Thursday, March 24, 2011

ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার

0 comments
আমি তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি এবং কলেজ বিল্ডিংয়ের উল্টা দিকে মেয়েদের হোস্টেলে থাকি। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ থেকেই ঢাকা শহর ভাষা আন্দোলন নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র-জনতার সভা হয়েছে। ২১ তারিখ এসেম্বলিতে সভা হবে। ২১ তারিখ ছেলেরা এসেম্বলি হতে দেবে না ঠিক করেছে। সরকার ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করল। ছাত্র-জনতা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিল ১৪৪ ধারা ভাঙবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে।
সারাদিন মেডিক্যাল কলেজের রাস্তায় চলছে মিছিল ও স্লোগান। শুনলাম ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। মন্ত্রীদের এসেম্বলি হলে আসতে দেবে না। এসেম্বলি হল মেডিক্যাল কলেজের খুব কাছে ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণ এবং তার সামনের রাস্তায় দারুণ উত্তেজনা, স্লোগান, পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি চলছে। হঠাৎ বেলা ৩টার দিকে গুলির শব্দ শোনা গেল। ছাত্র-জনতা আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে পারল ছুটতে লাগল। আমরা মেয়েরা হোস্টেল থেকে বের হইনি। হোস্টেলের বারান্দা থেকে সব দেখা যাচ্ছিল। তখন ডিরিকশন হলের পেছনে ছেলেরা মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল। একজনের মাথার মগজ বেরিয়ে গিয়েছিল মনে আছে। তখন তার পরিচয় জানতে পারিনি, পরে জেনেছি তা রফিক বা বরকতের লাশ। আমরা শোকে ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিলাম। একজন সাদা কাপড় পরা বৃদ্ধা এবং অল্প বয়সী মহিলা কাঁদতে কাঁদতে ডিরিকশন হলের পেছনে বারান্দার দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল হোস্টেলের সামনে দিয়ে।

এই প্রথম '৪৭ সালের স্বাধীন দেশে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের মন অসহ্য ঘৃণায় ভরে উঠল। ছেলেদের হোস্টেল তখন বাঁশের ব্যারাকে ছিল। গুলির পর জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে যোগ দিলে তার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। ২২ ফেব্রুয়ারি দারুণ উত্তেজনা। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে গেল। দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেল। এলাকাজুড়ে চলতে লাগল মুহুর্মুহু স্লোগান, ছেলেদের হোস্টেলে দিনভর জ্বালাময়ী বক্তৃতা। রাতজুড়ে তা চলতে থাকল।

২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে দারুণ উত্তেজনা। আমাদের হোস্টেল থেকে ২০০ গজ দূরে যেখানে ছাত্রদের শাহাদাতবরণের ঘটনা ঘটেছে সেখানে একটি 'স্মৃতিস্তম্ভ' তৈরি হয়েছে এবং সবাই তাতে ফুল দিচ্ছে, আমরা মেয়েরাও গিয়ে ফুল দিলাম। এক ভদ্রমহিলা, সোনার চেইন খুলে দিলেন সে কি দারুণ উত্তেজনা। ঢাকা শহর ভেঙে পড়ল মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে। শহীদ শফিউর রহমানের পিতা প্রথম শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। ২৫ তারিখ সাংবাদিক আবুল কালাম সামছুদ্দিন সেটা আবারও উদ্বোধন করেন। শহীদ মিনারটি খুবই সুন্দর ছিল। ১০ ফুট লম্বা ও ৬ ফুট চওড়া। তার চারদিক শাড়ি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। নিচের অংশটা লাল সালু কাপড় দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। উপরের অংশে দুটি পোস্টার লাগানো হয়। একটা ছিল 'স্মৃতিস্তম্ভ', আর একটা ছিল 'শহীদ স্মৃতি অমর হোক' দুটো পোস্টারই আমার স্বামী প্রয়াত ডা. বদরুল আলমের হাতে লেখা। আমরা নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা সেটা প্রত্যক্ষ করলাম।

তবে বাঁশের খুঁটি ও দড়ি দিয়ে সে জায়গাটি ঘিরে রাখা হয়। ১৯৫৭ সালে যখন আমি পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ারে যাই, তখন বাঁশের খুঁটি ও দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পড়াশোনা করার জন্য চলে যাই ইংল্যান্ডে। দেশে ফিরে আসি ১০ বছর পর ১৯৬৭ সালে। এসে দেখি একুশের ভাষা আন্দোলন তখন অনেক জোরদার হয়েছে। ১৯৭১ সালে একদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, আমার ছেলেকে উদয়ন স্কুল থেকে আনতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল ডা. মোত্র্তুজার সঙ্গে। আমাদের দেখে তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে দৌড়ে এলেন। তখন তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল অফিসার এবং ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। তিনি আমার স্বামীকে বললেন, বদরুল ভাই একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছি। আপনি যে প্রথম শহীদ মিনারের নকশা করেছেন এবং আপনার আঁকা নকশা অনুসারে প্রথম শহীদ মিনার গড়ে তোলা হয়েছিল সে কথা আপনার পারমিশন না নিয়ে আমার বইয়ে লিখে ফেলেছি। বইয়ের নাম 'ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।'

আমার স্বামী হাসতে হাসতে বললেন, আমি কিছু মনে করিনি। শহীদ মোর্ত্তুজা আজ নেই। অনেক খুঁজেও তার সেই বইটি পাইনি।

বাংলা ভাষার ইতিহাসে শহীদ মিনার এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ শহীদ মিনার তিন দিন পর ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের বাঙালির মনে যে দাগ কেটেছিল ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি পালন প্রতি বছর এবং এর ফলশ্রুতি '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতা এবং বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এটিই আমাদের গর্ব।

-ডা. আফজালুননেসা

0 comments:

Post a Comment