Friday, December 4, 2009

ভিয়েতনামে ভ্রমণ: সম্রাটের সমাধি - মঈনুস সুলতান

0 comments

মঁশিয়ো বনোঁয়া চাকাওয়ালা ছোট্ট স্যুটকেসটি টেনে নিয়ে যান। আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি, কিন্তু তিনি এখন কোন দিকে তাকাচ্ছেন না। অতঃপর বনোঁয়া সমাধি-চত্বরের নির্জনতম কোণে এসে- কি একটা কৌশলে তার স্যুটকেসটিকে ট্যান্ডে রূপান্তরিত করেন। মনে হয় ট্যান্ডের উপর দূর দর্শনের জন্য ল্যান্স ফ্যান্স কিছু লাগিয়ে তিনি এখন সমাধি-সৌধের দিকে ফোকাস্ করছেন। হয়তো বনোঁয়া বেশ কয়েক শতাব্দীর পুরানো সৌধটির ঈশান কোণাভিমুখে হেলে পড়াটুকু সার্ভে করে নিচ্ছেন। এতদূর থেকে সঠিক করে কিছু বলা যায় না। মঁশিয়ো বনোঁয়ার সাথে মাত্র গেল সন্ধ্যায় আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুরাতাত্ত্বিক স্মৃতিময় শহর হোয়ের মাঝারি মানের সরাইখানায় আমরা তার প্রতিবেশী হিসাবে আছি। মঁশিয়ো মনুমেন্ট ওয়াচ্ নামক একটি আন্তর্জাতিক এন,জি,ও’র ভ্রাম্যমাণ কর্মচারী রূপে ভিয়েতনাম এসেছেন। যেহেতু আমি ও হলেন আন্তর্জাতিক এইড্ এজেন্সিতে কাজ করে থাকি তাই বনোঁয়ার সাথে খোশ্ আড্ডায় লিপ্ত হতে আমাদের বিলম্ব হয় না। বনোঁয়া চুটিয়ে গল্প করতে ভালোবাসেন। প্রশিক্ষণে আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার এ প্রায় বৃদ্ধ ফ্রেঞ্চ ইন্দোচায়নার কলোনী গোটানোর বছর সর্ব প্রথম ভিয়েতনামে আসেন আর্কিওলজি বিভাগে কাজ নিয়ে। সে থেকে অদ্যাবধি তিনি ভিয়েতনামে এসেছেন প্রায় বার বিশেক। ভিয়েতনামের ইতিহাসটিও বনোঁয়া পাঠ করেছেন রীতিমত আগ্রহ নিয়ে। আমরা সম্রাটের সমাধি সৌধে এসে এ বিষয়ে বিশেষ কিছু না জেনে বুদ্ধিভিত্তিক বিভ্রান্তির মাঝে আছি। ইচ্ছা হয় বনোয়াঁর সাথে এ নিয়ে কিঞ্চিৎ কথাবার্তা বলে প্রেক্ষাপটটি জেনে নেই। কিন্তু মঁশিয়ো তার কাজে রীতিমত মগ্ন হয়ে আছেন।

