Saturday, December 12, 2009

সর্বকালের সেরা ১০০ চলচ্চিত্রকার

0 comments
http://www.theyshootpictures.com/gf1000_top100directors.htm
১। অরসন ওয়েলস – যিনি চল্লিশের দশকে মার্কিন দর্শক ও ক্রিটিকদের ছয়টি ইন্দ্রিয়কে একসাথে আঘাত করেছিলেন। অর্ধ শতকের প্রচেষ্টায় নির্মিত সুরম্য অট্টালিকার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন শিল্পের এক নতুন প্রাসাদ। “সিটিজেন কেইন” (১৯৪১)- ইতিহাসের সবচেয়ে ইনোভেটিভ সিনেমা- এর পরিচালক হিসেবেই তিনি পরিচিত। কারণ এই সিনেমার ভাষা, সিনেমাটোগ্রাফি, থিম সবকিছুই ছিল একেবারে নতুন। এটাতেই প্রথম “ডিপ ফোকাস” দেখেছিলাম। পরে অনেক সিনেমাতেই ডিপ ফোকাসের ব্যবহার দেখেছি, কিন্তু সিটিজেন কেইনের সাথে কোনটারই তুলনা চলে না।

২। আলফ্রেড হিচকক – সাসপেন্স এবং রহস্যের জাদুকর, মানুষকে নিয়ে যিনি পিয়ানোর মত খেলতে পারতেন। থ্রিলার-সাসপেন্স জাগানোর নাকি পাঁচটি প্রধান সিনেমাটিক টেকনিক আছে। একমাত্র হিচককই এই পাঁচ টেকনিক একসাথে সফলভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছেন। হিচককের সিনেমা দেখতে হয় পুতুলের মতো- নিজেকে শিশু মঞ্চের পুতুল ভেবে রাশ দুটো ছেড়ে দিতে হবে হিচককের হাতে, তিনি যেভাবে নাচান সেভাবেই নাচতে হবে, এখানে হিচককের ভূমিকা অনেকটা ঈশ্বরের মতো।

৩। ফেদেরিকো ফেলিনি – জীবনকে কাব্যিকভাবে উপস্থাপন করার ধারা তিনিই শুরু করেছিলেন। কাব্যিক হওয়ার কারণেই ফেলিনির সিনেমায় বাস্তবতা আর স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য খুব কম। তার “এইট অ্যান্ড আ হাফ” সিনেমায় তো পার্থক্যটা একেবারেই লোপ পেয়েছে।

৫। স্ট্যানলি কুবরিক – আমার প্রিয় চলচ্চিত্রকার। তিনি চলচ্চিত্রের ঈশ্বর। ঈশ্বর যেমন সর্বদ্রষ্টা, সর্বনিয়ন্তা, কুবরিকও তার সিনেমার সেটে তেমনি সর্বদ্রষ্টা এবং সর্বনিয়ন্তা- একেবারে চূড়ান্ত পারফেকশনিস্ট। একই শট ১১৮ বার নিয়ে তিনি বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। নির্দিষ্ট কোন জনরাঁর প্রতি তার ঝোঁক নেই। তার অধিকাংশ সিনেমাকেই কোন জনরাঁতে ফেলা যায় না। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত- তিনি মানুষের মনকে খুব একটা নাড়াতেন না; মনোবিজ্ঞান নয় সমাজবিজ্ঞানই ছিল তার সিনেমার ভিত্তি। ভবিষ্যতে যখন মহাকাশ যুগ শুরু হবে, তখন মহাকাশের নাবিকেরা এই একজন শিল্পীর প্রতি তাদের ঋণের পরিমাণটা বুঝতে শুরু করবে, এখন সেটা বোঝা সম্ভব না। মানুষকে তিনি দেখছেন একজন মানবিক ঈশ্বরের দৃষ্টিতে।

