ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল। বরিশালকে নিয়ে এই প্রবাদের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে গেলে। কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত বরিশালের পূর্ব নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। প্রায় ২৭৯০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলার উত্তরে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও চাঁদপুর জেলা, দক্ষিণে পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলা, পূর্বে ভোলা ও লক্ষ্মীপুর জেলা এবং পশ্চিমে ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও গোপালগঞ্জ জেলা। কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁ, তেঁতুলিয়া, সন্ধ্যা ইত্যাদি জেলার প্রধান নদী। বরিশাল জেলার বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ নিয়ে কড়চার এবারের বেড়ানো।
কীর্তনখোলা নদী : বরিশাল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কীর্তনখোলা নদী। বরিশালের সায়েস্তাবাদ থেকে শুরু হয়ে নদীটি গাবখান খালের কাছে এসে গজালিয়া নদীতে পড়েছে। বর্তমানে এটি বরিশাল নদী নামেও পরিচিত।
অশ্বিনীকুমার টাউন হল : বরিশাল শহরের সদর রোডে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী অশ্বিনীকুমার টাউনহল। বরিশাল শহরের উন্নয়নের প্রাণপুরুষ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অশ্বিনীকুমার দত্তের নামানুসারে এ হলের নামকরণ করা হয়। এ হলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯০৬ সালে রাজা বাহাদুরের হাবেলিতে মিছিলের উপর পুলিশ হামলা চালায়। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে অশ্বিনীকুমার দত্ত একটি হল নির্মাণের প্রস্তাব করেন। ১৯২০ সালে অশ্বিনীকুমারকে সভাপতি ও শরৎচন্দ্র গুহকে সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। একই বছর রাজা বাহাদুরের হাবেলির মালিকদের নিকট থেকে জমিও ক্রয় করা হয়। পরের বছর হলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৩০ সালে। এর মাঝে ১৯২৩ সালে অশ্বিনীকুমার দত্তের মৃতু্য হলে এক শোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে হলটি তার নামে নামকরণ করা হয়।
বিএম কলেজ : বরিশালের প্রাচীন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজ মোহন কলেজ। ১৮৮৪ সালের ২৭ জুন এই কলেজ স্থাপিত হয়।
অক্সফোর্ড মিশন গির্জা : শহরের বগুড়া রোডে রয়েছে সুরম্য স্থাপনা সমৃদ্ধ অক্সফোর্ড মিশন গির্জা। এখানকার গির্জাটি বেশ আকর্ষণীয়। গ্রিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত গির্জাটির ভেতর আছে সুবিশাল প্রার্থনা কক্ষ।
মুকুন্দ দাসের কালিবাড়ী :শহরের পাশেই রয়েছে চারণকবি মুকুন্দ দাসের বসতভিটা। কবির জন্ম বিক্রমপুরে হলেও তার পিতা গুরুদয়াল বরিশালের আদালতে আরদালির কাজ করতেন। সেই সূত্রে তারা বরিশালের বাসিন্দা হন।
কড়াপুর মিঞাবাড়ী মসজিদ : জেলার সদর উপজেলার কড়াপুর ইউনিয়নের মিঞাবাড়ীতে রয়েছে প্রাচীন একটি মসজিদ। একটি উঁচু ঢিবির উপরে নির্মিত এ মসিজদে ওঠার জন্য সামনের দিকে ঠিক মাঝখানে একটি সিঁড়ি আছে। সামনের দেয়ালের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মিহরাব। মসজিদের উপরে আছে তিনটি গম্বুজ। মসজিদের সামনের দেয়ালে আছে চারটি মিনার এবং এগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আছে অপেক্ষাকৃত ছোট আরো ছয়টি সরু মিনার। ধারণা করা হয়, মসজিদটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত।
দুর্গাসাগর : বরিশাল শহর থেকে প্রায় এগারো কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মাধবপাশা গ্রামে ছিল বাকলা চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের আবাসস্থল। তারা পটুয়াখালী জেলার বাউফল থেকে মগ জলদসু্যদের ভয়ে কিংবা নদী ভাঙ্গনের ফলে এখানে চলে আসেন বলে জানা যায়। এখানে রাজাদের প্রাসাদ, মন্দির ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। তবে মাধবপাশার দর্শনীয় স্থান হলো প্রাচীন দীঘি দুগর্াসাগর। রাজা জয়নারায়ণের মা দুর্গাদেবীর নামে এর নামকরণ করা হয়। বিশাল এ জলাশয়ের ঠিক মাঝখানে আছে একটি ছোট্ট দ্বীপ। শীতে এ দ্বীপে প্রচুর অতিথি পাখির সমাগম হয়। বরিশালের নথুলস্নাবাদ বাস স্টেশন থেকে বানারীপাড়ার বাসে সহজেই আসা যায় দুর্গা সাগর।
