Friday, February 18, 2011

পুংলিঙ্গ কেটে বানানো হচ্ছে হিজড়া

1 comments
আমরা যাদের হিজড়া বলে জানি বা চিনি তারা কি আসলেই হিজড়া? দেহাকৃতি হিজড়ার মতো হলেও তাদের অধিকাংশই এক সময় সাধারণ মানুষ ছিল। কিন্তু লিঙ্গ কর্তনের মধ্য দিয়ে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়।

রাজধানীর শ্যামলী, ঢাকা জেলাধীন ধামরাই ও খুলনার ফুলতলায় কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিকে পেশাদার ও ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের দিয়েই পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরি করা হয়। এসব ক্লিনিক যেন এক একটি হিজড়া তৈরির কারখানা। হিজড়া নামের আড়ালে লিঙ্গ কর্তন করা হাজার হাজার পুরুষ ঢাকাসহ সারাদেশে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন-খারাবিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজির টাকায় গড়ে তুলেছে বাড়ি-গাড়ি। অঢেল সম্পদ। ঢাকায় বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এই হিজড়ারা নিয়োগ দিয়ে রেখেছে নিজস্ব সোর্স। ওই সোর্সের মাধ্যমেই কোনো নবজাতক জš§গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তারা খবর পেয়ে যায়। আর সে তথ্যের ভিত্তিতে বেঁধে দেয় চাঁদার পরিমাণ। তারা দলবদ্ধভাবে নবজাতকের পরিবারের উপর হামলে পড়ে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোন চক্রের খপ্পরে পড়ে বা স্বেচ্ছায় লিঙ্গ কর্তনকারী হিজড়াদের সঙ্গে অপরাধীদেরও যোগসাজশ রয়েছে। হিজড়া পরিবারের কাছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার এলাকার লোকজনও তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। ফলে এরা একবার যখন বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, তখন আর ফেরার উপায় থাকে না। এ কারণে বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে মিশে যে কোন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পতিতাবৃত্তির সঙ্গেও তাদের অনেকে জড়িয়ে পড়েছে। লিঙ্গ কাটা হিজড়াদের তাণ্ডবে জš§গতভাবে পৃথিবীতে আসা হিজড়ারাও কখনওবা অসহায় হয়ে পড়ে। সরকারের বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনীও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আবার হিজড়াদের অসহায় জীবন নিয়ে তারা নিজেরাও খুব যে সুখী তা নয়। চক্রের পেছনে পড়ে তারা নিজেরাও সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। না বলা কষ্টও রয়েছে তাদের। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তাদের বিষয়ে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। পুংলিঙ্গ কর্তন করে হিজড়ায় পরিণত করার বিষয়টি লিঙ্গ কর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সার্জিক্যাল চিকিৎসকরাও স্বীকার করেছেন। সার্জিক্যাল ক্লিনিকে পুংলিঙ্গ কেটে বিশেষ বিশেষ ওষুধ সেবনের মধ্য দিয়ে তাদের লিঙ্গ কর্তন এবং শারীরিক অবয়বে পরিবর্তন আনা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, লিঙ্গ কর্তনকারী হিজড়াদের মধ্যে খোদ রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। রাজধানীসহ সারাদেশে অশিক্ষিত, অভাবী ছেলেদের পাশাপাশি যেসব ছেলের একটু মেয়েলি ঢং রয়েছে এবং যেসব ছেলে বা পুরুষ সমকামিতায় আসক্ত তারা নানা ফাঁদে পড়ে বা প্রলুব্ধ হয়ে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়। তাদের সংগ্রহের জন্য রয়েছে দালাল চক্র। আবার চিহ্নিত কিছু হিজড়া নেতাও ওইসব ছেলেদের হিজড়া বানাচ্ছে। যারা হিজড়া হচ্ছে তারা সবাই ৩০ বছর আগেই এই অপকর্ম সেরে ফেলছে। যেসব হিজড়া পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছে, তারা সবাই হিজড়া হওয়ার পর পাল্টে ফেলে বাবা-মায়ের দেয়া নাম। হিজড়ার এ তালিকায় থাকা অনেকের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন থাকলেও সহজ পথে, অল্প সময়ে এবং নিরাপদে অর্থ আয়ের জন্য এ পথ বেছে নিয়েছে। তবে তাদের অনেকেই এখন অনুতপ্ত। