Friday, December 4, 2009

জীবনানন্দ দাশ - হাসান হাফিজ

0 comments
অত্যন্ত বড় মাপের কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কেমন ছিল তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবন? মানুষ হিসেবেই বা কেমন ধারার ছিলেন তিনি। কবির ব্যক্তিজীবন বিষয়ে জানার সামান্য চেষ্টা রয়েছে এই লেখায়। কবিদের জীবন সম্পর্কে নানা ধরনের কথা বলা হয়। কেউ বলেন, কাব্য পড়ে যেমন ভাবো, কবি তেমন নয় গো। আবার কারো কণ্ঠে শোনা যায়- কবিকে পাবে না তার জীবন চরিত্রে। যা হোক, কোনও লেখকের লেখা পাঠ করে মর্মোদ্ধার করা, মূল্যায়ন করার জন্যে তাঁর সময়ের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি যেমন যথাসাধ্য জানা প্রয়োজন, তেমনি সেই লেখকের ব্যক্তিগত জীবন জানতে পারলেও সুবিধে হয়। এতে ক্ষতি বিশেষ কিছু নেই, লাভের সম্ভাবনাই বেশি।

আপাতদৃষ্টে কবি ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, সেই গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকতো তাঁর কৌতুকপ্রিয়তা। ভীষণ ধৈর্যশীল মানুষ ছিলেন তিনি। জীবনানন্দ দাশ-লাবণ্য দাশ দম্পতির কন্যা মঞ্জুশ্রী যখন খুব ছোট তখনকার একটি ঘটনা। ছোট্ট মেয়েটি একবার আমাশয় ভুগছিল। অসুখ সারছে না। ভুগতে ভুগতে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। শেষটায় এমন দাঁড়াল যে, শিশু মঞ্জুশ্রী বিছানায় শুতে চায় না কিছুতেই। বাবা-মাকে সে বলে, কোলে শুয়ে ঘুরবো। কবি পতœী লাবণ্য দাশকে দিয়ে সে কাজ হতো না। কিন্তু কবির পরম ধৈর্য ছিল বিস্ময়কর। আদরের মেয়েকে কাঁধে শুইয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। রাতের পর রাত, ঘরের ভিতরে। লাবণ্য দাশ জানাচ্ছেন, এ কাজে কবিকে তিনি ক্লান্তি বোধ কতে দেখেননি কোনও দিন।

জীবনানন্দ দাশের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল কলকাতার সিটি কলেজে। ১৯২২ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেখানে অধ্যাপনা করেন তিনি। সিটি কলেজে অধ্যাপনা করার সময়ে কিছুদিন জীবনানন্দ থেকেছেন বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের একখানা ঘরে। থাকতেন এক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে। ছোট ভাই তখন এম.এস.সি ক্লাসের ছাত্র। মাঝে মধ্যে মা বরিশাল থেকে কলকাতায় যেতেন। সিটি কলেজ থেকে তাঁর চাকরি চলে যাওয়া সম্পর্কে কেউ কেউ লিখেছেন, তাঁর কবিতায় অশ্লীলতা রয়েছে এই অপবাদে তিনি কর্মচ্যুত হন। দৃঢ় ভাষায় এই অপবাদ খন্ডন করেছেন জীবনানন্দের সহোদরা সুচরিতা দাশ। সুচরিতা দাশ কলকাতার দেশ পত্রিকায় (২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮) ‘দাশপরিবার ও জীবনানন্দ’ শিরোনামে লিখেছেন তাঁদের কুলকাহিনী। সুচরিতা লিখেছেন. “ঃসিটি কলেজে দাদার কর্মাবসান সম্বন্ধে নানান সাহিত্যিকের লেখায় বিশেষ একটা কারণ বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা অনেকেই এই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতেন যে, তাঁর কবিতায় অশ্লীলতা আছে এই অপবাদেই তিনি কর্মচ্যুত হয়েছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই সময়ে সিটি কলেজে একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র সংখ্যা বিশেষ রকম হ্রাস হয়ে যাওয়ায় কলেজে অর্থাভাব দেখা দেয়। তার ফলে কিছু জুনিয়র অধ্যাপকের চাকরি চলে যায়। দাদাও তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন।