৭। আকিরা কুরোসাওয়া – আরেক পারফেকশনিস্ট। যুদ্ধের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া একটি দেশকে বুকে ধারণ করে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই তার সিনেমার অনেকটা জুড়ে থাকে মানুষের দুঃখ-কষ্ট, হিংস্রতা, বিশ্বাসঘাতকতা। আত্মপীড়নও মাঝেমাঝে দেখা যায়। এই কষ্ট থেকেই বোধহয় তিনি শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডিগুলোকে সেলুলয়েডে বন্দি করেছিলেন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল শেক্সপিয়ারিয়ান চলচ্চিত্রকার।

৮। ইংমার বারিমান – সুইডেনে ধর্ম পালনের হার সবচেয়ে কম হলেও বারিমান বড় হয়েছেন কড়া ধর্মীয় পরিবেশে। সবাই আত্ম-আত্মা, জীবন-মরণ, সসীম-অসীম নিয়ে প্রশ্ন করে। ছোটবেলায় তিনি বোধহয় এই প্রশ্নগুলোর খুব কড়া জবাব পেয়েছিলেন যা তার অতিরিক্ত সংবেদনশীল মনকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সিনেমা আর মঞ্চ নাটক দিয়ে আজীবন সেই মন পুনরায় গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন। তার “গড ট্রাইলজি”-তে এক অদ্ভুত ঈশ্বরানুভূতির সন্ধান পাই। বারিমানকে বলতে হবে চলচ্চিত্রের দার্শনিক এবং দর্শনের চলচ্চিত্রকার।

৯। ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা – যুদ্ধ কাকে বলে?- এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে অবশ্যই দর্শন আর সমাজবিজ্ঞানের কাছে হাত পাততে হবে, কিন্তু উত্তরটা উপলব্ধি করতে হলে দেখতে হবে কপোলার “অ্যাপোক্যালিপ্‌স নাউ”। এখন পর্যন্ত নির্মীত সেরা যুদ্ধবিরোধী সিনেমা। দেবতা-অসুর, অক্ষশক্তি-মিত্রশক্তি যাই বলি না কেন- যুদ্ধ মানে খেলাচ্ছলে নিজের অপরূপ সৃষ্টিগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া। এই খেলা আমরা দেখেছি গডফাদারে। আর খেলা শেষের ভাঙা খেলাঘর দেখেছি অ্যাপোক্যালিপ্‌স নাউ-এর শেষ ৩০ মিনিটে।

১০। জঁ লুক গোদার – নিয়ম ভাঙার কারিগর। সিনেমার জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রথাবিরোধী- নির্মাণ কৌশল এবং রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি- দুদিক দিয়েই। হলিউডের গতানুগতিক ঘ্যাচাং-ঘ্যাচাং অ্যাকশন-কমেডিকে ব্যাঙ্গ করে গেছেন আজীবন। তৎকালীন ফ্রান্সের তথাকথিত মূল্যবোধকে ময়লা ভেবে ঝেড়ে ফেলেছেন। সতীর্থদের সাথে মিলে জন্ম দিয়েছেন সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র আন্দোলনের- নুভেল ভাগ বা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ বা ফরাসি নবতরঙ্গ।

১১। চার্লি চ্যাপলিন – হাসিমুখে যিনি চপেটাঘাত করতে পারতেন। পৃথিবী থেকে চলচ্চিত্র শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গেলেও নাকি যার শিল্পকর্ম টিকে থাকবে। মুখমণ্ডলে যিনি ভয়ংকর সমাজ-সচেতনতা ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।

১২। বিলি ওয়াইল্ডার – শক্তিশালী সিনেমাটোগ্রাফির বদলে যিনি শক্তিশালী চিত্রনাট্য ও পরিপূর্ণ কাহিনীকে গুরুত্ব দিতেন। রাজনীতির ও সমাজের বদলে তিনি ছিলেন মানব সচেতন। গতানুগতিক বিনোদনের মধ্যেও তিনি শিল্পের জন্ম দিয়েছিলেন। তার “সাম লাইক ইট হট” অনেকের মতে সর্বকালের সেরা কমেডি সিনেমা।

