Friday, December 11, 2009

ফিদেল কাস্ত্রো

0 comments
লিখেছেন মোহাম্মদ লুত্ফর রহমান ৎ প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয়

Fidel Alejandro Castro Ruz
হত্যার উদ্দেশে তাঁর ওপর কম করে হলেও ছয় শতাধিক বার হামলা হয়েছে। বিশ্বের আর কোনো নেতার ওপর এমন হামলার নজির আছে কি না তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যেও ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। এই নেতার ওপর এসব হামলা চালিয়েছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) সুপ্রশিক্ষিত সদস্যরা। ওই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার হিটলিস্টে ছিলেন তিনি। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে সিআইএ সর্বাধুনিক রাইফেল থেকে শুরু করে বিষের বড়ি দিয়ে, বিষাক্ত কলম ছুড়ে, ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া পাউডার দিয়ে তাঁকে অসংখ্যবার হত্যার চেষ্টা করে।

এমনকি তাঁর শত্রুশিবির সিআইএর সঙ্গে নিজের এক বোনও হাত মিলিয়েছিলেন গোপনে। কিন্তু নিজের দৃঢ় মনোবল ও সতর্ক দেশ পরিচালনার কারণে শত্রুশিবিরের এসব অপচেষ্টা নস্যাত্ হয়ে গেছে বারবার। এখনো বিশ্বে তিনি তাই পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক সোচ্চার কণ্ঠ। অনেকের কাছে তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক প্রতীকের নাম। গত এবং বতর্মান শতাব্দীর পরিবর্তনের ধ্বজাধারী সর্বশেষ বিপ্লবী। হ্যাঁ, কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর কথাই বলা হচ্ছে।
সমপ্রতি কাস্ত্রোর মার্কিন আশ্রিত বোন হুয়ানিতা তাঁর লেখা একটি বইয়ে স্বীকার করেছেন, তিনি ভাই ফিদেলকে উত্খাতে সিআইএর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। একপর্যায়ে তিনি গোপনে দেশ ছাড়েন এবং যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। শত্রুশিবির সেই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে বহুবিধ পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন। চিরশত্রু কিউবার সঙ্গে অতীত তিক্ততার সম্পর্ক ভুলে নতুন করে সম্পর্ক গড়ার কথা বলছেন তিনি।
জীবনে বহুবার ফিদেল গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। সংগ্রামের প্রতীক এই বিপ্লবী সম্প্রতি আবারও আলোচনায় আসেন প্রেসিডেন্ট ওবামার নেওয়া নীতির ব্যাপারে খোলামেলা কিছু মন্তব্য করে। পরিবর্তন-প্রত্যাশী ওবামার দর্শন তাঁকে নাড়া দিয়েছে। ওবামার শপথ অনুষ্ঠানটিও তাই তিনি টেলিভিশনে সরাসরি দেখতে ভোলেননি। শপথের দিন ফিদেল তাঁর ভাষণের প্রশংসা করে ইন্টারনেটে লিখিত বিবৃতিও দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই বিশ্লেষকেরা বলতে শুরু করেন, গত ৫০ বছরের বরফ এবার বুঝি গলতে শুরু করল।
১৯৫০-এর দশক। ফিদেল তখন টগবগে যুবক। নিজে আইনজীবী ছিলেন বলেই কি না সমাজের বৈষম্যটা তাঁর চোখে পড়েছিল বেশি করে। ১৯৫৯ সালে তত্কালীন মার্কিন সমর্থিত একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তার সরকারকে উত্খাত করে ক্ষমতায় আসেন তিনি। অবশ্য ১৯৫৩ সালেই ফিদেলের বিপ্লবের প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বাতিস্তার অন্যতম সামরিক ঘাঁটি মনাকাদা ব্যারাকে ওই বছরের ২৬ জুলাই ওই ব্যর্থ হামলার পরিকল্পক ছিলেন তিনি। তবে অভিযানে ব্যর্থতার মধ্যেই যেন লুকিয়ে ছিল সাফল্যের বীজ। কিউবাবাসী তখন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল, গুটিকয়েক গেরিলা সেনার ছদ্মবেশে কীভাবে সামান্য ক্ষুদ্রকায় রাইফেল নিয়ে বৃহত্ একটি সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করলেন। তারা বুঝতে পারল, খুব শিগগিরই দেশে পরিবর্তন আসছে। ওই সময় গ্রেপ্তার এবং পরে নির্বাসনে যেতে হয় ফিদেলকে। একপর্যায়ে ১৯৫৬ সালে কাস্ত্রো মেক্সিকোর নির্বাসন থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরেক কিংবদন্তি গেরিলা এরনেস্তো চে গুয়েভারা। ১৯৫৯ সালে মাত্র নয় হাজার গেরিলা নিয়ে তাঁরা হাভানা আক্রমণ করেন। ক্ষমতাচ্যুত হন বাতিস্তা। পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। এরপর ফিদেলের দেশ গড়ার পালা।
