Thursday, November 11, 2010

রবিন হুড ক্রুসেড ও জাতীয়তাবাদ

0 comments
লোকগাথার আদি নিদর্শনে রবিন হুড অপরাধী কিন্তু ভালো লোক_এ পর্যন্তই পাওয়া যায়। কয়েক শ বছর ধরে লিখিত সাহিত্যে রবিন হুডের এই ক্রমবিবর্তন যেমন লক্ষ করার মতো, তেমনি চলচ্চিত্রে সেই একই চরিত্রের বিভিন্ন ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। রিডলি স্কট পরিচালিত ও রাসেল ক্রো অভিনীত সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে রবিন হুডকে দেখা হয়েছে ব্রিটিশ সিম্বল হিসেবে। ন্যাটো জোটভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন ইরাক ও আফগানিস্তানে স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুসলমান হত্যা করছে, তখন তাদেরই যৌথ প্রযোজনার ছবিতে রবিন হুড বলছে, সে আর মুসলমান হত্যা করবে না

মাত্র সতের জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে এখতেয়ার উদ্দীন মুহম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজি যখন বঙ্গদেশ দখল করেন তখন, ১১৯৯ সালে, ইংল্যান্ডের রাজা সিংহ-হূদয় রিচার্ড নর্ম্যান্ডি প্রদেশের লড়াইয়ে তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ দুটি যুদ্ধের মধ্যে যে ঐক্য পাই, তা সন্দেহাতীতভাবে কাকতালীয় এবং আমাদের আলোচ্য বিষয় ইংল্যান্ডের যুদ্ধ। ইংল্যান্ডের ওই যুদ্ধক্ষেত্রেই আমরা দেখি রবিন হুড নামের এক ঝানু তীরন্দাজ রাজার হয়ে লড়াই করছেন। ২০১০ সালে এসে ব্রিটিশ লোকগাথার চরিত্র রবিন হুডকে এভাবেই হাজির করা হয় রিডলি স্কট নির্মিত চলচ্চিত্রে, যে চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন রাসেল ক্রো।

সাম্প্রতিককালে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে পরিচালক রিডলি স্কট আমাদের দেখান, রাজার মৃতু্যর আগের রাতে সৎ সাহস দেখিয়ে বিপদে পড়ে রবিন হুড। সে রাজার সঙ্গে চতুর্থ ক্রুসেডে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ তৃতীয় ধর্মযুদ্ধে (১১৮৭ থেকে ১১৯২) মুসলমানদের কতল করার সময় নারী ও শিশুরা করুণভাবে প্রাণ ভিক্ষা চায় রবিন হুডের কাছে। যা দেখে ক্রুসেডে আর অংশ না নেয়ার অঙ্গীকার করে হুড। ফলে রাজ আক্রোশের শিকার হয় সে। কিন্তু সিংহ-হূদয়ের মৃতু্যর পর সে নটিংহ্যামে ফেরে। রাজাহীন রাজ্যে বাধ্য হয়ে তখন রাজা করা হয় রিচার্ডের দুষ্টু প্রকৃতির ভাই প্রিন্স জনকে। এরই মধ্যে দেখা মেলে ঘরের শত্রু বিভীষণের, তার নাম গডফ্রে। গোপনে সে সাহায্য করে ফরাসি রাজা ফিলিপকে। এই বিশ্বাসঘাতকতায় হুমকির মুখে পড়ে ইংল্যান্ডের স্বাধীনতা। কিন্তু প্রিন্স জনের প্রিয়পাত্র বেঈমান গডফ্রে হওয়ায় সৎ রাজকর্মীরা ছিটকে পড়ে দূরে। ইংল্যান্ডের মাটিতে সুকৌশলে ফরাসি সেনাদের নিয়ে খাজনা আদায়ের নামে লুটতরাজ শুরু করে গডফ্রে। শুধু তাই নয়, ফ্রান্সের রাজা ফিলিপকেও ডেকে পাঠায় ইংল্যান্ড দখলের জন্য। ঘটনার এক পর্যায়ে রবিন হুডই নেতৃত্ব দেয় ইংল্যান্ডকে পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে। সে এবার যুদ্ধ করে প্রিন্স জনের হয়ে। যদিও শেষ পর্যায়ে প্রিন্স জন অহমের কারণে হুডকে আউট ল বা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং হুলিয়া জারি করে তার নামে। তখন থেকেই হুডের জায়গা হয় গভীর জঙ্গলে, নাম শেরউড বা গ্রিনউড।

