অর্জিত হয় দেশের স্বাধীনতা। যুদ্ধকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের ইতিকথা দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পরে বিশ্বব্যাপী। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত “কাদেরিয়া বাহিনীর” বীরত্বের কথা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এখনও চিরস্মরনীয় হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ গঠন করা হয়। চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৬ মার্চ থেকে গ্রামে গ্রামে যুবকরা সংগঠিত হতে থাকে। ৩ এপ্রিল প্রথম পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধ ভেঙ্গে শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে আসে। তারা নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ ও সংগঠিত হতে থাকে। অল্প দিনের মধ্যেই ১১ নং সেক্টরের অধীনে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে বিশাল “কাদেরিয়া বাহিনী”। জেলার পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ। খন্দকার আব্দুল বাতেন বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত “বাতেন বাহিনীও” জেলার পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। চারদিক থেকে আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকবাহিনী। দেশে এবং দেশের বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে চলে গণসঙ্গীত।
১০ ডিসেম্বর বিকেলে কালিহাতীর পৌলিতে মিত্রবাহিনীর প্রায় ২ হাজার সেনা অবতরন করায় হানাদারদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তারা ছুটতে থাকে ঢাকার দিকে। ১১ ডিসেম্বর ভোর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করতে থাকে। টাঙ্গাইল শহর সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত হয়। মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারাও আনন্দের জোয়ারে ভাসতে থাকে। “জয় বাংলা” শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে টাঙ্গাইলসহ দেশের আকাশ বাতাস।
পাক হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধ চালাকালে অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে টাঙ্গাইল শহরের জেলা সদর পানির ট্যাঙ্কের পাশে বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাক বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষী এই বধ্যভূমিটি সংরক্ষনের উদ্যোগ বিজয়ের ৪০ বছরেও নেওয়া হয়নি। অপরদিকে দেশ মাতৃকার জন্য জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধ করেছিলো আজও তাদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়না। ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অনেকেই।
মুন্সিগঞ্জ মুক্তদিবস
১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার মুক্ত হয় মুন্সিগঞ্জ। গৌরবময় বিজয়ের ৪১ বছর পূর্তিতে যখন শারাদেশে নানা আয়োজন তখন মুন্সিগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর আর্ত্মনাদ যেনো আজো থামেনি।
২৬ মার্চ সকালে এ অঞ্চলের মুক্তি পাগল ছেলেরা মুন্সিগঞ্জ সদর থানার হানাদার ক্যাম্প এ অভিযান চালায়। দেশ মুক্ত করার প্রত্যয়ে থানার হানাদার ক্যাম্পে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে জয় বাংলা শ্লোগানে উড়ায় মানচিত্র খচিত বাংলার পাতাকা। নেতৃত্ব দেয় মুক্তিযোদ্ধা সুভষ চন্দ্র সাহা। যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে সে জন্য তাকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। রাজাকারদের সহযোগিতায় ১৪ মে তার বাবা ও ভাইসহ পরিবারের ১৪ জনকে ধরে নিয়ে একসাথে ব্রাসফায়ার করে মারা হয় জেলা সদরের কেওয়ার এলাকার একটি খালের পাশে। আজো সে কথা ভূলতে পারেনি তার পরিবার।
৯মে গজারিয়ায় ঘটে ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞ ষটায় পাক হানাদার ও তাদেও দোষররা। ফজরের আযানের সময় লঞ্চঘাটে থামে পাক নৌ-বহর। কিছু না বুঝে উঠার আগেই হত্যা করা হয় ৩৬০ জন নিরহ মানুষকে। অসহায় মানুষের রক্ত এসে মিশে যায় মেঘনার ঘোলা জলে।
যুদ্ধের ৯মাস জেলার বিভিন্ন স্থানে চলে ছোট,বড় অভিযান। লৌহজং এর গোয়ালী মান্দ্রায় সম্মুখ যুদ্ধে পাক হানাদাররা পরাস্ত হয়। চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে ১১ ডিসেম্বর ভোর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মুন্সিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন দিক থেকে পাক হানাদার বাহিনীর সব চাইতে বড় ক্যাম্প হরগঙ্গা কলেজ ছাত্রাবাসের দিকে এগুতে থাকে। ততক্ষনে বর্বর পাকিস্তানী হায়নারা বুঝতে পারে তাদের সময় ফুরিয়ে গেছে। দুপুরের আগেই ক্যাম্পের সব দিক ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধারা। কোন কুল কিনারা না পেয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করে। শক্রমুক্ত মুক্ত হয় পদ্মা,মেঘনা,ধলেশ্বরী ইছামতি বিধৌত মুন্সিগঞ্জ।
জামালপুর মুক্তদিবস
১৯৭১ সনের এই দিনে হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে অকুতভয় মুক্তিসেনারা জামালপুরকে শত্রুমুক্ত করে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১১ নং সেক্টরের অধীন জামালপুরের বিভিন্নস্থানে হানাদারবাহিনী তাদের দোসর আল-বদর রাজাকারদের নিয়ে ব্যাপক ধ্বংশযজ্ঞ চালায়, হত্যা করে অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে।
