১১ তারিখ বিকেল চারটায় মুক্তিবাহিনীনিয়ন্ত্রিত টাঙ্গাইলের পুংলি এলাকায় ভারতীয় ছত্রীসেনাদল অবতরণ করে। পুরো এক প্যারা ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যখন নেমে আসছিলেন আকাশ থেকে, সেটা হয়েছিল দেখার মতো দৃশ্য। এক মুক্তিযোদ্ধা লিখেছেন যে একটার পর একটা উড়োজাহাজ থেকে প্যারাসুটে শত শত ছত্রীসেনা নামছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আকাশটা প্যারাসুটে ভরে গেল, যেন সেগুলো পাখির মতো ভাসছে। এরপর আরও অবাক হওয়ার পালা। দেখা গেল, প্যারাসুটে ঝুলে কয়েকটা গাড়ি নামছে, আর নামছে বড় বড় কামান।
তবে যত না ছত্রীসেনা নেমেছিল, কাজ হয়েছিল তার চেয়ে বেশি। কেননা, ছত্রীসেনার সংখ্যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল স্ফীত হয়ে এবং পাকিস্তানিদের মনোবল ভাঙতে তা সহায়ক হয়েছিল। সানডে টাইমস-এর অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, ‘৫০টি ফ্লাইং বক্সকার পরিবহন বিমানে করে ৫০০০ ছত্রীসেনা ঢাকার নিকটবর্তী অঞ্চলে অবতরণ করেছে এবং পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে এগিয়ে আসছে ভারতীয় বাহিনী।’ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাগাত্ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর একাংশ তখন পৌঁছে গিয়েছিল নরসিংদী। অন্যদিকে মেজর জেনারেল কৃষ্ণা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন আট মাউন্টেন ডিভিশন উপনীত হয়েছিল ফেঞ্চুগঞ্জে। মিত্রবাহিনীর পদাতিক সৈন্যরা ঢাকার কাছে পৌঁছে গেলেও মূল বাহিনী রয়ে গিয়েছিল অনেকটা পেছনে। যুদ্ধের ভারী সব উপকরণ বয়ে এনে ঢাকা অভিযান পরিচালনায় দরকার ছিল কিছুটা সময়। আগের দিন বেতার ঘোষণায় জানা গিয়েছিল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরাকে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কমান্ডার করা হয়েছে। যুদ্ধ যে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে তা পরিষ্কার হয়ে উঠছিল।
এদিকে মার্কিন প্রশাসনের কেন্দ্রে এবং জাতিসংঘে চলছিল আন্তর্জাতিক কূটনীতির আরেক খেলা। দুবার সোভিয়েত ভেটো দ্বারা প্রতিহত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে বিবেচনার জন্য পুনরায় উত্থাপিত হয়েছিল। প্রত্যাশিতভাবে ১০৪ বনাম ১১ ভোটে প্রস্তাব গৃহীত হয়। যেহেতু সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত প্রতিপালনে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তাই এর আশু রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না; কিন্তু বিষয়টি পুনরায় ফিরে আসে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। এ যাত্রায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ভেটো প্রদান ছিল কঠিন, তাই চেষ্টা চলছিল আলোচনা দীর্ঘায়িত করার। অন্যদিকে পর্দার অন্তরালে চলছিল চীন-মার্কিন আঁতাতের রাজনীতি, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানোর জন্য উভয়ের মধ্যে নানা পাঁয়তারা।
সম্প্রতি বর্তমান লেখকের হাতে এসেছে বেশ কিছু অবমুক্ত মার্কিন দলিল, যা পর্দার আড়ালের কূটনীতির পরিচয় মেলে ধরে। এমনি এক গোপন দলিলে জাতিসংঘে নিযুক্ত তত্কালীন মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ নিউইয়র্কে চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার সঙ্গে গোপন সভার বিবরণ দিয়েছেন। জর্জ বুশ অত্যন্ত খোলামেলাভাবে বৈঠকের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন এই রিপোর্টে। তাঁকে হোয়াইট হাউস ফোনে জানায় যে নিউইয়র্কের ৭৪তম স্ট্রিটের একটি অ্যাপার্টমেন্টে চীনাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে এবং হেনরি কিসিঞ্জার ও আলেকজান্ডার হেগ এতে যোগ দেবেন। জর্জ বুশ লিখেছেন, “উইনস্টন লর্ড দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে কিসিঞ্জার ও হেগের উদয় হলো, এর পরপরই হুয়াং হুয়া ও তাঁর সহকারী দুই অনুবাদকসহ এসে হাজির। হেনরি ভারত-পাকিস্তান বিষয়ে আমাদের সামগ্রিক নীতি মেলে ধরে বললেন, এই নীতি চীনাদের মতো একই। কিসিঞ্জার আরও জানান, ‘মাঝদরিয়ায় কয়েকটি জাহাজের গতি আমরা পরিবর্তন করেছি। জর্দান, তুরস্ক ও ইরানের মাধ্যমে কিছু যুদ্ধের সরঞ্জাম পাঠিয়েছি।’ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পতন ঠেকাতে প্রদত্ত সাহায্যের কথাও তিনি বলেন। আমাদের অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানকে অটুট ও সুরক্ষিত রাখার কথা ভাবতে হবে। ভারত ইঙ্গিত দিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানকে পালিশ করার কাজ শেষ করে তারা কাশ্মীরের কতক অঞ্চলে প্রবেশ করবে। জবাবে হুয়াং হুয়া এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বললেন, প্রয়োজনে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করতে হবে।”
এরপর বেশ আগ্রহোদ্দীপক একটি ঘটনার কথা জানা যায়। জর্জ বুশ লিখেছেন, ‘হুয়াং হুয়া জানতে চান, বাংলাদেশের প্রতিনিধির সঙ্গে বুশ সত্যিই দেখা করেছিলেন কি না। বাংলাদেশ শব্দটা চীনাদের কাছে একটি নোংরা শব্দ। আমি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলি যে বিচারপতি (আবু সাঈদ) চৌধুরীকে নিয়ে এমন একটা রটনা সম্প্রতি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তিনি থার্ড কমিটির সদস্য সেজে ভিন্ন রূপ ধারণ করে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের মিশনত্যাগী এক কর্মকর্তাও ছিলেন। এটা আমাদের জন্য ছিল বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং নিউইয়র্ক টাইমস যেমন লিখেছে, দুই দিন আগে তা নয়, দু-তিন সপ্তাহ আগে এটা ঘটেছে।’
জর্জ বুশ আরও এক কৌতুকপ্রদ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিক ডেকে সংকটের পটভূমি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ প্রশ্ন ও ভারতের বিরুদ্ধে কিসিঞ্জারের যে কোনো বৈরিতা নেই, তেমন ধারণা তিনি দিতে চেয়েছিলেন। হুয়াং হুয়ার কাছে এই সাংবাদিক বৈঠকের রিপোর্ট দেন কিসিঞ্জার এবং জর্জ বুশ তাঁর নোটে লিখেছেন, ‘কিসিঞ্জার হুয়াং হুয়াকে বলেছেন যে তিনি পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন এবং সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা পাকিস্তানের পক্ষে। এ কথা শুনে আমি অ্যাল হেগের দিকে ঝুঁকে তাঁকে মনে করিয়ে দেই যে ওই পটভূমির কার্যপত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গও রয়েছে, সেটা জানলে হুয়াং হুয়ার চুল খাড়া হয়ে যাবে।’
এমনি নানা খোলামেলা ভাষ্য মেলে এই নোটে, চীন ও আমেরিকা যে পরস্পরকে বুঝে নিতে চাইছিল, অপরকে দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট ছিল, সেটা বেশ পরিষ্কার। আর এ ক্ষেত্রে কিসিঞ্জার ছিলেন পরম উত্সাহী। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক রীতি-নীতি ও আচারের ধার ধারেননি। কিসিঞ্জারের কথাবার্তার ধরনেও জর্জ বুশ বেশ বিরক্ত বোধ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘হেনরি তাঁকে (হুয়াং হুয়া) বলেন যে জাতিসংঘে তাঁরা তাঁদের ইচ্ছেমতো প্রস্তাব আনতে পারেন, আমেরিকা সেটা সমর্থন করবে। এটা আমাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করেছিল। কেননা, চীনারা (জাতিসংঘে) কঠোর নিন্দামূলক ভাষায় কথা বলছিল। সোভিয়েতের মোকাবিলায় সম্ভাব্য পরিকল্পনা ও যোগাযোগ রক্ষার পদ্ধতি বিষয়ে কথা বলতেও হেনরি আগ্রহী ছিলেন। তিনি জানান যে ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর দেখা হবে এবং তিনি ভুট্টোকে বলবেন কেবল তাঁর ও হেগের কথা শুনতে, বিদেশ মন্ত্রণালয়ের কারও নয়।’ শোষোক্ত এই বক্তব্য থেকে মার্কিন প্রশাসনের ভেতরের দ্বন্দ্ব এবং কিসিঞ্জারের ঔদ্ধত্য ও শক্ত অবস্থানের পরিচয় পাওয়া যায়।