হলেনের উদ্যোগ নেয়ার স্বভাব আছে, উপরন্তু বিদেশ বিভুঁই-এ দরকার পড়লে তার চেচাঁমেচিতেও আপত্তি কিছু নেই। সে দ্রুত পায়ে পর্যবেক্ষণরত বনোঁয়ার দিকে এগিয়ে যায়। তার শ্রবণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে বলে, ‘মঁশিয়ো, উই আর হিয়ার, ইফ্ ইউ উড্ লাইক টু কাম্ এন্ড জয়েন আস্।’ বনোঁয়া সার্ভে-কর্ম থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হাত নেড়ে সমতি জানান। হলেন ফিরে এলে পর আমরা কৃত্তিম হ্রদের উপর বিস্তৃত সেঁতুর দিকে হাঁটি। পুলটির দিকে তাকালে মনে হয় পানির উপর ভাস্ছে তিনটি বন্ধনী। আমরা এসে এর নীচু তবে প্রশস্ত রেলিং-এ বসি। অল্প দূরের রাঁধাচূড়া গাছে সূর্যালোক হলুদ কুসুমে সোনালি হয়ে প্রতিফলিত হয়। গাছটি তার ঝরা ফুল ও দুপুর বেলার তীব্র উজ্জ্বলতা নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাজরি তার ম্যাগনেফায়িং গ্লাস নিয়ে ওখানে চলে যায়। আমাদের ছোট্ট মেয়েটি আতশি কাঁচ দিয়ে ঝরা ফুলের পাপড়িতে খুঁজে চলমান পিঁপড়া। হ্রদের উপর বসে থেকে থেকে আমাদের ভেতর যেন জলের প্রতিচ্ছায়া ভাসে। বন্ধনী ব্রীজের দু’ধারে প্রসারিত কৃতিম জলাশয়কে কিংবদন্তীর কোন এক মরালের উড্ডীন ডানা বলে ভ্রম হয়। জলের বর্ণ এখানে কালচে গভীর, তার উপর ভাসে হালকা পীতাভ্ সর। আমরা তন্ময় হয়ে পদে“র সবুজ পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কাজরি গাছের তল থেকে ফিরে এসে আতশি কাঁচ রেখে তার শিশুতোষ বাইনোকুলার নিয়ে ভিন্ন দিকে হাঁটে। ওদিকে টি-বোশের মতো বিচ্ছিন্ন কিছু ঝোপঝাড়। সে এখন একটি ঝোপের আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে। আমরা খেয়াল করে দেখি-রাশি রাশি মেঘের ছত্রছায়ায় মেদুর হয়ে ফুটে আছে নীল পাহাড়ের রেখা। মনে মনে ভাবি-ভিয়েতনামের রাজাধিরাজ অন্তিম শয়ানের জন্য জায়গাটি নির্বাচন করেছেন তোফা। মঁশিয়ো বনোঁয়াকে স্যুটকেসসহ এদিকে আসতে দেখা যায়।

সার্ভে করে মনে হলো মঁশিয়ো সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এসেই অনুযোগ করে বলেন, ‘এ মনুমেন্টটি এন্ডেনজারড্ হয়ে গেলো। মনে হয় না সৌধটি আরো বছর পঁচিশেক টিকবে বলে।’ হলেন আগ্রহ নিয়ে বলে, ‘বনোঁয়া ভিয়েতনামের সম্রাট সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন?’ মঁশিয়ো স্যুটকেসের উপর কনুই রেখে গল্প বলার জন্য তৈরী হন। তিনি জানান, ‘সম্রাট মধ্য জামানার স্ট্যান্ডার্ডে শাসক হিসাবে খারাপ ছিলেন না। তবে তার প্রকৃতি ছিল বিচিত্র রকমের বিলাসী। ভোরবেলা শিশিরের জমানো জলে পদ“ফুলের নির্যাস মেশানো চা খেতে ভালোবাসতেন। তার মহিষী ও উপপতœীতের সংখ্যা ছিল অগণিত। কিন্তু নারীদের সকলেই ব্যর্থ হন সন্তানের জন্ম দানে। রাজধানীতে রাজনৈতিক ডামাডোল তীব্র হলে প্রায়ই সম্রাট এখানে এসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে লেকের জলে নাও বেয়ে সময় কাটাতেন। জীবনে রচনা করেছেন সহস্রাধিক কবিতা ও একটি চমৎকার ডায়েরী। মৃত্যুর প্রায় তিরিশ বছর আগে এ স্থানটি নির্বাচন করেন অন্তিম শয্যার জন্য।’ হলেন আরো জানতে চায়, ‘মঁশিয়ো সম্রাটের কবিতাগুলো পড়েছেন কি?’ বনোঁয়া ঈষৎ হেসে বলেন, ‘ডায়েরীর কিয়দংশ ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। রচনাটি রীতিমত ইন্টারেস্টিং। রাজত্বের শেষ দিকে তার হেরেমের নারীকুলের উপর তিনি রীতিমত ত্যক্তবিরক্ত হয়ে লিখেছিলেন রাজ্য শাসনের চেয়েও অনেক জটিল কাজ এ মেয়েগুলোর কোন্দল মেটানো।’ এ পর্যন্ত বলে বনোঁয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘চল তোমাদের সম্রাটের লেখা কবিতার কিছু ক্যালিওগ্রাফ্ দেখাই।’ কাজরি পাতায় বোনা মাথাইল হাতে ছুটে এসে আমাদের বলে, ‘লুক্, দিস ওমেন গিভ মি দিস হ্যাট। ক্যান আই হ্যাভ ইট?’ মাথাইলের উপর রেশমের সুতা দিয়ে ফুল পাতার নকশা আঁকা। বনোঁয়া তার হাত থেকে মাথাইলটি নিয়ে আমাদের পরখ করার জন্য সূর্যালোকে তুলে ধরেন। ফুল পাতার মোটিফের আড়ালে ভিয়েতনামিজ্ লেখনীর বিচিত্র সব কারেক্টার ফুটে ওঠে। বনোঁয়া আমাদের জানান, ‘এ সম্রাটের রাজত্বে শিল্পকলার প্রভূত উন্নতি হয়। কুটির শিল্পীরা পাতার মাথাইলে কবিতার ছত্র সুঁই দিয়ে আঁকে। প্রথাটি আজকের দিন পর্যন্ত চালু আছে।’ বিষয়টি আমাদের কাছে অভিনব লাগে। হলেন কাজরির সাথে চলে যায় রাঁধাচূড়া গাছের নীচে দাঁড়ানো- কাঁধে দড়ি দিয়ে ঝুলানো এক গাদা পদ্য লেখা মাথাইলসহ তরুণীর কাছে। নতমুখি নারীটি কিছুতেই কাজরিকে দেয়া মাথাইলের জন্য দাম নেবে না। অবশেষে হলেন তার কাছ থেকে আরো দু’টি বড় মাপের মাথাইল কিনে আনে। আমি মনে মনে ভাবি ভিয়েতনামিজ্ ভাষা জানেন এমন কাউকে খুঁজে পেলে কবিতাগুলো তর্জমা করে শোনা যেত।