১৪। মার্টিন স্করসেজি – তার সিনেমার চরিত্রগুলো খুব সাধারণ কিন্তু দুর্লভ স্বপ্নের খোঁজে ছুটে বেড়ায়। কিন্তু বাস্তব ছুটে বেড়ানোটাই আমরা দেখতে পাই। তার চরিত্রগুলো প্রচণ্ডভাবে অস্তিত্বশীল। স্করসেজি স্বপ্নপূরণের সহিংস এবং বেদনাদায়ক পথকেই শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। আর আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, শেষে গিয়ে চরিত্রগুলো যেই অসীমে ছিল সেই অসীমেই রয়ে গেছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারের শেষ দৃশ্য স্বপ্ন না বাস্তব- এটা তাই আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়ে উঠেনি, রেইজিং বুলের শেষ দৃশ্যে রবার্ট ডি নিরোর শৈল্পিক ঘুষাঘুষি কোন দ্রোহের প্রতীক সেটাও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। এই বুঝতে না পারার ব্যঞ্জনাই স্করসেজি দর্শকদের তাড়িয়ে বেড়ায়।

১৮। ফ্রিডরিশ ভিলহেল্ম মুর্নাউ – যার উচ্চাভিলাষ সকল পর্বতের চূড়া ছাড়িয়ে গেছে। অকাল মৃত্যু না হলে তিনি যে কত কি করে দেখাতেন সেটা ভাবতে গিয়ে একালের সিনেমোদীদের দম বন্ধ হয়ে আসে। ড্রাকুলা নিয়ে করা প্রথম সিনেমা তার, নাম নসফেরাতু (১৯২২)- জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের সর্বোৎকৃষ্ট উপহারগুলোর একটি। শুধু ছবি দিয়ে কথা বলতে চাইলে আমাদের বারবারই তার কাছে ফিরে যেতে হবে।

২১। ফ্রিৎস লাং – মাস্টার অভ ডার্কনেস। তার “মেট্রোপলিস” (১৯২৭) নির্বাক যুগের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমা। এত ব্যয় করেছিলেন কেবল মানব সভ্যতার ডার্কনেস তুলে ধরার জন্য। প্রযুক্তিকেন্দ্রিক সভ্যতার রূপ তিনি সেকালেই উপলব্ধি করেছিলেন; মেট্রোপলিসের শিল্প কারখানার আন্ডারগ্রাউন্ড যেন সভ্যতার অন্ধকার ভিত্তিভূমিকেই নির্দেশ করে। ইনিই হলিউডী ফিল্ম নয়ারের জনক। সিনেমাটগ্রাফিক স্টাইলের মাধ্যমে মানুষের অন্ধকার দিক তিনিই প্রথম তুলে ধরেছিলেন, “এম” (১৯৩১) সিনেমাতে।

২৩। ফ্রঁসোয়া ত্রুফো – নুভেল ভাগের আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা। তার সিনেমা যেন তার জীবনেরই প্রতিধ্বনি। এরকমটা একটা জীবন না পেলে “দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোস” এর মত সিনেমা বানাতে পারতেন কি-না কে জানে। উল্লেখ্য ত্রুফো জীবন শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে। সিনেমার বিখ্যাত “ওটার তত্ত্ব” তাদেরই (তৎকালীন ফরাসি ক্রিটিক গোষ্ঠী) দেয়া।

২৫। ডেভিড লিন – লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া এবং ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই এর নির্মাতা হিসেবে ডেভিড লিনের সাথে অনেকেই পরিচিত। এপিক সিনেমা বানাতে তার জুড়ি নেই। মানব জীবনের মহিমা রূপায়নে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

৩০। স্টিভেন স্পিলবার্গ – স্পিলবার্গ সর্বকালের সেরা এন্টারটেইনিং চলচ্চিত্র শিল্পী। বক্স অফিসে দুর্দান্ত সাফল্য এবং সমালোচক মহলে প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতা কজনার ভাগ্যে জোটে? তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী চলচ্চিত্রকারও- সিনেমা বানিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কামিয়েছেন। ৭০-৮০-৯০ এই তিন দশকের সবচেয়ে ব্যবসা সফল ছবি তিনটাই তার করা: জস, ইটি এবং জুরাসিক পার্ক। ইটির শিল্পমূল্য এবং শিন্ডলার্স লিস্টের মানবতাবোধই তাকে সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত করেছে।

