Thursday, December 3, 2009

মহাভারতের বাস্তবানুগ পাঠ

0 comments
মহাভারতের মহারণ্যে
লেখক: প্রতিভা বসু
প্রকাশক: বিকল্প প্রকাশনী, কলকাতা
প্রকাশকাল: জানুয়ারি ১৯৯৮
প্রচ্ছদের ছবি: নন্দলাল বসুর স্কেচ ‘দুর্যোধন’
মূল্য: ৬০ টাকা
পৃষ্ঠা: ২১৪

महाभारत
ভারতবর্ষে এমন কিছু নেই যা মহাভারত-এ অনুপস্থিত—এ রকম এক প্রবচন জানার পর এ মহাগ্রন্থের প্রতি আকৃষ্ট হই। তত দিনে মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রত্বে উন্নীত হয়েছি। রাজশেখর বসুর সারানুবাদ দিয়ে শুরু। তারপর অনার্সে পা দিয়ে কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ। প্রায় বছরখানেক কাটে তাঁর লাইনে লাইনে হাঁটাহাঁটিতে।
গ্রন্থটি আয়তনে এত বিশাল, এত সুদূরে এর বিস্তার যে একবার পাঠে তা আয়ত্তে আনা দুরূহ। আর হূদয়ঙ্গমের জন্য চাই আরও গভীরে ডুব, শতপাঠ। জীবিকার তাগিদ সে সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছে। তাই যতটুকু সম্ভব আয়ত্তে আনার জন্য প্রাসঙ্গিক বইয়ের দ্বারস্থ হই। হাতের কাছে যা পাই, সাধ্যে যা কুলোয়, তা সংগ্রহ করি। এর কোনোটা সঙ্গে সঙ্গে পাঠ হয়ে যায়, আবার কোনোটা আলমারিতে বসে বয়স বাড়ায়, যেমন প্রতিভা বসুর মহাভারতের মহারণ্যে।
মহাভারত-এর মতো মহাগ্রন্থ পাঠে যে-কারও মনে অনেক প্রশ্ন জাগে, হাজারো বৈপরীত্যের জোড় মেলে না। সাধারণ পাঠক হিসেবে আমাকেও সে ঘূর্ণিবায়ুতে পড়তে হয়েছে। তা থেকে বের হওয়ার দরজা খুঁজছিলাম। হাতড়াচ্ছিলাম প্রাসঙ্গিক বই। প্রতিভা বসু যেন সে দরজা দেখিয়ে দিলেন। অনেক প্রশ্নের উত্তর, শত বৈপরীত্যের জোড় মিলে গেল।
প্রতিভা বসু তাঁর বইয়ে কোনো কল্পকাহিনীকে প্রশ্রয় দেননি। মহাভারতজুড়ে অ্যাখ্যান-উপাখ্যান, রূপকথা-উপকথার যে বিশাল মেলা রয়েছে, তা ছেঁটে ফেলে মূল কাহিনী নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তার অলৌকিক ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে বাস্তবানুগ ব্যাখ্যা খুঁজেছি।’
এ বাস্তবধর্মী ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে গিয়ে তাঁকে তৈরি করতে হয়েছে অনেক নতুন পথ। আর তাঁর ইট-পাথরের যুক্তি একে করেছে সুদৃঢ়। যেমন আমরা জানি, মহাভারত হচ্ছে ‘ভরতবংশ’র ইতিহাস। এর চূড়ান্ত মুহূর্ত কুরুক্ষেত্রে ভাইয়ে ভাইয়ে, কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষের মধ্যে মহাযুদ্ধ। কিন্তু প্রতিভা বসু তা মনে করেন না। তাঁর মতে, ‘মহাভারত নামত ভরতবংশের ইতিহাস হলেও, প্রকৃতপক্ষে সত্যবতী-দ্বৈপায়নের বংশের ইতিহাস। হয়তো সে জন্যই দ্বৈপায়ন লোকগাথায় বেঁধে সেই মূল আখ্যানটিকে অমরত্ব দিতে চেয়েছিলেন।’ তাঁর মতে, সত্যবতীর পুত্র হচ্ছে মহাভারতের রচয়িতা দ্বৈপায়ন, তাঁর পুত্র বিদুর এবং তাঁর পুত্র যুধিষ্ঠির। তাঁকে হস্তিনাপুরের তথা ভারতবর্ষের অধিপতি করার জন্য শুরু থেকে নানা উদ্যোগ-আয়োজন চালায় মাতা-পিতা ও পিতামহ। আর সে পথে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায় কৌরব পক্ষের জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে, তাঁর জন্মের পর থেকেই চলে হাজারো অপপ্রচার। জন্মের পরপরই তাঁর গায়ে লাগানো হয় ‘পাপাত্মা’র তকমা। সহস্র সহস্র বছর ধরে তাই সবাই তাঁকে মহাভারত-এর ভিলেন হিসেবে বিশ্বাস করে এসেছে। আর যিনি ‘ধর্মাত্মা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, তিনি নিজে অক্ষম হয়েও অপরের পারঙ্গমতার সাহায্যে তাঁর নিজের লোভ চরিতার্থের জন্য যেকোনো পাপকর্মে অন্যদের লিপ্ত হতে দিতে মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করেননি’, সেই যুধিষ্ঠির গিয়ে দাঁড়িয়েছেন নায়কের কাতারে।