যে পাহাড়টির উপর সম্রাটের স“ৃতিমন্দির তার আকার তিমি মাছের দেহের মতো। এখানে ভবন একাধিক। মঁশিয়ো বনোঁয়ার ভাষ্যানুযায়ী- একটি গৃহে বসে সম্রাট বছরের পর বছর ধরে তার কবরস্থানের নকশা করেন। অন্য ঘরটি নির্দিষ্ট ছিল মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য। এখানে রাজাধিরাজ পদ্য লিখতেন, তুলি দিয়ে আঁকতেন হস্তলিপি, পর্যবেক্ষণ করতেন আসমানী মানচিত্রে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ। এ পর্যন্ত শুনে হলেন মন্তব্য করে-,‘তা সম্রাট রাজ্য শাসনের সময় পেতেন কখন?’ বনোঁয়া সরাসরি তার মন্তব্যের জবাব না দিয়ে বলেন,‘ এসব ছাড়াও সম্রাটকে সঙ্গ দিতে হতো শতাধিক নারীর।’ আমরা মূল সৌধ ভবনের কাছে চলে আসি। বনোঁয়া ভবনটি দেখিয়ে বলেন, ‘এখানে এক সময় সম্রাট স্বয়ং বাস করতেন। মৃত্যুর পর অট্টালিকাটিকে স“ৃতিমন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়। এখানকার দেওয়ালে এখনো ঝুলছে তার হাতের ক্যালিওগ্রাফ করা কবিতার পংক্তি।’ এ পর্যন্ত বলে মঁশিয়ো হাতের ইশারায় ইমারতের প্রবেশপথ দেখিয়ে ‘এক্সুজ আমওয়া’ বলে চলে যান দালানের দেয়াল পরীক্ষা করতে। আমি, হলেন ও কাজরি স“ৃতি মন্দিরে প্রবেশের সময় দেখি বনোঁয়া একটি কাঠি হাতে ভবনের দেওয়ালে ঠক্ ঠক্ আওয়াজ করে ভেতরে বোধকরি কতটুকু ফাঁপা হয়েছে তার জরিপ করে নিচ্ছেন।

