Sunday, April 3, 2011

ম্রো আদিবাসীদের গো-হত্যা উৎসব

0 comments
বান্দরবানের টংগাবতী ইউনিয়নের ম্রো পাড়ায় গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়েছে ম্রো আদিবাসীর গো-হত্যা উৎসব। অতি প্রাচীনকালের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আয়োজিত এ উৎসবে কোনো আদিখ্যেতা না দেখা গেলেও আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। এবারের উৎববে তাদের উচ্ছ্বাসকে একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন ও পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান বীর বাহাদুর ঊশৈ সিং যোগ দিয়ে। উৎসবে ম্রো উপজাতি ছাড়াও আশপাশের অন্য উপজাতি ও বাঙালিরাও যোগ দিয়েছেন উৎসাহের সঙ্গেই।

গো-হত্যার প্রচলিত বিশ্বাস ও ম্রো উপজাতির আদি উপাখ্যান থেকে জানা যায়, সৃষ্টিকর্তা যখন প্রত্যেক জাতির উন্নয়নের জন্য নিজস্ব অক্ষর বা বর্ণমালা প্রদান করতে ধরণীতে নেমে আসেন, তখন সব জাতি উপস্থিত থাকলেও ম্রো জাতি ছিল না। তারা সেদিন আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত থেকে নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করেই দিন কাটায়। সৃষ্টিকর্তা গরুকে দূত হিসেবে ডুমুরপাতায় লেখা ম্রো ভাষার বর্ণমালা পাঠান। পথিমধ্যে ভীষণ ক্ষুধা পেলে গরুটি ডুমুর গাছের পাতাসহ ম্রোদের অক্ষরগুলো খেয়ে ফেলে। পরে বিধাতার কাছে ম্রোরা জানতে চাইলে তাদের বলেন, 'তোমরা নাচ, গান, আনন্দ-উল্লাসের মধ্যদিয়ে গরু হত্যা কর, যাতে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করা যায়।'

উৎসবের মূল আয়োজক ও গো-হত্যাকারী এলাকার হেডম্যান পূর্ণচন্দ্র ম্রো চেয়ারম্যান উৎসব সম্পর্কে বলেন, আমাদের ধর্মে অন্যায়ভাবে বা ইচ্ছাকৃতভাবে গরুকে হত্যা করা যায় না। বৈদ্য গণনা অনুসারে অথবা জুমের বিভিন্ন পূজার মধ্যে গো-হত্যা করা হয়। এবারও তাই যথারীতি নিয়ম মেনে গো-হত্যা করা হয়েছে। গতবছর দুটি গরু হত্যা করা হয়েছে, এবার একটি।

সরেজমিন দেখা গেছে, একটি গরুকে হেডম্যানের উঠানে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা একটি ছোট্ট ঘেরার মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। তার উপরে বাঁশের আঁশ তুলে তৈরি করা একটি বিশাল রঙিন চাটাই দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় চাটাইয়ের নিচে গরুকে ঘিরে ম্রোদের নিজস্ব ধারায় তৈরি বাঁশের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য। এভাবে একেকটি দল রাতব্যাপী পালা করে নাচতে থাকে। পাশাপাশি আগত অতিথিদের জন্য গরুর মাংস, মুরগি, শূকর, মাছ ও বিভিন্ন ভর্তা দিয়ে আপ্যায়ন এবং চোলাইমদ পানের ব্যবস্থা করা হয়। রবিবার সূর্যাস্তের পর শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। হেডম্যান ভোর ৭টার দিকে একটি বিষ মাখানো সেল দিয়ে পরপর তিনবার আঘাত করে গরুটিকে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় ভাগ-বাটোয়ারা ও রান্না-বান্নার আয়োজন এবং নাচ-গান। এভাবেই সারাদিন চলতে থাকে উৎসব।

তবে আশির দশকে ম্রো উপজাতির এক সাধারণ সন্তান হঠাৎ চারদিকে হৈচৈ ফেলে দেন। তার নাম মেনলে ম্রো। তিনি এক ধ্যানী কিশোর ছিলেন। একদিন হঠাৎ তিনি ম্রোদের জন্য একটি ভিন্ন বর্ণমালা আবিষ্কার করেন এবং একটি নতুন ধর্মীয় রীতি চালু করেন, যার নাম ক্রামা ধর্ম। বর্ণমালা আবিষ্কারের তিন-চার বছরের মধ্যে তিনি হঠাৎ উধাও হয়ে যান। তার প্রবর্তিত ক্রামা ধর্ম ও বর্ণমালা খুমি ও ম্রো উপজাতির অনেকেই অনুসরণ করেন। তাদের ধারণা, মেনলে ম্রো একদিন দেবতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন। ফলে এই অংশটি এখন আর গো-হত্যা করেন না।

-ফারুক তাহের ও নাজিম উদ্দিন

0 comments:

Post a Comment