Saturday, February 19, 2011

গণতান্ত্রিক মিসর

0 comments
শেষ পর্যন্ত মিলে গেল ফিদেল ক্যাস্ত্রোর পূর্বাভাস_ 'মোবারকের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে'। সত্যি সত্যি হার মানতে বাধ্য হলেন মোবারক। সেই সঙ্গে হার মানল তিন দশকের একচেটিয়া শাসন,। তবে নীল নদের তীর পুরোপুরি মুক্ত হয়ে গেছে এ কথা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে প্রবল গণবিক্ষোভে অবসান ঘটল ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের। পতন ঘটল বিরাশি বছরের বর্ষীয়ান হোয়াইট হাউস ঘনিষ্ঠ একনায়কের। গণআন্দোলনের মুখে চাপিয়ে দেওয়া শাসন ও শাসক যে টিকতে পারে না এরই প্রমাণ হলো এবার মিসরে। বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করল মিসরে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই। যা নাড়িয়ে দিল বাকি বিশ্বকে। এ বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ওয়ায়েল ঘোনিম। তার ফেসবুক পাতা থেকেই হোসনি মোবারকবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এক পর্যায়ে এ আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাবেক প্রধান এল বারাদি, নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের লোক এ আন্দোলনে অংশ নেন। ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে মিসরের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক মিনিটের ঘোষণায় হোসনি মোবারকের তিন দশকের স্বৈরশাসনের অবসানের কথা জানান। ওমর সুলাইমানের এ ঘোষণার পরপরই সমগ্র মিসরবাসী আনন্দে ফেটে পড়েন। রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষোভকারী একের পর এক স্লোগান, পতাকা নেড়ে, একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ও গাড়ির হর্ন বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। কেবল কায়রোই নয় মিসরের সর্বত্র আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায়। আতশবাজি পোড়ানো এমনকি ফাঁকা গুলি ছুড়েও জনতাকে উল্লাস করতে দেখা যায়। মিশরের এই গণতান্ত্রিক বিজয় সুচনা করেছে এক নতুন ইতিহাস। কিন্তু কেমন ছিল স্বৈরশাসক মোবারকের মিসর?
গত বছর জুনে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ হোসনী মোবারকের দীর্ঘ তিন দশকের স্বৈরশাসন নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়_ 'রাজনৈতিক অনৈক্যকে ক্রমাগত গোপন রাখতে মিসর সরকার বিক্ষোভগুলোকে ছত্রভঙ্গ করছে। মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠনের চরম হেনস্থা করা হচ্ছে। জেলে আটক রাখা হচ্ছে সাংবাদিকসহ মুসলিম ব্রাদারহুড সদস্যদের।'

শুধু তাই নয়। মিসরে গণতন্ত্র শেষ করে দিতে মোবারকের কুকর্মে বাধ্য হয়ে ২০০৮-এ খোদ মার্কিন 'স্টেট ডিপার্টমেন্টের' মানবাধিকার প্রতিবেদনেও লিখতে হয়, 'মিসর সরকারের মানবাধিকারের প্রতি মর্যাদা অত্যন্ত ক্ষীণ। বিভিন্ন এলাকায় এর গুরুতর অপব্যবহার চলছে। ... এই সরকার নাগরিকদের সরকার পরিবর্তনের অধিকারকে সীমিত করে তুলছে, এই লক্ষ্যে জরুরি অবস্থা চালিয়ে যাচ্ছে। যা বলা যায়, ১৯৬৭ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে বলবৎ। নিরাপত্তারক্ষীরা অবাঞ্ছিত লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে জেলে বন্দী এবং বিনাবিচারে আটককৃতদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে।'

আশঙ্কার ব্যাপার হলো মার্কিন প্রশাসন নিজেদের তৈরি প্রতিবেদনে মোবারক জমানার ভয়ঙ্কর ছবি তুলে ধরলেও অন্ধের মতো তাদেরই মদদ দিয়ে এসেছে। ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে মিসরের জন্য বারাদ্দ বার্ষিক ২ লাখ কোটি ডলার। ইসরায়েলের পর এটি দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মার্কিন বরাদ্দ। ১৯৭৯তে ইসরাইয়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় থেকে মিসর পেয়েছে ৬৪ লাখ কোটি ডলার মার্কিন ভর্তুকি। এ তথ্য ২০০৯ এর সেপ্টেম্বরে খোদ মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করা হয়।