৩২। ভিত্তোরিও দে সিকা – মানুষের আত্মাকে যিনি ভিডিও করতে পারতেন। আত্মা নিয়ে অনেকে গবেষণা করলেও আত্মার সন্ধান খুব কম চলচ্চিত্রকারই পেয়েছে- দে সিকা সেই কয়েকজনের মধ্যে সেরা। নগ্ন বাস্তবতা দিয়েও যে শিল্প সৃষ্টি করা যায়, “বাইসাইকেল থিফ” (১৯৪৮) এ আমরা সেটাই দেখেছি। টু উইমেন (১৯৬০) এর ধর্ষণ দৃশ্যের আর্তনাদ ডি সিকার কারণেই আমাদের কাছে মানবতার আর্তনাদ হিসেবে ধরা দিয়েছে। উল্লেখ্য ডি সিকা ইতালিয়ান নিওরিয়েলিজম আন্দোলনের পথিকৃৎ।

৩৫। সত্যজিৎ রায় – যার সম্পর্কে লিখে শেষ করা যাবে না। রাসা-ভক্ত সত্যজিৎ ক্লোজ-আপ এর মাধ্যমে মানুষের মুখমণ্ডলে মানবতা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। তার সিনেমার অদ্ভুত তারল্য ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বের সকল সিনেমোদীর কাছে আপন করে তুলেছে। তার “অপু ত্রয়ী” সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্ল্যাসিকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। সত্যজিৎ পুরো একটি দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মেরুদণ্ড নির্মাণ করেছেন। পরিচালনা, চিত্রনাট্য, আবহ সঙ্গীত, চিত্রগ্রহণ, পোস্টার তৈরী, শিল্প নির্দেশনা সব দিকেই ছিলেন সমান পারঙ্গম।

৩৭। উডি অ্যালেন – প্রেম এবং কামের চলচ্চিত্রকার। তার অ্যানি হলেই বোধহয় আমরা প্রথমবারের মত সেক্স-কমেডি দেখেছি। মানব-মানবীরা যতদিন প্রেম করবে ততদিনই উডি অ্যালেনের সিনেমা জীবন্ত থাকবে।

৪০। রোমান পোলানস্কি – মানুষের নিঃসঙ্গতা তীব্র আবেদন নিয়ে ধরা দিয়েছে যার সিনেমাতে। মানুষকে তিনি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমন সব জায়গায় নিয়ে গেছেন যেখানে প্রেম-দ্রোহ-শিল্পের জন্ম হয়।

৪৩। ফ্রাংক কাপরা – হলিউডের স্বর্ণযুগের মানুষ। স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে যে কজন পরিচালক শিল্পমুল্য ধরে রেখেছিলেন তাদের মধ্যে কাপরা সেরা। তার রোমান্টিক এবং সামাজিক কমেডিগুলোতে আবহ সঙ্গীতের যথার্থ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় যা সেকালের হলিউডে ছিল না বললেই চলে। তার “ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট” (১৯৩৪) আমার অল টাইম ফেভারিট। কাপরার ক্যামেরায় কেবল সুখী মানুষেরাই স্থান পেয়েছে- যারা ক্ষেত্রবিশেষে দুঃখ অনুভব করলেও একসময় পরিপূর্ণ সুখের সন্ধান পায়। “ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ” (১৯৪৬) সেদিকটাই তুলে ধরে।

৪৬। সের্জিও লেওনে – মানুষের অতি সূক্ষ্ণ সব অনুভূতিকে অতি সূক্ষ্ণ উপায়ে তুলে ধরার একটা উপায় তিনি আবিষ্কার করেছিলেন- সেটা হল বিগ ক্লোজ আপ। তার সিনেমার অনেক দৃশ্যে কেবল এক জোড়া চোখ দেখা যায়, পুরো স্ক্রিন জুড়ে। মার্কিন সভ্যতার বিবর্তন নিয়ে তার আগ্রহের কারণেই আমরা ডলার্স ট্রাইলজির মত অসাধারণ ওয়েস্টার্ন পেয়েছি। ওয়ান্স আপোন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্টের মাধ্যমে ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতির পতন প্রত্যক্ষ করেছি। আর ওয়ান্স আপোন আ টাইম ইন অ্যামেরিকাতে দেখেছি- নব্য সহিংসতাকে কেন্দ্র করে মানুষ জেগে উঠছে। লেওনে আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেন- তার চরিত্রগুলো যত হিংস্রই হোক- সবাই হোমো স্যাপিয়েন্স।