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাইলেও আর সম্ভব নয়। তাদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংগঠন, সমাজবিজ্ঞানী ও হিজড়া সংগঠনের কর্মকর্তারাও এসব ঘটনা স্বীকার করেছেন। এমনকি লিঙ্গ কর্তনকারী চিকিৎসকরাও যুগান্তরের কাছে এসব নির্মম ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন।
আপন, রহিমা, নাছিমা, জনা ও জয়াদের হিজড়া হওয়ার পেছনের কথা : জনার আগের নাম ছিল জাহাঙ্গীর। মানিকগঞ্জ জেলাধীন দৌলতপুর থানার দৌলতপুর পিএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র। দেখতে বেশ সুন্দর। নাদুস-নুদুস চেহারা। হঠাৎ করে একদিন নিখোঁজ। তার বাবা-মা দিশেহারা হয়ে পড়লেন ছেলে কোথায় গেল। সব আÍীয়-স্বজনের বাসায় খোঁজ করা হল। কিন্তু সন্ধান মেলে না। থানায় দায়ের করা হলো সাধারণ ডায়েরি। কিন্তু পুলিশও তার কোন হদিস পায়নি। আড়াই বছর আগের ঘটনা। এক রাতে জাহাঙ্গীর মানিকগঞ্জের ধনাই গ্রামে বাবার বাড়ি এসে হাজির। কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তার কান্না থামতেই চায় না। তাকে অনেক বুঝানোর পর সে জানায়, হিজড়াদের একটি চক্র তাকে স্কুলের সামনে থেকে ফুসলিয়ে খুলনা ফুলতলা নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তাকে একটি ক্লিনিকে ঢোকানো হয়। চিকিৎসকের হাতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। জাহাঙ্গীর আঁতকে ওঠে। তাকে উলঙ্গ করে অস্ত্রোপচার বেডে চিৎ করে শোয়ানো হয়। জাহাঙ্গীর বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে। কিন্তু হিজড়া বাহিনী পিছু ছাড়ে না। তারা চাপ দেয় ডাক্তারকে। ব্যস। জাহাঙ্গীরের পুংলিঙ্গ কাটা পড়ল। সে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। জ্ঞান ফেরার পর তাকে কিছুদিন চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর তার নামকরণ করা হল জনা। সেই থেকে সে জনা হিজড়া। জাহাঙ্গীরের এক ভাই কাইয়ুম। থাকেন ঢাকায়। কাজ করেন ১৯২, ফকিরাপুলের একটি ছাপাখানায়। সেখানে গিয়ে কাইয়ুমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, জাহাঙ্গীরের বয়স যখন ১৪ বছর তখন সে একটি চক্রের খপ্পরে পড়ে হিজড়াদের খাতায় নাম লেখায়। আমাদের ভাইদের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। সবার আদরের। কিন্তু তার লিঙ্গ কেটে হিজড়া হওয়ার পর সে আর বাড়িমুখী হয়নি। মাঝে মাঝে রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে আসে। মা-বাবাকে এক নজর দেখে আবার চলে যায়। তার জন্য আমাদের পুরো পরিবারকে আজ চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে একই শ্রেণীতে পড়তো শাওন। সে জানায়, জাহাঙ্গীর ভালো ছাত্র ছিল। সে হিজড়া হয়েছে এটা শুনে আমরা সবাই খুব দুঃখ পেয়েছি। জাহাঙ্গীর এখন জনা হিজড়া নামে পরিচিত। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সে নিজের ছবি পত্রিকায় না দেয়ার শর্তে যুগান্তরকে বলে, এটা আমার ভাগ্যে ছিল। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার কারণে আমার এই জীবনের আর কোন মূল্য নেই।