এই কাহিনি ২০১০ সালের। আদি লোকগাথা থেকে শুরু করে যতগুলো সিনেমা হয়েছে সবগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রবিন হুড একেক জায়গায় আবির্ভূত হয়েছে একেক ভূমিকায়। যেমন রবিন হুডকে নিয়ে সবচেয়ে পুরনো যে লোকগাথাটি পাওয়া যায়, ১৪৫০ সালে, নাম 'রবিন হুড এন্ড মঙ্ক' সেখানে হুড একজন অপরাধী মাত্র। নটিংহ্যামের শেরিফ ও তার দলবল হুডের শত্রু। প্রধান বন্ধু লিটিল জন। এরপরের শতাব্দীর নমুনাতেও একই রকম চিত্র পাওয়া যায় রবিন হুডের। তবে ষোড়শ শতাব্দীতে এসে দেখা যায় রবিন হুড বনে গেছে রাজা রিচার্ডের অনুগামী। এই শতাব্দীর লোকগীতিতে উলেস্নখ আছে, দ্বাদশ শতাব্দীতে রিচার্ডের অবর্তমানে প্রিন্স জনের স্বৈরশাসনের ফলে রাজ আইনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে হুড। ফলে আউট ল ঘোষণা করা হয় তাকে। মনে রাখা বাহুল্য নয় তখনো আমরা অধুনা বিনির্মিত রবিন হুডকে পাইনি। অর্থাৎ যে রবিন হুড ধনীর শত্রু, গরীবের বন্ধু। বড়লোককে যে লুট করে, যে দান করে দরিদ্রকে। ভিক্টোরীয় যুগে (১৮৩৭-১৯০১) রবিন হুড এই দাতা চরিত্রে আবির্ভূত হন। ১৮৮৩ সালে লেখা হাওয়ার্ড পাইলের উপন্যাস 'দ্য মেরি অ্যাডভেঞ্চারস অব রবিন হুড'-ই মূলত 'দাতা' সিলমোহরটি লাগায় রবিনের পিঠে। তবে সপ্তদশ শতকের কয়েকটি মঞ্চনাটকে রবিনের ওই রূপ দেখা যায়। কিন্তু তা পাইলের উপন্যাসের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। যা হোক উপন্যাস প্রকাশের পর বিংশ শতাব্দী জুড়ে যতবার রবিন হুডকে নিয়ে লেখা হয়েছে তার বেশির ভাগেই রবিনকে দেখা গেছে গরীবের ত্রাতা হিসেবে। ফলে সাধারণ একজন অপরাধী থেকে ভিক্টোরীয় যুগে রবিন হুড বনে যায় 'দাতা হাতিম তাই'। লোকগাথার আদি নিদর্শনে রবিন হুড অপরাধী কিন্তু ভালো লোক, ঐ পর্যন্তই পাওয়া যায়। কয়েকশ বছর ধরে লিখিত সাহিত্যে রবিন হুডের এই ক্রম বিবর্তন যেমন লক্ষ্য করার মতো তেমনি চলচ্চিত্রে সেই একই চরিত্রের বিভিন্ন ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।

সিরিয়া ও মিশর যখন সুলতান সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে একজোট তখন ১১৮৭ সালে সুলতানের জিহাদে জেরুজালেম পুনর্দখল হয়। জার্মান সম্রাট ফ্রেডরিক বারবারোসা, ফরাসি রাজা ফিলিপ অগাসটাস ও ইংলিশ রাজা রিচার্ড সিংহ-হূদয়ের সমন্বয়হীন প্রতিরোধ প্রকৃত কোনো বাধাই তৈরি করতে পারে নি সুলতানের সামনে। ফলে পবিত্র স্থান হাতছাড়া হয় খ্রিস্টানদের। সেটি ফিরিয়ে নিতে শুরু হয় চতুর্থ ধর্মযুদ্ধের তোড়জোড় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে। এই সময়টা রবিন হুডকে নিয়ে লেখা সাহিত্য ও নির্মিত চলচ্চিত্রে ধরা পড়েছে বিভিন্ন ভাবে। এসব সৃষ্টিতে রবিন হুডের কর্মকাণ্ড এক রকম নয়। বিভিন্ন সাহিত্যে যেমন ভিন্ন, আমরা চলচ্চিত্রেও দেখি আলাদা আলাদা রবিন হুডকে। হুডকে নিয়ে প্রথম ছবিটি তৈরি হয় ১৯২২ সালে, নাম 'রবিন হুড'। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৯০ বছর; কিন্তু এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে কম করে হলেও ১৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য মূলত তিনটি। একটি হলো ১৯৩৮ সালে এরল ফ্লিন ও অলিভিয়া দো হাভিলান্ড অভিনীত 'এ্যাডভেঞ্চার অব রবিন হুড', এর পরিচালক ছিলেন মাইকেল কার্টিজ ও উইলিয়াম কিইলি। দ্বিতীয়টি হলো শ্যন কনেরি ও অড্রে হেপবার্ন অভিনীত 'রবিন এন্ড ম্যারিয়েন' (১৯৭৬)। এর পরিচালক ছিলেন রিচার্ড লেস্টার। তৃতীয়টির কথা শুরুতেই বলেছি, ২০১০ সালে রাসেল ক্রোর রবিন হুড। চলচ্চিত্রে ত্রিশের দশকে আমরা দেখি রবিন হুড স্যাক্সন ও নর্ম্যানদের সমস্যা নিয়ে ভাবিত। সেখানে সে নিজে স্যাক্সন আর প্রিন্স জনসহ ম্যারিয়েন নর্ম্যান। এই দুই জাতিকে ইংলিশ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে যেন ক্যানভাসার হিসেবেই হাজির হয় রবিন হুড। বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে অবশ্য দেখা যায় রবিন হুড নিপীড়িত স্যাক্সনদের পক্ষে ও নমর্্যান লর্ডদের বিরুদ্ধে। রবিন যে স্যাক্সন ছিলো তাও হলফ করে বলতে পারবে না কেউ। কিন্তু তারপরও স্যাক্সন ও নর্ম্যান প্রসঙ্গ নিয়ে ছবি বানানো হয়। ১৯৩৮ সালে 'এ্যাডভেঞ্চার অব রবিন হুড' ছবিটি যখন মুক্তি পায় তখন ইউরোপ জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। হিটলারের জাতীয়তাবাদ তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ওই অবস্থায় রবিন হুড কেন ইংলিশ জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়।