একাত্তরের ২২ এপ্রিল হানাদার পাকবাহিনী জামালপুরে প্রবেশ করে। জামালপুরে স্থাপন করে পাক হানাদার বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার। যুদ্ধকালীন সময়ে জেলা সদরের পিটিআই হেড কোয়াটার, বর্তমান ওয়াপদা রেস্ট হাউস, আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেল টর্চার সেল, ব্রহ্মপুত্রের তীরে শ্মশান ঘাট বধ্যভূমি, ফৌতি গোরস্থান বধ্যভূমিতে ধরে এনে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সরিষাবাড়ীর বারই পটল এলাকায় একদিনেই হত্যা করা হয় শতাধিক মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে। চিহ্নিত না করায় বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো এখনো পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। ৪ ডিসেম্বর কামালপুর বিজয়ের পর মুক্তি বাহিনী চর্তুদিক থেকে জামালপুরকে ঘিরে ফেললে হানাদার বাহিনীও আত্মরক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এক পর্যায়ে ১০ ডিসেম্বর দিন ও রাতব্যাপী মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমনে হানাদার বাহিনী পরাস্ত হলে ১১ ডিসেম্বর ভোরে কোম্পানী কমান্ডার ফয়েজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিসেনারা হানাদার বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পুরানা ওয়াপদা ভবনে স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্ত হয় জামালপুর। জামালপুর মুক্ত করার যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ২৩৫ জন সৈন্য নিহত হয় এবং ৩৭৬ জন হানাদার সৈন্য আত্মসমর্পন করে। আর এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর ১১জন শহীদ হয়।
স্বাধীনতার ৪১ বছর যাবত মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতিচিহ্ন অযতœ অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। আশেক মাহমুদ কলেজ ডিগ্রি হোস্টেল টর্চার সেল পরিণত হয়েছে গরুর খোয়াড়ে। একটি বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে সরিষাবাড়ির বারইপটল (বর্তমান নাম শহিদ নগর) বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মানের কাজ চলছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাথা তুলে ধরতে টর্চার সেল, বধ্যভূমি, গণকবরসহ সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে এটাই এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের দাবি।
ভোলা মুক্তদিবস
১৯৭১সালের ১০ ডিসেম্বর ভোলা হানাদার মুক্ত হয়। ৭১ এর ৪ঠা নভেম্বর ভোলার দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নের গরুচৌখা খালে ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক-হানদার বাহিনীর সর্বশেষ যুদ্ধ হলে সেখানে হানাদার বাহিনীর ৯ সদস্য নিহত হয়। এর পর ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও সদস্য বৃদ্ধির খবর পেয়ে পাক বাহিনী তাদের অভিযান বন্ধ রাখে। পরে ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের সকল ইউনিটের সদস্যরা এক হয়ে প্রায় ১মাস যাবৎ পাক হানাদার বাহিনীকে ভোলার যুগির ঘোলের ওয়াপদা কলোনীতে নজর বন্ধি করে রাখে। ১০ ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে পাক হানাদার বাহিনীর ২টি দল ভোলা খালের চিতাখোলার সামনে থেকে এমভি তৃনা নামের একটি লঞ্চ দিয়ে পালিয়ে যেতে প্রস্তুতি নেয়। এর পর ভোলার সঙ্গবদ্ধ মুক্তি যোদ্ধারা তাদেকে পেছন থেকে আক্রম করার চেষ্টা করলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি ছুরে নিরাপদে চলে যায়। এ খবর ভোলার সকল উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছলে তারা ভোলা শহরে এসে সমবেত হয়। তাদের সাথে যোগ দেয় কয়েক হাজার নারী-পুরুষ। পরে মুক্তিযোদ্ধা ও সম্মিলিত জনতা ভোলা যুগিরঘোল চত্তর থেকে পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় মিছিল বের করে পুর শহর প্রদক্ষিণ করে।
উল্লেখ্য ৭১এর মে মাসের ৩ তারিখে পাক হানাদার বাহিনীর ২টি দল লঞ্চ যোগে ভোলায় প্রবেশ করে যুগির ঘোলের ওয়াপদা কলোনী দখল করে। তারা ভোলাতে মোট ৭মাস ৭দিন অবস্থান করে। তারা সর্ব প্রথম আক্রমন চালায় বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা ইউনিয়নে এভাবে তারা ভোলার চরফ্যাশন, লালমোহন, দৌলতখান ও ভোলা সদর উপজেলায় আক্রমন চালায়। তাদের নির্মম অত্যাচারের প্রধান ২টি স্থান ছিল যুগির ঘোলের ওয়াপদা কলোনী ও ভোলা লঞ্চ ঘাট। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও অসহায় নারী-পুরুষদের ধরে এনে প্রথমে ওয়াপদার টর্চার সেলে হাত-পা বেধে নির্যাতন চালাত। পরে তাদেরকে ট্রাক ভর্তি করে লঞ্চ ঘাট তেতুলিয়া নদীর পারে এনে সারিবদ্ধ ভাবে দার করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে নদীতে লাশ ফেলে দিত। তাদের নির্মম নির্যাতনে ভোলার ৭৯জন মুক্তি যোদ্ধাসহ অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশুরা প্রাণ হারায়।
নওগাঁ মুক্তদিবস
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে একজন অন্যতম মহান সংগঠক ছিলেন আব্দুল জলিল । ১৯৭২ সালে আত্রাই রাণীনগর নকশালী রাজনীতির ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। শ্রেণী শক্র খতমের নামে নকশালরা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আব্দুল জলিল নিজের জীবন বিপন্ন করে বড় ঝুঁকি নিয়ে নকশালদের ব্যুহ ভেঙ্গে চুরমার করে রক্তাক্ত প্রান্তরে সোনালী সূর্য্যরে আলো প্রদান করেন। দমন করেন নকশালী তৎপরতা।
১৯৭৩ সালে তিনি সর্ব্ব প্রথম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নওগাঁ সদর আসনে এম.পি. নির্বাচিত হন। দেশ পুনর্গঠনের কাজে পুরো মাত্রায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু বিধি বাম স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্ররা মাথাচারা দিয়ে উঠে।
মানবতা বিরোধীরা, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদর আলশামস্ বাহিনী ও দেশী বিদেশী শক্ররা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের অতর্কিত হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ তার গোটা পরিবারকে হত্যা করে। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে জারি করা হয় সামরিক শাসন। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয় গলা টিপে। অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আব্দুল জলিলকেও গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ ৪ বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