৫০। বেরনার্দো বেরতোলুচ্চি – বলা যায় মাস্টার অভ ভয়ারিজম। ভয়ারিজম মানে ঈক্ষণকাম, অর্থাৎ লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের রতিকর্ম উপভোগ করা। সমাজের সবচাইতে গোপন যৌন সম্পর্কগুলো তিনি নির্লজ্জের মত সবার সামনে তুলে ধরেন। ড্রিমার্স সিনেমায় তিনি নিজেই বলেছেন, “চলচ্চিত্রকার মানে ভয়ারিস্ট, ক্যামেরা হল তার গোপন বাইনোকুলার”। তিনি ইনসেস্ট তথা অজাচারের মত বিতর্কিত বিষয়েরও বস্ত্রহরণ করেছেন। তবে এই ভয়ারিজমের আড়ালে তিনি জটিল মনস্তত্ত্বের ছাপ রেখে দেন, একটু লক্ষ্য করলেই যা বোঝা যায়। এজন্য অনেক বিতর্কের পরও তিনি সম্মানিত, কারণ তিনি শিল্পী।

৫২। রিডলি স্কট – শুধু “ব্লেড রানার” করে মারা গেলেও যাকে আমরা আজীবন মনে রাখতাম। কুবরিকের “২০০১: আ স্পেস অডিসি” যে ভিজ্যুয়াল স্টাইলের জন্ম দিয়েছিল সেটার পুনরুত্থান ঘটেছে ব্লেড রানারে যা পরবর্তীতে অনেক পরিচালককে প্রভাবিত করেছে। ব্লেড রানারে এত বেশি থিমের সার্থক সমন্বয় ঘটেছে যে আজ থেকে লক্ষ-কোটি বছর পরও এটার প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে না। তবে ইদানিং রিডলি স্কট আমাদের বেশ হতাশ করছেন।

৫৬। জর্জ কিউকর – সুনীল বলেছিলেন, হলিউডের আমাদেরকে দেয়া সেরা উপহার হচ্ছে মিউজিক্যাল সিনেমাগুলো। কিউকরের “মাই ফার্স্ট লেডি” দেখার পর সে কথার মর্ম বুঝেছি।

৬১। ভের্নার হের্‌ৎসগ – জার্মান নিউ ওয়েভের প্রতিনিধি। যিনি মানুষের মনে অ্যাডভেঞ্চার জাগিয়ে তুলেন। যিনি স্রোতহীন নদীর স্লো শট দেখিয়েও আমাদের মনকে আন্দোলিত রতে পারেন। তার “আগির্‌রে, ডের ৎসর্ন গটেস” (১৯৭২) আমার দেখা সেরা ট্র্যজেডি এবং অ্যাডভেঞ্চার সিনেমা। তার ছবিতে অসম্ভব স্বপ্নকে তাড়া করে বেড়ানো নায়ক চরিত্র এবং খুব সাধারণ কোন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অনন্য গুণের পরিচয় পাওয়া যায়।

৬২। ডেভিড লিঞ্চ – অবচেতনের পরাবাস্তব শিল্পী। আধুনিক চলচ্চিত্রে প্রথম যুগের শৈল্পিক মাধুর্য্য ফিরিয়ে এনেছেন তিনি, তবে এক্সপ্রেশনিজম বা ইমপ্রেশনিজমের বদলে সাররিয়েলিজমের মাধ্যমে। তার সিনেমাতেও বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা ঝাপসা। ট্রান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন থেকে তিনি শিল্পের অনুপ্রেরণা পান। তাকে বলা যায় এ যুগের পাগলা ডিরেক্টর। মানুষের “ভীতি” এবং “সম্মান” তার সিনেমার প্রধান বিষয়বস্তু।

