Sunday, February 13, 2011

বালিয়াটী জমিদারবাড়ি, মানিকগঞ্জ

0 comments
বালিয়াটীর জমিদারবাড়ি। মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটী গ্রামে এই জমিদারবাড়ির অবস্থান। ঐতিহ্য বুকে ধরে এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। একটি নিম্নবিত্ত সাহা পরিবার থেকেই পরবর্তীতে বালিয়াটী জমিদার বংশের উদ্ভব। মহেশরাম সাহা নামে জনৈক বৈশ্য বারেন্দ্র শ্রেণীর ছোট্ট এক কিশোর ভাগ্য অন্বেষণে বালিয়াটীতে আসে এবং জনৈক পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকরি নেয়। পরে মহেশরামের ছেলে গণেশ রাম লবণের ব্যবসায় উন্নতি করেন। গণেশ রামের চার ছেলের মধ্যে একজন হলো গোবিন্দরাম। তিনি সে বিয়ে করেন বালিয়াটীতে। তার ঘরে জন্ম নেয় চার ছেলে। যথাক্রমে আনন্দরাম, দধিরাম, পণ্ডিতরাম ও গোপালরাম। এই চার ভাইয়ের পৃথক ব্যবসা ছিল। ওই চার ভাই থেকেই বালিয়াটী গোলাবাড়ি, পূর্ববাড়ি, পশ্চিমবাড়ি, মধ্যবাড়ি ও উত্তরবাড়ি নামে পাঁচটি জমিদার বাড়ির সৃষ্টি হয়। আনুমানিক ১৭৯০ সালে ওই চার ভাইয়ের মাধ্যমেই বালিয়াটী জমিদার বাড়ির গোড়া পত্তন হয়।
বালিয়াটীর জমিদার বাড়িতে আছে দৃষ্টিনন্দন ইমারত, নির্মাণ কৌশল আর অলংকরণে অপূর্ব। বিশাল বিশাল ভবন জমিদার আমলে জমিদারদের বিত্তবৈভবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে। জমিদারবাড়ির সিংহ দরজায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে প্রশস্ত আঙ্গিনা। একই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে চারটি বহুতল ভবন। এগুলোর পেছনে জমিদার অন্দরমহল এবং রয়েছে কয়েকটি পুকুর।

লবণের একটি বড় গোলা ছিল বলেই এ বাড়ির নাম গোলাবাড়ি। গোলাবাড়ির চত্বরে দোল পূর্ণিমার ১২ দিন পর বারুণীর মেলা বসত। সেই মেলা এখন বসে বালিয়াটীর পুরনো বাজারে। এ বাড়ির জমিদাররা ছিলেন ধর্মপ্রাণ। বাড়ির মন্দিরে বিগ্রহের পূজা হতো। কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওই বিগ্রহ এবং গোলাবাড়ি পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকাররা লুটপাট করে। জমিদারবাড়ির পশ্চিম অংশে অবস্থিত বলেই এ বাড়ির নাম পশ্চিমবাড়ি। দধিরাম পশ্চিমবাড়ির জমিদারদের পূর্ব-পুরুষ। এই বাড়ির জমিদাররা বাণিজ্যকেন্দ্র সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঝালকাঠী, নলছিটি প্রভৃতি স্থানে লবণ, সুপারি, চাল ইত্যাদি ব্যবসার মাধ্যমে অনেক অর্থের মালিক হন। এদের ঐশ্বর্য বেড়ে উঠলে তারা জমিদারি ও তালুকাদি কিনতে শুরু করেন। এই বাড়ির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে এটি ছিল স্কুল। বর্তমানে এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কলেজে উন্নীত হওয়ার সময় স্কুল শাখা আলাদা হয়। সেটি এখন কে এল জুবিলী হাইস্কুল নামে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এছাড়া ওই জমিদাররা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং পাঠাগার নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

বালিয়াটীর পূর্ব অংশে এ বাড়ির অবস্থান বলেই এ বাড়িটির নাম পূর্ববাড়ি। এ বাড়ির প্রথম জমিদার পুরুষ রায়চাঁন। তিনি দুটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সম্পত্তির দশ আনা অংশ এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তানদের দান করেন ছয় আনা অংশ। দশ আনির জমিদারবাড়িটিই বর্তমানে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এ বাড়িটি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর অধিগ্রহণ করে এবং এখনো এর সংস্কার কাজ চলছে। এ বাড়িটি বালিয়াটী প্রাসাদ নামে পরিচিত। এখানে পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত চারটি সুবৃহৎ অট্টালিকা বিদ্যমান। এগুলো বড় তরফ, মেজ তরফ, নয়া তরফ এবং ছোট তরফ নামে পরিচিত। ছয় আনি জমিদারবাড়ির অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। ৫.৮৮ একর জমির ওপর বাড়ির মূল সৌধমালা। গোলাপ রাম হলেন এ বাড়ির প্রাচীন পুরুষ। এ বাড়ির এক তেজস্বিনী মহিলা জমিদারের নাম উজ্জলা রানী রায় চৌধুরানী। এ বাড়িটি স্থাপত্যকলার দিক দিয়ে বহু প্রাচীন। এই বাড়ির অনেক স্থাপনাই এখন আর বর্তমান নেই। পণ্ডিত রাম হচ্ছেন এ বাড়ির আদিপুরুষ। এ জমিদারের এক প্রাণপুরুষ শাম্বিকা চয়নের মেয়ে কিরণ বালাকে বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দানবীর শহীদ রনদাপ্রসাদ সাহা (আরপি সাহা)। তিনি বালিয়াটীতে হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জমিদার অনুমতি দেননি বলে তিনি নিজের গ্রাম মির্জাপুরে তার মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিরা আরপি সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আজও ফিরে আসেননি। জমিদারদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য কীর্তির মধ্যে রয়েছে ধামরাইয়ের রথ, ঢাকাস্থ কে এল জুবিলী হাইস্কুল, ঢাকাস্থ জনগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বালিয়াটী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যালয়, বালিয়াটী রামকৃষ্ণ মিশন, নহবত খানা, শ্রী শ্রী মাধব গৌড়ীর মঠ ঢাকা, নিতাই গৌড়ের আখড়া। মিরপুর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে জনসেবা পরিবহন অথবা আরিচাগামী যে কোনো বাসে ধামরাই কালামপুর বাসস্ট্যান্ড হয়ে সরাসরি সাটুরিয়া উপজেলা। সেখান থেকে রিকশায় বালিয়াটী জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে অনুভব করা যায়, তখনকার জমিদাররা কি রকম শানসওকত, জাঁকজমকের সঙ্গে বসবাস করতেন। বিশাল অন্দরমহল, প্রশস্ত আঙ্গিনা, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট_ আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। হয়তো হারিয়ে যাবেন আগের দিনগুলোতে।

-ইউনুস আহমেদ

0 comments:

Post a Comment