মহাভারত-এর আরেক নায়ক অর্জুন, তৃতীয় পাণ্ডব। তাঁর বীরত্বের কাহিনী ভুবনজোড়া। তবে প্রতিভা বসুর বাস্তবানুগ কাহিনীর আয়নায় তাঁর যে ভূমিকা ফুটে উঠেছে, তা হচ্ছে, ‘সারা মহাভারতে কোটি কোটি অক্ষরের প্রকাশে যাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেই অর্জুন কিন্তু যুদ্ধের সময় প্রকৃতপক্ষে কোনো বড় যোদ্ধার সঙ্গেই শঠতা ব্যতীত বীরত্বের প্রমাণ দেননি।’ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কুরুক্ষেত্রে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ। কর্ণ যেহেতু অঙ্গীকার করেছিলেন, পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন ছাড়া আর কাউকে বিনাশ করবেন না, তাই অন্যদের বাগে পেয়েও ছেড়ে দেন। কিন্তু যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে তাঁর রথের একটি চাকা মাটিতে দেবে যায়। এ সময় তাঁকে আঘাত করা যুদ্ধরীতি ও ক্ষত্রীয় ধর্মবিরোধী। কিন্তু অর্জুন তা মানেননি, বরং কর্ণ যখন অস্ত্রহীন হয়ে রথের চাকাটা তোলার চেষ্টা করছিলেন, তখন কৃষ্ণের প্ররোচনায় কাপুরুষের মতো তাঁর মস্তক ছেদন করেন।
মহাভারত-এর সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র কৃষ্ণ। তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার যেমন শেষ নেই, তেমনি তাঁকে অবতার ভেবে পুজোপাদ্য দেওয়ারও ক্ষান্তি নেই। তবে প্রতিভা বসুর মনে হয়েছে, ‘কৃষ্ণ অনৃতবাক্য উচ্চারণে যেমন বিমুখ নন, তেমনি যেকোনো হীনকর্ম করতেও দ্বিধাহীন।’
আর দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের ঘটনার সঙ্গে রয়েছে অলৌকিকত্বের ছোঁয়া। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মুড়ে তাকে বাস্তবানুগ করার কোনো চেষ্টাই করেননি প্রতিভা বসু। তবে তাঁর মতে, রাজসভায় দ্রৌপদীকে অপমানের ঘটনা ছিল পাণ্ডবদের হিংসার বদলে কৌরবদের প্রতিহিংসা মাত্র। আর পঞ্চস্বামী গ্রহণ, একেক বছরের জন্য একেকজনের শয্যায় যাওয়াকে মনে হয়েছে, ‘নারী দেহ তো নয়, যেন খেলার বল।’
তবে প্রতিভা বসুর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার দুর্যোধন। তাঁর মতে, তাঁর আসল নাম ‘সূর্যধন’। রচনায় দ্বৈপায়ন এবং রাজসভায় বিদুর একজোট হয়ে অপপ্রচার চালিয়ে তাঁকে দুর্যোধন করেছেন। কেননা কোনো পিতাই তাঁর সন্তানের এ নাম রাখতে পারেন না, সে যে যুগের দোহাই পাড়া হোক না কেন।
আর মহাভারতজুড়ে তাঁর ঘাড়ে এত সহস্র অপকর্মের দোষ চাপানো হয়েছে যে এর নিচে চাপা পড়ে গেছে তাঁর যত সুকীর্তি ও সুকর্ম। অথচ তিনি ছিলেন সুশাসক, প্রজাবত্সল এবং বিশাল বীর। প্রতিভা বসুর তাই আক্ষেপ—‘যদি বলি দুর্যোধন স্বভাবতই কিছুটা সংযত ও সহিষ্ণু চরিত্রের মানুষ, তাহলে শতকরা ১০০ জনই হয়তো অট্টহাস্য করে উঠবেন। কেননা, কেবল শুনে শুনে, প্রচারের মহিমায়, তার উল্টো কথাই সবাই বিশ্বাস করে এসেছেন সহস্র সহস্র বছর যাবত্।’
সুতরাং যারা মেদহীন বাস্তবানুগ মহাভারত পড়তে আগ্রহী, তাদের জন্য মহাভারতের মহারণ্যে অবশ্যপাঠ্য।
লিখেছেন জিয়া হাশান

0 comments:

Post a Comment