দেশ পরিচালনার দীর্ঘ সময়ে বহির্বিশ্বের বিশেষ করে মার্কিনি আগ্রাসন থেকে কিউবাকে রক্ষায় এক অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন ফিদেল। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত তিনি দেশকে আগলে রাখেন ভালোভাবেই।
ফিদেল তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক সময় অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব সিদ্ধান্তের সমালোচনা হয়েছে। তবে একটা কথা ফিদেল বারবার বলেছেন, ‘আমাকে ঘৃণা করো, কোনো সমস্যা নেই। তবে দেশের কল্যাণে যেসব সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেই নিরিখে ইতিহাস আমাকে মার্জনা করবে।’ কাস্ত্রোর রাজনৈতিক দর্শন এমনই। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে তিনি তাঁর কমিউনিস্ট শাসনের নানা নীতির পরিবর্তন করেছেন। মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে কিউবা। তখন তিনি ভেনেজুয়েলার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সেই পরিস্থিতি সামাল দেন। এখন কিউবার বড় অর্থনৈতিক সহযোগী হলো ভেনেজুয়েলা। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিজের ট্রেডমার্ক জলপাই রঙের সেনা পোশাকের বদলে স্যুট-টাই পরে হাজির হয়েছিলেন তিনি। অনেকে মনে করেন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য শুরুর ইঙ্গিত দিতেই ফিদেল ওই কাজ করেছেন। বর্তমান সময়ে গোটাবিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দায় ধুঁকছে, কিউবা কিন্তু নিজেকে সেই বিপদ থেকে ঠিকই রক্ষা করেছে। লন্ডনভিত্তিক নিউ ইকোনমিক ফাউন্ডেশনের মতে, কীভাবে বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হয় কিউবা তারই শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
ফিদেলের শাসনকালে কিউবার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। লাতিন আমেরিকার মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার কিউবায়ই সবচেয়ে কম। পোলিও নির্মূল করা হয়েছে সেই ১৯৬২ সালেই। এরপর ডিপথেরিয়া, হাম, মাম্পস রোগ নির্মূল করা হয়েছে। নিজের দেশের স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৪ হাজারেরও বেশি কিউবান বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক কাজ করছেন। জনসংখ্যার অনুপাতে দেশটিতে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিত্সকও রয়েছেন। শিশুমৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণেও ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করেছে কিউবা। বর্তমানে সেখানে শিশুমৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৫ দশমিক ৮, যা কি না যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অনেক কম। সর্বোপরি কিউবার স্বাস্থ্যসেবার মান সুইডেন ও সিঙ্গাপুরের সমপর্যায়ের। কিউবার এসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে মার্কিন তথা বহির্বিশ্বের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই।
প্রায় দুই বছর হতে চলল কাগজ-কলমে কিউবার ক্ষমতায় নেই ফিদেল। তবে দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ফিদেলের পরামর্শ নিয়ে কাজ করেন ভাই রাউল। রাউল সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, ওবামার সঙ্গে তিনি যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। ফিদেলও রাউলের এমন উদ্যোগে সম্মতি দিয়েছেন। ফিদেলের বর্তমান স্লোগান—‘একটি সুন্দর পৃথিবী গড়া খুবই সম্ভব।’ ওবামাও এখন পরমাণু অস্ত্র ও হানাহানিমুক্ত একটি পৃথিবীর কথাই বলছেন। ফিদেল যদি সেই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকেন, নিশ্চয়ই তিনি সেই পৃথিবী দেখে যেতে পারবেন, যার জন্য একবার তিনি বিপ্লবের দীর্ঘ পথে হেঁটেছিলেন।

0 comments:

Post a Comment