Tuesday, November 16, 2010

আশুতোষ মিউজিয়াম, কলকাতা

0 comments
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণা জাদুঘর হলো আশুতোষ মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটি কলেজ স্ট্রিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সার্বজনীন জাদুঘর হিসেবেও প্রশংসিত। উপমহাদেশের আধুনিক শিক্ষার মহান প্রচারক স্যার আশুতোষ মুখার্জির নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। আশুতোষ মুখার্জি ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ৪ বার এবং ১৯২১ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত আরেকবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত হন। বাংলা শিল্পকলার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে ভারতীয় শিল্পকলার বিভিন্ন স্তরের নমুনাসমূহ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আশুতোষ মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আশুতোষ মিউজিয়াম প্রধানত বাংলা এবং বিহার থেকে শিল্পকর্ম ও প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রীর মাঝারি ধরনের সংগ্রহ নিয়ে যাত্রা শুরু করে শীঘ্রই সমৃদ্ধ সংগ্রহশালায় পরিণত হয়। জাদুঘরটি উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত ৩০ হাজারেরও অধিক প্রত্নতাত্তি্বক হাতিয়ার, টেরাকোটা, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, মুদ্রা, ব্রোঞ্চ শিল্পকর্ম, বস্ত্রশিল্প, কাঠখোদাই কাজ, লোকশিল্পসমূহের নিদর্শনাদি সংরক্ষিত আছে এবং প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘরটি লোক ও গ্রামীণশিল্প, যুগ পরিক্রমায় বাংলার পোড়ামাটিশিল্প, ভাস্কর্য ও ব্রোঞ্চশিল্পের পূর্ব ভারতীয় রীতির কয়েকটি অপূর্ব সৃষ্টির চমৎকার সংগ্রহের জন্য বিশেষভাবে গর্ব করতে পারে। পাহাড়পুর মঠ হতে প্রাপ্ত পুরানিদর্শনগুলো অপ্রত্যাশিত সংগ্রহ বলে এ জাদুঘরে স্থান দেয়া হয়েছে। পাহাড়পুর মঠটি ধর্মপাল (আনু. ৭৭-৮১০ খ্রি:) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মোসপুর মহাবিহার হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির তৎকালীন কারমাইকেল প্রফেসর ড. ভাণ্ডারকারের নেতৃত্বে একটি দল ১৯২২-২৩ সালে নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরের উঁচু ঢিবিতে খননকার্য শুরু করে। মঠ চত্বর থেকে উদ্ধারকৃত নানা ধরনের খোদাই করা ইট এবং পোড়ামাটির ফলকসমূহ দক্ষিণ এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতির ছাত্রদের কাছে বিশেষ আগ্রহের বিষয় হিসেবে বিবেচিত। ১৯৩৭ সালে মিউজিয়াম উত্তর দিনাজপুর জেলার বানগড় (প্রাচীন কোটিবর্ষ) প্রত্নস্থলে নিয়মিত খননকার্যের প্রকল্প হাতে নেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের শিক্ষক কেজি গোস্বামী ১৯৩৮-৪১ সালে রাজবাড়ী ঢিবির নির্ধারিত প্রত্নস্থলে খননকার্য পরিচালনা করেন। ঢিভি থেকে আবিষ্কৃত ধূসর, লাল ও মসৃণ কালো রঙের সুক্ষ্ম কারিগরিপূর্ণ জিনিসপত্র জাদুঘরে অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য জিনিসের মধ্যে ছিল রূপার ছাপাঙ্কিত ও তামার মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, সীলমোহর ও সীল করার উপাদান, নানা পদার্থের গুটিকা এবং অলঙ্কৃত ইট। জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে কেজি গোস্বামী ১৯৫৪-৫৫ সালে মেদিনীপুরের টিলায় চাঁদপুর ঢিবিতেও পরীক্ষামূলক খননকার্য চালান। এখানে প্রাপ্ত আদি ঐতিহাসিক যুগের পোড়ামাটির কিছু নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৯৫৬ সালে আশুতোষ জাদুঘর উত্তর চবি্বশপরগনার অন্তর্গত বেরাচম্পার চন্দ্রকেতুগড়ে ১৯৬৭-৬৮ সাল পর্যন্ত ব্যাপক খননকার্য চালায়। প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত সমৃদ্ধ নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে রয়েছে রূপার ছাপাঙ্কিত ও তামার ছাঁচে ঢালা প্রচুর মুদ্রা, মৌর্য-সুঙ্গ-কুসান যুগের পোড়ামাটির ফলক, সীলমোহর ও সীল করার উপকরণাদি এবং উত্তরাঞ্চলীয় সমৃদ্ধ কালো রঙের পণ্যসামগ্রীসহ মৃৎপাত্রাদি ও রুলেট সামগ্রী। খননকার্য ছাড়াও মিউজিয়াম প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আবিষ্কারের লক্ষ্যে মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও পান্না এবং চবি্বশপরগনা জেলার হরি নারায়ণপুর, বোরাল, আটঘর, মাহিনগর এবং হরিরামপুরসহ ভাগীরথীর ব-দ্বীপের অনেক আদি ঐতিহাসিক স্থানসমূহ মাঝে মাঝে পরিদর্শন করার ব্যবস্থা করে। এ প্রত্ন স্থানগুলোর প্রত্যেকটির তামার ছাঁচের ঢালা মুদ্রা, পোড়ামাটির ক্ষুদ্র মূর্তি, মাটির পাত্রাদির ভাঙা টুকরা এবং রুলেট সামগ্রীসহ সমৃদ্ধ অনেক প্রাচীন সামগ্রী ও নিদর্শনসমূহ পাওয়া গেছে। আশুতোষ মিউজিয়ামটি সমভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পাথরের ভাস্কর্য ও ব্রোঞ্জ নির্মিত শিল্পসমূহের সমাহারের জন্য প্রসিদ্ধ। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী হতে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের পাথরের ভাস্কর্য এ জাদুঘরে রয়েছে। সবচেয়ে পুরনো নমুনা হলো_ দাঁড়ানো পুরুষ মূর্তিসহ একটি পাথরের গরাদ এবং ভারি পেঁচানো পাগড়িসহ দ্বারক্ষীর মাথা। এ দুটি ভগ্নমূর্তিই সংগৃহীত হয়েছে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের কাফে উদয়গিরির হতে এবং এগুলো খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর। উত্তর চবি্বশপরগনার চন্দ্রকেতুগড় হতে সংগৃহীত বহুবর্ণে চিত্রিত লাল বেলে পাথরের (আনুমানিক দ্বিতীয় শতাব্দী। মাথা ও হাতবিহীন বুদ্ধের ক্ষুদ্র মূর্তিটি ছিল বাংলায় প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন মূর্তি। বগুড়ার মহাস্থানগড় হতে আবিষ্কৃত বেলে পাথরের কার্তিকের মস্তকবিহীন মূর্তি ও পাখির মূর্তিটি দ্বিতীয় শতাব্দীর বলে মনে হয়। শিল্প শৈলীর বিচারেই এ সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে। দক্ষিণ চবি্বশপরগনার কাশীপুরে প্রাপ্ত সূর্যের কালো পাথরের মূর্তি ষষ্ঠ শতাব্দীর, যা নন্দনতত্ত্বের নিরিখে এবং ভাস্কর্য রীতির বিচারে গুপ্ত যুগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। আশুতোষ মিউজিয়ামের পাথর ও ধাতুনির্মিত বেশিরভাগ ভাস্কর্যই ছিল পাল ও সেন রাজত্বকালের। বিহার ও বাংলা থেকে সংগৃহীত এসব মূর্তি আনুমানিক অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে এ অঞ্চলের পাথুরে শিলের বিবর্তনের প্রক্রিয়া প্রদর্শন করে। মধ্যযুগীয় সমৃদ্ধ চিত্রকলা সংগ্রহের দিক থেকে আশুতোষ মিউজিয়াম সুপরিচিত। ১১০৫ খ্রিস্টাব্দের পক্ষরক্ষা চিত্রলিপিতে বুদ্ধের জীবনের আটটি চিত্র রয়েছে, যা সমকালীন পূর্ব ভারতীয় চিত্রকলার ঐতিহ্যের উন্নত মানের বর্ণনা দেয়। মিউজিয়ামে আরও রয়েছে পশ্চিম ভারত থেকে সংগৃহীত বিখ্যাত জৈন চিত্রকলাসমূহ এবং সপ্তদশ, অষ্টম ও ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজস্থান ও হিমালয়ের রাজ্যগুলোর যুবরাজদের পৃষ্ঠপোষকতায় অঙ্কিত চিত্রসমূহ। এ সময়কার বাংলার আঞ্চলিক ও গ্রামীণ চিত্রকলার ওই চিত্রাঙ্কনগুলোর মধ্যে রয়েছে মূর্তি দ্বারা শোভিত গ্রন্থের মলাট, কালিঘাট পটচিত্র ও রঞ্জিত কাগজ।

0 comments:

Post a Comment