সৌধের মস্ত হল কক্ষে কালো কাঠের সারি সারি পিলার। ছাদ থেকে ঝুল্ছে সিল্কের ট্যাসেল দুলানো কারুকাজ করা ভিয়েতনামী লণ্ঠন। বাতিগুলোর জড়োয়া শেডের নীচে একটি করে টাংগানো ম্লান হয়ে আসা সোনালি ফ্রেম। ফ্রেমগুলোর ভেতরে কবিতার ক্যালিওগ্রাফ। পদ্য গুলো পড়া যায় না বটে তবে প্রতিটি কবিতার পাশে পাশে আঁকা ইলাবরেট্ চিত্র। আমরা ঘুরে ঘুরে চিত্রগুলোর ডিটেল লক্ষ্য করি। মনে হয় স্বর্গ ও নরকের বর্ণনা সিল্কের জমিনে রঙ-তুলি দিয়ে আঁকা হয়েছে। কোথাও কিংবদন্তীর বিকট দর্শন দৈত্য, খিল খিল হাসছে ক্ষীণকটি পরী। কোন কোন চিত্রের রেখায় প্রাসাদ, তরবারী হাতে যোদ্ধা, অশ¡ ও দূরাগত পর্বতের পানে উড়ে চলা মরালের ঝাঁক আমাদের বিসি“ত করে। আমরা কবিতার রস বা ছবির বিষয়বস্তুর সাথে কমিউনিকেট করতে পারি না, কিন্তু দৃশ্যগুলো থেকে সহসা চোখ ফেরানো কঠিন হয়। নরম কাদায় মাছের সন্তরণ ছাপের মতো বাঁধানো ফ্রেমগুলোর ভিজুয়্যাল ইমপ্যাক্ট আমাদের মনে গাঢ় হয়ে বসে যেতে থাকে। সিল্কের লণ্ঠন ঝুলা কক্ষটির আলো আঁধারি থেকে আমরা সহসা বেরিয়ে আসতে পারি না।

এত যুগ পরেও সম্রাট কিন্তু তার স“ৃতি মন্দিরে তেমন একটা অবহেলিত না। তার কীর্তি দেখতে এখানে সমবেত হয় পঞ্চজন পর্যটকের। নীল সিরামিকের বিশাল সব ফুলদানীতে থোকা থোকা রজনী গন্ধা ও পদ“ ফুল সৌরভ ছড়ায়। পিতলে তৈরী সারসাকৃতির বিরাট সব বাতিদানে রাশি রাশি মোম রহস্যময় আলো ছড়ায়। এ আলো আঁধারিতে ধুসর সাফারি স্যুট পরা রূপালি চুলের এক বুড়ো লোক হুইল চেয়ারে চড়ে একটি স্তম্ভ থেকে চলে যান অন্য স্তম্ভের কাছে। মিনিস্কার্ট পরা অতি অল্প বয়সী যুবতী তার হুইল চেয়ারটি ঠেলে নিয়ে যায়। বৃদ্ধ মনে হয় কপাল কুঁচকিয়ে মনযোগ দিয়ে একটি ফ্রেমের কবিতা পড়েন। যুবতীটি নতমুখে তার বেগুনী বর্ণের দীর্ঘ নখ নিয়ে খেলা করে। বৃদ্ধ তার কাছে কিছু একটা চাইলে সে বের করে দেয় অপেরা গ্লাস। তাতেও বোধ করি বুড়োর কবিতা পাঠে বিশেষ যুৎ হয় না। মেয়েটি এবার নীচু হয়ে ব্যাগ থেকে বের করে আনে চার্জার লাইট। সে লাইটটি জ্বেলে ফ্রেমের কাছে ধরে। ফ্রেমে প্রতিফলিত হয়ে আলোর কণিকা মেয়েটির বেগুনী বর্ণের ঠোঁটে খেলা করে। বুড়ো বিড় বিড় করে কবিতার পাঠোদ্ধার করেন। যুবতী চার্জার লাইট নামিয়ে আনলে হঠাৎ আলোয় তার অনাচ্ছাদিত স্তনরেখা দীপ্যমান হয়ে ওঠে। বুড়ো ছোট্ট নোটবুকে খস্ খস্ করে কিছু লিখে চলেন। আমি মনে মনে আন্দাজ করতে চেষ্টা করি বুড়োর সাথে তরুণীটির সম্পর্ক। ভাবি সাফারি স্যুট পরা মানুষটি কোন বিখ্যাত লেখক অথবা অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ কিনা? নাকি নগুয়েন রাজ বংশের অধস্তন কোন উত্তর পুরুষ চুপিসারে চলে এসেছেন পূর্ব পুরুষের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে? আমার এলোমেলো ভাবনা স্রোতে ছেদ পড়ে। দেখি মাথাইল বিক্রেতা মেয়েটি এসে স“ৃতিমন্দিরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছে।