দাদা যখন সিটি কলেজে কাজ করতেন তখন কেবল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তই নন, আরও অন্যান্য সাহিত্যিকরাও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। কবি মোহিতলাল তাঁর কবিতা পড়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। অনেক শীতের সন্ধ্যায় কালো কোট পরে গলায় কমফর্টার জড়িয়ে এসে আসন গ্রহণ করতেন। বহুক্ষণ ধরে কবিতা নিয়ে তাঁদের আলাপ-আলোচনা হত।

সিটি কলেজের চাকরি যাওয়ার পর প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে থেকে জীবনানন্দ দাশ দু’একটা টিউশনি করতেন। পাশাপাশি চলত কাজের খোঁজ-খবর নেয়া। বাগেরহাট কলেজে একটা চাকরি পাওয়া গেল। কবির ভালো লাগেনি সেই কাজ। ছেড়ে দিলেন কয়েক মাস পরেই। দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপনার কাজ পেলেন অতঃপর। সেটা ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের কথা। বিয়ে করতে বরিশাল এলেন। তারপর আর দিল্লি ফিরে যাননি। বেকার ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। এই সময়টাতে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট ছিলেন কিছুদিন, এক বন্ধুর সঙ্গে কিছুদিন ব্যবসাও করেছেন। বরিশালের বি.এম কলেজে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে। এখানে ছিলেন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। জানা যায়, বরিশালের নিজের বাড়িতে থেকে কাজ করতে পারায় কবি জীবনানন্দ দাশের মানসিক স্বস্তি এবং আর্থিক সচ্ছলতা দুই-ই ছিল সে সময়টাতে।

ওই সময়ের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে সুচরিতা দাশ লিখছেন, “ঃ.১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল বি.এম. কলেজে ইংরাজি অধ্যাপকের কাজ পেলেন। ১৯৪৬ পর্যন্ত তিনি বি.এম. কলেজে ছিলেন। বরিশালে বাড়িতে থেকে কাজ করায় এই সময়ে তাঁর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও মানসিক স্বস্তি ছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট দেশ বিভাগ স্থির হওয়ায় দাদা কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় ভাই অশোকানন্দের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু তাঁর একান্ত প্রিয় বরিশালে তাঁর আর ফিরে যাওয়া হয়নি। দলে দলে হিন্দুরা তখন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসতে লাগলেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিল। তাই আর তাঁর বরিশাল যাওয়া হল না কোন দিনই। তখন তিনি কলকাতায়ই কাজ পাবার চেষ্টায় তৎপর হলেন এবং কিছু দিন পরে ‘স্বরাজ’ নামে একটি নতুন দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগটি সম্পাদনার কাজ পেলেন কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চেষ্টায়। কিন্তু কিছু দিন পরেই ‘স্বরাজ’ বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৫০-এর শেষে তিনি খড়গ্পুর কলেজে কাজ পেলেন। ওখানে মেসে থাকতেন। ছোট ভাই তখন দিল্লিতে বদলি হয়ে গেছেন। স্ত্রী, পুত্র কলকাতায়, কন্যা তার পিসিমার কাছে থেকে পড়াশুনা করছে। হঠাৎ স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফলে খড়গ্পুরের কাজ তিনি ছেড়ে দিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বড়িয়া কলেজে কাজ পেলেন, ১৯৫৩র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই কাজ তিনি করেছিলেন। এর পরে ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে কাজ পেলেও পারিবারিক কতগুলো অসুবিধা থাকায় সে কাজ পারেননি। এর পরে গোপাল রায় মহাশয়ের চেষ্টায় তিনি হাওড়া গার্লস কলেজে কাজ পেলেন। বহুদিন পরে তাঁর স্বস্তি এল- কর্মক্ষেত্রে যেন কিছুটা আনন্দ ও স্বচ্ছন্দ্য পেলেন।”

জীবনানন্দ দাশ অত্যন্ত শান্ত ও নিরীহ প্রকৃতির বলেই সবাই জানেন। সেই শান্ত স্বভাবের আড়ালে লুকোনো ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। কেউ কেউ সেটাকে ছাইচাপা আগুনের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। চিৎকার, চেঁচামেচি করে তিনি সেই ব্যক্তিত্বে বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর ব্যাপারটি পছন্দ করতেন না। অল্প কথায় শান্তভাবে, অসম্ভব দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন।