৭০। উইলিয়াম ওয়াইলার – তার একটা সিনেমাই আমি দেখেছি: রোমান হলিডে- আমার জীবনে দেখা সেরা রোমান্টিক কমেডি। পুরো সিনেমা জুড়ে এতসব মনকাড়া দৃশ্যের পর হৃদয় বিদারক সমাপ্তিটাই আমাকে রোমান হলিডের সাথে যুক্ত করে রেখেছে। এই মোহ থেকে কোনদিন মুক্তি পাব না, মুক্তি পেতে চাইও না।

৭১। আব্বাস কিয়ারোস্তামি – যিনি কোন নিয়ম ভাঙারও ধার ধারেননি। সব ফেলে দিয়ে একেবারে নতুন ভাষা তৈরী করেছেন। সিনেমাকে এক নতুন রূপ দিয়েছেন। কিয়ারোস্তামির সিনেমা হল নতুন যুগের সিনেমা, পরিচালক এবং দর্শকের সিনেমা। তার সিনেমায় আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনের প্রভাব লক্ষ্যনীয়। ফেলিনির কাব্যিকতাকে পূর্ণতা দেয়ার মাধ্যমে তিনি এক দিক দিয়ে ইরানী কবিতা আন্দোলনকেই পূর্ণ করেছেন। তিনি হলেন চলচ্চিত্রের কবি এবং কবিতার চলচ্চিত্রকার। সেদিক থেকে তার সিনেমার আয়ুই বোধহয় সবচেয়ে বেশি।

৭৫। মিলশ ফরমান – সমাজরূপী পাগলা গারদ থেকে কেবল একজনই পালাতে পেরেছিল- ওয়ান ফ্লু ওভার দ্য কুকুস নেস্ট অন্তরে গেঁথে নেয়ার মত সিনেমা। একজন পূর্বে, আরেকজন পশ্চিমে যায়- কিন্তু পূর্ব-পশ্চিম সবদিকেই দাড়িয়ে থাকে সমাজ। পালিয়ে যায় একজন, সমাজ ছেড়ে দূরে কোথাও। মোৎজার্টের জীবনী নিয়ে করা তার “আমাদেউস” সিনেমাটা দেখার খুব ইচ্ছা কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না।

৮১। কুয়েন্টিন টারান্টিনো – সহিংসতাকে যিনি নৈসর্গ্যিক রূপ দিয়েছেন। টারান্টিনো হয়ত একদিন হঠাৎ বুঝতে পেরেছিলেন, পৃথিবী থেকে কোনদিন সহিংসতা যাবে না। কিন্তু শিল্পী হয়ে এই সহিংসতার সাথে সহবাস করার উপায় কি? নিজেই সে উপায় বের করেছেন। সহিংসতা যখন যাবেই না, তখন বরং এটা নিয়ে রং-তামাশা করে সুখে থাকি। সেই থেকে তার সিনেমা বানানো শুরু। তাকে বলা যায় আর্টিস্ট অভ এক্সট্রিম ভালোলেন্স।

৮২। ডেভিড ক্রোনেনবার্গ – যার থ্রিলার অনেক দিক দিয়ে হিচককের চেয়ে আলাদা। তার মতে, হিচকক তার দর্শকদেরকে পুতুল মনে করতো আর তিনি তার দর্শকদের মানুষ মনে করেন। তার থ্রিলারে যে নগ্ন সহিংসতা দেখা যায় সেটার মানবিক গভীরতা হিচককের সাইকটিক সিনেমাগুলোর সাথে তুলনীয়। ক্রোনেনবার্গের আরেক বড় পরিচয় বডি হররের জনক হিসেবে। গুলির আঘাতে বিধ্বস্ত মুখমণ্ডল, ছুরি দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গলা কাটা- এগুলো তিনি ক্লোজ-আপ এর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