আপন হিজড়া : সোহেল মাহমুদ। এখন আপন হিজড়া। বয়স ২৭ বছর। তার পিতার নাম সিরু খাঁ। গ্রামের বাড়ি ভোলায়। বর্তমানে তার বাবা-মা ও ভাইবোন থাকেন দক্ষিণখান থানার ফায়দাবাদ এলাকায়। সে থাকে শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পেছনে বাউনিয়া এলাকায়। ফায়দাবাদ এলাকার জয়নাল মাতব্বরের বাড়িতে ১ বছর আগে ভাড়ায় থাকত আপনরা। গত ১৫ মার্চ ফায়দাবাদের ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় এলাকার আবদুস সালাম, লাইলী বেগম ও রেহেনাসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা যুগান্তরকে জানান, আপনরা দুই ভাই ও ৪ বোন। তার বড় ভাই সুজন গাড়িচালক। এক বোন রেনু ৮ মাস আগে লেবাননে গেছে। আপন (সোহেল) যখন ৮ম শ্রেণীতে পড়তো, তখন সে হিজড়াদের সঙ্গে মেশা শুরু করে। লাইলী বলেন, একদিন আমার মেয়ে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সোহেলকে হিজড়াদের সঙ্গে নাচতে দেখে আমাকে এসে ঘটনা বলে। সে দিনই আমি জানলাম সে হিজড়াদের সঙ্গে চলাফেরা করে। মাঝেমধ্যে হিজড়াদের বাসায় নিয়ে আসত। আমরা তখনও বুঝেনি সে হিজড়ার খাতাই নাম লেখাবে। প্রায় ৮/৯ বছর আগে সোহেল হিজড়া হয়েছে। হিজড়া হওয়ার পর সে বাড়ি থাকত না। হিজড়াদের সঙ্গে থাকত। মাঝেমধ্যে বোরকা পরে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত। এখন আর আপনকে দেখি না। কারণ তার মা-বাবা এলাকা ছেড়ে দিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আপনের বাবা-মা লোকলজ্জার কারণে ফায়দাবাদের অন্য একটি বাড়িতে ভাড়া নেয়। ৪২ নং ফায়দাবাদের ওই বাড়িটি আরিফ নামের এক ব্যক্তির। সেখানে গিয়ে জানা যায়, আপনের কারণে তার বাবা-মা সেখান থেকে বাসা পাল্টিয়ে আবদুল্লাপুর আদম আলী মার্কেটের কাছে ভাড়া নিয়েছে।
অনুসন্ধানকালে আপনের সন্ধান পাওয়া যায়। তখন তারা ৭/৮ জন মিলে চাঁদার টাকা সংগ্রহ করে বাসায় ফিরছিল। ১৫ মার্চ দুপুরের ঘটনা। উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের জহুরা মার্কেটের সামনে কথা হয় আপন হিজড়ার সঙ্গে। সে যুগান্তরকে জানায়, বাউনিয়া এলাকায় একসঙ্গে তারা প্রায় ১৫ জন হিজড়া থাকে। তার দেয়া তথ্যমতে, একসঙ্গে থাকা সবাই লিঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছে। সে জানায়, আমিও ছেলে হয়েই জšে§ছিলাম। আমি আবদুল্লাহপুর মালেকাবানু আদর্শ বিদ্যা নিকেতনে পড়তাম। সেখান থেকে এসএসসি পাস করেছি। ২০০১ সালে আমি বাড়ি ছেড়ে হিজড়াদের সঙ্গে চলে আসি। এরপর ২০০৪ সালের দিকে খুলনার ফুলতলার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে লিঙ্গ কেটে ফেলি। এখন আমি পুরোপুরি হিজড়া। তবে আমার বাবা-মা, ভাই-বোনের সঙ্গে এখনও সম্পর্ক আছে। আমার আয়ের একটা বড় অংশ বাবা-মাকে দিই। আপন বলে, রাস্তায় আমার মায়ের সঙ্গে দেখা হলে মা কথা বলে না। আমাকে দেখলে কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখ লুকায়। আমি হিজড়া হয়েছি এতে আমার মা-বাবা লজ্জা পায় সমাজে। আমার এক বোন লেবাননে থাকে। আরেক বোন উত্তরায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। এসব বলতে বলতে চোখের পানি ছেড়ে দেয় আপন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাই রাতে। তাও আবার বোরকা পরে। মানুষ আমাকে দেখলে বাসায় এসে ভিড় জমায়। মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে খোলামেলা মিশতে, তাদের সঙ্গে থাকতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু এই ইচ্ছা আর পূরণ হওয়ার নয়।
