ভারতীয় বিমানবাহিনী বোমা ফেলছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে। ঘরের চাল থেকে তা দেখছে ঢাকাবাসী
ছবি: আনোয়ার হোসেন, ঢাকা ১৯৭১
৩ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের পশ্চিম সীমান্তের কতক শহরে হামলা চালিয়ে ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর নাজেহাল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান কেন ভারত আক্রমণ করে যুদ্ধের সূচনা ঘটাল, সেটা অনেকের কাছে বড় জিজ্ঞাসা হয়ে রয়েছে। এর আগে ভারত মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে সীমান্ত অতিক্রম করলেও তা ছিল সীমিত সংখ্যায় ও সীমিত আকারে। ভারত যুদ্ধ শুরুর দায় নিজের কাঁধে নিতে চাইছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন প্রদানের নীতি গ্রহণের পরও এ ক্ষেত্রে ভারতের দ্বিধার মূল কারণ ছিল, বিশ্বের সামনে নিজেকে আক্রমণের সূচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে না দেওয়া। তা হলে পাকিস্তান কেন স্ব-উদ্যোগে যুদ্ধের সূচনা করল? এর উত্তর আসলে খুঁজতে হবে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ও এলিট চক্রের মানসের মধ্যে। দীর্ঘকাল রাষ্ট্রক্ষমতা যথেচ্ছভাবে ভোগের ফলে বিপুল সামরিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়ে ক্ষুদ্র এক চক্র, যারা নিজেদের বুদ্ধি অথবা বুদ্ধিহীনতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে বিপুল মানুষের জীবনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিচয় দেয় চরম অবিমৃশ্যকারিতার। এ কারণেই তাদের হাতে প্রণীত হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইটের মতো নিষ্ঠুর গণহত্যা-পরিকল্পনা, যা অচিরে পরিগণিত হয় জাতিহত্যা বা জেনোসাইডে। বিশ শতকের ইতিহাসে হিটলারের নািস বাহিনীর মতো আরেক ঘৃণিত বাহিনীর রূপ নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী, যদিও যেই কুিসত চেহারা আড়াল করার জন্য প্রসাধনী জোগানো হয়েছে অনেক দিক থেকে, বিশ্ব রাজনীতির ক্ষমতাধরেরা দিয়েছে এক প্রলেপ, ইসলামের নাম ভাঙিয়ে লাগানো হয়েছে আরেক প্রলেপ।
যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল উভয় দেশ। সীমান্তজুড়ে অবস্থান নিয়েছিল সেনাবাহিনী; লজিস্টিক ও সরবরাহের ব্যবস্থাদি ছিল প্রস্তুত। কেননা, জানা ছিল না কখন কীভাবে শুরু হবে যুদ্ধ। ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে। এতে বলা হয়, ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।’ ঠিক তখনই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশে উড়তে শুরু করে। পাঁচটা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে হাজার পাউন্ডের বোমা নিয়ে ১২টি স্যাবর উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের দিকে। এক মিনিট পর সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে প্রেরিত হয় ভারত ভূখণ্ডের গভীরে আগ্রায় আঘাত করার উদ্দেশ্যে। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আকস্মিক আক্রমনে।
সেই বিকেলে রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট হাউসের বিবরণ পাওয়া যায় ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকীর ইস্ট পাকিস্তান: দি এন্ড গেম বইয়ে। প্রেসিডেন্টের প্রেস উপদেষ্টা হিসেবে তাঁকে জরুরি তলব করে আনা হয়েছিল যুদ্ধ শুরুর প্রেস রিলিজ তৈরি করার জন্য। জেনারেল গুল হাসানের পরামর্শে একটি মুসাবিদা তৈরি করে তিনি অপেক্ষা করছিলেন প্রেসিডেন্টকে একবার তা দেখিয়ে নিতে। তিনি লিখেছেন, “মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড তখন ভেতরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও