বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন পুন্ড্রনগরের (মহাস্থানগড়ের) নির্দশনগুলো তত্ত্বাবধানের অভাবে এবং স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীদের কারণে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মহাস্থানগড়ের একাংশ দখল করে গ্রাম গড়ে তোলা হয়েছে। মহাস্থানগড়ে পল্লী গড়ে ওঠায় যেমন শ্রীহীন হয়ে পড়ছে তেমনি ইতিহাস থেকে মুছে যাচ্ছে এর গুরুত্ব। জানা যায়, বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-রংপুর সড়কের ও করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত মহাস্থানগড়। বাংলাদেশের এটিই সবচেয়ে প্রাচীনতম পুরাকীর্তি। চারপাশের কৃষিজমির চেয়ে গড়ে প্রায় ৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এ দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তির স্থানটি একটি আয়তকার ঢিবি, যার দৈর্ঘ্য ১৫৫২ ও প্রস্থ ১৩৭০ মিটার। এর চারপাশে খুব উঁচু প্রাচীর রয়েছে। প্রাচীরের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সর্বোচ্চ স্থানটিজুড়ে রয়েছে হযরত শাহ সুলতান বলখী (রাঃ) মাহী সাওয়ারের মাজার। সুরক্ষিত নগরটি উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক একটি গভীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। অনেক পর্যটক ও পণ্ডিত বিশেষত বুকানন হ্যামিল্টন ও ডোলেন, ওয়েস্টম্যাকট, বেভারিজ ও স্যার আলেকজান্ডার কালিংহাম এ শহরতলী এলাকাটি পরিদর্শন করে প্রতিবেদনে তা উল্ল্লেখ করেন। কিন্তু ১৭৭৯ সালে এ ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ রূপে শনাক্ত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের। এখানে প্রাপ্ত ব্রাহ্ম্যলিপিতে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপিতে 'পুন্ড্রনগথ' (পুন্ড্রনগর) উল্ল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয়, নগরটি সম্ভবত মৌর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত জনবসতি ছিল। ১৯২৮-২৯ সালে কেএন দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে ভারতের প্রত্নতাত্তি্বক জরিপ বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে প্রথম নিয়মানুগ উৎখনন পরিচালিত হয় এবং তা তিনটি ঢিবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ঢিবিগুলো হলো_ স্থানীয়ভাবে পরিচিত 'বৈরাগীর ভিটা', 'গোবিন্দ ভিটা' এবং 'মুনির গুন' নামে পরিচিত একটি বুরুজসহ পূর্ব প্রাচীরের কিছু অংশ। তিন দশক খনন কাজ বন্ধ থাকার পর ষাটের দশকে আবার তা শুরু হয়। এসব উৎখননের প্রাথমিক প্রতিবেদন ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। প্রায় দু'দশক পর ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছরই খনন কাজ চলতে থাকে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির (১৯৯২) অধীনে ১৯৯৩ সালের প্রথমদিকে বাংলাদেশি ও ফরাসি প্রত্নতাত্তি্বকদের একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এসবের পরেও স্থানীয় একটি প্রভাশালী দল মহাস্থানগড়ের একাংশ দখল করে কয়েকশ' ঘরবাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে। কেউ কেউ আবার নিজেরাই বসবাস করছে। মহাস্থানগড়ের পতিত জমির বড় একটি অংশ দখল করে করা হচ্ছে চাষাবাদ। চাষাবাদের কারণে মাটির নিচে চাপাপড়া মূল্যবান নিদর্শনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আজও এর প্রাচীর রক্ষায় নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। কিছুদিন আগে এর শ্রী-বৃদ্ধির কাজ শুরু করা হলেও যত্নের অভাবে তাও আর কাজে আসছে না। দূরদূরান্তের ভ্রমণপিপাসুরা মহাস্থানগড়ে এসে নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
আব্দুর রহমান টুলু, বগুড়া
0 comments:
Post a Comment