Monday, November 22, 2010

পুরাণ গল্পে মানুষ

0 comments
মিথ মিথলজি বা মিথিক্যাল বিদেশি শব্দগুলো নিশ্চয়ই বেশ পরিচিত। বাংলায় এতদিন লেখা হচ্ছিল পুরাণ। পুরাণ শব্দটির গায়ে নিশ্চয়ই প্রাচীনতার ভরপুর গন্ধ আছে। হাতের কাছে হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের সেই দুর্দান্ত অভিধান বঙ্গীয় শব্দকোষ আছে? সেই বিরাট আকার গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড খুলে দেখি, পুরাণ শব্দের তিনটি অর্থ রয়েছে পুরাভব, পুরাতন ও চিরন্তন।

কিন্তু ইংরেজি অর্থের ক্ষেত্রে বিশেষণ হিসেবে মিথিক্যাল শব্দটার অর্থ হলো ইনক্রেডিবল অর্থাৎ অসম্ভব। আশ্চার্য। অসম্ভব কথাটা এখানে এলো কেন? আসলে মিথলজি হলো দর্শন ধর্মবীরত্বের সেই সব কথা, যা আমাদের অভিজ্ঞতার আওতা থেকে অনেক দূরে। যেসব কথা সত্য বলে, বাস্তব বলে আমরা বিশ্বাসই করতে পারি না, আমাদের কাছে খুব অবাক করা ঠেকে, অসম্ভব বলে মনে হয়। সুতরাং মিথিক্যাল শব্দটার মূল অর্থ যে অসম্ভব তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা অবশ্য মূলত পুরাণ শব্দটাই ব্যবহার করব।

পুরাণ-বিশেষজ্ঞরা বলেন, মিথ বা পুরাণের গল্পের মূলত দুটো কাজ। এক. শিশুরা যেমন উদ্ভট, মজার মজার প্রশ্ন করে, যেমন_ কে এই দুনিয়াটাকে তৈরি করল? পৃথিবী কি শেষ হবে? যদি হয়, কিভাবে হবে? প্রথম মানুষ কে ছিল?-এসব প্রশ্নের সোজা-সাপটা উত্তর দেওয়াই পুরাণের গল্পের প্রথম কাজ। তবে হ্যাঁ, উত্তরগুলো নেহাত মন ভোলানোই। এর সঙ্গে বিজ্ঞানের বা বাস্তবতার খুব বেশি যোগাযোগ নেই। অবশ্য বাস্তবতার খানিকটা আভাস থাকতে পারে। যেমন_ পৃথিবী ও মানুষের উদ্ভব-সংক্রান্ত একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পুরাণগুলোতে সেই সেই অঞ্চলের জলবায়ুর একটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। হিমশীতল উত্তরাঞ্চলে মানুষের উদ্ভব-সংক্রান্ত যে গল্পগুলো আছে, সেখানে দেখা যায় মানুষের উদ্ভব ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া একটি পাথর থেকে। আবার গ্রিস দেশের জলবায়ু যেখানে সুন্দর, মনোরম এবং অনুকূল সেখানে মানুষের উদ্ভব বিষয়ে যে গল্প প্রচলিত তার মধ্যে রুক্ষ প্রতিকূল প্রকৃতির কোনো ছোঁয়াই নেই।

পুরাণ গল্পের দ্বিতীয় কাজ হলো কোনো একটি দেশের, অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থা, প্রচলিত রীতিনীতি, সমাজ বিবর্তন বিষয়ে সন্ধান দেওয়া। সুতরাং একটি দেশের ওপর বৈদেশিক আক্রমণ, দেশ ছেড়ে মানুষজনের অন্যত্র চলে যাওয়া, বিভিন্ন রাজতন্ত্রের পরিবর্তন, বৈদেশিক রীতি-নীতির অনুপ্রবেশ_ এসব কিছুর ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যাবে একটি পুরাণ গল্পকে যদি গভীরভাবে পাঠ করি। সমাজ ব্যবস্থার কথাই যদি ওঠে এবং আমরা যদি নির্দিষ্ট করে গ্রিক পুরাণের এলাকাতেই তাকাই তাহলে শুরুতেই যে জিনিসটা চোখে পড়বে তা হলো_ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আদল। মনে রাখব, প্রাচীন ইউরোপে ঈশ্বর ছিল না। ছিল শুধু ঈশ্বরীরা। তারাই দোর্দণ্ড প্রতাপময়ী, সর্বত্র বিরাজমান এবং অক্ষয় শক্তির অধিকারিণী। এটাই হলো মাতৃতান্ত্রিক সমাজরীতির প্রধান লক্ষণ। মানুষ এই দেবীদের ভয় পেত, পূজা করত এবং মানত। আবার এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজরীতির কারণেই গ্রিক পুরাণে দেখা যায় সূর্য নয়, চাঁদেরই দাপট। চাঁদের সঙ্গে নারীর অনেক বিষয়ে গূঢ় মিল আছে। সময়কেও মাপা হতো সূর্য নয়, চাঁদের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী। কিন্তু সমাজরীতি তো আস্তে আস্তে বদলাচ্ছিল। মাতৃতন্ত্র থেকে পুরুষতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছিল সমাজ এবং মজার কথা হলো_ এই যে বদলের পথরেখা গল্পের আদলে গ্রিক পুরাণ ধরে রেখেছে তার শরীরে। বলি দু-একটা গল্প। না থাক গল্প এখনই সব বলে ফেলা ঠিক হবে না। যখন গল্পগুলো একে একে বলব, তখন না হয় খুঁজে নেওয়া যাবে ওই বদলের ইঙ্গিত। শুধু গ্রিকপুরাণ নয়, সব দেশের পুরাণই সেই দেশের পুরাকালের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাস।

মনস্তত্ত্ববিদরা বলছেন, গ্রিক পুরাণের গল্পগুলোতে মানুষের মনের যে বিজ্ঞান তার হদিস বা পাওয়া যাবে। জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান না জানলে নাকি পুরাণগল্পগুলো পড়াই যায় না। পণ্ডিতরা বলছেন, পুরাণগল্পগুলো পড়তে হলে ভূগোল, ইতিহাস ধর্মতত্ত্ব নৃ-বিজ্ঞান নিয়েও যথেষ্ট অধিকার থাকা দরকার। প্রথম দিকের গ্রিক পুরাণের গল্পগুলো অধিকাংশই পাওয়া গেছে মন্দিরের গায়ের দেওয়াল ছবি অথবা পাত্র, আয়না, সিন্দুক, বর্ম এবং বিভিন্ন ধরনের জিনিসের গায়ে আঁকা ছবি থেকে।



-শফি ইসলাম

0 comments:

Post a Comment