২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ একটি সূর্যালোকিত সকাল। স্থান বিডিআর সদরদপ্তর পিলখানা। সকাল ৯টার পর শুরু হলো সম্পূর্ণভাবে অকল্পনীয় এবং জাতির ইতিহাসের ভয়াবহতম একটি অধ্যায়ের। বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানরা দখলে নিয়ে নেয় পুরো পিলখানা, নৃশংসভাবে হত্যা করে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। এই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আর বিদ্রোহের বিচার চলছে বিডিআরের নিজস্ব আইনে। ২১৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই বাহিনীর ভেতরে ঘটে যাওয়া এমন নৃশংসতা গোটা জাতি তথা পুরো বিশ্বকে করেছে হতবাক।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সোয়া ৮টায় বিডিআর সদরদপ্তরের ব্যাটালিয়ন মেসে উপস্থিত হয় বিদ্রোহীদের একটি দল। সেখান থেকে দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটি দল কেন্দ্রীয় কোত ভেঙ্গে অস্ত্র বের করে। আরেকটি দল নিয়ে আসে গোলা-বারুদ। ৪৪ ব্যাটালিয়নের সামনের চৌরাস্তায় অস্ত্রে ম্যাগাজিন ভরে তারা রওনা হয় দরবার হলের দিকে। অবস্থান নেয় দরবার হলের পাশে।
নির্মম, বর্বর
সকাল ৯টায় শুরু হওয়া দরবারে তখন বক্তব্য রাখছিলেন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। প্রায় ২ হাজার ৫০০ বিডিআর জওয়ানের উপস্থিতিতে সেই দরবারে অপারেশন ডালভাতসহ বিডিআর সদস্যদের উন্নয়ন ও কল্যাণ নিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন তিনি। হঠাৎ রান্নাঘরের পাশ দিয়ে অস্ত্র হাতে প্রবেশ করে সিপাহি মইন। মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে অস্ত্র তাক করতেই পাশের কর্মকর্তারা তাকে নিরস্ত্র করতেই ‘জাগো' শ্লোগানের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে বিদ্রোহীরা। শুরু হয় বৃষ্টির মতো গোলাগুলি।
বিদ্রোহীদের সামাল দিতে বের হলে কর্নেল মুজিব, লে. কর্নেল এনায়েত আর মেজর মকবুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিকে, দরবার হলের ভেতরে অবস্থানরত সেনা কর্মকর্তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। প্রাণ বাঁচাতে এদিক-সেদিক পালিয়ে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে গুলি করা হয়। দুপুরের আগেই হত্যা করা হয় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে। এই ঘটনায় মৃত্যু হয় মোট ৭৪ জন সামরিক-বেসামরিক লোকের। অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয় সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রী-সন্তানদের উপর।
সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পর লাশগুলো প্রথমে পুড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা করলেও পরে কয়েকটি লাশ নর্দমার ম্যানহোলে ফেলে দেয়া হয়। দরবার হলের সামনে থেকে দুপুর ১টার দিকে বাকি লাশগুলো ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। দুটি গর্ত খুঁড়ে লাশগুলো মাটি চাপা দেয়া হয়।
দেশজুড়ে আতঙ্ক
পিলখানার ভেতরে সেদিন আসলে কী ঘটছে বাইরে থেকে তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। পুরো পিলখানা জুড়ে চলছিলো গোলাগুলি। সকাল থেকেই স্থানীয় সাংসদ আর জনপ্রতিনিধিরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করছিলেন। দুপুরের মধ্যে পিলখানার চারপাশে সশস্ত্র অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী।
দফায় দফায় বৈঠক
ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের একটি দল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠক করে অস্ত্রসমর্পণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা তা করেনি। বিকেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ধ্যা থেকে পাশের একটি হোটেলে চলে দফায় দফায় বৈঠক।
উদ্ধার তৎপরতা
পরে রাত ১টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি দল প্রবেশ করে পিলখানার ভেতরে। বিডিআরের কিছু সদস্য অস্ত্রসমর্পণ করেন। ভোরের দিকে কয়েকটি পরিবারকে উদ্ধার করেন তারা। তখনো থেমে থেমে চলছিলো গোলাগুলি।
