Tuesday, February 15, 2011

সারদাহ কুঠি

0 comments
আধুনিক রাজশাহী শহর গড়ে ওঠার পেছনে ওলন্দাজ বা ডাচ বণিকদের রয়েছে অনন্য অবদান। তাদের তৈরি সারদাহ'র কুঠিবাড়ি আজকের বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী। রাজশাহীর সারদায় এর অবস্থান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএস'র পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবর রহমানের মতে_ রাজশাহীর বড়কুঠি নির্মিত হয় সপ্তদশ শতকের শেষদিকে। ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। চুচড়া'র ওলন্দাজ গভর্নর ভেন ডেন ব্রোক ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রথম মানচিত্র তৈরি করেন। এ মানচিত্রে পদ্মার তীরে বোয়ালিয়ার নাম উল্লেখ রয়েছে। ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজদের ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে বাণিজ্য ফরমান লাভ করায় তাদের বাণিজ্যের বৃদ্ধি ঘটায়। তারা রেশম ব্যবসা করতে বোয়ালিয়ায় আসে এবং এখানে নির্মাণ করে বড়কুঠি। তাদের এ রেশম ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই রাজশাহী শহরের গোড়াপত্তন ঘটে। ওই গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে, পলাশীর যুদ্ধের পর ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধ হলে ডাচরা পরাজিত হয়। তারপরও তারা নিজ শক্তিবলে রাজশাহী ও সারদায় রেশম ব্যবসা চালিয়ে যায়। পরে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজরা সুমাত্রার পরিবর্তে ইংরেজদের হুগলির চুচড়া ছেড়ে দেয়। আর রাজশাহী ও সারদাহ'র বড়কুঠি বিক্রি করে দেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। জানা গেছে, 'চার্টার অব অ্যাক্ট' প্রবর্তনের কারণে ব্রিটিশরা ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে এ কুঠিগুলো বিক্রি করে দেয় মেসার্স রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানির কাছে। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ওয়াটসন কোম্পানি এখানে নীল চাষ ও ব্যবসা শুরু করে। এ অবস্থায় এক সময় এখানে কলেরা-মহামারীতে কুঠিয়ালসহ কর্মকর্তারা মারা যান। ধস নামে তাদের ব্যবসায়। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে তাদের কুঠিবাড়ি। এ সময় বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ কোম্পানি হাতবদল হওয়ার পর ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের জমিদারি এস্টেট এটি ক্রয় করে এবং পরে আর্থিক সংকটে ব্যবসা বন্ধ করে দিলে সারদাহ কুঠি পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়। 'বাংলাদেশ পুলিশ, উত্তরাধিকার ও ব্যবস্থাপনা' গ্রন্থে আহমেদ আমিন চৌধুরী বলেছেন, ভারতের পুলিশ বিভাগে অনাচার, অরাজকতা ও দুর্নীতি দেখা দিলে লর্ড কার্জন ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে একটি পুলিশ কমিশন গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী অঞ্চলে একটি পুলিশ অফিসার্স ট্রেনিং কলেজের স্থান নির্ধারণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ পুলিশ সুপার মেজর এইচ চেমনীর ওপর। ভারতের গাজীপুরে কর্মরত এ ইংরেজ পুলিশ সুপার রাজশাহী সফর শেষে স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে সারদাহ কুঠিবাড়িকে নির্বাচন করেন। ১৪২ দশমিক ৬৬ একর এলাকাবেষ্টিত এ পরিত্যক্ত কুঠিবাড়িটি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের জমিদারি এস্টেটের কাছ থেকে সরকার ২৫ হাজার টাকায় ক্রয় করার পর এখানে স্থাপন করে সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজ। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে কলেজটি ১০৩ জন কনস্টেবল, ৭ জন সহকারী পুলিশ সুপার ও ২৫ জন ক্যাডেট সাব ইন্সপেক্টরকে প্রশিক্ষণদানের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। ১৯৫০ সালে প্রিন্সিপালের পদটি ডিআইজিতে উন্নীত করা হয়। তারপর এটি উপমহাদেশের একটি প্রথম শ্রেণীর পুলিশ ট্রেনিং কলেজ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। ফলে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সালে এ পুলিশ ট্রেনিং কলেজকে একাডেমীতে পরিণত করে। বর্তমানে ঘোড়ার ব্যবহার না থাকলেও ঐতিহ্যগত কারণে সারদাহ একাডেমীতে এখনো অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ জন্য এখানে রয়েছে ৪৯টি ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন বিশাল আকৃতির ঘোড়া। পাশাপাশি দেওয়া হয় অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৩ এপ্রিল সারদাহ দখল করে নেয়। আশপাশের গ্রামের শতাধিক নিরস্ত্র মানুষসহ সারদায় কর্মরত ৪১ জনকে হত্যা করে। এর মধ্যে শিক্ষানবিস অফিসার ছাড়াও ছিলেন পুলিশ সদস্য ও কর্মচারী। সারদাহর ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্যের শহর মুর্শিদাবাদ মোগল আমলে মারাঠা বর্গীদের তাড়ানোর জন্য নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ও আলী বর্দী খাঁর সৈনিকরা মুর্শিদাবাদ থেকে পদ্মার পাড়সহ সারদার বিশাল উম্মুক্ত ময়দানে তাঁবু গেড়ে এখানে অবস্থান করেছিলেন। পুলিশ একাডেমীতে এখন সারদাহ্ শব্দটি লেখা হচ্ছে সারদা।

সারদাহ্ এক সময় বাঘ-ভাল্লুক হিংস্র জানোয়ারের আবাসস্থল ছিল। বাঘ বা শের'র আবাসস্থলের কারণে স্থানটির নামকরণ হয়েছে সারদাহ্। কিন্তু ইতিহাসবিদরা দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিকে অগ্রহণযোগ্য দাবি করে বলছেন_ শুধু সারদাহ্ নয়, প্রাচীনকালে বাংলার প্রায় সর্বত্রই বাঘ বসবাস করত।

শ.ম সাজু, রাজশাহী

0 comments:

Post a Comment