Monday, February 21, 2011

রহস্যময় তরুণীর মোবাইলের কল লিস্ট থেকে ক্লু উদঘাটন

36 comments
রাজধানীর দারুস সালাম থানার পুলিশ তরুণ ব্যবসায়ী কামরুল হাসান (৩৫) হত্যাকাণ্ডের ক্লু এক রহস্যময় তরুণীর মোবাইল ফোনের কললিস্টের মাধ্যমে উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে রহস্যময় তরুণীসহ হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মাজেদুল হক ও জড়িতদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে জড়িয়ে একজন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সাক্ষী হিসাবে তিনজন জবানবন্দি দেয় একই আদালতে। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত বটিসহ সকল আলামত পুলিশ জব্দ করেছে। সাবিনা আকতার নামের এই রহস্যময় তরুণী একটি বেসরকারি ল' কলেজের ছাত্রী। তার সঙ্গে নিহত ব্যবসায়ী কামরুল হাসান ও প্রধান আসামি মাজেদুল হকের গভীর সম্পর্ক ছিল। সাবিনা দুইজনের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক বজায় রেখে বিনিময়ে দুইজনের কাছ থেকেই মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিত। এটা তার মূল ব্যবসা। গত শুক্রবার দারুস সালাম থানার ওসি আব্দুল মালেক, অপারেশন অফিসার এসআই মোঃ আবু সালাম ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোকাম্মেল হক তরুণ ব্যবসায়ী কামরুল হাসান হত্যার রহস্য উদঘাটন এবং জড়িতদের গ্রেফতারের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানান। তাদের ভাষায়, প্রথম দিকে মামলাটি ছিল ক্লু বিহীন। পরে অবশ্য কামরুল হাসানের আত্মীয়-স্বজনই সাবিনা ও হত্যাকাণ্ডের মোটিভসহ অন্যান্য বিষয়ে তথ্য জানিয়েছেন।

যেভাবে ব্যবসায়ী হাসানকে খুন করা হয়: পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মাজেদুল হকের দারুস সালাম থানাধীন পশ্চিম শ্যাওড়াপাড়ার ১৫৯/১৬/সি ভবনের নিচতলা এক কক্ষ বিশিষ্ট ভাড়া বাসায় ব্যবসায়ী কামরুল হাসানকে পাওনা টাকা দেয়ার কথা বলে ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর আসার জন্য সংবাদ দেয়া হয়। কামরুল হাসানের ব্যবসায়িক পার্টনার মাজেদুল হক। তারা এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করতো। দুইজনের মধ্যে ছিল গভীর সম্পর্ক। এক বাসায় সাবিনাসহ একাধিক বান্ধবীকে নিয়ে দুই বন্ধু মনোরঞ্জন করতো। ৫ লক্ষাধিক টাকা পাওনা নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে। ঐ রাতে টাকা প্রদানের পাশাপাশি বন্ধু কামরুলের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা ছিল। ঐ দিন সন্ধ্যার পর কামরুল পার্টনার মাজেদুল হকের উক্ত বাসায় যায়। ঐ রাতে মাজেদুল হক, গুলশানের সজিব ও কামরুল মিলে তাস খেলে। সঙ্গে মদ সেবন করে তারা। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এক পর্যায়ে পাওনা টাকা নিয়ে মাজেদুল পার্টনারের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। বটি দিয়ে সজিব কামরুলকে আঘাত করতে থাকে। ঐ সময় বাঁচার জন্য কামরুল বান্ধবী সাবিনাকে দুই দফা তার মোবাইল ফোন থেকে মেসেজ পাঠায়। কিন্তু সাবিনা তাকে রক্ষায় কোন ধরনের সহযোগিতা করেনি। এরপর মাজেদুলও কামরুলের দেহে আঘাত করে। মাজেদুল ও সজিব কামরুলের মৃতু্য নিশ্চিত জেনে আঘাত বন্ধ করে।

