Tuesday, December 1, 2009

বাংলাদেশে এইডসের ঝুঁকি বাড়ছে

1 comments
দেশের এইচআইভি/এইডস পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখছে না। জরিপ শেষ হয়েছে ২০০৭ সালের জুনে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছিল ওই বছরই। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কারিগরি কমিটি প্রতিবেদন দেখে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে এক বছর আগে। কিন্তু স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এই প্রতিবেদন কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা তা বলতে পারেননি।
এইচআইভি/এইডস নিয়ে কাজ করে এমন এনজিও ও জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা অভিযোগ করছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নেতৃত্বহীনতার কারণে দেশে এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকি বাড়ছে।
সর্বশেষ জরিপ বলছে, ঢাকা শহরের একটি অঞ্চলে শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের (ইনজেক্টিং ড্রাগ ইউজার—আইডিইউ) ১১ শতাংশ এইচআইভি-সংক্রমিত। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর পাঁচ শতাংশ কোনো রোগে সংক্রমিত হলে তাকে মহামারি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী থেকে তা দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
আমলাতন্ত্র কাজ আটকে দিয়েছে: আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে দেশের এইচআইভি/এইডস পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ শুরু করে। রক্তের নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে ‘সেরো সার্ভিলেন্স’ নামের এই বিশেষ জরিপ শেষ হয় ওই বছরের জুন মাসে।
সরকারি-বেসরকারি একাধিক সূত্র বলছে, ২০০৭ সালের আগস্টে আইসিডিডিআরবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জরিপ প্রতিবেদন জমা দেয়। এর ১৬ মাস পর অর্থাত্ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এইডস-বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটি সেই প্রতিবেদন অনুমোদন করে। এরপর তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় আজও তা প্রকাশ করেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও এইচআইভি ভাইরাস বিশেষজ্ঞ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান জরিপ করে প্রতিবেদন তৈরি করে। কারিগরি কমিটি সেই প্রতিবেদন দেখেছে। তিনি বলেন, ‘একটি জরিপ তথ্য প্রকাশের জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন কেন দরকার তা বুঝতে পারি না। আর এত দিন অনুমোদনের অপেক্ষায় রাখাও ঠিক হচ্ছে না।’
জাতিসংঘের একটি অঙ্গ সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জরিপের মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস পরিস্থিতি জানা যায়। জরিপের উপাত্তের ভিত্তিতে কর্মসূচি পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়। কিন্তু আড়াই বছর ধরে এসব বন্ধ।
গতকাল সোমবার যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব দেশের বাইরে। একজন যুগ্ম সচিব জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর আলী বেলালের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। আলী বেলাল এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি কয়েক দিন আগে এই পদে যোগ দিয়েছেন, বিশেষ কিছু জানেন না।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রায় এক বছর ধরে হাতি (এইচআইভি অ্যান্ড এইডস টার্গেটেড ইন্টারভেনশন) প্রকল্প বন্ধ আছে। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ২০০৪ সাল থেকে হাতি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছিল (শুরুতে নাম ছিল এইচআইভি অ্যান্ড এইডস প্রিভেনশন প্রজেক্ট-হ্যাপ)। ইউনিসেফ প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল। ইউনিসেফ সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, ২০০৮ সালে প্রকল্পের একটি পর্যায় শেষ হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে নতুনভাবে প্রকল্প শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এনজিও নির্বাচনের কাজ শেষ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাই সরকারের অুনরোধে ইউনিসেফ ২০০৯ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্প চালিয়ে যায়।
বিশ্বব্যাংক ১৬ জুন সরকারকে চিঠি দিয়ে দ্রুত প্রকল্প শুরু করতে বলে। আর তা না করলে কী বিকল্প ব্যবস্থা নেবে তা বিশ্বব্যাংককে জানাতে বলে। ২৫ জুন বিশ্বব্যাংক ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সভা হয়, তাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় মন্ত্রী দ্রুত প্রকল্পের কাজ শুরু করার পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। দেড় লাখের বেশি মানুষ এই প্রকল্প থেকে সরাসরি সেবা পেত। প্রকল্প বন্ধ থাকায় দেশে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টরের কার্যালয় থেকে এই প্রতিবেদককে বলা হয় যে এনজিও বাছাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে।
ঝুঁকি বাড়ছে: সরকার, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সূত্রগুলো জানাচ্ছে, আইসিডিডিআরবির সর্বশেষ জরিপে ঢাকা শহরের একটি এলাকায় শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের ১১ শতাংশ এইচআইভি-সংক্রমিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ শতাংশ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে ‘কেন্দ্রীভূত মহামারি’ (কনসেন্ট্রেটেড এপিডেমিক) বলে। এর বিপদ হচ্ছে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী থেকে ভাইরাস যেকোনো সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের কাছ থেকে এ রোগ দ্রুত অন্য মাদক গ্রহণকারী, যৌনকর্মী বা স্ত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০০৮ সালের আঙ্গাস (ইউনাইটেড নেশনস জেনারেল অ্যাসেমব্লি স্পেশাল সেশন অন এইচআইভি/এইডস) প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বাড়ছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০০ সালে শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের ১ দশমিক ৪ শতাংশ এইচআইভি-সংক্রমিত ছিল। ২০০১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে তা ১ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০০২ ও ২০০৪ সালে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে চার শতাংশে দাঁড়ায়। দাতাদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ নিয়ে চোখধাঁধানো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সংক্রমণ হ্রাস বা বন্ধ করা যায়নি। ২০০৫ সালে সংক্রমণের হার ৪ দশমিক ৯ শতাংশে এবং ২০০৬ সালে সাত শতাংশে পৌঁছায়।
অসন্তোষ: সরকারের কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতো বিশেষজ্ঞরা। নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ছোট একটি এলাকায় ক্রমাগতভাবে সংক্রমণের হার বাড়বে, এটা সহজে মেনে নেওয়া যায় না।’ তিনি বলেন, কর্মসূচিতে কোনো গলদ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার দরকার আছে। কর্মসূচি হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবায়নে সমস্যা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তিনি নজরদারি জোরদার করার পরামর্শ দেন।
শনাক্তকৃত এইচআইভি-সংক্রমিত ব্যক্তি বা এইডস রোগীদের একটি বড় অংশ বিদেশ ফেরত, প্রধানত প্রবাসী শ্রমিক। এসব শ্রমিককে উদ্দেশ করে সরকারের বা এনজিওদের কোনো কাজ নেই।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) গত সপ্তাহে প্রবাসী নারী শ্রমিক ও এইচআইভি সংক্রমণ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, ২০০২ সালে এইচআইভি-সংক্রমিতদের ৫১ শতাংশ ছিলেন বিদেশ ফেরত শ্রমিক। ২০০৪ সালে সরকার সারা দেশে নতুন ১০২ জন সংক্রমিত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে, তাঁদের মধ্যে ৫৭ জনই ছিলেন প্রবাসী শ্রমিক।
নজরুল ইসলাম বলেন, শ্রম ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। বিদেশে শ্রমিকদের ঝুঁকি কী, তাঁদের করণীয়—এসব বিদেশে যাওয়ার আগেই শ্রমিকদের জানানো দরকার।
প্রবাসী শ্রমিকদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বিবেচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে ইউএনডিপি।


