Thursday, November 11, 2010

খুরি মরুভূমি

42 comments
সমভূমি, মালভূমি, পাহাড়-পর্বত থেকে শুরু করে মরুভূমি ও বরফের ছোঁয়া পর্যন্ত পাওয়া যায় ভারতের প্রকৃতিতে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় লীলাখেলা দেশটির একেক রাজ্যে এককভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতির এই খেলাকে কেন্দ্র করে ভারতে পর্যটন শিল্প বিশাল পরিধি ধারণ করেছে। প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছোটে আসেন পর্যটকরা। কেউবা আসেন কাশ্মীরের শীতল ছোঁয়া পেতে, কেউবা দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের কোলে আবার কেউবা আসেন মরুভূমিতে। এ রকম একটি স্থান রাজস্থানের খুরি মরুভূমি। অনেকেই একে প্রাচ্যের সাহারা বলে থাকেন। এ স্থানকে কেন্দ্র করে সমগ্র রাজস্থান বিশ্ব পর্যটকের নজরে আসতে সক্ষম হয়েছে। যে কেউ এখান থেকে পেতে পারেন মরুভূমির উষ্ণ ছোঁয়া। ভাবিয়ে তুলতে পারে পৃথিবীর বৈচিত্র্য নিয়ে।

জয়সলমের থেকে ৪০ কিলোমিটার পথ পেরুলেই পেঁৗছা যায়, খুরি মরুভূমির সীমানায়। রাস্তায় যানবাহন খুব একটা দেখা যায় না। শুধু পর্যটকদের আনা-নেয়ার জন্য রয়েছে কিছু বাস। প্রকৃতপক্ষে খুরি হলো এ মরুভূমির বহু পুরনো একটি গ্রাম। পাকিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন গ্রাম হলেও রাজস্থানের অন্যান্য ১০টি গ্রামের মতোই শান্ত। অনেকেই এখানে আসতে ভয় পান। কারণ হিসেবে যেটা বলেন, সেটা হলো পাক-ভারত সীমান্তের অস্থিরতা। অনেকেই মনে করেন, যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই ভীতি বর্তমান সময়ে একেবারে অবাস্তব। খুরি গ্রামটি সীমান্ত থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত। তারপরও সতর্কতা অবলম্বন করা ভালো। অনেক পর্যটকই ভুল করে ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু মাঝপথে সীমান্তরক্ষী মনে করিয়ে দেয় আপনার অবস্থান। তবে সঙ্গে গাইড থাকলে এ সমস্যা এড়ানো যেতে পারে। মরুভূমির মাঝে খুরি গ্রামটির অবস্থানের জন্য মরুভূমি এখানে হাতের মুঠোয়। বাড়ির জানালা দিয়ে বা তাঁবুর দরজা ফাঁক করলেই আদিগন্ত বালিয়াড়ি। সোনালি তরঙ্গ। খুরির পশ্চিম আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটি পুরোটাই মরুভূমি।

এ মরুভূমির নিজস্ব ঐতিহ্য এখনও চোখে পড়ে। প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীনত্ব নিয়ে খুরি ঐতিহ্যশালী। খড় বা টিনের চালের নিচে গোলাকার ঘর। মাটি লেপা দেয়ালজুড়ে নানা রঙিন কলকা। এসব ঘরেই মরুভূমির মধ্যে রাত পোহাতে হয় পর্যটকদের। আধুনিকতার কোল ছেড়ে এরকম মাটির তৈরি মাটির বিছানাতে ঘুমালে যে কারও মনে পড়ে প্রকৃতির কোমলতা। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যেতে পারেন ইট-পাথরের কাঠখোট্টা এ জীবনের কথা। মরুপ্রদেশের রংয়ের বিন্যাস_ সতেজতার বহিঃপ্রকাশ সব কিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন নকশা বা কারুকাজের মাধ্যমে। এগুলো পরিলক্ষিত হয় ঘরের মাটির দেয়ালে। গ্রামের লোকজনের বাড়িগুলোর মধ্যেই কয়েকটা গেস্ট হাউসও রয়েছে। গেস্ট হাউস ছাড়াও আছে তাঁবুতে রাত কাটানোর রোমাঞ্চকর সুযোগ। মরুভূমিতে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ হলো উটের পিটে চড়ে ধু ধু বালির সমুদ্রে এগিয়ে যাওয়া। উটে চাপার জন্য ভিড় বেশি না হওয়ায় ঘণ্টাপ্রতি ভাড়াও কম। ভারতের অন্যান্য পর্যটন শহর যেমন কলকাতা, দার্জিলিং, দিলি্ল, শিমলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক পর্যটককে দেখা যায়। কিন্তু রাজস্থানের এই খুরি মরুভূমিতে বাংলাদেশের কোনো পর্যটক খুব একটা দেখা যায় না। এর কারণ দূরত্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে ইউরোপের পর্যটকরা এখানে সবচেয়ে বেশি আসা-যাওয়া করেন।