রহিমা হিজড়ার কথা : নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মিজমিজি গ্রামে বাড়ি ছিল রহিমের। তারা দুই ভাই আর এক বোন। বেশ কয়েক বছর আগে রহিম থেকে রহিমা হয়ে যায় মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। এখন পুরোদস্তুর মেয়ের মতো দেখালেও রহিমা লিঙ্গ কর্তন করা একজন হিজড়া। রহিম থেকে রহিমা হিজড়া। এরপর সে আর বাড়ি যায় না। থাকে রাজধানী সংলগ্ন কাঁচপুরে। গত ১০ মার্চ রহিমার সঙ্গে কথা হয়। রহিমা জানায়, বাবা-মায়ের ছোট ছেলে ছিলাম আমি। আমার নাম ছিল রহিম। শখ ছিল পাখি শিকারের ও নাচ-গানের। তরুণ বয়সেই আমি সমকামিতায় আসক্ত হয়ে পড়ি। তখন আমার বয়স ১৫ কি ১৬ বছর। নারায়ণগঞ্জের খালেক নামের এক হিজড়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরিচয়ের অল্পদিনের মধ্যে তার সঙ্গে অনেক বেশি অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ি। আমাকে হিজড়া হওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে লাগল খালেক। আমিও তার কথায় রাজি হয়ে যাই। সেই থেকে হিজড়া। সে জানায়, ভারতের বিহার প্রদেশের পাটনা-ছাপড়া এলাকায় গিয়ে সে তার লিঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে এসেছে। সেই সময় সে প্রচুর পরিমাণে ওষুধ সেবন করেছে। সে যুগান্তরকে জানায়, পরবর্তীতে আমি ভারতে গিয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় অপারেশন করে স্ত্রী লিঙ্গ বানিয়ে নিয়ে এসেছি। জীবনের এ পর্যায়ে এসে আজ আমি অনুতপ্ত। যে ভুল করেছি তার মাশুল দিতে হচ্ছে সারাজীবন। এখন আমি মা-বাবা, ভাই-বোন, আÍীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন। না আছে সংসার, না আছে আÍীয়-স্বজন।
নাছিমা হিজড়ার কথা : বাবা-মায়ের দেয়া নাম আসিফ। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে। দুই ভাই, দুই বোন। বাবা দরিদ্র কৃষক। সংসারের অভাব ঘুচাতে ২০০১ সালে ঢাকায় আসে। তখন বয়স ছিল ১৬ বছর। কাজ নেয় ফকিরাপুলের একটি ছাপাখানায়। নাছিমা বলে, ছাপাখানায় কাজ করার সুবাদে পরিচয় হয় আরিফা নামের এক হিজড়ার সঙ্গে। আরিফা আমাকে নিয়ে যায় তাদের গুরু মায়ের কাছে। গুরু মা আমাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে প্রেসের কাজ ছেড়ে হিজড়া সম্প্রদায়ে আসতে বলে। আর এজন্য তিনি সব খরচ বহন করবেন বলে জানায়। ২০০৩ সালের শুরুর দিকে গুরু মা আমাকে খুলনার ফুলতলার একটি ক্লিনিকের কর্মচারী রফিকের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে একটি ক্লিনিকে ঢুকানো হয়। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে। জ্ঞান ফেরার পর দেখি পুরুষাঙ্গ নেই। ব্যান্ডেজ করা। এরপর গুরু মা আমার নাম দেয় নাছিমা। বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে আমি স্তন বড় করেছি। নাছিমা এখন মতিঝিল এলাকার হিজড়া। যাত্রাবাড়ী এলাকার হিজড়াদের নেতা দিপালীর এক শিষ্য বৃষ্টি। সেও গত ফেব্র“য়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ধামরাই রোম আমেরিকান হাসপাতাল থেকে লিঙ্গ কাটায়।
আবুল হিজড়া : যাত্রাবাড়ী ধলপুর লিচুবাগানে থাকে আবুল হিজড়া। সে যাত্রাবাড়ী এলাকার হিজড়াদের দলনেতা। আবুল হিজড়ার ভাগ্নে রবিন যুগান্তরকে জানায়, আবুল হিজড়া আমার ছোট মামা। আমার আম্মার কাছে শুনেছি, মামা ২০ বছর বয়সে লিঙ্গ কেটে হিজড়া হয়ে যায়। এ কারণে মামা বিয়ে করতে পারেনি। একটি মেয়ে ও একটি ছেলে দত্তক নিয়ে মানুষ করছে। মনু হিজড়ার খপ্পরে পড়ে আবুল হিজড়া হয়েছে বলে জানা যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, স্ত্রী-সন্তান রয়েছে এমন হিজড়ার সংখ্যাও কম নয়। তাদেরই একজন মগবাজার এলাকার হান্নান। এমন আরেকজন হলো বাড্ডা এলাকার পলি হিজড়া। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। সেখানে তার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। বনশ্রী এলাকার বিউটি হিজড়ার আসল নাম ফালা হোসেন। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে। সেখানে তার এক ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে। বিউটি হিজড়া স্ত্রীর কাছে প্রতিমাসে টাকা পাঠায়। বরিশাল জেলার রাজ্জাক। কামরাঙ্গীরচর এলাকার রিজিয়া হিজড়া। তার দুই ছেলে আছে। গাজীপুর বোর্ডবাজার এলাকার লাইলীও স্ত্রী-সন্তান রেখে হিজড়ার খাতায় নাম লিখিয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। সেখানে তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে থাকে।
