Sunday, April 3, 2011

টাঙ্গাইলের কাঁসা শিল্প

0 comments
বাঙালির গৃহস্থালি ও সংস্কৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তামা, কাঁসা ও পিতলশিল্প। বিয়ে, খাৎনা, অন্নপ্রাসন, জন্মদিন, আকিকা প্রভৃতি অনুষ্ঠানাদিতে প্রধান উপহারসামগ্রী ছিল কাঁসার গ্লাস, বাটি, ফুলদানি, চামচ, রেকাব শানকে, গামলা, বেলিবগি, পানদানি, থালা, পিতলের টব, কলসি, বালতি, কড়াই, পানের থালা, ধূপদানি, তামার কলস, হাঁড়িপাতিল, পুষ্পপাত্র ইত্যাদি। সেসব উপহারসামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে আধুনিক ডিজাইনের মেলামাইন, প্লাস্টিক, কাঁচ ও স্টিলসামগ্রী। কাঁচামালের অভাবে তামা, কাঁসা, পিতলশিল্প এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

একসময় টাঙ্গাইলের কাঁসা, তামা ও পিতলশিল্প বিশ্ববিখ্যাত ছিল। টাঙ্গাইলের কাগমারিতে তৈরি 'কাগমারি কলস' নামে বিখ্যাত একটি পণ্যের চাহিদা ছিল দেশজুড়ে। এসব শিল্পের অন্যান্য পণ্যের মধ্যে ছিল পূজার ঘট, ঘণ্টা, তাম্রকুণ্ড, জাহাজের ঘণ্টা, গামলা, প্রদীপ গাছা, পিতলের মূর্তি, সংগীতের যন্ত্রপাতি, সন্দেশ পেয়ালা, বেলিবগি, টেডিগ্লাস, রাজভোগ, রাধাকান্তী, হাতঘণ্টা, স্কুলের ঘণ্টা, চাদরে ঘটি, গিনি গ্লাস, বেলেশ্বরী ইত্যাদি। বর্তমানে ঢাকা জেলার ধামরাই, জামালপুর, ইসলামপুর, নবাবগঞ্জ ও বিক্রমপুরের ঘোড়দৌড় বাজার, টাঙ্গাইল জেলার কাগমারি, বাঘিল, মগড়া ও বল্লায় বেশকিছু ক্ষুদ্র ও বড় কারখানা রয়েছে।

১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘল শাসনামলে এদেশে তামা, কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। এসব ধাতু দিয়ে তারা ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক ও কামান তৈরি করত। ব্রিটিশ শাসনামলে এই শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার শুরু হয় এবং খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই শিল্পের ছোট-বড় বহু কারখানা গড়ে উঠে।


টাঙ্গাইল জেলার কাগমারির মহাদেব কর্মকার ও দুর্গাচরণ কর্মকার জানান, অনুন্নত কাঁচামাল ও এর উচ্চমূল্যের ফলে ধাতব পণ্য তৈরি দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কাঁসা, পিতল ও তামার তৈরি বাসন-কোসনের ব্যবহার ও চাহিদা কমে যাওয়ায় এই শিল্প এখন হুমকির মুখে। অভিমান করে দুলাল চন্দ্র কর্মকার বলেন, 'এসব লেইখা কি করবেন? ভাঙা মাল সব ভারতে চইলা যাইতাছে। তাই তো কাঁসা পেতল দুর্লভ অইয়া গ্যাছে।' সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, কাগমারীতে এখন মাত্র দু'টি, বাঘিলে দু'টি, মগড়াতে ৬টি ও বল্লাতে ১২টি ক্ষুদ্র পিতল শিল্পের কারখানা রয়েছে। বর্তমানে টাঙ্গাইলের কোথাও কাঁসা শিল্প নেই। এটি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জাপান ও ইতালিসহ অন্যান্য দেশ থেকে আগে এসব আমদানি করা হতো। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, শিল্পীদের পেশা বদল ও ধাতব পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ শিল্প বিলুপ্তির পথে। এছাড়া একবস্তা কয়লা যেখানে ১০০ টাকা ছিল, এখন তা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ১ কেজি ভাঙা কাঁসার দাম ছিল ১৬০ টাকা, এখন তা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসায় দারুণ প্রভাব ফেলছে। ফলে কারিগররা পেশা বদল করে অন্য পেশায় ঝুঁকছে। দুলাল চন্দ্র কর্মকার জানান, টাঙ্গাইলে আর মাত্র একযুগ এই শিল্প টিকে থাকতে পারে। কেননা, আমরা এ পেশায় জড়িত থাকলেও অলাভজনক হওয়ায় আমাদের সন্তানরা এ কাজে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অপরদিকে অত্যাধুনিক ও বৈচিত্র্যময় প্লাস্টিক ও মেলামাইন পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগুতে পারছে না তামা, কাঁসা ও পিতলশিল্প। ফলে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে।

-সৈয়দ সরোয়ার সাদী, ভূয়াপুর

0 comments:

Post a Comment