Thursday, February 3, 2011

টাঙ্গুয়া হাওর

0 comments
নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল_জীববৈচিত্র্যের অনন্য আধার টাঙ্গুয়ার হাওরকে স্থানীয় অধিবাসীরা এভাবেই চেনেন। তাদের এ উপমাতেই লুকিয়ে আছে টাঙ্গুয়ার হাওরের বিশালত্বের বর্ণনা। সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরনা) মিতালি পেতেছে এই হাওরের সঙ্গে। দুই উপজেলার ৫১টি ছোট-বড় বিল নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃতি। হাওরের দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার এবং প্রস্থ সাত কিলোমিটার। বর্ষায় এর আয়তন দাঁড়ায় ২০ হাজার একরের বেশি আর হেমন্তে প্রায় সাত হাজার একর। ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এ হাওরের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ৮৮টি গ্রাম। টাঙ্গুয়ার হাওর এ গ্রামগুলোর মানুষের জীবনের সঙ্গে এক সুতোতেই বাঁধা। বিশ্বের ১ হাজার ৮৮৮টি রামসার সাইটের অন্যতম টাঙ্গুয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। টাঙ্গুয়ার হাওর একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের মুখর ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিরূপ আচরণের ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরের সে রূপে ভাটা পড়েছে। ১৯৯৯ সালে এ হাওরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তারপরও টাঙ্গুয়ার হাওরও চোখ জুড়িয়ে দেয় দর্শনার্থীর। এখনো শীতকালে টাঙ্গুয়ার হাওরের মায়ায় ছুটে আসে অতিথি পাখিরা।
টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার জীববৈচিত্র্যের অন্যতম উপাদান সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত এ পরিযায়ী পাখিরাই। এর বাইরে বাংলাদেশি পাখির আনাগোনা রয়েছে হাওরজুড়ে। সব মিলিয়ে এ হাওরে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। এছাড়াও ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর বাস, এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর।

টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম হলো জলজ উদ্ভিদ। এছাড়া আছে হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলশী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চালি্লয়া ইত্যাদি জাতের উদ্ভিদ। এ হাওরে রয়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির গাছগাছালি। কোলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিলের কারণে টাঙ্গুয়ার হাওর মাদার ফিশারিজ হিসেবেও পরিচিত। বিলুপ্তপ্রায় মহাশোলেরও দেখা মেলে এ হাওরে। বিস্তীর্ণ এ জলাভূমিতে নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ উদ্ভিদের পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় সোয়াম্প ফরেস্টের অস্তিত্ব রয়েছে। নলখাগড়া, হিজল করচ, পাতুরি চাইল্যাসহ নানা প্রজাতির বনজসম্পদ হাওরকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।

জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে প্রায় ১৪১ প্রজাতির মাছ, দেশি প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর পাখি, ১০ প্রজাতির বিলুপ্ত বিদেশি পাখি, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২১ প্রজাতির সাপ, ২০৮ প্রজাতির জলজ ও স্থলজ উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। বিশ্বের বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এখানে। স্থানীয় জাতের পাখিদের মধ্যে রয়েছে শকুন, পানকেঁৗড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক সারস ইত্যাদি। শীতে আসে অতিথি পাখি। জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পর্যটন সম্ভাবনার কারণে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে টাঙ্গুয়ার রক্ষণাবেক্ষণে। হাওর এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষার জন্য ২০০৩ সালে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। যুগ যুগ ধরে হাওরের ওপর নির্ভরশীল লোকদের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলে প্রশাসন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের উন্নয়ন হচ্ছে না। উল্টো নানা বাধা-নিষেধের কারণে হাওর পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা সংশয়ের মুখে পড়েছে।

শাহ দিদারুল আলম, সিলেট

0 comments:

Post a Comment