তার হাতে রাইস ক্রেকার ও একটি বেলুন। তাকে দেখা মাত্রই কাজরি পলকের সান্নিধ্যে ছুটে যাওয়া কুকুর ছানার মতো ধাবিত হয়। তাদের ভাষাহীন বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে মনে হয় আমাদের মেয়েটি এতক্ষণ রাইস ক্রেকার খাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। কাজরি ফেরিওয়ালা নারীর সাথে বেলুন উড়িয়ে হাঁটছে দেখে আমাদের স“ৃতিমন্দির দর্শনের এখানেই ইতি পড়ে।

পাহাড় তলে বৃত্তাকার হ্রদ। ফেরিওয়ালা মেয়েটি আধশুকনো পাতায় নৌকা বানায়। কাজরি নাও এর গলুইতে ঝরা চম্পা ফুল রেখে তা লেকে ভাসাচ্ছে। পানিতে মৃদু হাওয়ায় পদ“ ফুলের বৃহৎ পাতাগুলো দোলে। একটি পাতা ঈষৎ ডুবে গিয়ে ভেসে উঠলে ভেতরে রূপালি জল অশ্রুর মতো টলমল করে উঠে। হ্রদের মধ্যখানে কৃত্রিম দ্বীপাণু। জলে ভরা এ ভাসমান ক্ষুদ্র স্থলখন্ডে বহু যুগের পুরানো রক্ ফর্মেশন। আমি হলেনকে ক্যামেরা হাতে পানির দিকে দিশা ধরে তাকিয়ে থাকতে দেখি। পানির সারফেসে সাবলিল গতিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে ছোট্ট মাকড়শার মতো দেখতে অগুণতি জলপোকা। হলেন তার মনযোগ গাঢ় করে পোকাগুলোর একটিতে ফোকাস্ করতে চেষ্টা করে। আমি অল্প হেঁটে বৃত্তময় হ্রদের অন্য পাড়ে এসে পড়ি। দ্বীপাণুর জলভাগের কাছাকাছি গর্ত থেকে উঁকি দেয় মাছরাঙার উৎসুক চোখ।

আমি কাঠে তৈরী বোটহাউসের কাছে এসে দাঁড়াই। অনেক কালের পুরানো এ কুটিরের খোলা ডেক্ চলে গেছে ঠিক জলের উপর। কাঠের বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ির সর্বনিম্ন স্তরে বসে দু’টি কিশোরী। মেয়ে দু’টি পানিতে পা ডুবিয়ে শরীর দুলিয়ে পরস্পরের চোখে চোখ রেখে বিড় বিড় করে কিছু বলে- অজানা কোন কৈশোরতোষ খেলা খেলে যায়। খেলাটির এক পর্যায়ে তারা ভেজা পায়ে পানি ছিটিয়ে পরস্পরের হাতে হাতে তালি বাজিয়ে খিল্ খিল্ করে হেসে ওঠে। হ্রদের জলে মাছের ঘাই এর মতো হাসির গমকে তাদের বুকে অর্ধস্ফুট স্তনরেখা দোলে। আমি হাঁটতে হাঁটতে তাদের পেছনভাগে চলে আসি। তাদের পদ-তাড়নে খানিক দূরে একটি পদ“ পাতা জলে মুখ মোছে। দ্বীপাণুর আড়াল থেকে কাজরির ভাসানো নাওখানা চাঁপা ফুলের সওদা নিয়ে এগিয়ে আসে। খানিক পরেই- কাজরি, হলেন ও ফেরিওয়ালা নারীকে এদিক পানে আসতে দেখা যায়। আমি আবার ক্ষণিকের জন্য ঘাটে বসা বালিকা দু’টির দিকে তাকাই। তীব্র সূর্যালোকে তাদের কাঁধে ঝুলানো মাথাইলে আঁকা কবিতার রঙীন পংক্তিগুলো রেডিয়ামের মতো সবুজাভ্ দ্যুতি ছড়ায়। আমরা আবার পারিবারিক ভাবে মিলিত হয়ে সম্রাটের কবরস্থলের দিকে যেতে যেতে ডাঙ্গায় ভেসে ওঠা মৎস্য কন্যা যুগলের মতো কিশোরী দু’টিকে পায়ে আলোড়ন তোলে জল ছিটাতে দেখি। ঢেউ এর বৃত্তাকার রেখা হ্রদের জলে বিস্তৃত হয়। চাঁপা ফুল ভরা পাতার নাওখানা তীব্র হয়ে দোলে। তার আশেপাশে চলমান জল পোকাগুলো তাদের অদৃশ্য পদ সঞ্চালনে যেন পরমাণুর রেখাচিত্র এঁকে চলে।