কূটনীতিক মহলের ভেতরের এসব বিবরণ থেকে বোঝা যায়, আমেরিকা বড়ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পতন ঠেকানোর, চীনাদেরও প্ররোচিত করেছে সামরিকভাবে সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানোর লক্ষ্যে বিশ্বজনীন আয়োজন এইভাবে ঘনীভূত হয়ে আসছিল এবং এর পরিচয় পাওয়া যায় আরেক গোপন মার্কিন দলিলে, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ৮ ডিসেম্বরের টপ সিক্রেট-সেনসিটিভ ডকুমেন্টে। সেখানে সুপারিশকৃত পদক্ষেপের মধ্যে ছিল মার্কিন নৌশক্তিকে অবিলম্বে ভারত মহাসাগরে পাঠানো, চীনকে জানানো যে পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়োজনে চীন সামরিক ব্যবস্থা নিলে মার্কিন সরকার তা অনুকূল মনোভাব নিয়ে বিচার করবে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সিয়াটো/সেন্টোর জরুরি সভা আহ্বান ইত্যাদি। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল দ্বাদশ বা শেষ সুপারিশ, যেখানে বলা হয়েছিল, ‘অবিলম্বে সিনক্ল্যানটের আওতায় সম্ভাব্য মার্কিন হস্তক্ষেপের ইঙ্গিতবহ সামরিক পরিকল্পনা সূচিত ও সক্রিয় করা।’
যুদ্ধের ময়দানে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা-জনতা এবং ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা বুকের রক্ত দিয়ে নিশ্চিত করে চলছিলেন বিজয়, আর রক্তপায়ী বর্বর পাকিস্তানি-সামরিক চক্রকে বাঁচাতে ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠছিল আমেরিকা ও চীন। মুক্তিযুদ্ধ উপনীত হয়েছিল বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একেবারে মুখোমুখি। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে সামরিক-কূটনৈতিক অনেক ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত ছিল নিক্সন প্রশাসন, ঝুঁকি নিতেও পরোয়া ছিল না তাদের। আর বাস্তবে চীন কী করবে, সেটা খোদ আমেরিকানরাও বুঝে উঠতে পারছিল না। আগামী দিনগুলো তাই ছিল অশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
মফিদুল হক: প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
ই-মেইল: mofidul_hoque@yahoo.com ১১ তারিখ বিকেল চারটায় মুক্তিবাহিনীনিয়ন্ত্রিত টাঙ্গাইলের পুংলি এলাকায় ভারতীয় ছত্রীসেনাদল অবতরণ করে। পুরো এক প্যারা ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যখন নেমে আসছিলেন আকাশ থেকে, সেটা হয়েছিল দেখার মতো দৃশ্য। এক মুক্তিযোদ্ধা লিখেছেন যে একটার পর একটা উড়োজাহাজ থেকে প্যারাসুটে শত শত ছত্রীসেনা নামছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আকাশটা প্যারাসুটে ভরে গেল, যেন সেগুলো পাখির মতো ভাসছে। এরপর আরও অবাক হওয়ার পালা। দেখা গেল, প্যারাসুটে ঝুলে কয়েকটা গাড়ি নামছে, আর নামছে বড় বড় কামান।
