স্বাধীনতা পদক হাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাক আহমেদ
সব অর্থেই একজন ব্যতিক্রমী মানুষ মোস্তাক আহমেদ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। দেশে-বিদেশে ৮০০ মিটার থেকে শুরু করে ১০ হাজার মিটার ম্যারাথন দৌড়ের রেসে টানা কয়েক দফায় প্রথম হয়েছেন তিনি। ১৯৭৩ থেকে ’৭৭ সাল পর্যন্ত অ্যাথলেটিক্সে টানা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবও রয়েছে তার দখলে। অ্যাথলেটিক্সের বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৬৯টি পুরস্কার পেয়েছেন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ১৯৭৭
সালে প্রথম স্বাধীনতা পদক। ১৯৮৯ সালে পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার।
অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নিয়েছেন সেনাবাহিনী থেকে। এখনো বেঁচে আছেন তার ১২০ বছর বয়সী বাবা তকলিম আলী। মোস্তাক আহমেদ তার বড় ছেলেকে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এতো সফলতা অর্জন খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটে। এ অর্থে একজন ব্যতিক্রমী সফল মানুষ ছাড়া আর কী বলা যায় মোস্তাক আহমেদকে।
বিশাল গর্বের এসব অর্জনের পরও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাক আহমেদ বর্তমানে দারুণ অর্থকষ্টে রয়েছেন। সাড়ে তিন লাখ টাকার ঋণের দায় এড়াতে বাড়িছাড়া হয়েছেন বহু আগে। ১৯৮৫ সালে সরকার থেকে অস্থায়ী লিজ পাওয়া ৪৫ শতাংশ জমি থেকেও উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চলছে তার বিরুদ্ধে, এমনকি হয়েছে সরকারি জমি দখলের মামলা। এসব কারণে সংসার থেকে অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মোস্তাক আহমেদ। কিন্তু পেটের খিদে তো আর পালিয়ে বেড়ানো বোঝে না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন মোস্তাক আহমেদ। জীবনের বড় অর্জন স্বাধীনতা পদক ও ৬৯টি পুরস্কার বিক্রির জন্য সোমবার ঢাকায় আসেন তিনি। দুপুরের দিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পদক বিক্রির জন্য ঘুরেছেন। কিন্তু তাকে ঘিরে মানুষের জটলা বেধেছে ঠিকই, কিন্তু কেউ এ পদক কিনতে রাজি হননি। বিকালের দিকে শাহবাগ মোড়ে দেখা হয় এ বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। হঠাৎ আষাঢ়ের আলো ঝলমল রোদে ঝলসে ওঠে স্বাধীনতা পদকটা। সোনারঙা ঝকঝকে মেডেলটার দিকে বারবার তাকিয়ে দুই চোখে জল চলে আসে তার। আনমনে মেডেলের দাম বলতে পারেন না তিনি। শুধু হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন মোস্তাক আহমেদ। কোনো কথাই স্পষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি।
১৯৭০ সালে ইপিআরে যোগ দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথমে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পরে চার নাম্বার সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা সিআর দত্তের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন মোস্তাক আহমেদ। মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাক আহমেদের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের বারুই গ্রামে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১১। বৃদ্ধ বাবা তকলিম আলী, মা মায়ারুন নেছা (৬৫) এখনো বেঁচে আছেন। ২০০২ সালে সেনাবাহিনী থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নিয়েছেন তিনি। মাসে অবসর ভাতা পান সাড়ে তিন হাজার টাকা। তা দিয়ে ১১ সদস্যের সংসার চলে না মোস্তাক আহমেদের।
২০০৩ সালে ঋণ করে বড় ছেলে মাসুদ আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন। এতে তার ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা। অবসর নেয়ার সময় পেনশন পান প্রায় চার লাখ টাকা। পেনশনের পুরো টাকা দিয়েও ঋণের টাকা শোধ হয়নি। ভাবছিলেন ছেলে উপার্জন করে পরিবারের অভাব মেটাবে। কিন্তু ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সব স্বপ্নই ভেস্তে গেছে। বিদেশের মাটিতে মরতে বসলেও ছেলের কোনো খোঁজ নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। উল্টো ঋণের সাড়ে তিন লাখ টাকার জন্য বাড়িছাড়া হয়েছেন তিনি। চার ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে ও এক মেয়ে বিবাহিত। অর্থভাবে ছেলেমেয়েদের মাত্র নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করাতে পেরেছেন। মেজো ছেলে মামুন আহমেদ (২৬) ও চতুর্থ ছেলে হাবিব আহমেদ (২২) বিয়ানীবাজারে ছোট একটা ব্যবসা করেন। তৃতীয় ছেলে রুবেল আহমেদ বেকার। বড় মেয়ে রোকসানা আক্তার বিবাহিত। ছোট মেয়ে ফারজানা আক্তার বাড়িতেই আছে। এছাড়া বাবা ও সৎ মা মায়ারুন নেছা বেঁচে থাকায় তাদের ব্যয়ভারও তাকেই বহন করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় পতিত মোস্তাক আহমেদের তিন ভাই থাকলেও তারাও বাবা-মা ও ভাইয়ের কোনো খোঁজ নিতে পারেন না।
সংসারের অভাব-অনটন দূর করার জন্য ১৯৮৫ সালে বিয়ানীবাজারে ৪৫ শতাংশ জমি অস্থায়ীভাবে তাকে লিজ দেয় সরবকার। ওই জমিতেই হোটেল করে ব্যবসা করেন মোস্তাক আহমেদের দুই ছেলে। বর্তমানে ওই জমি থেকে উচ্ছেদের জন্য তাকে বিভিন্নভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে। অবৈধভাবে সরকারি জমি দখলের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও দেয়া হয়েছে বিয়ানীবাজার থানায়। মোস্তাক আহমেদ বলেন, আমার সব কাগজপত্র আছে। ১৯৮৫ সালে আমাকে এ জমি সরকার অস্থায়ীভাবে লিজ দিয়েছে। তা দখল করতে এখন নানা মহল উঠেপড়ে লেগেছে।
নিয়েছি পদ্মা পাড়ের মানুষ হতে
0 comments:
Post a Comment