Thursday, November 4, 2010

কপিলমুনি, পাইকগাছা, খুলনা

0 comments
প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যের ধারক-বাহক কপোতাক্ষ তীরের কপিলমুনির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। শাহ সুফি হযরত জাফর আউলিয়া (রহ.), মুনি কপিলেশ্বর এবং রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর স্মৃতিবিজড়িত কপিলমুনির অনেক ইতিহাস এখন কিংবদন্তি। অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে গেছে অনেক ঐতিহাসিক স্থানের চিহ্ন। অবৈধ দখলের কারণে আধুনিক কপিলমুনির রূপকার রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বিনোদ ভবন ও বৈঠকখানা এখন জরাজীর্ণ। জীর্ণ ভবনে চলছে ১০ শয্যার ভরতচন্দ্র হাসপাতাল ও সিদ্ধেশ্বরী ব্যাংকটি (বর্তমানে বণিক সমিতির অফিস) নিশ্চিহ্ন হয়েছে সরোবর ও পাবলিক স্টেডিয়ামটি। আজও নির্মিত হয়নি বিনোদ বাবুর জীবদ্দশার স্বপ্ন কানাইদিয়া কপিলমুনি যোগাযোগের মাধ্যম ব্রিজটি। কপিলমুনিকে-কপোতাক্ষ সভ্যতার প্রচীনতম নিদর্শন বলে দাবি করেন অনেক ঐতিহাসিক। তাদের মতে বৃহত্তর খুলনার মধ্যে কপিলমুনিতে প্রথম হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়।

পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে রয়েছে হজরত খাজা খানজাহান আলী (রহ.) এর শিষ্য হজরত জাফর আউলিয়ার মাজার। খানজাহানের সঙ্গে এদেশে যে ৩১৬ জন দরবেশ ও আউলিয়ার আগমন ঘটে এরমধ্যে পীর জাফর আউলিয়া একজন। কপোতাক্ষ নদের তীর ধরে সুন্দরবন অঞ্চলে এসে ইসলাম প্রচারে ও সমাজসেবায় নিয়োজিত ছিলেন পীর জাফর আউলিয়া। তার মাজার রয়েছে কপিলমুনিতে। এ মাজার ঘিরে তার নামেই গড়ে ওঠেছে জাফর আউলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসা ও মসজিদ। মাজারসংলগ্ন একটি ছোট পুকুর আছে। অনেকেই রোগব্যাধি সারতে এ পুকুর থেকে পানি নিয়ে খেতেন। বর্তমানে সেখানে নোংরা পানি ফেলা হচ্ছে।

কপিলেশ্বর থেকে কপিলমুনি। এক হিন্দু মুনি কপিলের নামানুসারে এ এলাকার নামকরণ হয় কপিলমুনি এমন মত প্রচলিত আছে। ৬০ হাজার সাগর সন্তানকে শাপবদ্ধ করে চাড়ালে রূপান্তর করেন কপিলদেব। ঐতিহাসিকদের মতে, গৌড় দেশের পরাক্রমশালী রাজা বসুদেব পুত্র পার্থিব সম্পদের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে কপিলদেব সুন্দরবনাঞ্চলীয় কপোতাক্ষ তীরে এসে একটি বটতলায় আশ্রম তৈরি করে তপস্যা শুরু করেন। চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে তিনি এখানে তৈরি করেন একটি কালীমন্দির। তিনি তপস্যার জন্য যে স্থানে আশ্রম তৈরি করেন সে স্থান তারই নামানুসারে হয়েছে কপিলমুনি। এমন মত প্রচলিত রয়েছে। কালের গর্ভে কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে আশ্রম প্রাচীনতম স্মৃতিচিহ্ন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে ওই স্থানে বটবৃক্ষের চারা রোপণ করে স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার চেষ্টা চলছে।এ অঞ্চলটি একসময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত ছিল। ১৮৯৬ সালে রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ির কাছে একটি পুকুর খননকালে এখানে পাওয়া যায় বৌদ্ধ যুগের তিনটি পাথরের মূর্তি। মূতির সঙ্গে ছিল মোমের স্তূপ। ধারণা করা হয়, বৌদ্ধ বিহারে মোম জ্বালিয়ে এখানে উপাসনা করা হতো। কপিলমুনির কাশিমনগর (দম দম) গ্রামে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসবাসের স্মৃতিচিহ্ন আজও চোখে পড়ে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চাঁদ সওদাগরের মতো একাধিক সওদাগর গয়না নৌকা করে এ অঞ্চলে বাণিজ্য করতে আসতেন এবং কালক্রমে এখানে বসতি স্থাপন করেন। এ অঞ্চলে মাটি খুঁড়লে আজও পুরাকীর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। পুরাকীর্তি নিদর্শনসমৃদ্ধ এ অঞ্চলকে আজও সরকারিভাবে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মূল্যবান সম্পদ ও ঐতিহাসিক স্থানের স্মৃতিচিহ্ন। কপিলমুনির আরেক বিদগ্ধের নাম রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু। এলাকাবাসী তাকে আধুনিক কপিলমুনির রূপকার ও স্থপতি হিসেবে জানেন। কপিলমুনিজুড়েই তার স্মৃতি বিদ্যমান। ক্ষণজন্মা বিনোদ বিহারী সাধু ছিলেন একজন তেল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক জীবনের উত্থান-পতনের সময় তার উপদেষ্টা হিসেবে সাহায্য করেন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তার সমাজসেবামূলক কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে রায়সাহেব উপাধিতে ভূষিত করেন। এশিয়া মহাদেশে হিন্দু ধর্মের মূল চারটি ধর্মগ্রন্থের একটি বেদ এ মন্দিরে রক্ষিত আছে। অধিকাংশ শ্বেত পাথরে আবৃত এ মন্দিরটি। এ মন্দিরে আরও আছে শ্বেত পাথরের তৈরি রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর প্রতিকৃতি। বর্তমানে আধুনিক কপিলমুনির রূপকার বিনোদ বিহারী সাধু তৈরি করেন বিনোদগঞ্জ বাজার। তার নামানুসারে বাংলা ১৩৩৯ সনে এ বাজারের নামকরণ হয় বিনোদগঞ্জ। কালক্রমে এটি এখন কপিলমুনি হিসেবে পরিচিত। এটি জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম উপশহর।



-মহানন্দ অধিকারী মিন্টু, পাইকগাছা, খুলনা

0 comments:

Post a Comment