উপসাগরীয় যুদ্ধে সমর্থনের জন্যও পুরস্কৃত করা হয় মিসরকে। এপ্রিল ১৯৯১ সালে মওকুফ করা হয় ৭ লাখ কোটি ডলার মার্কিন ঋণ। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতে মিসরের ২০ লাখ কোটি ডলার ঋণের অর্ধেক ভাগ মওকুফেও হস্তক্ষেপ করে মার্কিন প্রশাসন। এ থেকে স্পষ্ট যে, মোবারক সরকারের দুর্নীতি ও ভ্রষ্টতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের শান্তিচুক্তির জন্য মোবারকের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে রণনীতি সম্পর্ক গড়ে তোলে।

৯/১১-এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ দমন অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন মোবারক। ওয়াশিংটন এবং ব্রিটেন যৌথভাবে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে বিনা বিচারে আটককৃতদের বন্দী রাখে মিসরে। খবর বিবিসির ২০০৫-এ। খবরের সত্যতা স্বীকার করে স্বয়ং মিসরের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে জানান, ২০০১ সাল থেকে মার্কিন প্রশাসন শুধু সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে ৬০-৭০ জনকে মিসরে বন্দী রেখেছে। বুশ আমলে প্রচুর প্রশংসা কুড়ায় মোবারক। এমনকি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মোবারকের ভূমিকায় উচ্ছ্বসিত বুশ জনসমক্ষে স্বীকার করেছেন কৃতজ্ঞতা।

বহু আগ থেকেই মিসর যুক্তরাষ্ট্রের রণনীতিগত মিত্র। ২০০৬ সালের মে মাসে মোবারক পুত্র জামাল গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। কেমন আতিথেয়তা পেয়েছিলেন তিনি? ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে প্রকাশ সরকারি কোনো পদাধিকারী নন এমন এক বিদেশি নাগরিকের (জামাল মোবারক) প্রতি এমন শীর্ষস্থানীয় আতিথেয়ার নজির বিরল। উপ-রাষ্ট্রপতি ডিক চেনি, মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট কন্ডোলিসা রাইস এবং মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন হাডলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জামাল। শুধু তাই নয়, এ ব্যক্তিগত সফরে জামালকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ।

পূর্বসূরির 'ওভারকোট' পরে বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার মনোভাবও অপরিবর্তিত। জুন ২০০৯-এ মিসর সফরকালে বেশ জোরালভাবেই বোঝালেন ওবামা। মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে সাম্প্রতি গণবিক্ষোভেও যথেষ্ট সতর্ক ওবামা। তিনি বা তার প্রশাসনের কেউই বিক্ষোভকারীদের নির্বিচারে হত্যার (তিনশ'র বেশি) জন্য মোবারকের সামান্য নিন্দাও করেননি। শুধু সতর্ক বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। মোবারকের শাসনামলের বিরুদ্ধে কোনো শব্দ ব্যবহার না করে মোবারককে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হিংস্র না হওয়ার আবেদন করে দায় সারতে চেয়েছেন ওবামা। গত ছয় দশকের বেশির ভাগ সময় ধরে ওয়াশিংটনের শকুন নজরে মধ্যপ্রাচ্য তথ্য বৃহত্তর মুসলিম দুনিয়া। লক্ষ্য তার বৃহত্তম তেলের ভাণ্ডার। আর সেই লোভেই তারা তৈরি করেছে ইসরায়েল। জুগিয়ে চলেছে ঢালাও সামরিক সাহায্য, অর্থনৈতিক সাহায্য তো বটেই! সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা। যাতে ফিলিস্তিনি নাগরিকরা তাদের জন্মভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকেন।
৩২ বছর আগে ইরান যোগ্য জবাব দিয়েছে ওয়াশিংটনকে। তিউনিশিয়া থেকে মিসর সেই একই শিক্ষা। তবু জনগণের শক্তিকে অগ্রাহ্য করে চলেছেন ওবামা। ভুলে গিয়েছেন ১৭৯৬-এ জর্জ ওয়াশিংটনের বিদায়কালীন সতর্ক বার্তা_ 'ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা থেকে এটাই প্রমাণিত যে, প্রজাতান্ত্রিক সরকারের কাছে বিদেশি শক্তির প্রভাব নিষিদ্ধ প্রতিপক্ষ।'

কায়রোর পথেঘাটে এখন কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, এক মজার ঘটনা। মোবারকের ভাষণ লেখক যখন তার দফতরে গিয়ে বলেন, প্রেসিডেন্ট মোবারক,' এই নিন আপনার জাতির প্রতি বিদায় ভাষণের কপি। তখন মোবারক নাকি বিস্মিত হয়ে বলেন, 'কেন? জনগণ কি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে?'

জর্জ ওয়শিংটন ভুলে গেলেও 'অগ্রণী মিত্র' মোবারকের এই করুণ আর্তি নিশ্চয় পেঁৗছেছে ওবামার কানে।

-রণক ইকরাম

0 comments:

Post a Comment