কল্যাণপুর মিরপুর সংলগ্ন একটি জনপদ। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকদের বড় একটি অংশ এ এলাকায় বাস করে। এক সময় এখানের জনজীবন খুবই সাধারণ ছিল। প্রচুর গাছপালাবেষ্টিত ছিল এ এলাকা। দিন দিন গাছপালা ধ্বংস করে গড়ে উঠছে আকাশ ছোঁয়া সব ভবন। ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কল্যাণপুর মিরপুরের অন্যান্য এলাকার মধ্যে এখনও শান্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত। সাধারণ জনগণের অভিমত সন্ত্রাস কিংবা কারও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই এখানে নেই। এখন কতদিন এমন থাকবে এটাও শঙ্কা এলাকাবাসীর। এ অঞ্চল ঘুরে এসে লিখেছেন জিসাদ ইকবাল
ওয়ার্ডভুক্ত(১১)এলাকা : কল্যাণপুর, দক্ষিণ পাইকপাড়া, মধ্য পাইকপাড়া, সায়েন্স ল্যাবরেটরি স্টাফ কোয়ার্টার, ডি-টাইপ সরকারি কলোনি, কল্যাণপুর হাউজিং স্টেট
জনসংখ্যা : ২ লাখ প্রায়
ভোটার সংখ্যা : ৬০ হাজার
ভোটকেন্দ্র : ৮টি
থানা : মিরপুর
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : হাইস্কুল চারটি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দুটি, কিন্ডারগার্টেন ২০টি
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : মসজিদ ২০টি, মাদ্রাসা ৬টি, গির্জা ১টি
অন্যান্য : পানির পাম্প চারটি, ক্লাব দুটি :অনুশীলন সংসদ ও অগ্রদূত সংসদ, বিআরটিসি বাস ডিপো, সড়ক গবেষণাগার, র্যাব-৪ এর কার্যালয়, ইবনে সিনা হাতপাতাল ও কলেজ, গ্গ্নুকোমা রিসার্চ ইনস্টিটিউট
বিহারিদের গণহত্যা
১৯৭১ সালে কল্যাণপুর একটি জনবিরল এলাকা ছিল। চারদিকে ধানক্ষেত আর কৃষিজমির মধ্যে দু-একটি ঘরবাড়ি ছিল। তখনকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুর বিহারি অধ্যুষিত এলাকা ছাড়াও কল্যাণপুরের মধ্য পাইকপাড়াতেও বিহারিদের বসবাস ছিল। এলাকাবাসী জানায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিরা কল্যাণপুরের বিভিন্ন বাড়িতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলা চালায়। অনেক বাড়িতে লুটতরাজ ও গণহত্যা চালায়। তখন অনেক বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও সমর্থক সন্দেহ করে অনেককে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে নির্জনে ছুরি, তলোয়ার দিয়ে গণহত্যা করত বিহারিরা। এখনও বিহারিদের গণহত্যার নিদর্শন রয়েছে অনেক স্থানে, বাড়িতে। বর্তমান কল্যাণপুরের ১২ নম্বর রোডের রিতা ভিলায় একই পরিবারের ১৩ জনকে হত্যা করার কথা জানায় এলাকাবাসী। ২ নম্বর রোডের মেলোডি হাউস, ১৩ নম্বর রোডের কলেল্গাল হাউসে লুকানো অবস্থায় একজনকে হত্যা করে বিহারিরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিদের হাতে নিহতদের স্মরণে শহীদ মিনার রোড এবং অনুশীলন সংসদ মাঠে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
কল্যাণপুর পোড়া বস্তি
গৃহায়ন ও গণপূর্তের হাউজিং বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জায়গায় কল্যাণপুর পোড়া বস্তি। ১৯৮৯ সালের দিকে বস্তিটি আগুনে পুড়ে যায়। এরপর থেকে পোড়া বস্তি নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানে বরিশাল, ভোলা অঞ্চলের লোকজনের বসবাস বেশি। ২০০৩ সালে বস্তি উচ্ছেদ করা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই আবার পুনর্বাসন হয় এখানেই। বস্তিবাসীর নাগরিক সংকট লেগেই আছে। বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও গ্যাস, পানির রয়েছে তীব্র সংকট। তেমনি রাস্তা, স্যুয়ারেজ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই বস্তির ভেতরে। অন্যদিকে পোড়া বস্তি নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। তাদের অভিযোগ, এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা, চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা রয়েছে পোড়া বস্তিকে ঘিরে। দক্ষিণ কল্যাণপুরের বাসিন্দা আকতারুজ্জামান বলেন, পোড়া বস্তিতে নীরবে জমজমাট মাদক ব্যবসা চলছে। আপনি একবার শুধু তাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন তারপর থেকে আর এখানে আসতে হবে না, মোবাইল ফোনে কল দিলেই ঠিকানামতো মাদক পেঁৗছে যাবে। কী চাই গাঁজা, ফেনসিডিল না ইয়াবা। আর মাদকসেবীরা নেশার টাকা জোগাড় করতে এলাকায় ছিঁচকে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বস্তির প্রবেশপথে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ভাঙাড়ি দোকান। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাসাবাড়ি থেকে চুরি হওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্র এসব ভাঙাড়ি দোকানে কেনাবেচা চলে।
অনুশীলন সংসদ
১৯৭২ সালে এলাকার কিছু যুবক খেলাধুলা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উদ্ভাসিত হয়ে গড়ে তোলেন অনুশীলন সংসদ নামে একটি ক্লাব। যে ক্লাবটি আজ ওয়ার্ডবাসীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনে কাজ করে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক রেজাউল করিম বাবুল প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি থেকে ১৯৭৬ সালে ক্লাবের রেজিস্ট্রেশন করা হয়। সামাজিক বন্ধনের টানে প্রতিদিন নবীন-প্রবীণ বাসিন্দাদের পদচারণায় মিলনমেলায় পরিণত হয়। খেলাধুলার পাশাপাশি শহীদ মিনারে ফুল প্রদান, শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিত, দুস্থ অসহায়দের চিকিৎসাসেবা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশবাসীকে সহায়তা করা হয়। এ ছাড়াও ক্লাবের উদ্যোগে মাঠে প্রবীণ ব্যক্তিদের সকালবেলা হাঁটাচলা ও ব্যায়ামের ব্যবস্থা, ফলদ ও ঔষধি গাছ রোপণ এবং শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। ওয়ার্ডবাসীর নাগরিক সংকট দূর করতে এবং রাস্তা প্রশস্ত করতে ক্লাবের সদস্যরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন সবসময়।
বিনোদন কেন্দ্র হতে পারে কল্যাণপুর খাল
ওয়ার্ডের সীমানা রয়েছে কল্যাণপুর খাল। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর নজরদারির অভাবে খালের দু'পাশ অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে। তেমনি তরল ও কঠিন বর্জ্য পরিষ্কার না করায় দূষিত হচ্ছে খালের পাশপাশের পরিবেশ। এলাকাবাসী জানায়, কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে খালের জায়গা একটু একটু করে দখল নিচ্ছেন বাড়ির মালিকেরা। এসব দখল এখনই ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে উদ্ধার করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। কল্যাণপুর প্রধান সড়কের ব্রিজ থেকে খালের দু'পাশে হাঁটাচলার জন্য ফুটপাত নির্মাণ ও খালের সীমানায় বৃক্ষরোপণ করা হলে খালটি বিনোদন কেন্দ্র পরিণত হবে।
0 comments:
Post a Comment