তবে যত না ছত্রীসেনা নেমেছিল, কাজ হয়েছিল তার চেয়ে বেশি। কেননা, ছত্রীসেনার সংখ্যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল স্ফীত হয়ে এবং পাকিস্তানিদের মনোবল ভাঙতে তা সহায়ক হয়েছিল। সানডে টাইমস-এর অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, ‘৫০টি ফ্লাইং বক্সকার পরিবহন বিমানে করে ৫০০০ ছত্রীসেনা ঢাকার নিকটবর্তী অঞ্চলে অবতরণ করেছে এবং পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে এগিয়ে আসছে ভারতীয় বাহিনী।’ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাগাত্ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর একাংশ তখন পৌঁছে গিয়েছিল নরসিংদী। অন্যদিকে মেজর জেনারেল কৃষ্ণা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন আট মাউন্টেন ডিভিশন উপনীত হয়েছিল ফেঞ্চুগঞ্জে। মিত্রবাহিনীর পদাতিক সৈন্যরা ঢাকার কাছে পৌঁছে গেলেও মূল বাহিনী রয়ে গিয়েছিল অনেকটা পেছনে। যুদ্ধের ভারী সব উপকরণ বয়ে এনে ঢাকা অভিযান পরিচালনায় দরকার ছিল কিছুটা সময়। আগের দিন বেতার ঘোষণায় জানা গিয়েছিল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরাকে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কমান্ডার করা হয়েছে। যুদ্ধ যে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে তা পরিষ্কার হয়ে উঠছিল।
এদিকে মার্কিন প্রশাসনের কেন্দ্রে এবং জাতিসংঘে চলছিল আন্তর্জাতিক কূটনীতির আরেক খেলা। দুবার সোভিয়েত ভেটো দ্বারা প্রতিহত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে বিবেচনার জন্য পুনরায় উত্থাপিত হয়েছিল। প্রত্যাশিতভাবে ১০৪ বনাম ১১ ভোটে প্রস্তাব গৃহীত হয়। যেহেতু সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত প্রতিপালনে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তাই এর আশু রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না; কিন্তু বিষয়টি পুনরায় ফিরে আসে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। এ যাত্রায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ভেটো প্রদান ছিল কঠিন, তাই চেষ্টা চলছিল আলোচনা দীর্ঘায়িত করার। অন্যদিকে পর্দার অন্তরালে চলছিল চীন-মার্কিন আঁতাতের রাজনীতি, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানোর জন্য উভয়ের মধ্যে নানা পাঁয়তারা।
সম্প্রতি বর্তমান লেখকের হাতে এসেছে বেশ কিছু অবমুক্ত মার্কিন দলিল, যা পর্দার আড়ালের কূটনীতির পরিচয় মেলে ধরে। এমনি এক গোপন দলিলে জাতিসংঘে নিযুক্ত তত্কালীন মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ নিউইয়র্কে চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার সঙ্গে গোপন সভার বিবরণ দিয়েছেন। জর্জ বুশ অত্যন্ত খোলামেলাভাবে বৈঠকের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন এই রিপোর্টে। তাঁকে হোয়াইট হাউস ফোনে জানায় যে নিউইয়র্কের ৭৪তম স্ট্রিটের একটি অ্যাপার্টমেন্টে চীনাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে এবং হেনরি কিসিঞ্জার ও আলেকজান্ডার হেগ এতে যোগ দেবেন। জর্জ বুশ লিখেছেন, “উইনস্টন লর্ড দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে কিসিঞ্জার ও হেগের উদয় হলো, এর পরপরই হুয়াং হুয়া ও তাঁর সহকারী দুই অনুবাদকসহ এসে হাজির। হেনরি ভারত-পাকিস্তান বিষয়ে আমাদের সামগ্রিক নীতি মেলে ধরে বললেন, এই নীতি চীনাদের মতো একই। কিসিঞ্জার আরও জানান, ‘মাঝদরিয়ায় কয়েকটি জাহাজের গতি আমরা পরিবর্তন করেছি। জর্দান, তুরস্ক ও ইরানের মাধ্যমে কিছু যুদ্ধের সরঞ্জাম পাঠিয়েছি।’ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পতন ঠেকাতে প্রদত্ত সাহায্যের কথাও তিনি বলেন। আমাদের অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানকে অটুট ও সুরক্ষিত রাখার কথা ভাবতে হবে। ভারত ইঙ্গিত দিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানকে পালিশ করার কাজ শেষ করে তারা কাশ্মীরের কতক অঞ্চলে প্রবেশ করবে। জবাবে হুয়াং হুয়া এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বললেন, প্রয়োজনে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করতে হবে।”