বায়তুল আমান মসজিদ : জেলা সদর থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে বরিশাল-বানারীপাড়া সড়কের পাশে গুঠিয়া এলাকায় রয়েছে আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি বায়তুল আমান জামে মসজিদ। স্থানীয়রা একে গুঠিয়া মসজিদও বলে থাকেন। বিস্তীর্ণ খোলা চত্বরের মাঝে বিশাল এ মসজিদটির কেন্দ্রে রয়েছে কারুকাজ খচিত একটি গম্বুজ। মসজিদের উঁচু মিনারটিও বেশ আকর্ষণীয়। এটি বাংলাদেশের আকর্ষণীয় মসজিদগুলোর একটি।
গুঠিয়ার সন্দেশ : গুঠিয়ার আরেক বিশেষ আকর্ষণ এখানকার সন্দেশ। গরুর দুধের ছানা দিয়ে তৈরি এ সন্দেশ খুবই মজাদার। গুঠিয়া মসজিদের পাশেই পাওয়া যায় এ সন্দেশ। প্রতিটি সন্দেশ বিক্রি হয় সাত টাকায়, আর প্রতি কেজি ৩০০ টাকায়।
শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘর : বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বানারীপাড়ার চাখারে অবস্থিত শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘর। ১৯৮২ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখানে এ জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করে। এ জাদুঘরে দেখা মিলবে শেরে বাংলার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের দুর্লভ সব আলোকচিত্র, তার ব্যবহূত নানান আসবাবপত্র ইত্যাদি। জাদুঘরের অদূরেই রয়েছে ১৯২৯ সালে শেরে বাংলা কতর্ৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদ। শনিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ জাদুঘর।
শিকারপুরের তারা মন্দির : শহর থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে সুগন্ধা নদীর তীরে শিকারপুর গ্রামে অবস্থিত তারা মন্দির। দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর চলতি শতকের গোড়ার দিকে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়।
মাহিলারা সরকার মঠ : জেলার উজিরপুর উপজেলার মাহিলারা এলাকায় প্রাচীন একটি স্থাপনা সরকার মঠ। আটকোণাকৃতির এ মঠটি প্রায় ২০.২১ মিটার উঁচু। পুরো মঠের গায়ে নানান অলঙ্করণে শোভিত। জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে নবাব আলীবদর্ী খাঁর সময়ে সরকার রূপরাম দাসগুপ্ত এটি নির্মাণ করেন।
কসবা মসজিদ : জেলার গৌরনদী থানার রামসিদ্ধি গ্রামে অবস্থিত প্রচীন স্থাপনা কসবা মসজিদ। বর্গাকারে নির্মিত এ মসজিদের প্রত্যেক পাশের দৈর্ঘ্য ১৬.৯৬ মিটার। প্রাচীরগুলি বেশ প্রশস্ত। এর চার কোণে চারটি ছোট আকৃতির মিনার আছে। মসজিদের সামনের দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে। প্রবেশপথগুলো পোড়ামাটির অলঙ্করণে শোভিত। মসজিদের উপরে আছে নয়টি গম্বুজ। ধারণা করা হয়, খানজাহানের সময়ে মসজিদটি নির্মিত।
কিভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে নদী ও সড়কপথে বরিশাল যাওয়া যায়। ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন রাতে ছাড়ে এমভি সুন্দরবন (০১৭১৩-০৩২০৮৯, ০১৭১৮৬৬৪৭০০), এমভি সুরভী (০১৭১৩-৪৫০১৪৫, ০১৭১১-৩৩২০৩২), এমভি দ্বীপরাজ (০১৭২৭৭০০৭৭৭), এমভি কীর্তনখোলা (০১৭২৭৭০০৭৭৭), এমভি কালাম খান, এমভি পারাবাত (০১৭১১৩৩০৬৪২, ০১৭১১৩৪৪৭৪৭) ইত্যাদি। এসব লঞ্চে প্রথম শ্রেণীর একক কেবিন ৪৫০-৫৫০ টাকা, দ্বৈত কেবিন ৯০০-১০০০ টাকা। ডেকে জনপ্রতি ভাড়া ২০০-২৫০ টাকা। এছাড়া ঢাকার গাবতলী থেকে সাকুরা পরিবহন (০২-৮০১৪৭০২), সুরভী পরিবহন, দ্রুতি পরিবহন (০২-৯০০২৯৮৯), শ্যামলী পরিবহন (০২-৯১৪১০৪৭), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (০২-৯১৩৫০১৮) ইত্যাদি বাস সরাসরি বরিশালে যায়। ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন : বরিশাল শহরে থাকার জন্য ভালো মানের হোটেল হলো_হোটেল এ্যাথেনা (০১৭১২-২৬১৬৩৩, ভিভিআইপি কক্ষ ২৫০০ টাকা, ভিআইপি ১৮০০ টাকা, দ্বৈত কক্ষ ১১০০ টাকা এবং একক কক্ষ ৯০০ টাকা)। হোটেল আলী ইন্টারন্যাশনাল (০১৭১৪২-০০৭০৭০, এসি একক কক্ষ ৭০০ টাকা, এসি দ্বৈত কক্ষ ১০০০ টাকা, ভিআইপি একক কক্ষ ১৫০০ টাকা, ভিআইপি দ্বৈত কক্ষ ২৫০০ টাকা, সাধারণ একক কক্ষ ৩৫০ টাকা, সাধারণ দ্বৈত কক্ষ ৪৫০ টাকা।
০০ লেখা মুস্তাফিজ মামুন ০০
0 comments:
Post a Comment