আমরা এবার আঁকাবাঁকা হ্রদের পাড় ধরে বৃহৎ সব গাছের ছায়ায় হাঁটি। কোথাও কোথাও জলভাগ পদ“ পাতায় একদম সবুজ হয়ে আছে। আমরা আধবোঁজা গোলাপি সব পদ“ ফুলের আশে পাশে বেশ ক’টি বককে ঝিম্ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমাদের পথরেখা পাথুরে সিঁড়িতে রূপান্তরিত হয়। আমরা পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে দেখি খানিক সামনে ঈষৎ তফাতে সাফারি স্যুট্ পরা বৃদ্ধটিও চলেছেন রাজ সমাধি পানে। তার হুইল চেয়ারখানা বয়ে নিয়ে চলেছে দু’টি জোওয়ান মর্দ। বুড়োটি চাকাওয়ালা চেয়ারে বসে মেঘের দিকে তাকিয়ে ফুঁকে চলেছেন মস্ত এক সিগার। তার পিছন পিছন হাই হীল পরে চড়াই উৎরাই ভাঙ্গছে মিনিস্কার্ট পরা যুবতী। তার হাঁটার ভঙ্গিতে ফুটছে তীব্র রকমের লীলায়িত লাস্য। মনে হচ্ছে তার দুদোল্যমান নিতম্ব যেন গোলাকার জোড়া ড্রাম হয়ে বাজিয়ে যাচ্ছে সংবেদনের তুমুল বাদ্য। আমি ও হলেন এবার খোলাখুলি বৃদ্ধের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করি। আমরা অনুমান করি- মেয়েটি হয়তো বৃদ্ধের কনভেন্টে পড়া নাতনি ফাতনি হলেও হতে পারে। কাজরি শিশুতোষ ক্যামেরায় হুইল চেয়ারের ছবি তুলতে চাইলে হলেন তাকে নিষেধ করে।

আমরা ‘অনার কোর্ট ইয়ার্ড’ বলে খ্যাত বাঁধানো চত্বরে আসি। এখানে বৃক্ষ ছায়ায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাথরে গড়া পাত্রমিত্র বা ম্যান্ডারিনের সারিবদ্ধ মূর্তি। মূর্তিগুলোর চোখে মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হয় তারা যেন রাজাধিরাজের আগমন প্রতীক্ষায় উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের পাশাপাশি রাজসিক বাহন হিসাবে প্রস্তুত প্রস্তরের ক্ষয়িষ্ণু হস্তি ও অশ¡। মঁশিয়ো বনোঁয়াকে দেখা যায় জ্যামিতির ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে- হাতি, ঘোড়া ও ওমরাহরা কয়েক শতাব্দীতে ঠিক কত ডিগ্রি হেলে পড়েছে তার মাপজোক নিতে। মঁশিয়ো তার ‘মনুমেন্ট ওয়াচ্’ নিয়ে ব্যস্থ হয়ে আছেন বটে- তবে তার কাছ থেকে ওমরাহদের মূর্তিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানতে ইচ্ছা হয়। বাসনাটি হলেনকে বলি। সে এগিয়ে গিয়ে সমীক্ষারত বনোঁয়াকে সম্বোধন করে বলে, ‘মঁশিয়ো, কুড্ ইউ টেল্ আস্ এ্য লিটল মোর এবাউট দিজ্ ট্যাচুস্?’ বনোঁয়া বোধ করি- এ ধরনের সওয়ালের প্রতীক্ষায় ছিলেন। তিনি মাপজোক থেকে চোখ তুলে বলেন, ‘মূর্তিগুলো সব সম্রাটের পারিষদবর্গের অনুকৃতি বিশেষ। তবে যেহেতু জাঁহাপনা খাটো ছিলেন তাই ওমরাহের মূর্তিগুলো সে অনুপাতে খর্বাকৃতি করে গড়া হয়েছে।’ মঁশিয়ো আবার এন্ডেন্জারড্ মনুমেন্টের মূল্যায়নে লিপ্ত হলে- খোশ্গল্প জমার কোন সম্ভাবনা নেই দেখে আমরা ধীর লয়ে ‘অনার কোর্ট ইয়ার্ডটি’ অতিক্রম করে যাই।