৮৩। জোল কোয়েন এবং ইথান কোয়েন – ব্ল্যাক কমেডির প্রবাদ পুরুষ- একজন না অবশ্য দুজন। দুই ভাই মিলে অসাধারণ কিছু সিনেমা বানিয়েছেন যার অন্তত তিনটিকে মডার্ন ক্ল্যাসিক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বার্টন ফিংকে (১৯৯২) যে শিল্প বিশ্লেষণ দেখা গেছে সেটা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক মাইলফলক। ব্ল্যাক কমেডির পাশাপাশি কোল্ড থ্রিলারেও তারা সিদ্ধহস্ত। তবে তাদের কমেডি-থ্রিলারের অন্তরালে থেকে যায় সমাজ সচেতনতা এবং মানবিক উৎকর্ষতা।

৮৬। ক্লিন্ট ইস্টউড – অন্য কোন অভিনেতা পরিচালক হিসেবে এত নাম করতে পারেনি। তার মূল পরিচয় ষাটের দশকের ওয়েস্টার্ন হিরো নাকি এ যুগের অন্যতম সফল পরিচালক সেটা নিয়েই আমাদের দ্বিধায় পড়তে হয়। তার সফলতার পরিচয় বহন করছে দুই দুইবার অস্কার জয়- আনফরগিভেন (১৯৯৩) এবং মিলিয়ন ডলার বেবির (২০০৫) জন্য। তিনি মানুষের ভালো দিকটাকে খুব বেশী বিশ্বাস করেন। ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতি থেকেই বোধহয় এই চেতনা এসেছে। কাঁদতে চাইলে ইস্টউডের সিনেমা দেখার বিকল্প নেই।

৯১। সিডনি লুমেট – প্রথম সিনেমা দিয়েই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। “টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন” (১৯৫৭) সিনেমাটা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ভাল লাগার মতো। সিনেমায় সবগুলো চরিত্র সমান গুরুত্বের সাথে ফুটিয়ে তুলতে ওস্তাদ তিনি। তার সবগুলো চরিত্রই নিজের হয়ে কথা বলে।

৯২। ব্রায়ান ডি পালমা – জনপ্রিয় ধারার সিনেমাই বেশি করেছেন। “স্কারফেস” (১৯৮৩) ভোলার মত না। রিমেইক সিনেমাও এত নাম করতে পারে, স্কারফেস না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। আল পাচিনোর এই রূপ অন্য কোথাও দেখিনি। তবে ইদানিং স্কট সাহেবের মত পালমাও বেশ হতাশ করছেন।

৯৫। জর্জ লুকাস – স্টার ওয়ার্সই তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এছাড়া তিনি ইন্ডিয়ানা জোন্স সিরিজের লেখক। এন্টারটেইনার হিসেবে স্পিলবার্গের পরই লুকাসের অবস্থান। স্টার ওয়ার্সের প্রথম দিককার সিনেমাগুলোর শিল্পমূল্য লক্ষ্য করার মত- বিশেষত সেগুলোতে ডিপ ফোকাসের ব্যবহার।

লেখাটা শেষ করছি একজন নারী চলচ্চিত্রকারের কথা বলে। অন্য সব পেশা মত এখন অনেক নারী চলচ্চিত্রকার হিসেবেও নাম কুড়াচ্ছেন। ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার মেয়ে সোফিয়া কপোলা, মোহসেন মাখমালবফের মেয়ে সামিরা মাখমালবফ, হলিউডের ন্যন্সি মায়ার্স বা নিউ ফ্রেঞ্চ এক্সট্রিমিটির রূপকার Catherine Breillat উল্লেখযোগ্য। তবে সর্বকালের সেরা ১০০-র মধ্যে নারী কেবল একজন। তার নাম Chantal Akerman, বেলজিয়ামের; অবস্থান ৯৯। তার কোন সিনেমাই দেখিনি, সুতরাং কিছু বলতে পারছি না। নেট ঘেটে দেখলাম তার সবচেয়ে বিখ্যাত সিনেমা “Jeanne Dielman, 23 quai du Commerce, 1080 Bruxelles”- তিন দিন ধরে একজন মা-র দৈনন্দিন কাজ কারবার দেখানো হয়েছে এতে, ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটের সিনেমা।

0 comments:

Post a Comment