Tuesday, April 12, 2011

রাংকুট বিহার, কক্সবাজার

0 comments
ছায়া সুনিবিড় সবুজ অরণ্যে ঘেরা পাহাড়। নিচে বিশালাকৃতির শতবর্ষী বটবৃক্ষের পা-ঘেঁষে থরে থরে সাজানো সিঁড়িগুলো উঠে গেছে পাহাড়চূড়ায়। ওপরে উঠেই দেখা যায়, ছোট-বড় পাশাপাশি চারটি বৌদ্ধমূর্তি। যার একটি হচ্ছে মহাকারণিক গৌতম বুদ্ধের (বুড়া গোঁয়াই) মূর্তি। কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের রাংকুট (রামকোট) বনাশ্রম বৌদ্ধবিহারে গেলে দেখা যাবে এ দৃশ্য। এখানে বেড়াতে আসা দর্শকেরা নিজের অজান্তেই যেন চলে যান সুদূর অতীতের বৌদ্ধ সভ্যতার দিনগুলোতে। পূরাকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের পুণ্যভূমি রামুতে আরও প্রায় ৩০টি বৌদ্ধবিহার থাকলেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে রাংকুটের গুরুত্ব এ কারণেই বেশি।


জানা গেছে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে ভারতবর্ষের সম্রাট অশোক এ মন্দির নির্মাণ করেন। এ প্রসঙ্গে ধন্যবতী রাজবংশ বইতে উল্লেখ আছে, গৌতম বুদ্ধ ধন্যবতীর রাজা চাঁদসুরিয়ার সময়ে সেবক আনন্দকে নিয়ে আরাকানের রাজধানী ধন্যবতী আসেন। সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গৌতম বুদ্ধ আনন্দকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘হে আনন্দ, ভবিষ্যতে পশ্চিম সমুদ্রের পূর্বপাশে পাহাড়ের ওপর আমার বক্ষাস্থি স্থাপিত হবে। তখন এর নাম হবে রাংউ।’
‘রাং’ অর্থ বক্ষ, আর ‘উ’ অর্থ অস্থি অর্থাৎ ‘রাংউ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বক্ষাস্থি’। ধারণা করা হচ্ছে ভাষার বিবর্তন হয়ে রাংউ থেকে রামু শব্দটি এসেছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোকজনের বিশ্বাস বর্তমানে রামুর রামকোট বৌদ্ধবিহারেই মহাকারণিক গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থি স্থাপিত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেশকিছু পুরোনো স্মৃতিচিহ্ন মূর্তির ধ্বংসাবশেষ, সেকালের ইটের টুকরা করে কাচের বক্সে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিহারের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাবংশ মহাথের জানান, ব্যাপকভাবে খননকাজ চালালে এখান থেকে আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করা যাবে।
‘রামকোটের ইতিহাস’ শিরোনামের একটি বাঁধাই করা প্রচারপত্র থেকে জানা গেছে, খ্রিষ্টপূর্ব ২৬১ অব্দে সংঘটিত ইতিহাসের বিভীষিকাময় কলিঙ্গ যুদ্ধের সময় মানবতার ধ্বংস এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্রাট অশোকের মনে দারুণ রেখাপাত করে। মানবসেবায় আত্মনিয়োগের জন্য এ সময় তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের প্রচার এবং শ্রীবৃদ্ধিকল্পে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে ৮৪ হাজার ধর্ম স্কন্ধ (মন্দির) নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, রামুর রামকোট বনাশ্রম বৌদ্ধবিহার তার মধ্যে একটি। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৮ সালে এ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরের প্রধান ফটকের উপরেও এমন সময়ের কথা উল্লেখ আছে।
এ প্রচারপত্রে আরও উল্লেখ আছে, ‘বিহারটি নির্মাণের পরবর্তী সময়ে এখানে ৭০০ বৌদ্ধ ভিক্ষু বসবাস করতেন। প্রাচীন চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণ কাহিনিতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৬৬৬ সালে মোগলদের আক্রমণে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায় ঐতিহাসিক রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধবিহার। ওই সময় বিহারটি ধ্বংসস্তূপ ও বন জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। মোগল আক্রমণের প্রায় ২৬৩ বছর পর ১৯২৯ সালে আবার নতুন করে বিহারটি আবিষ্কৃত হয়।’
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু, রামু মেরংলোয়া সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের জানান, ‘১৯২৯ সালের দিকে বিহারের ধ্বংসাবশেষ দেখে তৎকালীন জগৎচন্দ্র মহাস্থবির নামের এক বৌদ্ধধর্ম সংস্কারক এটি পুনর্প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। ওই সময় রাংকুটের পাহাড়ের পাদদেশে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এবং প্রাচীন বুদ্ধমূর্তির অসংখ্য টুকরা পাওয়া যায়। স্থানীয় জমিদার মতিসিং মহাজনের আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে জগৎচন্দ্র মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। সেই থেকে আবার রাংকুট বৌদ্ধবিহারে ব্যূহচক্র মেলা (পেঁচঘর), ৮৪ হাজার ধর্ম স্কন্ধ পূজাসহ নানা উৎসব উদ্যাপন করা হচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, জগৎচন্দ্র মহাস্থবিরের অনুপ্রেরণায় বাংলা নববর্ষের বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে সাত দিনের ব্যূহচক্র মেলার (পেঁচঘর) আয়োজন করা হতো। যা পরবর্তীকালে রামকোটের মেলা নামে পরিচিতি লাভ করে।
রাংকুট (রামকোট) বনাশ্রম বৌদ্ধবিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুরেশ বড়ুয়া জানান, ‘১৯৬৬ সালে প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথের নামের এক ধর্মসংস্কারক এ মন্দিরের সংস্কারকাজ করেন। সুদীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় তিনি এখানে অবস্থান করেন। ১৯৮৮ সালে মন্দিরে অবস্থান কালে গভীর রাতে তিনি ডাকাতদলের আক্রমণের শিকার হন। এ সময় ডাকাতেরা মন্দিরের বহু প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর করে।’ দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সুস্থ হলে প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথের রামকোট থেকে চলে যান। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিবছর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত ‘৮৪ হাজার ধর্ম স্কন্ধ পূজা’ প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথের প্রবর্তন করেন।
স্থানীয় সঞ্জয় বড়ুয়া জানান, গৌতমবুদ্ধের মূর্তির সামনে ৮৪ হাজার ধর্ম স্কন্ধ পূজাকে ঘিরে প্রতিবছর বৈশাখী পূর্ণিমার আগের রাত থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৌদ্ধ নর-নারীরা এ বিহারে ছুটে আসেন। রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাবংশ মহাথের বলেন, ‘ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ মন্দিরের গুরুত্ব খুব বেশি। আর এখানে সংরক্ষিত বুড়ো গোঁয়াই মূর্তি বৌদ্ধদের কাছে অতি পূজনীয়।’ তিনি জানান, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিহারটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। বিহারটিকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হলে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পুরাকীর্তি হিসেবে পরিচিতি পাবে।

-Source: Daily Prothom Alo

0 comments:

Post a Comment