লাশ গুমের চেষ্টা: ভোর রাতে মাজেদুল হক ও সজিব মেঝেতে জমা কামরুলের রক্ত পরিষ্কার করে ফেলে। বাসভবনের সিকিউরিটি গার্ড মকবুল হোসেনকে মাজেদুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি জানায়। কিভাবে লাশ গুম কিংবা অন্যত্র ফেলে দেয়া যায় সে বিষয়েও পরামর্শ করে তারা। গার্ড মকবুলকে এ বাবদ মাজেদুল তিন হাজার টাকাও দেয়। এছাড়া পাটের চট কেনার জন্য দেয় আরো একশত টাকা। এই টাকা দিয়ে মকবুল স্থানীয় বাজার থেকে দুইটি পাটের চট ক্রয় করে নিয়ে আসে। বড় বালতির মধ্যে কামরুলের লাশটি হাত-পা বাকা করে ঢুকিয়ে পাটের চট ও কম্বল দিয়ে বস্তাবন্দি করে গার্ড মকবুল। বিকাল ৪টায় মাজেদুল ও সজিবের পূর্ব পরিচিত সিএনজি ট্যাক্সি চালক মাসুদকে সংবাদ দেয়। মাসুদ ট্যাক্সি নিয়ে পশ্চিম শ্যাওড়াপাড়ার মাজেদুলের বাসায় আসে। ঐ সময় তারা একটি বস্তা ট্যাক্সি ক্যাবে উঠায়। চালক মাসুদ বস্তায় কি জানতে চাইলে জবাবে মাজেদুল ও সজিব বলে, বস্তায় বিদেশী মদ রয়েছে এবং তা গাবতলী বাস টার্মিনালে নেয়া হবে। সেখানে অন্য লোক অপেক্ষা করছে। চালক বস্তাসহ মাজেদুল ও সজিবকে নিয়ে গাবতলী বাস টার্মিনালে যায়। সেখানে বস্তাটি নামিয়ে দেয়া হয়। সচিব ট্যাক্সি চালকের সঙ্গে চলে যায়। তবে চালককে বস্তার জন্য তিন হাজার টাকা ভাড়া দেয়। বস্তাটি মাজেদুল একটি রিকশায় তুলে দেয়। রিকশা চালক সুমন আলীকে একটু দাঁড়ানোর কথা বলে মাজেদুল কেটে পড়ে। রিকশা চালক বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকার পর বস্তার মালিক আর আসেনি। বিষয়টি স্থানীয় কয়েক ব্যক্তিকে জানালে তারা বস্তাটি যাচাই করে সন্দেহ হয় যে, এটার ভিতরে মৃত দেহ রয়েছে। সংবাদ পেয়ে দারুস সালাম থানার ওসি ও অপারেশন অফিসার ঘটনাস্থলে গিয়ে বস্তা খুলে একটি ক্ষত বিক্ষত মৃত দেহ দেখতে পান। লাশের সঙ্গে থাকা মানিব্যাগের ভিতর থেকে দুইটি মামলার নম্বর উদ্ধার করেন পুলিশ কর্মকর্তাগণ। এই মামলা দুইটি নথিপত্র যাচাই করে ব্যবসায়ী কামরুলের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার মদ্দেরবাগ ঠিকানা উদ্ধার করে। সংবাদ পেয়ে আত্মীয়-স্বজন কামরুলের লাশ শনাক্ত করেন।

রহস্য উদঘাটন: কামরুলের ব্যবহূত মোবাইল ফোন নম্বরের কললিস্ট দারুস সালাম থানার পুলিশ বের করেন। এর আগে গাবতলী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মেহেদী হাসান বাদি হয়ে দারুস সালাম থানায় কামরুল হত্যা মামলা দায়ের করেন। মিরপুর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার ইমতিয়াজ আলম এই হত্যা মামলা মনিটর করেন। দারুস সালাম থানার ওসির তত্ত্বাবধানে মামলার তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়। কামরুলের মোবাইল ফোনে ঘটনার রাতে দুই মেসেজের সূত্র ধরে সাবিনাকে পুলিশ খুঁজে বের করে। রহস্যময় তরুণী সাবিনা প্রথমে কামরুলের সঙ্গে পরিচয় থাকার বিষয়টি এড়িয়ে যায়। ফোনের কললিস্ট অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গুলশান থেকে সজিবকে গ্রেফতার করে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সাবিনাকে এবং পরে মাজেদুলকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। সাবিনা পুলিশের জেরার মুখে কামরুল ও মাজেদুলের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কের বিষয় এবং উভয় পার্টনারের বিস্তারিত তথ্য জানায়। ঘটনার রাতে কামরুল তাকে দুই দফা মেসেজ পাঠানোর কথা পুলিশের কাছেও স্বীকার করে। সাবিনার কাছ থেকে মাজেদুলের দেয়া ৪ লাখ টাকার একটি চেকও পুলিশ জব্দ করে। পরে মাজেদুল, সজিব ও সাবিনাকে রিমান্ডে নিয়ে দারুস সালাম পুলিশ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে মাজেদুল ও সজিব হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল বিষয়ে বর্ণনা দেয়। মোটিভ সম্পর্কে তারা পুলিশকে জানিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী পুলিশ মাজেদুলের বাসায় গিয়ে গার্ড মকবুলকে আটক করে। মকবুল ও মাজেদুল এবং সজিব কামরুলকে হত্যা এবং লাশ গুম করার চেষ্টার বিষয়টি পুলিশকে জানায়। ঐ বাসা থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত বটি ও রক্তমাখা কামরুলের প্যান্ট, শার্ট উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে সজিব আদালতে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সাক্ষী হিসাবে বাড়ির গার্ড মকবুল, রিকশাচালক সুমন আলী ও ট্যাক্সি চালক মাসুদ আদালতে জবানবন্দি দেয়।
সজিব ও সাবিনাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়। মাজেদুলকে দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দারুস সালাম থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করে। আজ রবিবার দ্বিতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর হতে পারে বলে পুলিশ জানায়।

সূত্রঃ ইত্তেফাক

36 comments:

Post a Comment