এরপর বেশ আগ্রহোদ্দীপক একটি ঘটনার কথা জানা যায়। জর্জ বুশ লিখেছেন, ‘হুয়াং হুয়া জানতে চান, বাংলাদেশের প্রতিনিধির সঙ্গে বুশ সত্যিই দেখা করেছিলেন কি না। বাংলাদেশ শব্দটা চীনাদের কাছে একটি নোংরা শব্দ। আমি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলি যে বিচারপতি (আবু সাঈদ) চৌধুরীকে নিয়ে এমন একটা রটনা সম্প্রতি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তিনি থার্ড কমিটির সদস্য সেজে ভিন্ন রূপ ধারণ করে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের মিশনত্যাগী এক কর্মকর্তাও ছিলেন। এটা আমাদের জন্য ছিল বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং নিউইয়র্ক টাইমস যেমন লিখেছে, দুই দিন আগে তা নয়, দু-তিন সপ্তাহ আগে এটা ঘটেছে।’
জর্জ বুশ আরও এক কৌতুকপ্রদ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিক ডেকে সংকটের পটভূমি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ প্রশ্ন ও ভারতের বিরুদ্ধে কিসিঞ্জারের যে কোনো বৈরিতা নেই, তেমন ধারণা তিনি দিতে চেয়েছিলেন। হুয়াং হুয়ার কাছে এই সাংবাদিক বৈঠকের রিপোর্ট দেন কিসিঞ্জার এবং জর্জ বুশ তাঁর নোটে লিখেছেন, ‘কিসিঞ্জার হুয়াং হুয়াকে বলেছেন যে তিনি পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন এবং সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা পাকিস্তানের পক্ষে। এ কথা শুনে আমি অ্যাল হেগের দিকে ঝুঁকে তাঁকে মনে করিয়ে দেই যে ওই পটভূমির কার্যপত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গও রয়েছে, সেটা জানলে হুয়াং হুয়ার চুল খাড়া হয়ে যাবে।’
এমনি নানা খোলামেলা ভাষ্য মেলে এই নোটে, চীন ও আমেরিকা যে পরস্পরকে বুঝে নিতে চাইছিল, অপরকে দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট ছিল, সেটা বেশ পরিষ্কার। আর এ ক্ষেত্রে কিসিঞ্জার ছিলেন পরম উত্সাহী। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক রীতি-নীতি ও আচারের ধার ধারেননি। কিসিঞ্জারের কথাবার্তার ধরনেও জর্জ বুশ বেশ বিরক্ত বোধ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘হেনরি তাঁকে (হুয়াং হুয়া) বলেন যে জাতিসংঘে তাঁরা তাঁদের ইচ্ছেমতো প্রস্তাব আনতে পারেন, আমেরিকা সেটা সমর্থন করবে। এটা আমাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করেছিল। কেননা, চীনারা (জাতিসংঘে) কঠোর নিন্দামূলক ভাষায় কথা বলছিল। সোভিয়েতের মোকাবিলায় সম্ভাব্য পরিকল্পনা ও যোগাযোগ রক্ষার পদ্ধতি বিষয়ে কথা বলতেও হেনরি আগ্রহী ছিলেন। তিনি জানান যে ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর দেখা হবে এবং তিনি ভুট্টোকে বলবেন কেবল তাঁর ও হেগের কথা শুনতে, বিদেশ মন্ত্রণালয়ের কারও নয়।’ শোষোক্ত এই বক্তব্য থেকে মার্কিন প্রশাসনের ভেতরের দ্বন্দ্ব এবং কিসিঞ্জারের ঔদ্ধত্য ও শক্ত অবস্থানের পরিচয় পাওয়া যায়।
কূটনীতিক মহলের ভেতরের এসব বিবরণ থেকে বোঝা যায়, আমেরিকা বড়ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পতন ঠেকানোর, চীনাদেরও প্ররোচিত করেছে সামরিকভাবে সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানোর লক্ষ্যে বিশ্বজনীন আয়োজন এইভাবে ঘনীভূত হয়ে আসছিল এবং এর পরিচয় পাওয়া যায় আরেক গোপন মার্কিন দলিলে, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ৮ ডিসেম্বরের টপ সিক্রেট-সেনসিটিভ ডকুমেন্টে। সেখানে সুপারিশকৃত পদক্ষেপের মধ্যে ছিল মার্কিন নৌশক্তিকে অবিলম্বে ভারত মহাসাগরে পাঠানো, চীনকে জানানো যে পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়োজনে চীন সামরিক ব্যবস্থা নিলে মার্কিন সরকার তা অনুকূল মনোভাব নিয়ে বিচার করবে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সিয়াটো/সেন্টোর জরুরি সভা আহ্বান ইত্যাদি। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল দ্বাদশ বা শেষ সুপারিশ, যেখানে বলা হয়েছিল, ‘অবিলম্বে সিনক্ল্যানটের আওতায় সম্ভাব্য মার্কিন হস্তক্ষেপের ইঙ্গিতবহ সামরিক পরিকল্পনা সূচিত ও সক্রিয় করা।’