পরদিন সকাল থেকে একে একে উদ্ধার করা হয় পিলখানায় আটকে পড়া মানুষদের। দুপুর বেলা বিদ্রোহীরা অস্ত্রসমর্পণ করতেই চারপাশে অবস্থানরত সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ে ভেতরে। সঙ্গে পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেডসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা নাগাদ পিলখানা থেকে উদ্ধার করা হয় ৫৭ সেনা কর্মকর্তার লাশ।
ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ
পিলখানায় দরবার শুরুর পরপরই সেখানেই প্রথম বিদ্রোহ করে সিপাহী মইন। তাকে নিরস্ত্র করার পরপরই শুরু হয় সশস্ত্র বিদ্রোহ। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো পিলখানার ৪ বর্গ কিলোমিটার সংরক্ষিত এলাকায়। আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে এবং টানা তিন দিন ধরে একের পর এক দেশের বিভিন্ন বিডিআর স্থাপনা থেকে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। বিডিআরের মোট ৪৬টি ব্যাটালিয়নের মধ্যে ৪৩টিতেই জওয়ানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্বীকার করেন সেনা অফিসারদের কর্তৃত্ব।
তবে ঢাকার বাইরে এসব বিদ্রোহে কোনো রক্তপাত হয়নি। আর বিদ্রোহ করেননি কুমিল্লা, চট্টগ্রাম আর রাঙামাটির বরকল ও কাপ্তাই ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা।
ঢাকার বাইরে ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ১২টার দিকে খুলনা ব্যাটালিয়নে প্রথম উত্তেজনা দেখা দেয়। এক ঘণ্টার মধ্যে বিদ্রোহ করেন পুরো ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা।
পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থকে ১০টার মধ্যে প্রায় একই সঙ্গে বিডিআরের ৪৬ ব্যাটালিয়নের ৩৮টি ব্যাটালিয়নেই বিদ্রোহ করেন বিডিআর সদস্যরা।
প্রথমে কক্সবাজারের টেকনাফে বিডিআর সদস্যরা দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাদের আটকের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন। এরপর রাঙামাটির রাজনগর, ম্যারিশ্যা ও ছোট হরিণা ক্যাম্পে বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা পুরো ব্যাটালিয়নের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নেন।
প্রায় একই সময়ে খাগড়াছড়ি সদর ও রামগড় ব্যাটালিয়নে বিদ্রোহ শুরু হয়। রামগড়ের বিডিআর জওয়ানরা দফায় দফায় গুলি ছুড়ে পুরো ক্যাম্প দখলে নেন। তবে এ সময় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
সাতক্ষীরার নীলডুমুর ক্যাম্পেও বিদ্রোহের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের জওয়ানরা পিলখানার বিদ্রোহীদের সঙ্গে একাত্বতা ঘোষণা করেন। চুয়াডাঙ্গার ক্যাম্প ও স্থাপনাগুলো দখলে নেন জওয়ানরা।
কুষ্টিয়াতেও জওয়ানরা গৃহবন্দি করে রাখে সেনা কর্মকর্তাদের। রাজশাহী ব্যাটালিয়নের জওয়ান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি ব্যাটালিয়নের ২টি ক্যাম্পে বিডিআর সদস্যরা নিজেদের কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেন।
যশোরে বিদ্রোহ হলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
বান্দরবানের বিডিআর রিক্রুট ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড স্কুল, নাইক্ষ্যংছড়ি ও বলিপাড়ায় জওয়ানরা রক্তপাত না ঘটালেও কমাণ্ডিং সেনা অফিসারদের আটক করে রাখেন।
সিলেটের শ্রীমঙ্গল ও আখালিয়ায় ২৬ তারিখ উত্তেজনা থাকলেও বিদ্রোহ হয় ২৭ তারিখে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলেও বিদ্রোহ হয় একইদিন।
তবে চট্টগ্রামের হালিশহর, রাঙামাটির বরকল ও কাপ্তাই এবং কুমিল্লার ৩৩ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সদস্যরা বিদ্রোহে অংশ নেননি।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আইন সংশোধন করা হয় এবং নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সেইসঙ্গে তাদের পোশাকেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।
দিনটি উপলক্ষে সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। শুক্রবার সকালে বনানীতে সামরিক কবরস্থানে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের সমাধিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও তিন বাহিনীর প্রধান তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানান। সেখানে নিহত কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
সূত্রঃ
দেশ টিভি খবর