এর পরে নির্মিত ছবি দুটিতে রবিন হুড ক্রুসেডে অংশ নিয়েছে শ্যন কনেরি ও রাসেল ক্রো উভয়েই। শ্যন কনেরি যেখানে সাধারণ নারী ও শিশুকে হত্যা করে একটি মূর্তি আদায় করতে অস্বীকৃতি জানায় সেখানে রাসেল ক্রো আর ক্রুসেডে যাবে না বলে অনড় অবস্থান নেয়। দুটো ঘটনাই রাজ আদেশকে অমান্য করা। শ্যন কনেরির রবিন হুড এরপর নটিংহ্যামের শেরিফ ও ম্যারিয়েনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বোঝাই যায় মূলত ব্যবসা করার জন্যই দুই তারকাকে আনা হয় এই রবিন হুড ছবিতে। রাসেল ক্রোর ছবিতে কিন্তু ক্রুসেডের প্রসঙ্গ এসেছে খোলামেলা ভাবেই। হোক একটি ছোট দৃশ্যে কয়েকটি লাইন, তার গুরুত্ব কিন্তু ছোট নয়। ন্যাটো জোটভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন ইরাক ও আফগানিস্তানে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য মুসলমান হত্যা করছে তখন তাদেরই যৌথ প্রযোজনার ছবিতে রবিন হুড বলছে সে আর মুসলমান হত্যা করবে না। সমঝদারদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। ১৯৯১ সালে কেভিন কস্টনার অভিনীত 'রবিন হুড : প্রিন্স অব থিভস' ছবিতেও আমরা দেখি রবিন হুড মুসলমানদের বিপক্ষে নয়। বরং আজিম নামের এক মুসলমান বন্ধু রয়েছে তার। উলেস্নখ করা দরকার, তখন মার্কিন বাহিনী ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। যাহোক রাসেল ক্রো অভিনীত ছবিতে মুসলমানদের নিয়ে ছোট ওই ইঙ্গিত ছাড়া যেটি আছে সেটি হলো আবারো সেই জাতীয়তাবাদ। যে রবিন হুড সত্যি সত্যি ছিলো বলে কেউ বলতে পারেনি, যে রবিন হুড লোকগাথার বিখ্যাত চরিত্র, যে রবিন হুডকে দেখা হয় ব্রিটিশ সিম্বল হিসেবে, সে ২০১০ সালে আবারো অবতীর্ণ হয় জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা হাতে। যে রবিন হুডকে এর আগে সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে প্রিন্স জনের শত্রু হিসেবেই দেখানো হয়েছে, সেখানে নতুন এই ছবিতে আমরা দেখি ইংরেজ জাতিকে রক্ষায় প্রিন্স জনের সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে নামে রবিন হুড। প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। ইংলিশ চ্যানেলের এপার আর ওপারের দীর্ঘ রেষারেষির খবর কমবেশি সকলেরই জানা। কিন্তু অত্যাচারী রাজার শত্রু আর শোষিত মানুষের বন্ধু রবিন হুড এখানে কেন ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদের কাণ্ডারী? ধনী-গরীবের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিয়ে জাতীয়তাবাদের ক্যানভাসার কেন বানানো হলো তাকে? কোন জ্ঞান উৎপাদন করতে চায় তারা? উত্তরে বলা যায়, ইংরেজ জাতির শৌর্য-বীর্য জনপ্রিয় চরিত্র রবিন হুডকে দিয়ে শক্তিশালী গণমাধ্যম চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপনের মর্মার্থ উদ্ধার করতে রকেট প্রকৌশলী হওয়ার প্রয়োজন নেই।

সূত্র: ইত্তেফাক

0 comments:

Post a Comment