যুদ্ধের ময়দানে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা-জনতা এবং ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা বুকের রক্ত দিয়ে নিশ্চিত করে চলছিলেন বিজয়, আর রক্তপায়ী বর্বর পাকিস্তানি-সামরিক চক্রকে বাঁচাতে ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠছিল আমেরিকা ও চীন। মুক্তিযুদ্ধ উপনীত হয়েছিল বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একেবারে মুখোমুখি। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে সামরিক-কূটনৈতিক অনেক ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত ছিল নিক্সন প্রশাসন, ঝুঁকি নিতেও পরোয়া ছিল না তাদের। আর বাস্তবে চীন কী করবে, সেটা খোদ আমেরিকানরাও বুঝে উঠতে পারছিল না। আগামী দিনগুলো তাই ছিল অশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলো'য় ৎ লিখেছেন মফিদুল হক: প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
বিষয় সমূহ
- Animal (67)
- Artical (29)
- Education (79)
- Fitness (19)
- Food (40)
- Game (12)
- Hijra(হিজড়া) (7)
- Journalism (23)
- Law (19)
- Liberation War(মুক্তিযুদ্ধ) (34)
- Love Effect (26)
- Mosque (42)
- Music (16)
- Nobel Prize (5)
- Organization (30)
- Others (56)
- Plants(গাছ-পালা) (29)
- Politics(রাজণীতি) (22)
- Scandal Religion (1)
- Tribe (8)
- Violence (16)
- Wikileaks (3)
Like for Update
64 Districts
- Bagerhat (4)
- Bandarban (3)
- Barisal (3)
- Bhola (3)
- Bogra (11)
- Brahmanbaria (2)
- Chandpur (4)
- Chapai Nawabganj (2)
- Chittagong (6)
- Comilla (2)
- Cox's Bazar (13)
- Dhaka (65)
- Dinajpur (6)
- Faridpur (1)
- Feni (1)
- Gaibandha (1)
- Gazipur (3)
- Gopalgonj (2)
- Habiganj (2)
- Jamalpur (4)
- Jessore (3)
- Jhenidah (2)
- Khagrachari (1)
- Khulna (3)
- Kishorgonj (2)
- Kurigram (1)
- Kushtia (3)
- Lalmonirhat (2)
- Madaripur (3)
- Magura (1)
- Manikgonj (1)
- Meherpur (2)
- Moulvibazar (14)
- Munsiganj (3)
- Mymensingh (5)
- Naogaon (8)
- Narayanganj (2)
- Natore (10)
- Netrokona (1)
- Nilphamari (2)
- Noakhali (1)
- Pabna (3)
- Panchagarh (2)
- Patuakhali (7)
- Pirojpur (1)
- Rajbari (1)
- Rajshahi (8)
- Rangamati (3)
- Rangpur (5)
- Satkhira (4)
- Sherpur (2)
- Sirajganj (5)
- Sunamganj (4)
- Sylhet (11)
- Tangail (1)
Blog Archive
-
▼
2009
(230)
-
▼
December
(79)
- অন্যের গর্ভে নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান
- মাঝের আঙুলটি লম্বা কেন
- শকুন্তলা
- ঢাক
- কোকাকোলা, পেপসি, নোভা,
- বিদ্যুৎ ব্যবহারের শুরু যেভাবে
- বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘোড়া
- অর্জুন
- বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু
- ইকারোস
- গরুড়
- ক্রিসমাস ট্রির কথা
- সুমন্ত্র
- চিত্রসেন
- হুলহুলিয়া : যেন রূপকথার এক গ্রাম
- আনুশেহ্ আনাদিল
- নারীর জরায়ুর ক্যান্সার, প্রয়োজন সচেতনতা
- চলে গেলেন ব্রিটানি মরফি
- শীতে ছেলেদের ত্বকের যত্ন
- মাইকেল মুর
- CV আর Resume এর মধ্যে তফাত কি?