১৯৮২ সালে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করার পর গ্রেপ্তার করা হয় আব্দুল জলিলকে। ১৫ দিন অজ্ঞাত স্থানে বন্দী রেখে অবর্ণনীয় দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় তার উপর । জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর মা’র মৃত্যু হলেও সামরিক জান্তা মাতৃ মুখখানা এক নজর দেখার জন্য কোন সুযোগ দেয় নাই।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ৯ মাসের যোদ্ধাদের খরচ মোকাবিলায় মোঃ আব্দুল জলিল ভারতের প্রত্যেকটি রিসিপশন ক্যাম্পের জন্য নওগাঁ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ব্যাংক থেকে ৭১,৮০,০০০/- টাকা তিনি ব্যাংকের ভোল্ট রেজিষ্টারে এন্ট্রি করে উক্ত টাকা গ্রহণ করেন এবং সেই অর্থ দিয়ে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পগুলো পরিচালিত হত। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর নতুন সরকারের নিকট খরচ অন্তে অবশিষ্ট ৩৪,৫২,০০০/- টাকা ফেরত দেন। উল্লেখ তিনি কোন টাকা পয়সা আত্মসাৎ করেন নাই।
নওগাঁ জেলায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন নওগাঁ সদরে ১৯জন নিয়মতপুরে ৭জন পতœীতলায় ৯জন পোশায় ১জন রাণীনগরে ৪জন বদলগাছিতে ১৪জন সাপাহারে ৪জন ধামরহাটে ৯জন মাহাদেবপুরে ৩জন জেলায় মোট নামজানা ৭০জন বীর মুক্তিযুদ্ধা শহীদ হন এবং নামনাজানা মুক্তিযুদ্ধে কয়েক হাজার নিরহ নারিপুরুষ শহীদ হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও এখন পযন্ত প্রকৃত মুক্তিযদ্ধের সাধ এখনও আমরা পাইনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একনও শেষ হয়নি, মানবতা বিরোধীরা, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদর আলশামস্ বাহিনীর বিচার শেষ না হওয়া পযন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হবেনা। আমাদের সপ্ন রেখে যাচ্ছি আগামি প্রজন্মের কাছে।
নওগাঁ জেলায় তালিকা ভুক্ত মুক্তিযুদ্ধার সংখ্যা ২৫৬২ এবং সদর উপজেলায় ৮৬০ জন এদের মধ্যে ৭১০ জন সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধা ভাতা পায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে একজন মহান অন্যতম সংগঠক আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ইউনিট কমান্ডার সহ মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, দু’লক্ষ মা'বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এদেশের বিজয় অর্জিত এই বিজয়ের মাসে মানবতা বিরোধীরা, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদর আলশামস্ বাহিনীর বিচার ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ দেখতে চাই সরকারের নিকট আকুল আবেদন। ১০ই ডিসেম্বর নওগাঁয় একটানা ৩৬ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি হানার বাহিরি হাত থেকে মুক্ত হয়।
১২ ডিসেম্বর
কক্সবাজার মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাক হানাদার মুক্ত হয় কক্সবাজার। এরপর মুক্তিযোদ্ধা শহরের পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে জড়ো হয়ে বিজয়ের লাল সবুজের পতাকা উড়ান। এদিকে যাদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের নেই যথাযথ মুল্যায়ন। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর সন্তানদের ‘বধ্যভূমি’ও অরক্ষিত হয়ে আছে কক্সবাজারে।
১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এদেশের নিরস্ত্র মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর পাকিস্তানের সেনা বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মুক্তিকামি ও মুজিব আদর্শের নেতাকর্মীদের বেছে বেছে হত্যা করে। এ থেকে বাদ পড়েনি কক্সবাজারে মুক্তির আদর্শের সৈনিকরাও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসীদের ধরে এনে আজকের বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছে। সারা দেশের মত কক্সবাজার জেলায় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতনের পর নৃশংসভাবে হত্যা করত। বধ্যভূমিতে পরিদর্শনে গিয়ে ৭১ এর ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
এদিকে অনেক ত্যাগ, রক্ত আর মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাক হানাদার মুক্ত হয় কক্সবাজার।
১৩ ডিসেম্বর
নীলফামারী মুক্তদিবস
১৯৭১’এর ১৩ডিসেম্বর নীলফামারীর আকাশে উদিত হয় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত সবুজের বুকে রক্ত লাল পতাকা। নীলফামারী হয় হানাদার মুক্ত। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী নীলফামারীকে ঘোষনা করে হানাদারমুক্ত। আবাল বৃদ্ধ বনিতা উল্লাসে উচ্ছসিত হয়ে নেমে পদে রাজপথে। সবার মুখে ছিল একটি শ্লোগান “ জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু”।
বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের পর সারা দেশের ন্যায় নীলফামারীর দামাল ছেলেরাও দেশ মাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করতে ঝাপিয়ে পরে। পাক হায়েনারা যুদ্ধের নামে বাংলার স্বাধীনচেতা মানুষদের হত্যাযজ্ঞসহ নির্যাতন ও ধর্ষনে মেতে উঠে। নীলফামারী সরকারী কলেজ, কলেজ ছাত্রাবাস ও ভকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে গড়ে তুলে সেনা ক্যাম্পের নামে শক্ত ঘাটি। বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী পুরুষকে ধরে এনে এসব ঘাটিতে করা হতো নির্মম নির্যাতন ও ধর্ষন। টানা ৯মাসের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন বাশার, আলী হোসেন, আহমেদুল হক প্রধান, আনজারুল হক ধীরাজ, জাহেরুল ইসলাম, মোজাম্মেল হক, মিজানুর রহমান, মির্জা হাবিবুর রহমান বেগসহ ১৭জন বীর যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন।
দেশ মাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগুপ্তা হামলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অনেক পাক সেনাকে হত্যা করেছে। শহীদ হয়েছে অনেক মুক্তিযোদ্ধা। ১৩ডিসেম্বর নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের উপরে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।
১৪ ডিসেম্বর
চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। খুব সকালেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদীর তীরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। পাক সেনাদের বাঙ্কার থেকে আসা অবিরাম গুলির জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা। ওইযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরসহ আরো আট মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