কবরস্থলের প্রবেশ মুখে আরেকটি আংগিনা। এখানে অর্ধচন্দ্রাকৃতির মিনিয়েচার লেকের পাড়ে সিরামিকে গোড়া বাঁধানো দু’টি প্রাচীন বকুলের গাছ। স্থানটির নির্জন মায়া মুহূর্তের জন্য আমাদের আনমনা করে দেয়। আমরা সিঁড়ি ভেঙ্গে চলে আসি ঈষৎ উপরের স্তরে। এখানে পেল্লায় একটি কচ্ছপের পিঠে দাঁড় করানো প্রকান্ড পাথরের ফলক বা ট্যাবলেট। সাফারী স্যুট পরা বুড়োকেও দেখা যায় অপেরা গ্লাস দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফলকে লেখা অনুশাসনটি পড়ছেন। যেহেতু প্রস্তরলিপির ভাষান্তর আমাদের সাধ্যাতীত- তাই আমরা মনে মনে বনোঁয়ার আগমনের প্রত্যাশা করি। আন্দাজ করি হয়তো ফলকে সম্রাটের কীর্তি কলাপের বর্ণনা আছে। বুড়ো নোট্ নেয়া শেষ করে তার সাথের যুবতীর দিকে তাকান। মেয়েটি তার ব্লাউজের ভেতর থেকে লাইটার বের করে বুড়োর আধ পোড়া সিগার ধরিয়ে দেয়। শিলালিপি পরিবাহি কচ্ছপের আংগিনা ভরে ওঠে বিরল তামাকের মুখরোচক গন্ধে। অবশেষে আমরা সম্রাটের কবরে এসে ঢুকি। স্থানটি বৃত্তাকারে ল্যান্ডস্কেপ্ করা বলে অর্ধচন্দ্রাকৃতির হ্রদের প্রেক্ষাপটে উদিত সূর্যের গোলাকার আকৃতি ফুটে। বেশ ক’টি চাঁপা ফুলের গাছের আলোছায়ায় তুলনামূলকভাবে সাদামাটা কবরটি। চাকাওয়ালা স্যুটকেস টেনে টেনে বনোঁয়া এসে আমাদের সাথে যোগ দেন। তিনি তার চোখমুখ রহস্যময় করে নীচু গলায় হলেনকে বলেন, ‘এ কবরে লাশফাস কিছু নেই। সম্রাটের উইলানুযায়ী তাকে গোপন স্থানে সমাধিস্থ করা হয়। তার গোর যাতে ভবিষ্যতে ধনরতেœর জন্য লুণ্ঠিত না হয় এ জন্য কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। যে একশত দশজন রাজভৃত্য তার লাশ সমাহিত করে- তাদের কাছ থেকে যাতে কথা বের হয়ে না পড়ে- এর জন্য এদেরকে তৎক্ষণাৎ শিরèেদ করা হয়। এখানে আমরা যা দেখছি তা হচ্ছে সম্রাটের সমাধির রেপ্লিকা। এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তেস্টিক্রিয়া হয়, কবরে নামানো হয় ডালাবদ্ধ কফিন। আসল লাশটি কোথায় সমাধিস্থ তা এখনো কোন পুরাতাত্ত্বিক বা ধনরতœ সন্ধানী খুঁজে বের করতে পারেনি।’ মঁশিয়োর মুখে কাহিনীটি শুনে আমরা সহসা নির্বাক হয়ে পড়ি। মনে মনে ভাবি গল্পটি কী ইতিহাস নির্ভর নাকি নিছক কল্পনাপ্রসূত কিংবদন্তী বিশেষ? কাজরি জানতে চায়, ‘হোয়াই দ্যা রাজা কিল্ড হিস সারভেন্টস্?’ তীব্র রোদে আপাতঃ নকল সমাধির উপর ঝরে একটি দু’টি চাঁপা ফুল। আমরা ছোট্ট মেয়েটির কাছে নগুয়েন বংশের নাম না জানা এক সম্রাটের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিমশিম খাই। মনে হয় সারাদিন কাদামাটি ছেনে, চমৎকার মূর্তিটি গড়ার পর বনোঁয়ার গল্প যেন দৈত্য হয়ে এসে মট্ করে ভাস্কর্যটির ঘাড় মটকে দিল।

0 comments:

Post a Comment