- ব্রিটেনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে রিকশা
- দিনভর ঘুরেও স্বাধীনতা পদক বিক্রি করতে পারলেন না মো...
- বনসাই
- দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পাগলা ‘বড় মসজিদ’
- লালবক
- লাল মুনিয়া
- এসকর্ট
- Living to tell the Tale
- ১০০ টি দরকারী উইন্ডোজ শটর্কাট
- ফেসবুকে বাংলা অক্ষর ছোট দেখার সমস্যা দূর করে নিন স...
- Nameless folder
- পুরনো পাসওয়ার্ড না জেনেই নিমেষের মধ্যে পাসওয়ার্ড প...
- যদি Task Manager, Folder option, Registry edit ইত্...
- কয়েক মিনিটে উইন্ডোজ ইনষ্টল করুন
- টরেন্ট দিয়ে কিভাবে ডাওনলোড করা হয়
- বাংলা ফন্টস প্যাক
- Format Factory 2.1
- VOB to AVI Convert
- DU Meter 3.50 Full
- Any Weblock
- XP Codec Pack 2.4
- Uninstaller 2008 v6.2
- কিবোর্ড Remapper
- ৩০০ টাকার জন্য প্রাণ দিতে হলো মুক্তিযোদ্ধাকে
- একবিংশ শতকের ডারউইন
- সর্বকালের সেরা ১০০ চলচ্চিত্রকার
- মাদার তেরেসা
- জঁ ভিগো
- স্ট্যানলি কুবরিক
- ওয়ার্ডে ইকুয়েশন লিখবো কিভাবে
- ফিদেল কাস্ত্রো
- জব্দ করা শব্দ যত
- যুবকশূন্য সেই গাঁয়ের কথা
- বুঝতে হবে ফিগার অব স্পিচ (Rhetoric)
- গায়েবি মসজিদ
- বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির ট্রেন এখন চীনে
- বাংলাদেশকে রুখতে চীন-মার্কিন আঁতাত
- দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই থাইল্যান্ডের মরণ রেলপথ
- ১৯৭১ ঝটিকা আক্রমণ
- মোস্তফা জামান আব্বাসী
- পানি পানের পরিমান
- জীবনানন্দ দাশ - হাসান হাফিজ
- ভিয়েতনামে ভ্রমণ: সম্রাটের সমাধি - মঈনুস সুলতান
- কলম্বাস
- সাগরতলের মৎসকন্যা - রুবিনা মোস্তফা
- মেরিলিন মনরো
- বাংলাদেশে হেমন্তের উত্সব
- জাপানের সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো
- রেমা-কালেঙ্গায় নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে-বনের খাদ্...
- হিজড়া সম্বন্ধে জানুন আরো কিছু
- মুনতাজের আল জায়েদি
- যেভাবে শুরু হলো যুদ্ধ
- মহাভারতের বাস্তবানুগ পাঠ
- আজম খান এর সাক্ষাতকার
- শিল্পা শেঠির বিয়ে
- ধুপিনিবক
- বাংলাদেশে এইডসের ঝুঁকি বাড়ছে
- সৌদি আরবে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১১৩
-
▼
December
(79)
Friday, December 11, 2009
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment