Thursday, March 14, 2013

হেপাটাইটিস 'ই' : সাধারণ জন্ডিস

1 comments
লিভার বা যকৃতের প্রদাহের লক্ষণ হিসেবে জন্ডিস হয়। বহু কারণে এ অবস্থা হতে পারে। এর মধ্যে হেপাটাইটিস 'ই' ভাইরাস অন্যতম। এতে আক্রান্ত হলে রোগী ওষুধ ছাড়াই ভালো হতে পারে। কিন্তু এটি যকৃতকে অকার্যকরও করতে পারে। লিখেছেন সাহাব উদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ, গুলশান, ঢাকার মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ডা. মো. জুলহাস উদ্দিন

লিভারের বা যকৃতের নানা ধরনের রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে রোগটি হয়, তা জন্ডিস নামে পরিচিত। জন্ডিস আসলে কোনো রোগ নয়। এটা বিভিন্ন কারণে লিভারের প্রদাহের লক্ষণ মাত্র। বিভিন্ন কারণে লিভারের প্রদাহ হতে পারে। কিছু ভাইরাস আছে যেগুলো মানবদেহে ঢুকেই লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এগুলো হলো হেপাটাইটিস 'এ', হেপাটাইটিস 'বি', হেপাটাইটিস 'সি', হেপাটাইটিস 'ডি' ও হেপাটাইটিস 'ই' ভাইরাস। লিভার ক্যান্সার আর লিভার সিরোসিসের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস 'বি', হেপাটাইটিস 'সি' ভাইরাস। কিন্তু হেপাটাইটিস 'ই' যে অনেক ক্ষতি করতে পারে, তা কেন যেন ভুলে যাই। বাংলাদেশে হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ Hepatitis E ভাইরাস। তবে এই ভাইরাসে স্বল্পমেয়াদি প্রদাহ হয়।

হেপাটাইটিস 'বি' হেপাটাইটিস 'সি' ভাইরাসের মতো হেপাটাইটিস 'ই' লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সার সৃষ্টি করে না। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি যথাযথ বিশ্রাম নিলে আপনাআপনি সেরে যায়। তাই বলে এ ভাইরাসকে অবহেলা করার কোনো উপায় নেই। কারণ লিভার ফেইলিওরের অন্যতম কারণ হেপাটাইটিস 'ই' ভাইরাস। বিশেষ করে গর্ভবতী মা এবং আগে থেকে লিভার রোগে আক্রান্ত কারো যদি হেপাটাইটিস 'ই' হয় তাদের ক্ষেত্রে লিভার ফেইলিওরের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এমনকি আগে থেকে লিভার রোগ নেই এমন ব্যক্তির বেলায়ও লিভার ফেইলিওরের অন্যতম কারণ হেপাটাইটিস 'ই' ভাইরাস।

যেভাবে ছড়ায়
হেপাটাইটিস 'ই' পানিবাহিত একটি ভাইরাস। রোগটি মূলত পায়খানার মাধ্যমে ছড়ায়। দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়লে মহামারি আকার ধারণ করে। ফুটপাতের জুস, শরবত বা ফলের রস বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর ও ভাইরাসযুক্ত হয় বলে এগুলো পান করলে রোগটি সংক্রমিত হতে পারে। এ ছাড়া দূষিত খাবার পানি, আধা সিদ্ধ শাকসবজি ইত্যাদির মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে।

যারা বেশি আক্রান্ত হয়
হেপাটাইটিস 'ই' যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। তবে ১৫-৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াও এ রোগ দেখা দিতে পারে।

লক্ষণ
সাধারণত 'ই' ভাইরাস শরীরে ঢোকার মোটামুটি এক মাস পর রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। রোগটি বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জন্ডিস, খাবারে অরুচি, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব কিংবা বমিসহ অল্প জ্বর প্রভৃতি উপসর্গ থাকতে পারে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথম দিকে অল্প অল্প জ্বর, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব হওয়া, চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, জিহ্বার নিচের দিকে হলুদ হয়ে যাওয়া, মাটির রঙের মতো পায়খানা, গাঢ় প্রস্রাব ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।

রোগ নির্ণয়
হেপাটাইটিস 'ই' নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য রোগীর রক্তের সিরামে এ ভাইরাসের নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নিশ্চিত হতে হয়। এ ছাড়া সিরাম বিলিরুবিন ও লিভার ফাংশন টেস্ট করা হয় লিভারের অবস্থা দেখার জন্য।

চিকিৎসা
হেপাটাইটিস 'ই'-এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ এখনো বাজারে নেই। কোনো কার্যকর ভ্যাকসিনও আবিষ্কৃত হয়নি। সম্প্রতি নেপালে হেপাটাইটিস 'ই' ভ্যাকসিনের একটি ট্রায়াল হয়েছে তাতে এ ভ্যাকসিন দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরক্ষা দেয় না বলেই প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে। এ রোগ হলে রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। স্বাভাবিক খাবার খেতে হবে। আর লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হয়, যেমন রোগীর বমি বা বমি ভাব হলে অ্যান্টি-ইমেটিক্স দেওয়া হয় এবং ক্ষুধামন্দার কারণে ভিটামিন আর পায়খানার সমস্যা হলে পায়খানা পরিষ্কারের জন্য ল্যাক্সেটিভজাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস রোগীর ক্ষেত্রে পায়খানা পরিষ্কার হলে রোগী ভালো থাকে। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীকে প্যারাসিটামলজাতীয় এবং কবিরাজি ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এগুলো লিভারের ক্ষতি করে।

জটিলতা
গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস 'ই' ভালো না হলে জীবন বিপন্ন হতে পারে। লিভারের কর্মক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে বাঁচানো খুবই কষ্টকর। তাই রোগীকে রোগের শুরু থেকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে এবং কোনো জটিলতা দেখা দিলে শুরুতেই তার চিকিৎসা করতে হবে।

প্রতিরোধ
হেপাটাইটিস 'ই' থেকে বাঁচতে হলে এ রোগ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। যেহেতু এটি একটি পানিবাহিত রোগ, তাই এ রোগ প্রতিরোধের জন্য সব সময় পানি ফুটিয়ে (বিশুদ্ধ পানি) পান ও ব্যবহার করতে হবে। এতে শুধু হেপাটাইটিস 'ই' নয়, বরং টাইফয়েড আর ডায়রিয়ার মতো আরো অনেক পানিবাহিত রোগ থেকেও বাঁচা যাবে। খাওয়ার পানি ৩০-৪০ মিনিট ফোটালে হেপাটাইটিস 'ই'-এর জীবাণু মারা যায়। খাবার আগে ও পায়খানা থেকে ফেরার পর হাত-মুখ সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। ব্যক্তিজীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করা, ফুটপাতের খাবার না খাওয়া প্রভৃতি মেনে চলা দরকার।

1 comments:

Post a Comment