Monday, November 22, 2010

পলাশী

0 comments
মুর্শিদাবাদ শহর থেকে দক্ষিণে নদিয়া জেলা। পশ্চিম পাড় দিয়ে বইছে ভাগীরথী নদী। দক্ষিণে পলাশী গ্রাম। পলাশ গাছের প্রাচুর্যের জন্য এ গ্রামের নাম পলাশী। এছাড়াও রয়েছে লাখ লাখ আম গাছের বিশাল বাগান। ফলে এর নাম রাখা হয় পলাশীর আম্রকানন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত পলাশীর আম্রকাননে এখন স্মৃতিস্তম্ভ ছাড়া আর কিছুই নেই। ২৩ জুন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে এদিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। মধ্যরাতে ইংরেজরা সহস্রাধিক সৈন্য কামানের গোলা নিয়ে পলাশীর প্রান্তরে পেঁৗছল। ভোর ৬টায় নবাবের সেনাবাহিনী পরিখার ভেতর থেকে কুচকাওয়াজ করে বেরিয়ে এলো। সকাল ৮টায় মশিয়ে সিমফ্রের নেতৃত্বে প্রথম কামানের গোলা ছুড়ল ফরাসিরা। এ সময় একজন ইংরেজ সেনা মারা গেল আরেকজন আহত হলো। নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা রাজধানীর মুর্শিদাবাদের প্রাসাদে বসে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের খবর পেলেন এবং বাংলার সূর্যকে রক্ষা করার লক্ষ্যে পলাশীর আম্রকাননে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। বেলা ১১টায় ইংরেজ সৈন্যরা নবাবের সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়। নবাবের বারুদ গোলা ভিজে যায়। বৃষ্টি থামলে বীর বিক্রমে তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে নবাবের ৫০টি কামান, ৫০ হাজার পদাতিক বাহিনী, ১৮ হাজার অশ্বারোহী বাহিনী ছিল। দুপুর ১টায় সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যুতে নবাব হতাশ হয়ে পড়েন। এ সুযোগে মীর জাফর আলী খাঁ ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করার চিরকুট পাঠান। বিষয়টি নবাব বুঝতে পেরে মীর জাফরকে ডেকে এনে মাথার পাগড়ি খুলে মীর জাফরের পায়ের তলায় রেখে বলেন, দোহাই আপনি এর সন্মান রক্ষা করুন। মীর জাফর আলী খাঁ আপনি আমার পরম আত্মীয়। বাংলার এই দুর্দিনে আপনাকে করজোড়ে বলছি আপনি এ সময় আমাকে সহযোগিতা করুন। মীর জাফর কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিলেন এবং নবাবকে বুঝিয়ে বললেন আজকের মতো যুদ্ধ বন্ধ রাখা হোক। কাল সকালে আমরা পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যাব। আরেক বিশ্বাসঘাতক রায়দুর্লভ নবাবকে রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। নবাব মানসিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েন। দুপুর ২.৩০ মিনিটে নবাবের গোলন্দাজ বাহিনী কামান ছোড়া বন্ধ রাখলেন। আর এ সুযোগে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী এগিয়ে নিয়ে মীর জাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুরোদমে যুদ্ধ আরম্ভ করেন। অতর্কিত হামলায় নবাবের সৈন্য সামন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ হওয়ার পর মোহনলালের মৃত্যু ঘটে। পলাশীর প্রান্তরে সেদিন নবাবের সৈন্যদের রক্তাক্ত লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পুনরায় সৈন্য সংগ্রহে নবাব ছুটে যান মুর্শিদাবাদে। পরে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন। নবাবের পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে উল্লসিত হয়ে পড়েন ইংরেজরা। ২৯ জুন ১৭৫৭ সালে ক্লাইভ ২০০ ইংরেজ সৈন্য ও ৩০০ সিপাহির পাহারায় মুর্শিদাবাদে এসে পেঁৗছল। ক্লাইভ মীর জাফরকে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসালেন। হীরাঝিলে মনসুরগঞ্জ প্রাসাদ। প্রাসাদের হলঘরের এক প্রান্তে শূন্য সিংহাসন। শহরের অভিজাতগণ উপস্থিত। উপস্থিত হয়েছেন স্বয়ং ক্লাইভ। মীর জাফরকে সিংহাসনে বসতে বললেন। তবু তার দ্বিধা, সংকোচ অথবা লজ্জা ক্লাইভ নিজেই হাত ধরে তাকে সিংহাসনে বসালেন। ষড়যন্ত্রের পুরস্কার মিলল। মীর জাফর সিংহাসনে বসার পর সিরাজের ধনাগারে গেলেন ক্লাইভ ও মীর জাফর। তাদের সঙ্গে হিরণ ক্লাইভের সহকারী মেজর ওয়ালশ, কাশিমবাজার কুঠির অধ্যক্ষ ওয়াটস্ লংসিটন, দেওয়ান রামচাঁদ ও মুন্সি নবকৃষ্ণ। সিন্দুকের পর সিন্দুক খুলে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, মণিরত্ন যখন দেখান হলো ক্লাইভ ও অন্যদের চোখ ঝলসে গেল ধনরত্নের চাকচিক্যে। ধনাগারে ছিল ১ কোটি ৭৬ লাখ রৌপ্য মুদ্রা, ২ লাখ স্বর্ণ মুদ্রা, ২ সিন্দুক সোনার তাজ, ৪ বাক্স হীরা জহরত, দু'বাক্স চুনিপান্না। এছাড়াও সিরাজের অন্তঃপুরের ধনাগারে ৮ কোটি টাকা। ইংরেজরা খোঁজ পায়নি তার। এগুলো মীর জাফর, তার প্রপৌত্র আমির বেগ, রামচাঁদ ও নবকৃষ্ণের মধ্যে ভাগ হয় বলে জানা যায়। মীর জাফর ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করেন। ক্লাইভ ও মীর জাফর গেলেন জগৎশেঠের প্রাসাদে। সঙ্গে ওয়াটস, মিরন, রায়দুর্লভ, স্ক্রফটন ও জগৎশেঠ একটা মীমাংসা করে দিলেন। ইংরেজদের এখনই তাদের দাবির অর্ধেক দিতে হবে। ২/৩ নগদে এবং ১/৩ মণিরত্ন ও সোনা-রূপার থালায়। বাকি অর্ধেক তিন বছরে সমহারে নিতে হবে। সেনাবাহিনীর বকেয়া শোধ করার জন্য যথেষ্ট অর্থ দরকার ছিল মীর জাফরের। ক্লাইভ মত দিলেন। রায় দুর্লভকে দিতে হবে ৫ শতাংশ কমিশন। জগৎশেঠের প্রাসাদে ছিলেন উর্মিচাঁদ। তিনি তার পাওনা দাবি করেন। ক্লাইভ সাদা কাগজে লেখা আসল দলিলটা দেখালেন। তাতে উর্মিচাঁদের প্রাপ্যের উল্লেখ ছিল না। এর আগে তিনি ক্লাইভের কাছে যে জাল কাগজে দলিলটা দেখেছিলেন তাতে উল্লেখ ছিল। কিন্তু সেটা জাল দলিল। মর্মাহত উর্মিচাঁদ সম্বিত হারালেন। তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।

-এম.জি বাবর

0 comments:

Post a Comment