জেনারেল হামিদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। চীনা রাষ্ট্রদূত চ্যাং টাং দেখা করে চলে গেছেন। আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম, তার পরে ভেতরে যেতে পারব। ইতিমধ্যে বেয়ারা পানীয় নিয়ে এল। কিছুক্ষণ পর বিমানবাহিনীর প্রধান রহিম খান আমার দিকে ফিরে কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে জানতে চাইলেন আমি এখানে কী কাজে এসেছি। বললাম, ‘সাংবাদিকদের জানানোর আগে আমি প্রেসিডেন্টকে প্রেস রিলিজের ভাষ্য দেখিয়ে নিতে চাই’।”
কিছুক্ষণ নীরব থেকে বিমানবাহিনীর প্রধান বললেন, ‘কিসের প্রেস রিলিজ? কেন এর প্রয়োজন?’ আমি বিহ্বল হয়ে জবাব দেওয়ার জন্য শব্দ হাতড়ে ফিরছিলাম। ইতিমধ্যে জেনারেল গুল হাসান বললেন, ‘আপনি তো জানেন স্যার, রাজ্যের সাংবাদিক অপেক্ষা করছে কোন পরিস্থিতিতে এমনটা ঘটল, তা জানার জন্য। আমাদের পদক্ষেপের পক্ষে যুক্তি দেখাতে হবে।’
বিমানবাহিনীর প্রধান এবার গর্জে উঠলেন, ‘যুক্তি আবার কিসের? সাফল্যের চেয়ে বড় যুক্তি আর কি হতে পারে। এইক্ষণে আগ্রার আকাশে, আমার পাখিরা (মাই বার্ডস) শত্রুর জান কয়লা করে দিচ্ছে। আমি কেবল সুখবর শোনার অপেক্ষায় আছি।’
এভাবেই পাকিস্তান শুরু করেছিল যুদ্ধ এবং সুখবর আর রহিম খানের শোনা হয়নি। পরের কথা পরে, এমনকি সেই আকস্মিক বিমান হামলা চালিয়েও ভারতের ক্ষতি করা গিয়েছিল যত্সামান্যই। ভারতীয় বিমানবাহিনীকে আকস্মিক আঘাতে ভঙ্গুর করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তান, বরং পরে দেখা গেল ভারতীয় প্রত্যাঘাতে তাদেরই হয়েছে বেহাল দশা।
অপরদিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকলেও তা যে ৩ ডিসেম্বর এভাবে শুরু হবে, সেটা ভারতের কাছে কিছুটা অপ্রত্যাশিত ছিল। কেননা, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তাঁকে জানানো হয় বিমান হামলার খবর। তিনি সমবেত জনতাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে যথারীতি বক্তৃতা শেষ করে দ্রুত চলে যান রাজভবনে। ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল অরোরা তাঁকে গোটা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং বিমানবাহিনীর প্রহরায় তিনি ফিরে আসেন দিল্লি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ছিলেন বিহারে নিজ নির্বাচনী এলাকায়, অর্থমন্ত্রী চ্যবন বোম্বেতে। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সভা শেষে গভীর রাতে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে বলেন, ‘বাংলাদেশের যুদ্ধ এখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়ে উঠেছে।’ তাঁর এই বক্তৃতা যখন চলছিল, তখন পশ্চিম ও পূর্ব রণাঙ্গনজুড়ে গর্জে ওঠে কামান, ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলাও চলে যুগপত্। সেই রাতেই ঢাকা এবং আশপাশের সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর শুরু হয় বিমান হামলা। বোমা বিস্ফোরণের প্রবল শব্দে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে অবরুদ্ধ ঢাকার মানুষজন। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী এবার সমুচিত শিক্ষা পেতে শুরু করেছে, এই অনুভূতি তাদের নির্ঘুম করে তোলে। পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া ট্রেসারে যখন চারপাশ আলোকিত হয়ে ওঠে, তখন প্রায় নয় মাসের কৃষ্ণ দিনের অবসানের আলোকচ্ছটা যেন সবাই দেখতে পায়।
ইতিহাসে এ এক বিরল মুহূর্ত, যখন সর্বস্তরের মানুষ অভিনন্দন জানায় যুদ্ধকে। কেননা, এই যুদ্ধ যে মুক্তির জন্য যুদ্ধ।
মফিদুল হক: প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
0 comments:
Post a Comment