Saturday, December 26, 2009

হুলহুলিয়া : যেন রূপকথার এক গ্রাম

0 comments
নবীউর রহমান শিপলু, নাটোর
এ এক আশ্চর্য গ্রাম, যেখানে শিক্ষার হার শতভাগ। নেই একজনও নিরক্ষর। বরং অধিকাংশই উচ্চশিক্ষায় আলোকিত। এসএসসি পাস যারা, তারা বিবেচিত 'অর্ধশিক্ষিত' হিসেবে। নেই মামলা-মোকদ্দমা বিবাদ-হানাহানি। গ্রামের মানুষ রাষ্ট্রীয় শাসন মেনে চলে বটে, কিন্তু তারপরও গত দুশ' বছর ধরে রয়েছে নিজস্ব গণতান্ত্রিক শাসন আর বিচার ব্যবস্থা। গ্রামের আর্থিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি সংবিধানও। স্থানীয়ভাবে তৈরি এই সংবিধান অনুযায়ী ১ জন চেয়ারম্যান, ১ জন সহকারী চেয়ারম্যানসহ রয়েছে ২৩ সদস্যের একটি কমিটি। যারা বিচার-আচারসহ গ্রামোন্নয়নের সব কাজ করেন। তাদের গ্রামের সবাই মেনে চলেন। আর সে কারণেই ঘটে না কোনো হানাহানি। যেতে হয় না থানা-পুলিশ বা সরকারি বিচারালয়ে। নিসর্গ-সৌন্দর্যে ঘেরা এ গ্রামে শীতে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। কিন্তু পাখি মারার প্রবণতা নেই গ্রামবাসীর। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বশাসন ব্যবস্থা চলে আসছে এখানে। ১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রামের সর্বোচ্চ আদালতের পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। এখনও সেই
বিচার ব্যবস্থা চলমান। আরও বিস্ময়কর যে, সারাদেশ যখন রাজনৈতিক বিভাজনে বিরোধে বিভক্ত, তখনও এই গ্রামে রাজনীতি সৃষ্টি করেনি বিরোধ-বিবাদ!
প্রিয় পাঠক নিশ্চয়ই বিস্মিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, একুশ শতকের এই সংঘাতমুখর বাস্তবতায় এমন গ্রামও আছে এ দেশে! হ্যাঁ আছে। গ্রামের নাম হুলহুলিয়া। জেলা নাটোর। থানার নাম সিংড়া। ইউনিয়নের নাম চৌগ্রাম। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক আছেন বটে। কিন্তু নেই দলবাজি। নেই বিরোধ। সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের। উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির। ইউপি চেয়ারম্যান জামায়াতের। নির্বাচনী প্রচারে নেতারা আসেন জেলা, উপজেলা থেকে। কিন্তু গ্রামবাসী নীরবে যে যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। প্রকাশ্য কোনো দলাদলি নেই। রূপকথার মতো শোনালেও হুলহুলিয়া বাস্তবেই এক বিস্ময়কর গ্রাম।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম হুলহুলিয়া। নাটোর সদর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের হুলহুলিয়া গ্রাম স্বকীয়তায় একটি আদর্শ গ্রামের মডেল হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে।
সিংড়ার চৌগ্রাম ইউনিয়নের হুলহুলিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে 'নিয়ামত খাল' নামের একটি ছোট নদী, যা আত্রাই নদীতে গিয়ে মিশেছে। বর্ষা মৌসুমে চলনবিলের কোলের এই গ্রামের চারদিকে পানিতে থই থই করে। এ সময় সমুদ্রের আকার ধারণ করা চলনবিলের পানির বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে গ্রামের চারদিকে। তবে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক সময় খুব খারাপ ছিল। ছিল না কোনো রাস্তাঘাট। নৌকাই ছিল বর্ষা মৌসুমের প্রধান বাহন। এখন থানা সদরের সঙ্গে পাকা সড়ক নির্মাণ হওয়ায় চলাচল সহজ হয়েছে।
প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস এই গ্রামে। ভোটারের সংখ্যা এক হাজার ৩৫০। 'হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ' নামের একটি সর্বোচ্চ পরিষদের মাধ্যমে এই গ্রামের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। একজন চেয়ারম্যান ও একজন সহকারী চেয়ারম্যানসহ এ পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৩। গ্রামবাসীর ভোটে এ কমিটির সদস্যরা নির্বাচিত হন। প্রতি দু'বছর পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হানাহানি, জমিসংক্রান্ত বিরোধসহ বিভিন্ন জটিল বিষয় নিষ্পত্তি করা হয় এ কমিটির মাধ্যমে। এর জন্য রয়েছে একটি আদালত। পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরাই ওই আদালতের বিচার কাজ পরিচালনা করেন। ছোটখাটো সমস্যা মেটাতে গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে বিচার বিভাগ।
মোট ১১টি পাড়া নিয়ে হুলহুলিয়া গ্রাম। এর মধ্যে চকপাড়াকে 'ক্যাপিটাল সিটি' হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যগুলো হলো_ তালুকদারপাড়া, মণ্ডলপাড়া, প্রামাণিকপাড়া, শেখপাড়া, খলিফাপাড়া, বড় ফকিরপাড়া, ছোট ফকিরপাড়া, মোল্লাপাড়া, চোদরীপাড়া ও পুকুরপাড়া। এর বেশিরভাগেরই নামকরণ হয়েছে বংশীয় পদবির কারণে। ১৬টি পুকুর ও দুটি দীঘি থাকায় নামকরণ হয়েছে পুকুরপাড়ার।
