Friday, December 25, 2009

আনুশেহ্ আনাদিল

0 comments

‘তখন অন্ধকারের চাদরে ঢেকে গিয়েছিল আমার চেতনা। হারিয়ে ফেলেছিলাম সত্যকে। অসম্ভব আর অলীক স্বপ্নকে সত্যি ভেবে ভুল পথে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ছোট্ট এই জীবনের দশটি বছর বন্দি ছিলাম নেশার জগতে’, বলছিলেন এ সময়ের তারুণ্যের ক্রেজ সঙ্গীত শিল্পী আনুশেহ্ আনাদিল। দশ বছরের দাসত্বের শৃংখল ভেঙে স্পার্টাকাসের মতো বেরিয়ে এসেছেন সেই ভুল স্বপ্নের জগৎ থেকে। শুধু শৃংখল ভেঙেই ক্ষান্ত হননি, প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন আরও অসংখ্য শেকল ভাঙার, যেমন অদৃশ্য শেকলে বন্দি হয়ে আছে দেশের অগণিত তরুণ-তরুণী ও যুবসমাজ।
মুম্বাইয়ের ‘ডায়ারস’ পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিজের সঙ্গে যুদ্ধরত আনুশেহ্ পাশে পেয়েছিলেন তারই মতো আরও অনেক সহযোদ্ধাকে। অদৃশ্য ইচ্ছাশক্তির জোরে যারা মুক্ত হয়েছেন অন্ধকারের দাসত্ব থেকে, তাদের সঙ্গে নিয়ে আনুশেহ্ কাজ করছেন মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে, মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন করতে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে ‘সলেস’ নামের একটি সংগঠন। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে অভিভাবকদের করণীয়, দায়িত্ব সম্পর্কে পরামর্শ ও পদ্ধতিগত সাহায্যের জন্য কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি।
বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী লুবনা মরিয়মের মেয়ে আনুশেহ্ জš§াবধি বেড়ে উঠেছেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় ওস্তাদ সগির উদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে। নিজের সঙ্গীত জীবন সম্পর্কে আনুশেহ্ বলেন, ছোটবেলায় পারিবারিক রেওয়াজ অনুযায়ী গান শিখতে শুরু করি। আমার গান শেখার ব্যাপারে অভিভাবকরা খুবই সিরিয়াস ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হতো, সবকিছু যেন জোর করে করানো হচ্ছে। তবে ধীরে ধীরে অবচেতন মনে সঙ্গীত তার শেকড় ছড়াতে শুরু করল। ১৮ বছর বয়সে প্রথমে নিজের গান লেখা শুরু করি। দীর্ঘ পাঁচ বছর পড়াশোনার জন্য কানাডায় ছিলাম। দেশে ফেরার পর পরিচিত হই রব ফকির, কাঙ্গালিনী সুফিয়া, শাহ আলম ফকিরদের সঙ্গে। প্রকারান্তরে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, দর্শন ও কৃষ্টির সঙ্গে। শুরু হয় বিভিন্ন আখড়ায় ঘোরাঘুরি, গান সংগ্রহ ও গান গাওয়া। এ সময় বিবি খালার (বিবি রাসেল) সঙ্গে কাজ শুরু করি। বিবি খালার একটি প্রজেক্টে মডেল হিসেবে কাজ করার জন্য সিলেটের চা বাগানে যাই।
বাংলা ব্যান্ডের বেজিস্ট ও আমার জীবনসঙ্গী বুনোর সঙ্গে সেখানেই প্রথম দেখা। বুনো তখন সিলেটের উজান ব্যান্ডের সঙ্গে হাছন রাজার গান নিয়ে কাজ করছিল। গানের সূত্রেই পরিচয় ও বন্ধুত্ব, অবশেষে পরিণয়। আমরা একসঙ্গে প্রথম পারফর্ম করি ছেউরিয়ার লালন উৎসবে। কুষ্টিয়ার বাউল ও ফকিররা আমাদের প্রচুর উৎসাহ দেয় সাইজির গান নিয়ে কাজ করার জন্য। এই উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালে সোমি, বুনো, অর্ণব, কার্তিক মিলে ‘বাংলা’ ফর্ম করি।
এদেশের মাটির গান নিয়ে কাজ করছে ‘বাংলা’। আমাদের লোকজ সঙ্গীতকে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করছে শ্রোতাদের কাছে এবং বাউল গানের ওপর মৌলবাদী অপশক্তির পুনঃ পুনঃ হামলা, লালন ভাস্কর্য ভাংচুর ও শাসনযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে জনমত গঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে আনুশেহ্ ছিলেন সোচ্চার। আর তারই সম্মাননা স্বরূপ সম্প্রতি ভারতের দ্য মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড ফর ইয়াং সাউথ এশিয়ান্স (মিতো) অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন তিনি।
বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী কমলা ডাসিনের অকাল প্রয়াত মেয়ে মিতো। আহমদিয়া সম্প্রদায়কে নিয়ে তার লেখা ‘কমিউনাল হারমোনি’ (সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি) বইটি পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল। সেই মিতোর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এ বছর প্রচলিত হয় এই অ্যাওয়ার্ড। আনুশেহ্র সঙ্গে লাক্সমি বেন ডেস্কর নামে আরও এক গুজরাটি নারী পেয়েছেন এই অ্যাওয়ার্ড। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অসহায় মুসলিম নারীদের জন্য কাজ করছেন। এই অপরাধে (!) তাকে সমাজচ্যুত করে মৌলবাদী সমাজপতিরা। কিন্তু হার না মানা লাক্সমি লড়ে চলেছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে।
সম্মানসূচক এই অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় বিনয়ানত আনুশেহ্ জানান, হয়তো আমি এই অ্যাওয়ার্ডের যোগ্য নই। কারণ আমি এখনও তেমন কিছুই করতে পারিনি। তবে আমি অনেক স্বপ্ন দেখি, একটা অনেক বড় পরিবর্তনের। যে যুদ্ধটা ৭১-এ শুরু হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ পরিসমাপ্তি এখনও হয়নি। আমি স্বপ্ন দেখি সেই যুদ্ধটায় জয়ী হওয়ার।
নিজের বুটিক আউটলেট ‘যাত্রার’ মাধ্যমে দেশীয় ক্র্যাফটস-এর উন্নয়ন ও গুণগতমানের উৎকর্ষ সাধনের কাজ করছেন আনুশেহ্। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপানসহ বেশকিছু দেশে এদেশীয় ক্রাফটস ও কারুপণ্য রফতানি করছে যাত্রা। তিনি স্বপ্ন দেখেন, একদিন পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে ‘যাত্রার’ শোরুমে শোভা পাবে আমাদের দেশীয় কারুপণ্য।
আমরাও স্বপ্ন দেখি, আনুশেহ্র মতো অগণিত স্বপ্নবাজ তারুণ্যের হাত ধরে উঠে দাঁড়াবে আমাদের লোকজ শিল্প, সংস্কৃতি। আÍসচেতন নবপ্রজšে§র অকৃত্রিম ভালোবাসায় নিখাদ হবে সোনার বাংলা। শুরু হবে এক কিংবদন্তির গল্প।

0 comments:

Post a Comment