হিজড়াদের সঠিক পরিসংখ্যন নেই : হিজড়াদের কাজ করেন এমন সংগঠন বা সমিতির কাছে এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও হিজড়াদের কোন পরিসংখ্যন নেই। হিজড়াদের সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় ৪০ হাজার থেকে দেড় লাখ এমএসএম (পুরুষ সমকামী) রয়েছে। সারাদেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজার। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে ৫০ হাজার হিজড়া রয়েছে। অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানী ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস যুগান্তরকে জানান, ডেমোগ্রাফি সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে সমকামী ও হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এর মধ্যে ঢাকায় হিজড়ার সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। ঢাকায় সমকামীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ।
যেখানে কাটাকাটি হয় : ঢাকা জেলার ধামরাই এলাকার রোম আমেরিকান হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে প্রতিমাসে ৪/৫ জনকে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীর শ্যামলী ও খুলনার ফুলতলার কয়েকটি ক্লিনিকেও লিঙ্গ কেটে হিজড়া করা হয়। হিজড়াদের দলনেতারা নানা প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সের ছেলেদের ওইসব হাসপাতালে নিয়ে তাদের হিজড়া বানিয়ে নিজেদের দল ভারি করছে। রোম আমেরিকান হাসপাতালে পুরুষাঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে হিজড়া বানানো হয় এমন অভিযোগ পেয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে ওই হাসপাতালে অনুসন্ধান চালানো হয়। ১২ মার্চ ধামরাই থানা বাসস্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে জানা যায় লোমহর্ষক এ ঘটনার সত্যতা। থানা বাসস্ট্যান্ডে থেকে ৫০ গজ দূরে মানিকগঞ্জ-ঢাকা প্রধান সড়কের পাশেই ‘রোম আমেরিকান হাসপাতাল’ অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই হাসপাতালের মালিক ডাক্তার গোলাম রহমান শাহজাহান নিজেই হিজড়া বানান। কর্মচারী মোশারফ যুগান্তরকে জানান, প্রায়ই এ হাসপাতালে ছেলেরা এসে কিসব অপারেশন করে। এ জন্য ডাক্তার ১৫/২০ হাজার টাকা নেয়। হিজড়ারা তাদের নিয়ে আসে। গত ফেব্র“য়ারির মাঝামাঝিতে হিজড়াদের একটি গ্র“প একজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। পরে আরেক গ্র“প এসে মারামারি করে। প্রায় ৫০/৬০ জন হিজড়া সেদিন হাসপাতালে এসেছিল। পরে জানা যায়, ওই ছেলেটির নাম রাখা হয়েছে বৃষ্টি। জানা যায়, ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। চাকরির পাশাপাশি এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এলাকাবাসী মানিক জানান, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে এ হাসপাতালটি থানা রোডের লুৎফর নায়েবীর ৩ তলায় শুরু করেন ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান। আনিছ নামের এক ব্যক্তি জানান, ওই ক্লিনিকে সাধারণ কোন রোগী যান না। মূলত লিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরিই ওই ডাক্তারের মূল কাজ। সূত্র জানায়, একই কায়দায় খুলনা ফুলতলার একটি ক্লিনিকে লিঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হয়। এছাড়া রাজধানীর শ্যামলী এলাকায়ও একটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখানে লিঙ্গ কাটতে গিয়ে এক যুবকের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। তবে ওই ক্লিনিকটি কিছুদিন আগে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে রোম আমেরিকান হাসপাতালের কর্ণধার ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান যুগান্তরের কাছে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমি তো জোর করে কারও পুংলিঙ্গ কাটি না। ছেলেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এসে পুরুষাঙ্গ কাটতে বলে। তিনি নিজেই কিছু তথ্য দেন। তিনি জানান, প্রতিমাসে ৩/৪ জন ছেলেকে অপারেশনের জন্য হিজড়ারা ধরে নিয়ে আসে। এরা আমার কাছে রোগী। কত দিন ধরে এ ধরনের কাজ করছেন এবং এ পর্যন্ত কতজনের পুরুষাঙ্গ কেটেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা থেকেই পুরুষাঙ্গ কাটা হয়। প্রতিমাসে রোগী আসে। তবে এর সঠিক হিসাব জানা নেই। এসব অপারেশন করতে ১০ হাজার টাকা নিই। লিঙ্গ কাটতে গিয়ে কেউ মারা গেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার হাসপাতালে কেউ মারা যায়নি। শ্যামলীর একটি ক্লিনিকে পুরুষাঙ্গ কাটতে গিয়ে একজন মারা গেছে।
পুলিশের ভাষ্য : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম অভিনব পন্থায় হিজড়া তৈরির খবর শুনে বিস্মিত হন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া বানাচ্ছে এ ধরনের কোন অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারও অঙ্গহানি করা পেনালকোডে ৩২৬ ধারায় অপরাধ।
বিশেষজ্ঞদের কথা : হরমোন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোঃ হাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হলে তাদের জীবনে ভয়াবহ ঝুঁকি থাকে। দেহের হাড় ক্ষয় হয়, শারীরিক শক্তি কমে যায়। এছাড়া নানা রোগের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে হিজড়া বলতে তাদের বোঝায় যারা শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে নিজেদের মেয়ে ভাবে, মেয়েদের পোশাক পরতে ও মেয়েদের মতো ব্যবহার করতে পছন্দ করে। এটা হরমোনজনিত বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, জাতীয় এইডস বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস যুগান্তরকে বলেন, লিঙ্গ কাটলে তাদের হিজড়া বলা যাবে না। তারা হল বিকলাঙ্গ। লিঙ্গ কাটার কারণে ওই ব্যক্তি পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, সাাংস্কৃতিক সমস্যা ও হীনমন্যতায় ভুগবে। সমাজ তাকে দূরে রাখবে। লিঙ্গ কাটা সমাজে মারাÍক ধরনের অপরাধ। এর সঙ্গে যে দুষ্টচক্র জড়িত তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল হওয়ার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে দুষ্টচক্রটি। রাষ্ট্রকে এর বিহিত করতে হবে, নইলে সমাজ অধপতনের দিকে ধাবিত হবে।
পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহাসচিব অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা যুগান্তরকে বলেন, তার জানামতে, অনেক ছেলে স্বেচ্ছায় হিজড়া হচ্ছে। জয়া হিজড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ছেলে জয় পুংলিঙ্গ কেটে এখন জয়া। তাকে নিয়ে আমি টেলিভিশনে একটি প্রোগ্রামও করেছি। পরে জেনেছি তার হিজড়া হওয়ার কাহিনী। তাদের নিয়ে আলাদা কোন আইন নেই।

-বকুল আহমেদ। যুগান্তর

1 comments:

Post a Comment