কবিপতœী লাবণ্য দাশের স্মৃতিচারণা থেকে একটুখানি উদ্ধৃত করে শেষ করছি এ লেখা। ‘মানুষ জীবনানন্দ’ নামের ওই লেখাটিতে লাবণ্য দাশ লিখেছেন, “ঃতখন আমি শিশু বিদ্যাপীঠ নামে একটি সেকেন্ডারী স্কুলে সবে ঢুকেছি। একদিন রাত প্রায় ৯টার সময় বাইরে থেকে বেড়িয়ে এসে ঘরে ঢুকতে যাব, এমন সময় কবিকে বলতে শুনলাম, ‘হ্যাঁ রে খোকন, তোর মা কি বাড়ি ফিরেছেন?’ খোকন আমার ছেলের ডাক নাম। সে উত্তর দিল, ‘না।’

তিনি তখন বলতে শুরু করলেন- ‘তা ফিরবে কেন? এদিকে আমি যে জ্বরে পড়ে আছি- সেটা কে দেখে- কেই বা মুখে একটু জল দেয়?’

বলেই মনে হল যেন সারাদিন রোদ-খাওয়া লেপখানাকে বেশ আরামের সঙ্গেই গায়ে জড়িয়ে পাশ ফিরলেন।

কবির কথা শোনার পরে আমি আর ঘরে ঢুকলাম না। নিঃশব্দে বেরিয়ে সোজা একটা ওষুধের দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। কারণ আমি জানি যে, কবির জ্বর হলেও সেটা অতি সামান্য। অ্যানাসিন খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। একে তো শীতকাল, তাতে আবার বেশী রাত জেগে লেখাপড়ার কাজ করেছেন- তাতেই হয়ত শরীরটা বেশী খারাপ লাগছে।

শেষ পর্যন্ত দুটো অ্যানাসিন ট্যাবলেট নিয়েই বাড়ি ফিরলাম। ট্যাবলেট ও জলের গ্লাস টেবিলে রেখে বললাম, ‘ওষুধ রইল। ডাক্তার আজ বার্লি খেতে বলেছেন।’

কবি এতটার জন্য তৈরি ছিলেন না। আমি যে তাঁর কথা শুনে ফেলব সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। কাজেই চুপ করেই রইলেন।

আমি অন্য ঘরে বসেই শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম যে তিনি অ্যানাসিন খাচ্ছেন। খানিক বাদে আমি খোকনকে খেতে দেবার জন্য রান্নাঘরে গেলাম। তাকে থালায় ভাত দিয়েছি, এমন সময় বারান্দা থেকে কবির স্বগতোক্তি শুনতে পেলাম।- এখন তো মনে হচ্ছে জ্বর আর নেই। গরম ভাত একটু ডিমের ঝোল দিয়ে খেলেও খাওয়া যেতে পারে। তখন কেন যে বেশী জ্বর বলে মনে হ’ল? না- অন্যায়টা তো আমারই। একটা মানুষ সারাদিন স্কুলে কাজ করে এসে সন্ধেবেলা যদি একটু বেড়াতে না যায়, তবে তার শরীর টিকবে কি ক’রে?

আমি কিন্তু চুপ করেই রইলাম। কিছুক্ষণ আর কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। বোধহয় খাবার ঘরে ঢুকতে একটু ইতস্ততঃ করছিলেন। তারপরেই দেখি খোকনকে ডাকতে ডাকতে খাবার জায়গায় এসে হাজির। ছেলেকে ডিম খেতে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তাড়াতাড়ি থালা নিয়ে বসে পড়লেন। ডিম ছিল তাঁর অতি প্রিয় খাদ্য। ছেলেকে ডিম খেতে দেখলে তিনিও তখন নিতান্তই ছেলেমানুষ হয়ে যেতেন এবং তার ভাগ থেকে কিছুটা ভেঙে মুখে দিতে তিলমাত্রও দ্বিধা বোধ করতেন না। সুতরাং তখন আর কি করি- ভাত তাঁকে দিতেই হল। আর তিনিও গরম ভাত ডিমের ঝোল দিয়ে খেয়ে তবে উঠলেন।

পরীক্ষা দিতে যাবার সময় আমার ছেলে-মেয়ে অথবা আমি কোনদিন পেন্সিল কেটে নিয়েছি অথবা কলমে কালি ভরেছি বলে তো মনে পড়ে না। এসব কাজ কবি নিজেই করতেন। তাঁর কাজ ছিল নিখুঁত। চিহ্নস্বরূপ এখনও তাঁর হাতের কাটা একটি পেন্সিল আমি সযতেœ রেখে দিয়েছি।ঃ”

0 comments:

Post a Comment