Thursday, February 3, 2011

শেলাবুনিয়ার নকশিকাঁথা

36 comments
আবহমান গ্রামবাংলার লোকজ ঐতিহ্যগুলোর অন্যতম একটি নকশিকাঁথা শিল্প। শীতের কাঁথা কিংবা বিছানার চাদর অথবা বালিশের কভার হিসেবে নকশিকাঁথার ব্যবহার আমাদের দেশে প্রচলিত। গ্রামবাংলার নারীরা সময় পেলেই বসে যায় সুই-সুতা নিয়ে। তৈরি করে নতুন নকশিকাঁথা।

নিজেদের প্রয়োজনে নকশিকাঁথা অনেকে সেলাই করলেও এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা সংগঠিত সেলাই কেন্দ্র আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।

তবে ব্যতিক্রমী একটি নকশিকাঁথা সেলাই কেন্দ্র গড়ে উঠেছে দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন-সংলগ্ন বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার শেলাবুনিয়া গ্রামে। খুলনা গেলে একবার বেড়িয়ে আসতে পারেন এই সেলাই কেন্দ্র থেকে। দেখে আসতে পারেন গ্রামবাংলার নকশিকাঁথার অন্যরকম এক ভুবন। আর পছন্দ হলে কিনতেও পারেন। অসহায়-দুস্থ নারীদের জন্য শেলাবুনিয়ায় এই সেলাই কেন্দ্রটি গড়েছেন ফাদার মারিনো রিগন। তিনি মংলার সেন্ট পলস গির্জার পুরোহিত। গির্জার আঙিনায় ১৯৮২ সালে গড়া এই সেলাই কেন্দ্রে কাজ করছেন প্রায় অর্ধশতাধিক নারী কর্মী। যারা বেশিরভাগ অসহায়, দুস্থ ও স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা বিধবা।

এখানকার নারী কর্মীরা নকশিকাঁথার নকশায় ফুটিয়ে তোলে আমাদের আবহমান সবুজ-শ্যামল গ্রামবাংলার ফুল, ফল, পাখি, কবিতা, নদী, পালকি, ঢেঁকি, গ্রাম্য বধূ, কৃষক, কৃষাণী কিংবা কাঁচা-পাকা ধানক্ষেত, হাতি, ঘোড়া, বাঘসহ বিভিন্ন পশু-পাখি, রাখাল-গরু, নদী-ঘাট, পালতোলা নৌকা, নৌকা পারাপার, গ্রামীণ নারীদের ধানভানা, ধান শুকানো, আয়না দেখা, চুল বাঁধা, ঢেঁকিতে পার দেওয়া, বধূ সাজে পালকি, কনে দেখা, বিয়েতে হলদি বাটা, মেহেদি বাটা, কনে বরণ, দইওয়ালা, নাগর দোলা, বৈশাখী মেলা অথবা বাংলাদেশের রূপ-বৈচিত্র্য কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে।

শুরুতে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন নারী কর্মী নিয়েই এর যাত্রা। মারিনো রিগন নিজে এসব নারী কর্মী সংগ্রহ করে সেলাই কেন্দ্রে আনেন। তাদেরকে সেলাই বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণও দেন। তবে রিগন এতেতৃপ্তি পেলেন না। ভাবতেন এসব নারী কর্মীকে নকশিকাঁথা বিষয়ে ভালো কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় কিনা। আর তাই খোঁজা শুরু করলেন কে জানে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজ। এর জন্য ছুটে আসেন ঢাকায়। একদিন খোঁজ পেলেন ধানমণ্ডিতে নকশিকাঁথার একটি প্রদর্শনী হচ্ছে। ফাদার হাজির হলেন সেই প্রদর্শনীতে। খুঁজে বের করলেন প্রদর্শনীর প্রধান উদ্যোক্তা শিল্পী সুরাইয়া রহমানকে। সেখানেই ফাদার তাকে প্রস্তাব দিলেন মংলায় গিয়ে তার মেয়েদের নকশিকাঁথা সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিতে। সুরাইয়া রহমান ফাদারের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। বললেন, ঢাকা থেকে মংলায় গিয়ে আপনার মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আমার চাকরিসহ অন্যান্য কাজ রয়েছে। বরং আপনি আপনার কয়েকজন মেয়েকে ঢাকায় আমার কাছে পাঠিয়ে দিন, আমি তাদের প্রশিক্ষণ দেব। পরে তারা মংলায় গিয়ে আপনার অন্য মেয়েদের শিখিয়ে দেবে। এতে ফাদার রাজি হলেন। মংলায় ফিরে গিয়ে তিনি অঞ্জলি ও জুলিয়া নামের দুই মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন সুরাইয়া রহমানের কাছে। তারা নকশিকাঁথার প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে গিয়ে অন্য মেয়েদের শিখাল। তারপর সেখানে চলতে থাকল নকশিকাঁথা সেলাইয়ের ব্যাপক কাজ।

কিন্তু উৎপাদিত এসব নকশিকাঁথা কোথায় বিক্রি হবে কিংবা কারা কিনবে অথবা যারা নকশিকাঁথাগুলো সেলাই করছে তাদের সংসারই বা চলবে কি করে এ নিয়ে কিছুটা হতাশায় পড়ে গেলেন রিগন। কর্মি মালঞ্চকে নিয়ে একসময় ফাদার নিজেই এসব নকশিকাঁথা নিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। যেতে লাগলেন পরিচিতজনদের কাছে। কিছু কাঁথা বিক্রিও হচ্ছে। তবে ফাদার খুঁজছিলেন একটা স্থায়ী পথ। যার মাধ্যমে নকশিকাঁথাগুলো নিয়মিত বিক্রি করা যায়। আর তার এই স্থায়ী পথকে বাস্তবায়িত করতে হাজির হলেন ফাদারের বোন আনুনসিয়েত্তা। ইতালি থেকে ভাইয়ের কাছে বেড়াতে আসেন তিনি। গ্রামবাংলার-মেয়েদের সেলাই করা এসব নকশিকাঁথা দেখে তার পছন্দ হয়ে যায়। তাই ইতালিতে ফেরার সময় তিনি অনেকগুলো নকশিকাঁথা নিয়ে যান। সেগুলো তিনি সেখানে বিক্রি করে বেশ সাড়াও পান। তাই তিনি ভাবলেন ইতালির শিল্পরসিকদের কাছে এসব নকশিকাঁথার খবর পেঁৗছে দেওয়া দরকার। সেজন্য তিনি আয়োজন করলেন নকশিকাঁথার প্রদর্শনী। ১৯৮৬ সালের ২ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ইতালির ভিসেনজা শহরের মনতে ডি পিয়েত্রা হলে এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। আর এর মাধ্যমেই তৈরি হয় সেলাই কেন্দ্রের কাঁথা বিক্রির নতুন পথ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালের ৩ থেকে ১২ মে ভেনিসের লাউরেনতিয়ানুম'র মেসত্রে, ১৯৯৪ সালের ৮ থেকে ১৯ ডিসেম্বর এবং ২০০২ রোমের ডোমাস ম্যারিয়ে অব ক্যাথলিক অ্যাকশন-এ আরও তিনটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এসব প্রদর্শনীতে এখানকার অনেক কর্মীও গেছে। এছাড়া এখানকার নকশিকাঁথা ইতালির বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাতেও ব্যবহার করা হয়েছে। এখন নিয়মিত এখানকার নকশিকাঁথা ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে যায়। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়ও পাওয়া যায় এসব নকশিকাঁথা।

গাজী মুনছুর আজিজ

36 comments:

Post a Comment