Wednesday, December 9, 2009

মোস্তফা জামান আব্বাসী

0 comments
সামিরা আব্বাসী ৎ তারিখ: ০৮-১২-২০০৯ ৎ প্রথম আলো


পাখির সঙ্গে যাঁর ভালোবাসা। ফিঙে, দোয়েল, ময়না, টিয়া পাখির সুর যেমন তিনি কণ্ঠে তুলে নেন; একই সাবলীলতার সঙ্গে তুলেনেন ব্লু জে, নাইটিঙ্গেল কিংবা রবিন পাখির গান। দেশ-বিদেশে তিনি উপস্থাপন করেছেন বাংলার লোকগীতির মণি-মানিক-মুক্তো, সুদূর চীন থেকে, জাপান থেকে, আলমা আতা পর্যন্ত। ইহুদি মেনুহীন তাঁর বন্ধু, যাঁর বেহালা সারা পৃথিবী কাঁপায়, বিখ্যাত দার্শনিক সুফি লেখক উইলিয়াম চিটিক তাঁর ভক্ত। সুরের জাদুকর পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী তাঁকে দেখামাত্রই পা ছুঁয়ে সালাম করেন, তাঁর দোয়া, আশীর্বাদের ভাগ নেন।


আমি তাঁকে চিনি আমার আব্বুজি বলে। ভোরবেলা ফজরের ওয়াক্তে যখন আকাশে একটুখানি আলোর আভা হাসে তখন তাঁর সুমধুর কেরাতে ঘুম ভেঙে যায়; রাসূল (সা.)-এর জীবনের নানা আঙ্গিকের প্রতি গভীর ভালোবাসায় যিনি গবেষণা করেছেন প্রতিনিয়ত শিকাগো ও মায়ামির বিখ্যাত সব লাইব্রেরিতে।  তারপর সেই আর্দ্র ভালোবাসার কুসুম চয়ন করে লিখেছেন একটি অনিন্দ্য বই রাসূল (সা.)-কে নিয়ে। নামাজের পর ঘোরতর শব্দ করে সব ঘরের জানালা খুলে দেন, মশারি খোলেন সব সশব্দে। যেন আমরা সবাই উঠে পড়ি, আমরা ততধিক জোশে লেপ দিয়ে মুখটি ঢেকে ঘুমানোর চেষ্টা করি। এই বাবাই আমাদের সারা জীবন সরস্বতীপূজা দেখতে নিয়ে গেছেন ভারতেশ্বরী হোমসে। বাহাই মন্দিরে নিয়ে গেছেন।
কখনো সন্ধ্যার ঝিলিমিলি আলো এসে মেশে গুলশান লেকের শেষ সীমান্তে ‘সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা’ যেন! আমার বাবা তানপুরা নিয়ে বসেন, উদাত্ত কণ্ঠে দরবারি অথবা মিঞা কি মলহার। চারপাশ রুপালি জ্যোত্স্নায় ভরে ওঠে, ঝিকিমিকি করে তার প্লাবন। প্রতিদিন ঘণ্টা ধরে সাধা টান টান গলা এখনো উদাত্ত, এখনো সজীব, এখনো বাঙ্ময়। আমরা পাখির ছানার মতো গুটিশুটি বসে শুনি, মনে হয় আজিকার রাত্রি যেন না ফুরায়। তাঁর রবীন্দ্রসংগীতও যেন অতুলনীয়। ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও মোর প্রাণে...সঙ্গোপনে’ যখন গানটি গান মনে হয় স্বয়ং ঈশ্বর এসে তাঁর কণ্ঠে সুরের ও বোধের মালিকাখানি পরিয়ে গেছেন। আমার প্রিয় গ্রিক শিল্পী বলেছেন,‘দ্য হিউম্যান ভয়েস ইজ দ্য মোস্ট এক্সপ্রেসিভ ইনস্ট্রুমেন্ট নোন টু ম্যান...ইট ক্যান ইভোক অ্যান এনোরমাস অ্যামাউন্ট অব ইমোশনস।’

আমরা একই বৃন্তে দুটি কুঁড়ির মতো দুটি বোন, কোনো দিন তাঁর রাঙা চোখ দেখিনি। প্রচণ্ড ভালোবাসা, মায়া-মমতা দিয়ে বড় করেছেন। যত্নের সঙ্গে শিখিয়েছেন ভালো, মন্দ, পাপ, পুণ্য—সেই সঙ্গে সবুজ, নীল, হলুদ, বেগুনি ও লাল-কমলা রংকে। প্রচণ্ড স্বাধীনতায় বড় হয়েছি আমরা, কোনো সীমাবদ্ধতার স্থান ছিল না সেখানে। রুমী, নিফফারী আর রবিঠাকুর খেলা করতেন আমাদের সঙ্গে। বাবা মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। বাবার একটি কথা আমার জীবন দর্শন হয়ে গেছে, অন্যের জন্য সহমর্মিতায় যতক্ষণ তোমার অন্তর বিগলিত না হবে, তুমি পূর্ণ মানুষ হবে না।
ভালোবাসার অঞ্জন তাঁর চোখে। তাঁর আত্মজীবনী জীবন নদীর উজানে তিনি লিখছেন, ‘পৃথিবীর যত না রং, তার চেয়ে বেশি রং এই দু চোখে।’ তাই এই প্রবীণ নবীন পুরুষটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ই-মেইল, এসএমএস, ফেসবুকে তাঁর হূদয়ের সুরভি ছড়িয়ে দেন শত শত ভক্তের মধ্যে। প্রচণ্ড উত্সাহ নিয়ে এই ইলেকট্রনিক যুগের সঙ্গে একাত্ম তিনি। তাঁর মনোহর গ্রাফিক্স কম্পোজিশন করা আধুনিক ই-মেইলের পাশে তাঁর আমেরিকা প্রবাসী তথাকথিত আধুনিকা কন্যার ই-মেইল নেহাত সাদামাটা!পিছিয়ে থাকা তাঁর ধমনিতে নেই যে।ভালোবাসেন দেশমাতৃকাকে প্রচণ্ডভাবে। সারাটা জীবন রোটারির মাধ্যমে সহস্র লোকের জীবনকে ছুঁয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও মানুষকে দান করেন অবিরত, অকাতরে, অর্থ, জ্ঞান, তাঁর অতি পছন্দের নাগরা জোড়া থেকে শুরু করে সবচেয়ে বড় যে উপহার তা হলো অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বহু অনাবিষ্কৃত শিল্পীকে তিনি চয়ন করে তুলে ধরেছেন সবার সামনে। এদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত ‘আব্বাসী’ না থাকলে।
আমার জীবনে ভালোবাসা অনেক। কিন্তু সব ভালোবাসার উত্তম আমার বাবা। তাই ৮ ডিসেম্বর, তাঁর জন্মদিনে বলি—
‘তুমি যে তুমিই ওগো সেই তব ঋণ
আমি মোর প্রেম দিয়ে শুধিচিরদিন’

0 comments:

Post a Comment