১৮৬৯ সালে হুলহুলিয়া গ্রামে স্থাপিত হয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে এই গ্রামের সাধক মরহুম ফরিদ উদ্দিন শাহ ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়া হাইস্কুল নামে একমাত্র হাইস্কুলটি স্থাপন করেন। সে সময়ের শিক্ষকদের অনেকেই বিনাবেতনে এবং অর্ধবেতনে পাঠদান করতেন। স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা ১২ বছর স্কুল থেকে কোনো বেতন নেননি। তার অবসরের পর প্রধান শিক্ষক আশরাফ আলী মৃধা অর্ধেক বেতন নিতেন। এছাড়া এ গ্রামে রয়েছে দুটি ব্র্যাক স্কুল, একটি মসজিদ, একটি গোরস্তান, দুটি মাজার, একটি ডাকঘর, একটি দাতব্য চিকিৎসালয়, একটি খেলার মাঠ, একটি বাজার, বরেন্দ্র প্রকল্পের দুটি গভীর নলকূপ ও বায়োগ্যাস প্লান্ট চারটি। ১৯৪৪ সালে 'দ্য ডায়মন্ড ক্লাব' নামে একটি ক্লাব গঠন করা হয়। মাধ্যমিক পাস না করা পর্যন্ত এই ক্লাবের সদস্য হতে পারেন না কেউ।
গ্রামের বাসিন্দা হুলহুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাবিবুর রহমান (৫৩) জানান, গ্রামের শিক্ষার হার শতভাগ। যারা মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তারাই এ গ্রামের অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তি। অধিকাংশ পরিবারের সদস্য উচ্চশিক্ষিত। গ্রামের কৃতী সন্তানদের মধ্যে রয়েছেন আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক মরহুম ড. হানিফ উদ্দিন মিয়া, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব মরহুম এ কে তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান রহমত উল্লাহ, শিক্ষাবিদ মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা, বাংলাদেশ বিমানের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার তছলিম উদ্দিন, সেনাবাহিনীর কর্নেল মঞ্জুরুল কাদির, নৌবাহিনীর কমান্ডার জামসেদ আলী প্রমুখ। এছাড়া গ্রামের শতাধিক ব্যক্তি উচ্চতর শিক্ষা শেষে বিভিন্ন দেশে বড় বড় পদে চাকরি করছেন।
তিনি আরও জানান, 'ব্রিটিশ আমল থেকেই নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে গ্রামটিতে। এ নিয়ে আজও কারও নেই কোনো দ্বিমত। পরে ১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রামের সর্বোচ্চ আদালতের পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। এখনও একইভাবে চলছে ওই আদালতের কার্যক্রম। বিচারে ধর্মীয় গোঁড়ামি বা শরিয়তের দোহাই দিয়ে কোনো অমানবিক ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা শাস্তি দেওয়া বা দোররা মারার ঘটনা ঘটেছে বলে জানি না। হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের নির্বাচিত সভাপতি ওই আদালতে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।'
পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও বিচারক আবদুল মালেক (৫৯) জানান, 'বিচারকাজ পরিচালনায় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়াও পাঁচজন উপদেষ্টা অংশ নেন। পরিষদের রায়ের ওপর আস্থা আছে বলেই ভুক্তভোগীরা ওই আদালতে বিচারপ্রার্থী হন। কোনো কারণে বিচার মনঃপূত না হলে সবার মত নিয়ে থানা বা আদালতের আশ্রয় নেওয়া হয়। তবে এ রকম ঘটনা খুবই কম ঘটে। বিচারকাজ ছাড়াও দুস্থ-মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দেয় পরিষদ।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গোলজার হোসেন গিয়াস বলেন, 'হুলহুলিয়া গ্রামের সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। এ গ্রামে কোনো কারণে বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় না। কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে সরাসরি তা গ্রামের আদালতে নিষ্পত্তি করা হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা দেশের সর্বত্র চালু থাকলে কোথাও কোনো হানাহানি হতো না। হুলহুলিয়া গ্রামের অনুসরণে বিচার ব্যবস্থা আমার চৌগ্রাম ইউনিয়নের সব গ্রামেই চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছি। আমার চেষ্টা সফল হলে ইউনিয়নটি একটি মডেল হয়ে থাকবে।'
তবে এত কিছুর পরও স্বস্তিতে নেই এই গ্রামের মানুষ। কারণ নাগর নদী। এই নদীর কারণে বর্ষা মৌসুমে হুমকির সম্মুখীন হয় গ্রামটি। নাগর নদীর বাঁধ সংস্কার না করায় চলনবিলের পানির প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কায় যে কোনো মুহূর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে আদর্শ গ্রামের বিরল দৃষ্টান্ত এই জনপদ।

0 comments:

Post a Comment