নিষ্ক্রিয় জাতীয় কমিটি: সাড়ে তিন বছর ধরে জাতীয় এইডস কমিটির কোনো সভা হয় না। দেশের সর্বোচ্চ এই কমিটির মূল কাজ এইচআইভি/এইডস বিষয়ে নীতিনির্ধারণ, দেশের এইচআইভি/এইডস পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং জাতীয় কর্মসূচি দেখভাল করা। ৬১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সভাপতি রাষ্ট্রপতি এবং সদস্যসচিব স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী। এই কমিটি সর্বশেষ সভা করেছিল ২০০৬ সালের মে মাসে। জাতীয় এইডস কমিটি গঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। আর দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, জাতীয় এইডস কমিটি সক্রিয় নয় বলে এইডস-বিষয়ক কার্যক্রমে নানা অসংগতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ কান্ট্রি কো-অর্ডিনেশন ম্যাকানিজম (৪০ সদস্য), কারিগরি কমিটি (২৯ সদস্য), পর্যবেক্ষণ উপকমিটি (১২ সদস্য), প্রচার উপকমিটি (২১ সদস্য)—এ ধরনের বেশ কয়েকটি কমিটি আছে। কিন্তু এগুলো ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা দেখার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই।

1 comments:

Post a Comment