কুটির শিল্পের জন্য এ গ্রাম ভুবনবিখ্যাত। বয়নশিল্প ও মৃৎশিল্প খুরির অহঙ্কার। এখানে বিভিন্ন আদি ডিজাইনের পাশাপাশি আধুনিক ডিজাইনের মেলবন্ধনে কাপড়ের ওপর অঙ্কিত পোশাক পাওয়া যায়। মাটির হাঁড়ি-কলসিগুলোতে রয়েছে অপূর্ব কারুকাজ।

খুরিতে রাতযাপন করলে আপনি যা আতিথেয়তা পাবেন তা চিরকাল মনে থাকবে। রাজস্থানি লোকসংগীতের আসর জমে উঠবে সন্ধ্যাবেলা। রঙিন হয়ে উঠবে আপনার সন্ধ্যা। এ মরুভূমিতে পানির অভাব কিছুটা রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের ঘাটতি নেই। পর্যটন শিল্পের কথা চিন্তা করে এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। সন্ধ্যায় সব অতিথিশালার বারান্দাগুলো ঝলমলিয়ে ওঠে। পান-ভোজনের আয়োজন থাকে পর্যাপ্ত। এমনকি বুফে সিস্টেমে ডিনারও সারতে পারেন। ডিনারের আগে হয় ক্যাম্প-ফায়ার। এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে আপনি থাকতে পারবেন না। মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে চারদিকে বিভিন্ন দেশের পর্যটক নিজেদের কথাবার্তা ভাগাভাগি করে নেন। খুরি থেকে যেতে পারেন ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্কে। খুব একটা দূরে নয়। এখানে আছে চিঙ্কারা, ময়ূর। বাড়তি আকর্ষণ গ্রেট ইন্ডিয়ান ব্যাস্টার্ড। মাঝে-মধ্যে বড় গাছ। শুকনো, রুক্ষ। এই সবুজহীনতায় মনকে চাঙ্গা রাখতে ওয়াচ-টাওয়ারে উঠে ক্যামেরা তাক করুন। চোখের সামনে ডেজার্ট-ফক্স, ডেজার্ট-ক্যাট, চিঙ্কারা, ময়ূূরের ছোটাছুটি। কিন্তু গ্রেট ইন্ডিয়ান ব্যাস্টার্ডদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ধূসর রংয়ের সঙ্গে কালো-বাদামি মিশানো গ্রেট ইন্ডিয়ান ব্যাস্টার্ড বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীকুলের অন্যতম। এদের গলার নিচ থেকে পেট পর্যন্ত সাদা। সর্বদা দ্রুত চলে। নিচু ঘাসের জমিতে আস্তানা বানিয়ে থাকে। ডানা মেললে গোটা বৃত্তের আকার হয় প্রায় ৮ ফুট। জমিতে দৌড়ে চললেও এরা উড়তে পারে। তবে একটু উড়েই ক্লান্ত হয়। পাকিস্তান সীমান্ত যতই কাছে হোক_ খুরির বাতাসে নেই বারুদের গন্ধ। কোনো অচেনা, ভয় জাগানো শব্দে ঘুম ভাঙবে না। কানে বাজে রাজস্থানি লোকগীতির সুর। স্বপ্নবিভোর হয়ে পথ চলতে চলতে আপনি পেরিয়ে যাবেন বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি।

42 comments:

Post a Comment