একজন কমণ্ডার ও সাতজন সঙ্গী হারিয়ে শোকে মুহ্যমান মুক্তিযোদ্ধারা। একইসঙ্গে নিস্তব্ধ পাকসেনাদের বাঙ্কার। নেই কোন গুলির আওয়াজ। বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সামনের দিকে এগিয়ে যান। পাকসেনাদের বাঙ্কার ও আস্তানা উড়িয়ে দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দখল নেয় মুক্তিবাহিনী। সব শত্রু খতম করে অস্ত্র উচিয়ে বিজয়ের ঘোষণা দেন।
দিনাজপুর মুক্তদিবস
১৯৭১-এর মহান মুক্তি যুদ্ধের ৯মাস পর আজকের এই দিনে ৭ নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা মিত্রবাহিনীর সাথে যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর জেলা শহরকে পাক-হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেছিল।৭নং সেক্টরের সাব-সেক্টর হিসেবে দিনাজপুরের রনাঙ্গনে নেতৃত্ব দেন সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামান। ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর এবং শত্র“ কবলিত দিনাজপুরের দশমাইল হয়ে বীরমুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুর শহর দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল। এ সময় পাকহনাদররা দশমাইল হয়ে সৈয়দপুরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
চট্টগ্রাম মুক্তদিবস
১৪ ডিসেম্বর দক্ষিণ চট্টগ্রাম মুক্তদিবস। ৭১’র এই দিনে চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন পটিয়া থানার (বর্তমানে চন্দনাইশ উপজেলা) দোহাজারী
ও আশেপাশের এলাকাগুলো মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে হানাদারমুক্ত হয় পুরো দক্ষিণ
চট্টগ্রামের ৫টি থানা। দোহাজারীতে সংগঠিত পাক হানাদার বাহিনীর সাথে
মুক্তিযোদ্ধাদের দুইদিন ব্যাপী সম্মুখ সমরের পর ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে হানাদার
বাহিনী পালিয়ে গেলে ঐদিনই দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাঁচটি থানার সর্বত্র
উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা। মুক্ত হয় পুরো দক্ষিণ
চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীর পটিয়া থানা থেকে শুরু হয়ে চকরিয়া
থানার সীমানা পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকার তৎকালীন
পাঁচটি থানা বোয়ালখালী, আনোয়ারা, পটিয়া, সাতকানিয়া ও বাশঁখালী (বর্তমানে ৭টি) ১৯৭১
এর প্রায় পুরো ৯ মাস পাক হানাদারবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল। ৭১ এর ১৪
ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর দখল থেকে বৃহত্তর দোহাজারী মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে
পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাঁচটি থানা (তখন বর্তমান কক্সবাজার জেলা দক্ষিণ চট্টগ্রামের অংশ ছিল) সম্পূর্ণরূপে
শক্রমুক্ত হয়। এর আগে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণের সাথে
গেরিলা বাহিনীর মরণপণ আঘাত বিভিন্ন থানায় হানাদার বাহিনীর গড়ে তোলা
আস্তানাসমূহ আক্রান্ত হতে থাকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের
প্রথম দিকে প্রতিটি থানায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত
যৌথবাহিনীর আক্রমণ জোরদার হয়ে উঠলে পাকবাহিনী তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। ফলে
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের শেষ দিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েকটি থানা বিশেষ করে আনোয়ারা, বাঁশখালী মুক্ত হয়ে যায়। এই দুটি থানা হানাদারমুক্ত হলেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসহ মূল তিনটি থানা সাতকানিয়া, পটিয়া ও বোয়ালখালীর নিয়ন্ত্রণভার পাকবাহিনীর হাতেই ছিল এবং তা দোহাজারীতে দুইদিনের সম্মুখ যুদ্ধ পর্যন্ত বলবৎ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকবাহিনী
দোহাজারীকে ঘিরে দুর্ভেদ্য রক্ষণব্যুহ গড়ে তোলে। যাতে করে পুরো দক্ষিণ
চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা যায়। দোহাজারীতে স্থল, রেল, নৌ
ও আকাশপথের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সড়ক বিভাগের কার্যালয়টিকে তাদের প্রধান অফিস
হিসাবে বেছে নেয়। একই সাথে পাশাপাশি অবস্থিত সাঙ্গুভ্যালি টিম্বার
ইন্ডাস্ট্রিজের বাংলোকে ভিআইপি রেস্ট হাউজ বানিয়ে এবং উক্ত কারখানার বিশাল
মাঠকে হ্যালিপ্যাডে রূপান্তরিত করে তাদের দুর্গ গড়ে তোলে। একইভাবে
দেওয়ানহাট বিএডিসি কার্যালয়, দোহাজারী উচ্চ বিদ্যালয়, দোহাজারী বিদ্যুৎ ভবনকে ব্যারাকে পরিণত করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পুরো এলাকায় নির্বিচারে নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে থাকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে
যখন পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে বিভিন্ন থানা থেকে পিছু হটে আসতে
থাকে তখন পাক হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দালাল রাজাকার, আলবদর, আল
শামস বাহিনীর সহযোগিতায় ভয়ংকর আক্রোশে পটিয়া সাতকানিয়ার নিরীহ জনগণের ওপর
ঝাপিয়ে পড়ে। দালাল বাহিনীর সদস্যরা গ্রামে গ্রামে বিশেষ করে হিন্দু প্রধান
এলাকায় গিয়ে ধরে নিয়ে আসতো নিরীহ যুবক-যুবতীদের।
মুক্তিবাহিনীর চর অজুহাতে ধরে আনা যুবকদের পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা
হতো। আর মহিলাদের উপর চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন। মুক্তিযোদ্ধা অজুহাতে
কত বাসযাত্রীকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে তার হিসাব পাওয়া
দুস্কর। সেসময় রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল খরস্রোতা শঙ্খনদীর পানিও।
এরিই মধ্যে ১১ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর একটি দল শঙ্খ নদীর দক্ষিণপাড়ে কাটগড়, কালিয়াইশ
এলাকায় পাকবাহিনীর পরিত্যক্ত ব্যাংকারগুলোর দখল নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে।
১২ ডিসেম্বর দুপুরে ক্যাপ্টেন গুরুং এর নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর একটি দল এবং
বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিক আহমদ, সদ্য প্রয়াত ডাঃ বি এম ফয়েজুর রহমান (এমএলএ), প্রাক্তন
ছাত্রনেতা প্রয়াত আবুল কাসেম সন্দ্বীপের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো
একটি দল যৌথভাবে এসে অগ্রবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়ে হানাদার
বাহিনীর উপর আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১২ ডিসেম্বর বিকেল থেকে
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ দল সকালে শঙ্খনদীর অপর পাড়ে দোহাজারী উপ-শহরে
অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। এসময় পাকবাহিনীও সমানে জবাব
দিতে থাকে। এভাবে বিরামহীন যুদ্ধ চলার পর ১৪ ডিসেম্বর বেলা ২টার দিকে
পাকবাহিনী তাদের সব সরঞ্জাম ফেলে সদলবলে পালিয়ে যায়। তিনদিনের এই সম্মুখ
সমরে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও নিহত হয় হানাদার
বাহিনীর ৯ সদস্য (কারো কারো মতে আরো বেশী)। পাক হানাদার বাহিনী যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে দোহাজারী থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্ত হয়ে যায় দোহাজারীসহ পুরো (কক্সবাজার ছাড়া) দক্ষিণ
চট্টগ্রাম। সাথে সাথে মিছিল সহকারে রাস্তায় নেমে আসে শত শত মুক্তিপাগল
জনতা। বিজয়ের গানে গানে মুখরিত হয়ে উঠে রাজপথ। পৎ পৎ করে উড়তে থাকে
বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা।
১৫ ডিসেম্বর
গাজীপুর মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় গাজীপুর জেলা। এ দিন গাজীপুরের এ জনপদে ঘরে ঘরে ওড়ে বিজয়ের লাল সবুজের পতাকা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ১৫ ডিসেম্বর ভোরে পাকবাহিনী শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর তাদের দোসর রাজাকারা আত্মসমর্পন করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। এ ভাবেই মুক্ত হয় গাজীপুর জেলা।
১৫ ডিসেম্বরের দুদিন পূর্বেও গাজীপুরের দৃশ্যপট ছিল অন্যরকম। নিরিহ বাঙালী হত্যা আর রাজাকারদের লুটপাট তখনও থামেনি। জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর ক্যাম্পতো ছিলোই। রাজাকারদের শকুনের থাবা চলতো দিনে ও রাতে। ১৪ ডিসেম্বও রাতে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারে যে, পাক বাহিনীর একটি কনভয় গাজীপুর চৌরাস্তার অদূরে ছয়দানা মালেকের বাড়ী নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছে । এ সংবাদ পেয়ে তারা তৎকালিন আওয়ামী লীগ নেতা কাজী মোজাম্মেলের নেতৃত্বে ১৪ তারিখ রাতেই সেখানে অবস্থান নেয় এবং এম্বুশ তৈরী করে সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহন করে। ১৫ তারিখ ভোর থেকেই শুরু হয় পাক বাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ । এ যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর তিন জন ভারতীয় সৈনিক নিহত হলেও পাক বাহিনীর অধিকাংশ সেনাদেরকে খতম করে মুক্তিবাহিনী। আটক করে বাকীদের। এভাবেই বিজয় দিবসের এক দিন আগেই মুক্ত হয় গাজীপুর।
রাঙামাটি মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সারা দেশের মতো উত্তাল হয়ে উঠেছিল পার্বত্য জেলা রাঙামাটি।
স্বাধীনতার সুমহান চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে এ জেলার সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে
পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ রেসকোর্স
ময়দানে স্বাধীনতার ডাকে এদেশের সকল মুক্তিকামী জনগনের মত পার্বত্য এলাকার
জনগনও মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সংঘটিত রক্তক্ষয়ী
যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনী মুক্ত হয়
রাঙামটি। এতে করে রাঙামাটিতে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরিসমাপ্তি
ঘটে। ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় রাঙামাটি জেলার বরকলে অবস্থানরত পাক বাহিনীর
সামরিক ঘাঁটির ওপর ২টি যুদ্ধ বিমানযোগে আক্রমন চালায় বাংলাদেশ বিমান
বাহিনী। সেখানে ৭৫০ জন পাক সেনার সুদৃঢ় অবস্থান ছিল। অন্যদিকে,মিত্র ও
মুক্তিবাহিনী যৌথ বাহিনীর জৈলানন্দ সিং এবং সুলতান আহম্মদ কুসুমপুরীর
নেতৃত্বে প্রায় ৫শ’ মুক্তি যোদ্ধা বরকল অভিমূখে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে
বিলাইছড়ির ফারুয়ায় অবস্থানরত ছদ্মবেশী পাঞ্জাবীরাও ‘‘জয়বাংলা’’ শ্লোগান
সহকারে টইলদার গানবোট যোগে বরকলের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে মুক্তিবাহিনীর
মহিউদ্দিন গ্রƒপের উপর শত্র“ বাহিনী আচমকা আক্রমন চালালে সেখানে বেশ কিছু
সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। সে সময় মুক্তি যোদ্ধাদের পাল্টা
আক্রমনে পাঞ্জাবীরা পালিয়ে যায়।
জানা যায়, বরকলের ঘাঁটি দখলে নেয়ার পর মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল সুজন সিং ওভান বরকল পরিদর্শন করেন এবং ১৫ ডিসেম্বর
রাঙামাটি দখলে নেয় মিত্র বাহিনী। ওইদিন রাঙামাটির সর্বস্তারের জনতা মিত্র ও
মুক্তি বাহিনীদের প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানান। এরপর মিত্র বাহিনীর
পূর্বাঞ্চল কমান্ড-এর অধিনায়ক জেনারেল সুজন সিং ওভান ও শেখ ফজলুল হক মনি
ভারতীয় হেলিকপ্টার যোগে রাঙ্গামাটির পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং ময়দানে অবতরণ
করেন। এখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান তৎকালিন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান, আবদুর
রশিদ, মনীষ দেওয়ান (পরবর্তীতে কর্ণেল) এবং মোঃ ফিরোজ আহম্মদসহ হাজারো
ছাত্র-জনতা।
বঙ্গবন্ধু ডাকে ১৯৭১ সালে সারাদেশ ব্যাপী যখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল তখন জুন মাস থেকে ভারতের ত্রিপুরা প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিবাহিনীসহ থেমে থেমে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার নেতৃত্বে দেন রফিকুল ইসলাম। ৪টি প¬াটুন ভাগ হয়ে মুক্তিবাহিনীসহ একে একে পার্বত্য এলাকায় দখল করে নেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পাকবাহিনীরা যুদ্ধে টিকতে না পেরে খাগড়াছড়ি বাজারে লুটপাট করে পালিয়ে যায়। মহালছড়িতে সম্মুখযুদ্ধে নিহত হন ক্যাপ্টেন আবদুল কাদের। ঠিক বিজয় দিবসের আগে খাগড়াছড়ি শত্রু মুক্ত হন।
খাগড়াছড়ি মু্ক্তদিবস
১৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি হানাদার মুক্ত দিবস। এ দিনে মুক্তিবাহিনীরা পাকবাহিনীদের হটিয়ে সকালে খাগড়াছড়ি দখল করে খাগড়াছড়ি মহকুমা শহরে স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। পুরো শহরে বিজয়ের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তখন থেকে জেলাবাসী পালন করে আসছে হানাদার মুক্ত দিবস।বঙ্গবন্ধু ডাকে ১৯৭১ সালে সারাদেশ ব্যাপী যখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল তখন জুন মাস থেকে ভারতের ত্রিপুরা প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিবাহিনীসহ থেমে থেমে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার নেতৃত্বে দেন রফিকুল ইসলাম। ৪টি প¬াটুন ভাগ হয়ে মুক্তিবাহিনীসহ একে একে পার্বত্য এলাকায় দখল করে নেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পাকবাহিনীরা যুদ্ধে টিকতে না পেরে খাগড়াছড়ি বাজারে লুটপাট করে পালিয়ে যায়। মহালছড়িতে সম্মুখযুদ্ধে নিহত হন ক্যাপ্টেন আবদুল কাদের। ঠিক বিজয় দিবসের আগে খাগড়াছড়ি শত্রু মুক্ত হন।
১৭ ডিসেম্বর
যুদ্ধ তখন শেষ। নয় মাসের অসহ্য কষ্ট, দুর্ভোগ, আতঙ্ক সবই শেষ। সারাদেশ তখন বিজয়ের আন্দদে মাতোয়ারা। এরি মধ্যে খন্ড খন্ড যুদ্ধ চলছিল ফরিদপুর, রংপুর ও সিলেটে। শেষ রক্ষা হবে না জেনেও অজ্ঞাত কারণে তখনো কিছু অতি উৎসাহী পাকসেনা পা কামড়ে ধরতে চাইছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। তবে পুর্ভসুরিদের পথ ধরে ঠিক ১ দিন পর ১৭ ডিসেম্বর আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয় তারা। সে কারণে ফরিদপুর, রংপুর ও সিলেটকে মুক্ত ঘোষণা করা হয় একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর।
ফরিদপুর মুক্তদিবস
বিজয়ের একদিন পর ৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর ফরিদপুরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করায় ফরিদপুর মুক্ত হয়েছিল। সারাদেশ যখন স্বাধীনতার বিজয়ে উম্মদনায় মত্ত তখন ফরিদপুর শহরে ডিগ্রিরচরে পাকহানাদার বাহিনী, মিলিশিয়া বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল। ৭১ এর এই দিনে ফরিদপুর মুক্ত হলেও যুদ্ধে শহীদ হন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ এতে আহত হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা।৯ ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাস থেকে পরাস্ত হয়ে ঢাকাকে বাচাতে নিরাপদ সড়ক হিসেবে ফরিদপুরে দিকে যাত্রা করে পাকসেনারা। এমন সংবাদে মুক্তিসেনারা জেলার করিমপুর ব্রিজের কাছে চাঁনপুর নামক স্থানে আগে থেকেই ওত পেতে তাদেরকে হামলা করে। শুরু হয় মুখোমুখী তুমুল যুদ্ধ। এখানে যুদ্ধকালিন কমান্ডার কাজী সালাহউদ্দীন, নওফেল, ওহাবসহ সাত মুক্তিযাদ্ধা শহীদ হয়। বর্তমান পর্যটন সচিব হেমায়েত উদ্দীন তালুকদারসহ আহত হয় আরো ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা। করিমপুর যুদ্ধে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীরা শতাধিক পাকসেনাকে হত্যা করলেও মুক্তিবাহিনীর গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার করনে তারা (মুক্তিযোদ্ধারা) পিছু হটে। এসময় পাক সেনারা করিমপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধর আশ্রয় নেওয়া সকল বাড়ীতে হত্যা, নির্যাতন চলায় এবং গ্রামটি অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়।
এদিকে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যশোর সেনানিবাস ও রাজবাড়ী থেকে পলিয়ে আসা পাকসেনা, মিলিশিয়া বাহিনী, বিহারী ও তাদের দোসররা শহরের ডিগ্রিরচর এলাকার তালুকের চরে জড়ো হতে থাকে। এলাকাটির বিশাল অংশ নিয়ে তারা বাঙ্কার বানিয়ে ক্যাম্প করে। ১১ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর খন্ড খন্ড যুদ্ধ হতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর রাত হতে মোকাররম হোসেন ও নীতিভূষণ সাহার (মুজিব বাহিনী) নেতৃত্বাধীন বাহিনী পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু করে। সকালের দিকে মুক্তিবাহিনীর দলটিকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে পাকসেনারা আক্রমন শুরু করে দেয়। খবর পেয়ে মানিকগঞ্জ জেলা থেকে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী কয়েকটি লঞ্চ যোগে ও ফরিদপুর থেকে মোকাররম হোসেন, মো. আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ ও নীতিভূষণ সাহা এর নেতৃতে কয়েকটি দল একত্রিত হয়ে যুদ্ধকে আরো বেগবান করে তুলে।
দুপক্ষের সম্মুখ যুদ্ধে রাইফেল মেশিনগান, মর্টারসেল মুহুমুহু গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনা একপর্যয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়। সারারাত যুদ্ধ শেষে সকাল ১০ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকসেনারা আত্মসর্মপন করে।
রংপুর মুক্তদিবস
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষনার পর এদেশের মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে পাক্ হানাদার বাহিনী ও তার দোষররা এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ও নিরহ মানুষদের ধরে এনে নিরমম ভাবে গুলি করে হত্যা করে । স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও রংপুরের শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ ও বধ্যভূমি গুলো আজও অযত্নে আর অবহেলায় রয়ে গেছে সকলের দৃষ্টি অগোচরে ।১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ মুক্তিকামী প্রায় ৩০ হাজার মানুষ লাটি - সোটা ও লাঙ্গলের ইস এবং তীর ধনুক সহ দেশিয় অস্ত্র নিয়ে সারা দেশের মধ্য প্রথম রংপুর ক্যান্টনমেনট ঘেরাও করতে গেলে “রক্তের গৌরব” বধ্যভূমিতে পাক্ সেনারা তাদেরকে (৩০ হাজার) গুলি করে হত্যা করে । যা আজও এলাকার মানুষের কাছে এক ভয়াল স্মৃতি ।
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল রংপুর ও পার্বতিপুর থেকে ট্রেনেকরে এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও বাচ্চু খাঁনের নেতৃত্বে পাক্ হানাদার বাহিনী এসে বদরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়–য়া বিল এলাকায় নিরিহ ও মুক্তিকামী প্রায় ১৫থেকে ১৭ শ মানুষকে থরে এনে গুলিকরে, ট্রেনের বয়লারে, আবার অনেককে জবাই করে নির্মমভাবে হত্য করেছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ৪১ বছর পর ও রংপুর জেলার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এখনো অনেকেই ভিক্ষা করে , রিক্রা চালিয়ে, আবার অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন পরপাড়ে ,জীবিত অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যাদের মুক্তিযুদ্ধের সনদ আছে কিন্তু তাদের গেজেট এ নাম নাই । তাদের জীবনে শেষ ইচ্ছা, মুত্যুর আগে গেজেটে নাম অর্ন্তভুক্ত করে রাষ্ট্রিয় মযার্দা চান । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জটে অর্ন্তভূক্ত করবে আসন্ন বিজয়ের মাসে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন জেলার তালিকা বর্হিরভুত সকল মুক্তিযোদ্ধারা।
সিলেট মুক্তদিবস
দেশের ১১ টি সেক্টরের মধ্যে সিলেটে মুক্তিযোদ্ধারা ২টি সেক্টরে যুদ্ধ চালিয়ে যান। সমগ্র বাংলাদেশের ন্যায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সিলেট শহরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলেও ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীরা একত্রীত হতে দেরী হওয়ায় ১৭ই ডিসেম্ভর আনুষ্ঠানিকভাবে তারা অস্ত্রসর্মপন করে।মহান মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ৫নং সেক্টর ও পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল ৪নং সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। সিলেটের এই ৪ ও ৫ নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল প্রতিরোধের মূখে পাকিস্থানী হানাদাররা ২১ নভেম্বর প্রথম সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় পরাজয় বরণ করে। ৪নং সেক্টরের অর্ন্তভুক্ত এলাকা থেকে ১৪ ডিসেম্বর পাক সেনারা পিছু হটে। পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকর্তা সরফরাজ খান ১৬ই ডিসেম্বর পরে তার দলবলকে একত্রিত করতে এক দিন সময় চেয়ে নিয়ে ১৭ই ডিসেম্ভর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ মাঠে আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসর্মপন করে।
১৮ ডিসেম্বর
রাজশাহী মুক্তদিবস
পুর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত প্রায় ৯৫ হাজার পাক সৈনের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক এখন বাঙালীরা। সারাদেশকে বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা দেখে হানাদাররা আত্মসমর্পনের উদ্দেশ্যে ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে রাজশাহী ত্যাগ করতে থাকে। রাজশাহী শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তারা নাটোরের দিকে যেতে থাকে আত্মসমর্পনের জন্য। ১৮ ডিসেম্বর ভোরে পাকবাহিনীর শেষ দরটি ক্যন্টনমেন্ট ছেড়ে চলে যায়। সে দিন কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্টানে রাজশাহী মুক্ত ঘোষনা করা হয়।
নওগাঁ পাকহানাদারমুক্ত দিবস
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নওগাঁ মহকুমা (বর্তমানে জেলা) হানাদারদের
দখলে থাকে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন জানান, ১৬
ডিসেম্বর বিজয়ের খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধা জালাল হোসেন চৌধুরী পাকহানাদার
বাহিনীর দখলে থাকা নওগাঁ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৭ ডিসেম্বর
মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলে নওগাঁ। তারা জগৎসিংহপুর ও খলিশাকুড়ি গ্রামে
অবস্থান নিলে দুই বাহিনীর মধ্যকার দূরত্ব একেবারে কমে আসে। মাঝে শুধু শাখা
যমুনা নদী। এ অবস্থায় জালাল হোসেন চৌধুরী তার দলকে গুলি চালানোর নির্দেশ
দেন। ওইদিন গভীর রাত পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। ১৮ ডিসেম্বর সকালে বগুড়া থেকে
ভারতীয় মেজর চন্দ্রশেখর, পশ্চিম দিনাজপুর বালুরঘাট থেকে নওগাঁয় আসে পিবি
রায়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী। তারা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে নওগাঁয়
প্রবেশ করেন। প্রায় দুই হাজার পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। নওগাঁ জেলা
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার হারুন আল রশিদ জানান, তৎকালীন নওগাঁ মহকুমা
প্রশাসক সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে স্বাগত জানান।
এসডিও অফিস চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
রাজবাড়ী পাকহানাদারমুক্ত দিবস
১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিকেলে বিহারিরা আত্মসমর্পণ করার পর
রাজবাড়ী হানাদারমুক্ত হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আশপাশের প্রায়
সব এলাকা শত্রুমুক্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। রাজবাড়ী থানা, পুলিশ ক্যাম্প ও
ট্রেজারি অফিস লুট করে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করা হলেও শহরের উত্তর দিকে
রেলওয়ে নিউ কলোনি ও লোকোশেড কলোনি শত্রুঘাঁটি দখলে আনতে পারা যাচ্ছিল না।
অবশেষে মাগুরার ক্যাপ্টেন জামান বাহিনী, শ্রীপুরের আকবর বাহিনী, মাচপাড়ার
মতিন বাহিনী, পাংশার মালেক ও কমান্ডার সাচ্চু বাহিনী এবং গোয়ালন্দ মহকুমা
কমান্ডার শহীদুন্নবী আলমের বাহিনী যৌথভাবে শহরের চারদিক থেকে বিহারিদের
কথিত মিনি ক্যান্টনমেন্টে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। ১৪ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার
আক্রমণের ভেতর দিয়ে শহীদ রফিক, শফিক, সাদিক, শুকুর, দিয়ানত, জয়নাল মোল্লা,
আরশেদ আলী, জাহাঙ্গীর এবং আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার জীবনের বিনিময়ে ১৮
ডিসেম্বর বিকেলে শত্রুমুক্ত হয় রাজবাড়ী।
মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) পাকহানাদারমুক্ত দিবস
১৭ ডিসেম্বর শেষ রাতে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডিং অফিসার
লেফটেন্যান্ট আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে চার শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সুন্দরবন
অঞ্চল থেকে মঠবাড়িয়ার কালিরহাট বাজারে অবস্থান নেন। পাশাপাশি ওই রাতেই
মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা ও বামনা উপজেলার শান্তি কমিটির সভাপতি খান সাহেব হাতেম
আলী জমাদ্দারের মধ্যস্থতায় স্বাধীনতাবিরোধীরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে
আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন। ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের স্লোগান
দিতে দিতে বীরদর্পে মঠবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করেন। এভাবেই কোনো রক্তপাত ছাড়াই
১৮ ডিসেম্বর মঠবাড়িয়া মুক্ত হয়।
দিনাজপুর : দিনাজপুরে ১৯৭১ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন জোনাল কাউন্সিলের পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১-এর চেয়ারম্যান এম আবদুর রহিম। এ সময় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্নেল শমসের সিংয়ের নেতৃত্বে এম আবদুর রহিমকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
ক্যাম্প দখল নিয়ে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে হানাদারদের চূড়ানত্ম যুদ্ধ হয় ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিনে। ৩ দিন যুদ্ধের পর ১৯ ডিসেম্বর খুব ভোরে নড়াইল জেলার দিক থেকে ৮ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর, নড়াইল জোনের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা, লে. কর্নেল জোয়ান, কামাল সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে ক্যাপ্টেন ইসমত কাদির গামা ও বাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাররা সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়ার মিনি ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালান। এ যুদ্ধে কামাল সিদ্দিকী আহত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক হামলা ও বীরোচিত সাহসী যুদ্ধে সকাল ১০টার দিকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডারের কাছে ৬৫ পাকসেনা আত্মসর্মপণ করে। এ যুদ্ধে ৬ পাকসেনা নিহত ও আহত হয়। অপরদিকে কয়েক মুক্তিযোদ্ধাও নিহত ও আহত হন। হানাদারমুক্ত হয় কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়াসহ সমগ্র গোপালগঞ্জ অঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিজয় মিছিল বের করেন। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ এ বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে আনন্দ উলস্নাসে মেতে ওঠেন।
দিনাজপুর : দিনাজপুরে ১৯৭১ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন জোনাল কাউন্সিলের পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১-এর চেয়ারম্যান এম আবদুর রহিম। এ সময় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্নেল শমসের সিংয়ের নেতৃত্বে এম আবদুর রহিমকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
১৯ ডিসেম্বর
গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবস
সারাদেশ যখন বিজয়ের আনন্দে উদ্বেল ও আত্মহারা, সে সময়েও গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়ায় পাক হানাদাররা যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। বিজয়ের তিন দিন পর প্রচ- যুদ্ধের পর পাকি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আজ শনিবার গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া শত্রম্ন মুক্ত দিবস। এ দিন মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাকবাহিনীর দখলে থাকা কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনের মিনি ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে।ক্যাম্প দখল নিয়ে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে হানাদারদের চূড়ানত্ম যুদ্ধ হয় ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিনে। ৩ দিন যুদ্ধের পর ১৯ ডিসেম্বর খুব ভোরে নড়াইল জেলার দিক থেকে ৮ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর, নড়াইল জোনের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা, লে. কর্নেল জোয়ান, কামাল সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে ক্যাপ্টেন ইসমত কাদির গামা ও বাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাররা সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়ার মিনি ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালান। এ যুদ্ধে কামাল সিদ্দিকী আহত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক হামলা ও বীরোচিত সাহসী যুদ্ধে সকাল ১০টার দিকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডারের কাছে ৬৫ পাকসেনা আত্মসর্মপণ করে। এ যুদ্ধে ৬ পাকসেনা নিহত ও আহত হয়। অপরদিকে কয়েক মুক্তিযোদ্ধাও নিহত ও আহত হন। হানাদারমুক্ত হয় কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়াসহ সমগ্র গোপালগঞ্জ অঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিজয় মিছিল বের করেন। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ এ বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে আনন্দ উলস্নাসে মেতে ওঠেন।
ভৈরব মুক্তদিবস
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে দখলদার পাকিসত্মানী
সেনাবাহিনী পূর্ব রণাঙ্গনে মার খেয়ে পরাজয়ের গস্নানি নিয়ে পিছু হটে ভৈরব
শহরে এসে জমায়েত হতে থাকে। অগ্রসরমাণ মুক্তি ও মিত্রবাহিনী তখন পাকবাহিনীকে
আত্মসর্পণে বাধ্য করার জন্য ভৈরবকে পাশ কাটিয়ে রাজধানী ঢাকাকে চারপাশ থেকে
ঘিরে ফেলে। তখন মার খাওয়া পাকবাহিনী ও সহযোগী আলবদর- রাজাকার বাহিনীর এক
বিরাট অংশ ভৈরব শহরে আটক থাকাবস্থায় পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয়
সেক্টর কমান্ডার জেনারেল একে নিয়াজী তার ৯৫ হাজার নিয়মিত এবং সহযোগী
বাহিনীসহ ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। এর ৩ দিন পর ১৯
ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী মেজর জেনারেল দেবু ভট্টাচার্য এবং মেজর মেহ্তার
নেতৃত্বে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী ভৈরব শহরে প্রবেশ করে পাকসেনা সদস্যদের
নিরস্ত্র করে। পাকবাহিনীর পক্ষে অস্ত্র সমর্পণ এবং সেনা ও সহযোগী সদস্যদের
তালিকা প্রদান করেন ব্রিগেডিয়ার সাদ-উল্লাহ।
0 comments:
Post a Comment